ছয় দশক ধরে জীবনে কত কী দেখার সুযোগ হল। অনেকটাই নিজের চোখে দেখা। কিছু শোনা এবং পড়া। এবং সেগুলো রাজনৈতিক পরিবার হওয়ার ফলে জীবন্ত ও প্রত্যক্ষ মনে হতো। আমাদের বাড়ির সবাই, বাবার প্রভাবে ও কল্যাণে রাজনৈতিক আলোচনায় অংশ নিত। এমনকী বাড়িতে কাজ করা মাহিন্দারও। তর্ক বিতর্ক হতো। বোন দিদিরাও অংশ নিতেন। মা রাজনৈতিক আলোচনায় বিরক্ত বোধ করতেন। কিন্তু সিপিএমের দুর্দিনে ১৯৭৭ র আগে পার্টির কর্মী নেতাদের আশ্রয় দিয়েছেন। ক্ষমতায় আসার পর পার্টির প্রতি বিরক্ত। আবার পার্টির নতুন দুর্দিনে ২০০৯ এর পর থেকে মা ঘোর কমিউনিস্ট হয়ে গিয়ে বাড়ির সামনে এক বিরাট উঁচু বাঁশে লাল পতাকা টাঙিয়ে দিলেন। ২০১৩ তে পঞ্চায়েত নির্বাচনে, চারদিকে যখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার হাওয়া, ছেলেমেয়েদের তিরস্কার করে, গ্রামে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে, পার্টি করে জমি জমা সম্পত্তি উড়িয়ে দেওয়ার জন্য রাতদিন গাল দেওয়া স্বামী আর নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বহুদিন কার্যত হারা বুথে সিপিএমকে জিতিয়ে ছাড়লেন।
জন্মের পর নকশাল আন্দোলন, বাহাত্তরের রিগিং, সন্ত্রাস, সিপিএম নকশালদের পারস্পরিক লড়াই, জরুরি অবস্থা, জনতা দলের ক্ষমতা দখল, রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার, ইন্দিরার জেলযাত্রা, চিকমাগালুর আসনে ইন্দিরার পুনরুত্থান, পাঞ্জাবে ভিন্দ্রানওয়ালের ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে ওঠা, অমৃতসর স্বর্ণমন্দিরে সেনা অভিযান, ভিন্দ্রানওয়ালের মৃত্যু, তার পরিণতিতে ইন্দিরার মৃত্যু, রাজীবের মসনদ প্রাপ্তি,জাতীয় শিক্ষানীতি, শাহবানু মামলা, মুসলিম মহিলা বিল, বোফর্স ঘুষ বিতর্ক, দেশজুড়ে তুমুল আন্দোলন। বামফ্রন্ট ও বিজেপির যৌথ সমর্থনে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের সরকার , মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করা। সেই নিয়ে দেশ জুড়ে সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলন। পরে তপশিলিদের সমর্থন পেতে মণ্ডল ছেড়ে কমণ্ডলু রাজনীতি। এসব দেখেছি ১৯৮৯ পর্যন্ত। আর বাঙালি রাজনৈতিক জাতি। রাজনীতি তার রক্তে। বাংলার দুর্গম পল্লীর মানুষও রাজনীতি নিয়ে কিছু জানেন ভাবেন। আমাদের পরিবারে রাজনীতির পরিচয় বাবার কমিউনিস্ট পার্টি সংযোগে।
দেশভাগের প্রভাব আমাদের এলাকায় পড়েনি।
