গুলি ডাং? সে আবার কী? ৫০ বছর পর হয়তো এ-জন্য টীকাকারের প্রয়োজন হবে। জানতে চাইবে, গুগল বা বুগুল খুলে, হোয়াট ইজ গুলি ডাং, বুড়ি বসন্তী, ভাটা খেলা, নুনচিক/ গাদি/ জাহাজ খেলা। তাই লিখে দেওয়া সমীচীন। বন্ধুরা কেউ সাহায্য করবেন?
গুলি মানে বন্দুকের নয়, দুদিক ছুঁচলো একটা কাঠের দু ইঞ্চি থেকে চার ইঞ্চি একটা সরু টুকরো। ডাং হচ্ছে কাঠেরই একটা দুফুট থেকে তিন ফুটের একটা ডান্ডা। মাটিতে শোয়ানো গুলিকে ছুঁচলো দিকে ডান্ডা পিটিয়ে মাটির উপরে তুলে বা রেখে এক বা একাধিক বার ড্রিবল করে যত দূরে পাঠাবে, ততো পয়েন্ট জুটবে। হাতের ওই ডান্ডা বা গুলি দিয়ে মাপ হবে।
গুলিকে শূন্যে যতবার পেটানো হবে মাপ হবে ততোগুণ। অনেকটা ক্রিকেটের বড়দা।
উইকেটের বদলে পেছনে একটা গর্ত থাকবে।
বিপক্ষের লোক একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে গুলি ছুঁড়বে ওই গর্তে ফেলার জন্য। ডাং খেলি সেটিকে মেরে সপাটে দূরে পাঠাবেন। মাঝে যদি দুই বা ততোধিক বার শূন্যে পেটাতে পারেন তাহলে ততোগুণ পয়েন্ট হবে।
আর ক্রিকেটের মতো ফিল্ডার বা বিপক্ষের খেলোয়াড় থাকবে ক্যাচ ধরার জন্য।
ধরলেই খেলি / খেলোয়াড় আউট।
বুড়ি বসন্তী-- একজন ছেলে বা মেয়ে বুড়ি হবে। তার পক্ষের একজন 'কু' বলে ডাক দিয়ে বিপক্ষের ছেলে মেয়েদের তাড়া করবে যাতে বুড়ি ওই বসে থাকা জায়গা থেকে নিজের ঘরে ফিরতে পারে। কু ডাক দিয়ে বিপক্ষের কাউকে ছুঁয়ে দিলে সে মৃত।
এ খেলা ছেলে মেয়ে মিলে খেলা হতো।
গুলি ডাং ডাকাতে খেলা। মেয়েদের খুব একটা দেখা যেতো না। দু একজনের চোখ বা কপালে ফুটে যেতো।
এই গুলি ডাং বা মার্বেল বা ভাটা বা ফুটবল-- ওস্তাদ ছিল শ্যামলমামা।
পড়াশোনা আর খেলাধুলোয় বুঝি একটু দ্বন্দ্ব আছে। আমরা ক্লাসে প্রথম হতাম, খেলায় শ্যামলমামার শত হাত দূরে। শ্যামলমামার উল্টো।
তার গুলি পেটানো ছিল দেখার।
আমার তিনবার মারতে পারলেই হিরো ভাবি, সে শূন্যে গুলিকে পাঁচ থেকে ছয়বার অনায়াসে পিটিয়ে গোলামহল পার করে দিতো। খুব ভালো ফুটবল খেলতো।
মামার বাড়ি পাড়ায় বাড়ি। এক দেওয়ালের এ পিঠ ওপিঠ।
তাই সবাই মামা।
শ্যামলমামা আমাকে ছোটো থেকেই খুব ভালো বাসতো। বলতো, মামু।
দুষ্টুমিতে শ্যামলমামার খুব খ্যাতি ছিল। মারামারিতেও। কিন্তু আমার প্রতি তাঁর অগাধ স্নেহ।
শ্যামলমামারা জ্যাঠতুতো খুড়তুতো মিলিয়ে সাতজন।
সাতজনই দারুণ ফুটবল খেলতো।
অশোক তো জিনিয়াস।
সমীর ছিল ছোটো। তার খেলাও আজো মনে আছে।
ওরা সবাই মামা বলতো। নামে কেউ ডাকতো না। আমরাও তাই।
শ্যামলমামা আর চাঁদু চাচা বন্ধুত্ব ছিল দেখার মতো। হরিহর আত্মা। খুব ভালো মনের মানুষ চাঁদু চাচা এবং শ্যামলমামা। দুজনে একবার এমন কাণ্ড করলো, স্কুলে পরীক্ষাই পিছিয়ে দিল একদিন।
হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড।
স্যাররা শাস্তি দেবেন?; ক্লাস সিক্সের ঘর ছিল মজবুত না। সেই ঘরের দেওয়াল ভেঙে পগাড় পার।
শেষে ডেকে এনে বাবা বাছা।
এমন করিস না।
তা আর করে নি।
দুজনে ব্যাক খেলতো। ফুটবলে। চাঁদুচাচা শৌখিন মানুষ। চুলের দারুণ বাহার। কোঁকড়া চুল। শ্যামলমামার সে-সব দিকে নজর নাই। উস্কোখুস্কো চুল।
শ্যামলমামারা ছিল বেনে। দত্ত। পয়সাওয়ালা। চাঁদুচাচারাও ছিল অবস্থাপন্ন।
শ্যামলমামার সঙ্গে একজনের ছিল খুব দ্বন্দ্ব। প্রায়ই ঝামেলা। শ্যামলমামা তাঁকে বলতো, নেংটি বামুন।
আমাদের চেয়ে বড়ো দাদাটি, পড়াশোনায় ভালো। বাবা শিক্ষক। বামুনের ছেলে। একটু বেশিই অহঙ্কারী ছিল। ওর কারণে আমার জনপ্রিয়তা একটু বাড়তি জোটে। আমি সবার সঙ্গে মিশি। ডেকে ডেকে কথা বলি। সে উল্টো।
তা একবার একটা ঘটনা ঘটলো।
গ্রামে স্কুলের পাকা ঘর হবে, ইঁট আসছে লরি করে।
গ্রামে এখন ঘরে ঘরে বাইক বা চারচাকা। তখন তো মানে সাতের দশকের মাঝামাঝি লরি-- এখনকার হেলিকপ্টার বা চার্টার্ড প্লেনের সমান ব্যাপার।
তাই লরি ঢুকলেই বেদম ভিড়। ঢোকার আগে আওয়াজ পেলে এক কিলোমিটার দূরে গিয়ে লরির পিছন পিছন ছুটে আসা। খালাসির সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা।
এবার খালি লরি ফিরবে, আমরা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে , ড্রাইভার হেল্পারের কথা না শুনে লরির পিছনে উঠে পড়তাম।
তিন কিলোমিটার গিয়ে নামতাম।
কাঁচারাস্তার ছেলে পাকারাস্তা পৌঁছালেই নেমে পড়ো।
চালক হুমকি দিতো, নিয়ে পালাব, বুঝবে মজা। পাকারাস্তায় উঠতে গিয়ে একটু স্লো করতেই হতো।
আমরাও সে-সময় ফটাফট ঝাঁপ।
একটু আধটু ভালোই ছিঁড়তো। চোট লাগতো। লরি চাপার আনন্দের কাছে সে-সব প্ল্যান।্এখনকার দিন হলে সেসব রক্তারক্তিতে হাসপাতাল ডাক্তার নিদেনপক্ষে টিটেনাস, সাতদিন আটকে রাখা-- হয়ে যেতো।
হাঁটু রক্তাক্ত হয় নি, এমন ছেলে ছেলেই না। ... র অধম।
( এসব লিখবো না, নারীবাদীরা চটবেন। কিন্তু সমাজ ইতিহাস বুঝতে সেকালের মনোভাবটা জানা দরকার)। তবে আমাদের সময় মেয়েরাও কম যেতো না। গাছে চড়া, চুকিৎ কিৎ, সাঁতার, ফুটবলে এক্সপার্ট। ওদের পা-ও রক্তাক্ত হতো পড়ে ছিঁড়ে।
আর লরি থেক নেমে পড়ে ছুটে ছুটে ফেরা।
পাশের গ্রাম পলাশন। সেখানে হাট বসে পাকা রাস্তার ধারে। বাস যায়, দোকানপাট আছে। এই গ্রামের পশ্চিমদিকে আমাদের গ্রাম। পলাশনের মাঠে ছিল আখের খেত। আমাদের গ্রামের মাটিতে আখ হতো না।
চাষ করে দেখেছিল বাবা। চাষ ফেল।
সাহসীরা সেই আখের খেতে ঢুকে আখ ভেঙে আনতো।
আমরাও দু' এক টুকরো ভাগ পেতাম।
চাষিরা পাহারা দিতো। কিন্তু ৫০-৬০ জন ছেলে। বড়ো জমি। কে কোন দিয়ে ফুঁকফাঁক করে ঢুকে পড়ে।
