এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ইডেনের পাঁচ দিন  বাবা আর মেয়ের শীতের সিরিজ অয়ন মুখোপাধ্যায়

    Ayan Mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ২০ নভেম্বর ২০২৫ | ১১০ বার পঠিত
  •  
     
    ইডেনের পাঁচদিন : এক বাবা–মেয়ের শীতের সিরিজ
     
    অয়ন মুখোপাধ্যায়
     
     
     
    ১. দাওয়াতনামা
     
    কাল সকালের খবরের কাগজে প্রথম খবর
      ইডেনের মাঠে ভারতকে হারিয়ে দিল সাউথ আফ্রিকা
    কিন্তু আমার কাছে ওটা কোনো খবরই নয়।
    আমার খবর হলো—
    সামনের শীতকালে মেয়েকে নিয়ে যাব ইডেন গার্ডেন্সে।
     
    আমার কাছে ইডেন শুধু স্টেডিয়াম নয়—
    একটা দেশ, গোটা ভারতবর্ষ,
    তার রাজনীতি, তার সংস্কৃতি, আর ড়াইয়ের মানচিত্র।
     
    এই কথাটা বলতেই
    আমাদের বারান্দায় পাড়ার লোকেদের
    ভিড় জমে গেল।
     
    একজন মজা করে বলল—
    “সারা বছর ধুলো খেয়ে কাটাস,
    আর স্বপ্নগুলো মাথার ওপরে উড়ে বেড়ায় ?”
     
    আমি হেসে বললাম—
    “ধুলো মানুষকে ছোট করে না,
    শুধু চোখটা কে একটু জ্বালা  ধরায়
     
    ওরা কি জানে—
    আমার মেয়ের চোখে একটা ছোট্ট দিগন্ত লুকিয়ে আছে,
    যেটার রঙ এখনো পুরো পুরোপুরি বেরোয়নি;
    শুধু টুপটুপ করে অপেক্ষার আলো জ্বলে।
     
    ইডেনে ঢুকতে টিকিট লাগে—
    ঠিক আছে।
    কিন্তু মেয়ের হাত ধরে
    স্বপ্নের ভেতর ঢুকতে
    কোনো গেটম্যান থাকে না
    কোনো লাইন নেই, আমাকে কোন দাম দিতে হয় না।
     
    আমাদের কিছুই নেই শুধু স্বপ্নে ঢোকার স্বাধীনতাটাই একমাত্র অবশিষ্ট যা আমাদের জন্য সব চেয়ে সস্তা, সবচেয়ে উজ্জ্বল।
     
    তাই সামনের শীতে
    মেয়ে, বউ, সবাইকে নিয়ে যাব ইডেনে গার্ডেন্সে
    আর হাঁটতে হাঁটতে গাইব—
    “আ চল কে তুঝে ম্যায় লে কে চলু
    এক দূর গগন কি তলে 
     
     
    ২. মাইনে, বাজেট আর ব্যাট–প্যাড
     
    মাসশেষে এ.টি.এমের সামনে দাঁড়ালেই
    সবচেয়ে আগে মেয়ের মুখটাই ভেসে ওঠে।
    দায়বদ্ধতার অঙ্ক—
    অর্ধেক পারি, অর্ধেক পারি না।
     
    ব্যালান্স দেখে স্ত্রী বলল—
    “টাকা এত কম কেন?”
    আমি মজা করে বললাম—
    “দেশ তো উন্নতি করছে…”
     
    মেয়ে সব শুনে হেসে বলল
    “তা হলে তোমার পকেটে উন্নতি ঢুকছে না কেন?”
     
    এক লাইনেই
    সারা অর্থনীতির আবরণ খসে পড়ল।
     
    ইডেনের টিকিটের দাম—
    আকাশের মতো উঁচু।
    আমার মাইনে—
    মাটির মতো স্থির, নড়েও না, বাড়ে ও না।
     
    আমি বললাম—
    একটা ব্যাট থাকলে
    সব সমস্যাগুলো কে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিতাম
    মেয়ে শান্ত গলায় বলল—
    বাবা, যারা আমাদের জীবন নিয়ে খেলে,
    ওদের হাতে কিন্তু কোনো ব্যাটই নেই
     
    তবুও আমরা মাঠের বাইরেই থেকে গেলাম।
     
     
     
     
    ৩. ভোট আর ভিড়
     
    ইডেনের ভিড় আর ব্রিগেডের ভিড়—
    এই শহর বহুদিন ধরে দেখতে অভ্যস্ত।
     
     ভিড়ের কথা বলতে গিয়ে মেয়েকে বললাম—
    “ওরা সবাই দল দেখে না,
    দেখে আলো, দেখে উল্লাস, 
    মেয়ে চুপ করে জিজ্ঞেস করল—
    “তবে ভোটের সময় আলো নিভে যায় কেন?”
     