দাঙ্গা ফ্যাসাদ হয়নি। মিলেমিশে থাকতেন মানুষ। কিন্তু সাধারণভাবে শিক্ষিত হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই কংগ্রেস বিরোধিতা তীব্র ছিল। বামপন্থীদের শক্তি বৃদ্ধি হয় অপারেশন বর্গা ও খেতমজুরদের বেতন বৃদ্ধি আন্দোলন করে। আগে বর্গা উচ্ছেদ হতো। এখন তেভাগা নিয়ম চালু হল। বর্গাদার জমির এক তৃতীয়াংশের মালিক হলেন। মালিক ফসল তৈরির টাকা দিলে আধাআধি ফসল পেলেন। এর মাঝে এল প্রাথমিকে ইংরেজি না থাকার বিতর্ক। এতে মধ্যবিত্ত চটে। কিন্তু গরিব মানুষ খুশি হন। কারণ তাঁদের ছেলে মেয়েকে আর ক্লাস টুতে উঠলে ড্রপ আউট হতে হচ্ছে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঁউরুটি বা কেক দেওয়া হচ্ছে টিফিনে।
আমার রাজনৈতিক কাজ শুরু পাঁচ বছর বয়সেই। বুঝে বা না বুঝে। দিদির সঙ্গে গিয়ে লুকিয়ে চিরকুট বা পার্টির গোপন চিঠি আদান প্রদান করে । যুক্তাক্ষর পড়তে পারার পর থেকেই খবরের কাগজ পড়ি। ১৯৭৭ এর পর একটা নাটক পড়ি, কিসসা কুর্সি কা। ঠিক নাটক নয়, চিত্রনাট্য। ইন্দিরা গান্ধীর আমলে নিষিদ্ধ হয়েছিল। খবরের কাগজগুলো তখন খুব ইন্দিরা গান্ধী বিরোধী। ১৯৭৭-র আগে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বা আর দু একটি ছাড়া অনেকেই ছিল ইন্দিরা ভক্ত। এখন রোজ শাহ কমিশনের খবর। ইন্দিরা চোর, দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বৈরাচারী।
ইন্দিরার জেল হল কদিনের জন্য। এবং এই ঘটনাই মানুষের মধ্যে সহানুভূতির বান ডাকল। তার কিছুদিন আগে, আমিও পোস্টার মেরেছি, স্বৈরাচারী ইন্দিরা গান্ধীর শাস্তি চাই। সেটা মারতে দেখে আমার কংগ্রেস নেতা বড় মামা বলেন, বড়ভাই ম্যাট্রিক পাস করেছে, এটা তাও করবে না। বাপের মতো পার্টি করে বেড়াবে। এবং আমার প্রিয় বন্ধু বড় মামার বড় ছেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হল, মেশা যাবে না। এতে ফল উল্টো হল। আমার মামাতো ভাই বাবাকে খুব ভয় পেলেও মনে মনে এবং কাজে কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক হয়ে গেল। এবং এতে ক্ষুব্ধ বড় মামা মেরে পা ভেঙ্গে দিলে সে ১৯৭৮ এ পঞ্চায়েত ভোটের দিন মামার প্রিয় বন্ধু কংগ্রেস প্রার্থীর বিরুদ্ধে আমাদের বুথে সারাদিন বসে রইল। ইতিহাস আশ্চর্য। পরে আমার বড় মামা আমাকে খুব ভালোবাসেন। আমি সেহারা স্কুলে গিয়ে নবম শ্রেণিতে ভালো ফল করায়। এবং আমার মামাতো বাবার দলের প্রার্থীর মেয়েকে বিয়ে করে সুখে সংসার করছে। ১৯৭৮এর নভেম্বর মাসে ইন্দিরা গান্ধী চিকমাগালুর লোকসভা আসন থেকে বিপুল ভোটে জিতলেন। বীরেন্দ্র পাটিলকে হারিয়ে। বীরেন্দ্র পাটিল ছিলেন জনতা দলের নেতা। কিন্তু তিনি ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে রাজি হননি। পরে বীরেন্দ্র পাটিল ইন্দিরা কংগ্রেসে যোগ দেন। কর্ণাটকে দলের প্রধান হন। ১৯৮৯ এ কংগ্রেসের খারাপ সময়ে কর্ণাটকে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী হন। বীরেন্দ্র পাটিল ছিলেন জনতা দলের নেতা রামকৃষ্ণ হেগড়ের বিরোধী।