সেদিন দুটো লরি এসেছে। শ্যামলদারা আগে গেছে।
গিয়ে জমির মালিককে বলেছে, আজ তোমরা দেখতে পাবে কে আখ ভাঙে।
আমরা ভালো ছেলে, ওসব করি না।
এরপর আর কয়েকজন তাদের অপছন্দের ছেলেকে বার খাইয়ে গ্যাস দিয়ে আখের খেতে ঢুকিয়েছে।
সেতো আজ হিরোর সম্মান পাচ্ছে, আখ চুরির দলে নিয়েছে ভেবে খুব খুশি।
আখ ভাঙছে মনের সুখে।
এইসময় শ্যামলদারা গিয়ে খবর দিয়েছে চাষিদের, দেখো আসল চোর আজ পাবে।
ছেলেটি, এখন লোক, বিদেশে থাকে, বৈজ্ঞানিক, নাম লিখছি না, ৫/৬ টা আখ ভেঙেছে।
আরো ভাঙবে। এমন সময় চাষির দল হাজির।
ওই ভাঙা আখ দিয়ে বেদম মার।
পিঠ একেবারে লাল।
আমাদের খুব খারাপ লাগছে।
শ্যামলদারা ৫/৬ টা আখ পেয়ে গেল।
আর চুক্তি হলো, আখ চুরির দরকার নেই।
এমনসব ভালো ছেলে চোর ধরিয়ে দেয়।
গোটা চারেক আখ পাবে, লরি এলে ওরাই পাহারাদার।
দু চারটে খেতের শসা কাঁকুড়ও মিলতে লাগলো ভালো ছেলেদের জন্য।
তা আমার আর আজমের এ-রকম এক মার খাওয়ার গল্প আছে।
আমাদের সঙ্গে উত্তরপাড়ার দুটি ছেলে পড়তো। আমাদের বোঝালো, ওদের একটা কুল গাছ আছে। দারুণ মিষ্টি কুল। খেতে যেতে পারি। নমুনা হিসেবে চারটি খেতে দিল। নারকুলে কুল।
খেয়ে তর।
চল।
তো আমি আর আমার এক বন্ধু গেছি। বেড়া খুলে ঢুকে কুল পাড়ছি।
দেখি ওরা নেই। একটু সন্দেহ হলো। বের হতে গেলাম। তখনই হাজির গাছের আসল মালিকের ছেলে।
ব্যাটা তোমরা রোজ এসে কুল পেড়ে যাও। আমি ভাবি, ওরা।
দেখাচ্ছি মজা।
বলেই লাঠি দিয়ে মার।
ব্যাটারা করেছে কী, নিজেরা কুল পেড়ে খায়। আজ আমাদের ডেকে এনে নিজেদের গাছ বলে মালিকের ছেলেকে গিয়ে বলেছে, ওরা রোজ এসে কুল খেয়ে যায়।
আজ ধরবি তো চল।
বন্ধু ভাস্কর সেন কথাপ্রসঙ্গে জানালেন,
ইটের টুকরো বা মাটির হাঁড়ির টুকরো ঘষে গোল করে চাকতি বানানো হত। একটার ওপরে একটা লম্বা করে বসানোর পর একজন একজন করে একটু দূর থেকে বল গড়িয়ে সেটা ভাঙার চেষ্টা করত। যে ভাঙত সে হত চোর। একজন পালা করে চাকতির ছোট মিনারের পিছনে উইকেট কিপারের মত দাঁড়াত। মিনার ভাঙলেই বলের দখল নিত সে। তারপর বাকিরা বল নিয়ে ছুঁড়ে নিজেদের মধ্যে পাস করত। কিন্তু নিয়ম হল বল হাতে পেলে স্থান পরিবর্তন না করেই পাস করতে হবে। বল হাতে দৌড়ন যাবে না। চোরের কাজ হল বল নিজের দখলে আনা আর বল পেলেই সজোরে তা কোন একজনকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারা। বল গায়ে লাগলেই সেও চোর। এই ভাবে চোরের সংখ্যা বাড়তে থাকে। যে শেষ পর্যন্ত টিঁকে থাকবে জিত তার। বল এত জোরে ছোঁড়া হত লাগলে গায়ে চাকা চাকা দাগ হয়ে যেত। তবুও এ খেলার আকর্ষণ ছিল প্রবল। এও আপনার ভাষায় ডাকাতে খেলা। আর খেলা মাঠে শুরু হলেও একটু পরেই তা পাড়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ত।