১৯৭৯তে জুলাই সংকট এল। জনতা দলের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিল। আর এস এসকে এর আগে পরিত্রাতা হিসেবে দেখা হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীর আধা ফ্যাসিবাদী শাসনের মোকাবিলায় বাম ডান সবাই একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন। জনতা সরকারে আর এস এস ভালোই ছড়ি ঘোরাচ্ছিল। দেশে এর মধ্যে কয়েকটি জায়গায় দাঙ্গা হল। আর এস এসের নাম জড়াল।
মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের বিরোধিতা করে পদত্যাগ করেন। মোরারজি দেশাই একসময় গুজরাটের গোধরায় জেলাশাসক ছিলেন। তখন দাঙ্গার সময় তাঁর ভূমিকা সদর্থক ছিল না বলে এতদিনে কথা উঠল। সাধারণ মানুষ মোরারজি দেশাইকে চিনত যে তিনটি কারণে তার একটা কারণ ছিল, বহু প্রচারিত। তিনি সকালে নিজের মূত্র পান করতেন।
আর দুটি ছিল: জনতা কাপড় ও চিনির দাম বেঁধে দেওয়া।
১৯৬০-৭০ এ মহিলাদের শাড়ি নিয়ে খুব কষ্ট ছিল। একধরনের মোটা কাপড় পরতেন মহিলারা। মার্কিনি কাপড় বলা হতো। লোকমুখে মার্কিন। কড়া মাড় দিয়ে বিক্রি হতো। বড্ড মোটা। সাদা ঠিক নয় একটু ঘিয়ে রঙ। সবাই তো আর বিধবা নন। সাদা শাড়ি পরতে চাইতেন না। বাধ্য হতেন। মার্কিন শাড়ি মোটা। গরমে কষ্ট হতো। এর সঙ্গে মোরারজি দেশাই নিয়ে এলেন ১৩ ও ১৫ টাকা দামের রঙিন জনতা শাড়ি। শাড়িগুলো রেশন বা কন্ট্রোল দোকানে পাওয়া যেত।
একটু হাল্কা নরম শাড়ি।
১৯৭৯তে কথা উঠল, জনতা দল করলে আর এস এসের সদস্যপদ রাখা যাবে না। আদবানি বাজপেয়ী সিকন্দর বখত তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। এরা গ্রাফিক্স হলেন।
ইন্দিরা গান্ধী সুযোগটা নিলেন ।
চরণ সিং সরকার গড়তে এবং প্রধানমন্ত্রী হতে খুব আগ্রহী ছিলেন। অল্পদিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হলেন। চরণ সিং জাঠ কৃষক নেতা। বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। তখন আরেকজন নেতাও জনপ্রিয় দেবীলাল। দেবীলাল উপপ্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। লালুপ্রসাদ যাদব, মুলায়ম সিংহ যাদব তখন উঠতি নেতা। দেবীলাল প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন পরে। দেবীলালকে ঠেকাতে এরা ভালো ভূমিকা নিয়েছিলেন। কৌশল করে। সেকথা পরে বলা যাবে। লালুপ্রসাদ যাদব নিয়ে আলোচনায়।
ইন্দিরা গান্ধী কিছুদিন চরণ সিং সরকারের ওপর সমর্থন বজায় রাখলেন। চৌধুরী চরণ সিং ২৮ জুলাই ১৯৭৮ থেকে ১৪ জানুয়ারি ১৯৮০ প্রধানমন্ত্রী থাকলেন। বামপন্থীরাও চরণ সিং সরকারের পক্ষে ছিলষলেন।
আবার নির্বাচন হলো। এবার জিতলেন ইন্দিরা গান্ধী। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের দাপট আবার বেড়ে গেল। এর মধ্যে
আসাম ছাত্র আন্দোলন শুরু হল। প্রথমে এটা মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে থাকলেও আস্তে আস্তে বাঙালি বিতাড়ন আন্দোলনে পরিবর্তিত হয়ে গেল।
এতে ভারতের অতি দক্ষিণপন্থী সংগঠনের হাত আছে বলে জানা গেল। এবং শোনা গেল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপারেশন বল্কানাইজেশন নামে একটা প্রকল্প নিয়েছে। ভারত থেকে সেভেন সিস্টারকে আলাদা করার। বহু বামপন্থী আসামে খুন হলেন। আসামের ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় ছাত্র ধর্মঘট ডাকলেন। আসামে কোনও পণ্য যেতে দেওয়া হবে না ঘোষণা হল। এই ছাত্র ধর্মঘটের এস এফ আই বিরোধিতা করে। যতদূর মনে পড়ে আগস্ট মাসে হয়।
ছাত্র ধর্মঘটের দিন স্কুল যেতে গিয়ে আমি আক্রান্ত হই। সেদিন সাহেবজানের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমার সবসময়ের সঙ্গী ছিল। সাহেবজান বলল, আমার মাথায় লাঠি মেরেছিল। আমার ঠিক মনে পড়ছে না। তবে এটা মনে আছে, একজন ছুরি মারতে এসেছিল। বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রিয়নাথ নন্দী লম্বা হাত বাড়িয়ে সেই ছুরি আটকান।
স্কুলের রাস্তায় তখন কংগ্রেসের ভিড়। আর কাছেই রেল লাইন জুড়ে সিপিএম সমর্থকদের ভিড়। দু দলই সশস্ত্র। সিপিএমের সঙ্গে ছিল টাঙি লাঠি তীরধনুক। টাঙি লাঠি তীরধনুক আমি ১৯৮৪ পর্যন্ত বেশিরভাগ বাজার এলাকার জমায়েতে দেখতাম। কংগ্রেসের সঙ্গে বোমা বন্দুক বেশি থাকতো।
পরে শুনেছি, সেহারাবাজারে সিপিএম কংগ্রেস সঙ্ঘর্ষ হয়। কেউ মারা যাননি। দুপক্ষেই কিছু আহত হন। তখন সিপিএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা ছিলেন ওমর আলি মিদ্দে, চাঁদু চৌধুরী, মহফুজ রহমান। ১৯৮৭ সালের বোঝা গেল, বামফ্রন্ট সরকারকে দিল্লির সরকার আর ফেলতে পারবে না। তার আগে আশঙ্কা ছিল, ১৯৬৭ বা ১৯৬৯ র মতো সরকার ফেলে দেবে কংগ্রেস। আশঙ্কা চলে যাওয়ার পর থেকে সশস্ত্র জমায়েত দুপক্ষেই কমল। এর আগের কয়েকটি ঘটনার কথা বলা জরুরি। কলেজগুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঘিরে তুমুল ঘটনা ঘটত। দুপক্ষেই সশস্ত্র জমায়েত হতো।
১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান শহরের রাজ কলেজে আক্রমণ হল জোর। কংগ্রেসের লোকরা কলেজ আক্রমণ করার পর এস এফ আই সমর্থকরা ফজলুল হক ছাত্রাবাসে আশ্রয় নেয়।
বর্ধমান শহরে কংগ্রেসের তখন পাল্লা ভারি।
আমার দাদা ১৯৭৭ থেকে পর পর দুবার রাজ কলেজ সাধারণ সম্পাদক। বেশ জনপ্রিয় ছিল। দেখতে খুব সুন্দর। পড়াশোনায় ভালো। দক্ষ সংগঠক। শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত চিরাচরিত কংগ্রেসি বনেদি বাড়ির ছেলে মেয়ে রাজ কলেজে দাদার প্রভাবে বামপন্থী হয়ে যান।
দাদা ফজলুল হক হোস্টেলে থাকতেন। সত্তর দশকে এই হোস্টেল এলাকায় দুজন খুন হন। একজন আনোয়ার হোসেন। আরেকজন অখিলেশ। আনোয়ার হোসেন গরিব পরিবারের মেধাবী ছেলে। অবশ্য মেধাবী না হলে রাজ কলেজে সুযোগ পাওয়া যেত না। আনোয়ার হোসেন সিপিএমের সমর্থক। তাঁর খুনের রক্তের দাগ বহুকাল দেওয়ালে ছিল।
অখিলেশ কংগ্রেসের ছাত্র নেতা। সিপিএমের বক্তব্য ছিল, এই খুন গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে। কংগ্রেসের বক্তব্য উল্টো। এগুলো ১৯৭৭-র আগের ঘটনা। ১৯৮০র জানুয়ারি মাসে লোকসভা নির্বাচন হল। বিপুল ভোটে ৩৫৩ টির বেশি আসন নিয়ে আবার ক্ষমতায় এলেন ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৭৭র চেয়ে ১৯৯ টি বেশি আসন। ৪২.৬৯% ভোট পান। তাঁর শ্লোগান ছিল, মিলিজুলি খিচুড়ি সরকার নয় স্থায়ী শক্তিশালী সরকার।
এই শ্লোগানে বাজিমাত।
তখন লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ২৬৫ আসন পেতে হতো। এখন ২৭৩।
ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ফেরার পর পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসে আবার নবজোয়ার এলো। ভাবল, রাজ্যেও ক্ষমতায় আসা সময়ের অপেক্ষা। ইন্দিরা গান্ধী এই সরকার ফেলে দেবেন। চলতে দেবেন না। কলেজ নির্বাচনে বিপুল শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল কংগ্রেস। অনেক জেলা শহর কলেজ নির্বাচনে জেতেও। বর্ধমান রাজ কলেজ পেতে কংগ্রেস তখন মরিয়া।
১৯৮০-র ২৬ ফেব্রুয়ারি আবার রক্তাক্ত হল রাজ কলেজ। এসএফআই ছাত্র পরিষদ সঙ্ঘর্ষ। শোনা যায়, তার আগের দিন দোর্দণ্ডপ্রতাপ কংগ্রেস নেতা কমলনাথ বর্ধমান শহরে বৈঠক করে গেছেন। রাজ কলেজ চাই। রাজ কলেজ নির্বাচনের ওপর জেলার বাকি কলেজ এবং অন্যান্য নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব পড়তো।
এস এফ আই সমর্থকরা পিছু হটে হোস্টেলে আশ্রয় নেয়। রাণীগঞ্জ মোড়ে অনেকগুলো কসাইদের মাংসের দোকান ছিল। সেখান থেকে অনেক অস্ত্র এসেছিল বলে এস এফ আই দাবি করে।
ফজলুল হক হোস্টেল ঘিরে ফেলে কংগ্রেস। দাদা এবং কয়েকজন ছাদে উঠে পড়েন পাইপ বেয়ে।
যাঁরা পারেননি তাঁদের মাংস কাটার চপার দিয়ে কোপানো হয়।
দাদা ওপর থেকে ঝাঁপ দেন। পাশেই ছিল পুকুর। সেখানেও আক্রমণ হয়। পাশের বস্তির মহিলারা ঝাঁপিয়ে পড়ে দাদা সহ কয়েকজনের প্রাণ বাঁচান।
সন্ধ্যাবেলায় খবর এল বাড়িতে। ওই রাতেই সবাই ছুটলাম ২৬ কিলোমিটার দূরে বর্ধমান হাসপাতালে। ডাক্তার বললেন, ৭২ ঘণ্টা না কাটলে কিছু বলা যাচ্ছে না।
আমি তো কেঁদে অস্থির।
ওদিকে দেখি, বাবা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দেওয়ালে পিঠ দিয়ে, বই পড়ে চলেছেন।
জুলিয়াস ফুচিকের লেখা, ফাঁসির মঞ্চ থেকে।
সেকালে সব বামপন্থী কর্মীর কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ থাকতো, তাতে মুড়ির কৌটার সঙ্গে অবশ্যম্ভাবীভাবে থাকতো নানা ধরনের বই।
শুধু পার্টির পত্রিকা নয়, নানা ধরনের সাহিত্য।