    মনে পড়ল আমার বাবার কথা—
    “আলো দেখার চোখ তো অনেকের থাকে,
    কিন্তু আলো জ্বালানোর সুইচটা
    কার হাতে থাকে—
    সেটা দেখতে আরেকটা চোখ লাগে"
     
    হয়তো আমাদের সেটা নেই।
     
    ইডেনে স্ট্যান্ডের রঙে মিশে
    মানুষ মানুষই থাকে।
    ভোটের দিনে শুধু রঙ বদলে যায়—
    লাল, সবুজ, কমলা…
    আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকি আমরা,
    যাদের পকেটে কোনো রঙ নেই।
     
    মেয়েকে গর্ব করে বললাম—
    দেখ একমাত্র খেলা যেখানে কোন রাজনীতি হয় না 
    মেয়ে বলল—একমাত্র রাজনীতিই যেখানে সবচেয়ে বেশি খেলা হয়।
     
     
    ৪. বাদাম, বাজনা, বর্ণমালা
     
    টিভির সামনে বসলে
    গ্যালারির বাদামভাজার গন্ধও
    যেন ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে।
    চা, চিৎকার, উল্লাস—
    একদিনের জন্য ক্লান্তি পিছনে সরে যায়।
     
    মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল—
    “তুমি ছোটবেলায় ইডেনে গেছিলে?”
    আমি বললাম—
    “ইডেন তখনো খুব বড় ছিল,
    আর আমরা আরো ছোট ছিলাম।
    মাঠের দাম কম ছিল,
    আর আমাদের সামর্থ্য ছিল তার চেয়ে আরো কম।”
     
    এই দেশে স্বপ্ন দেখারও ভাগ আছে—
    কেউ মাঠে গিয়ে দেখে,
    কেউ টিভিতে দেখে,
    আর আমরা— স্বপ্ন দেখতে হয় বলে 
    স্বপ্ন দেখি।
     
    মেয়ে কে বোঝালাম যার বাবা যত গরিব 
    তার মেয়ের সোয়েটার তত বেশি গরম রাখতে হয়।
    এই অঙ্ক কোনো বইয়ে শেখানো হয় না। 
    এটা বুঝতে কোন বিশ্লেষক কে দরকার পরে না
     
    কিন্তু প্রতিটি বাবা এটা নীরবে জানে।
     
     
    -
    ৫. খেলা শেষের গল্প
     
    টিভির পর্দায় খেলা শেষ
    জীবনের পর্দা আবার আমাদের নতুন ম্যাচ শুরু হয়।
     
    মেয়ের চোখে ধীরে ধীরে আলো নেমে আসে।
    সে বলল—এবার তো পারলে না সামনের শীতে আমরা কি যাব ইডেন গার্ডেনসে? 
     
    পাড়ার লোকজন জিজ্ঞেস করল—
    “সামনের বার নাকি তোরা ইডেনে যাচ্ছিস?”
    আমার অনিশ্চয়তা।হেসে বলল
    “আমার তো হলো না—তোমাদের যেন হয়।
     
    তারপর মেয়ের কানে আস্তে আস্তে বললাম—
    “তোর চোখে ভেতরেই আমি ইডেন উদ্যান দেখতে পাই 
    এই পৃথিবীতে সেরকম ইডেন কোথাও নেই রে।”
     
    রাতে হাঁটতে হাঁটতে
    মেয়ে আবার জিজ্ঞেস করল—
    “আমরা কবে যাব, বাবা?”
     
    আমি বললাম—
    “দেশ ভালো থাক বা না থাক,
    সামনের শীতে আমরা সবাই মিলে ইডেন গার্ডেন্সে যাব
    স্বপ্ন দেখতে কোনো ঘোষণাপত্র লাগে না—
    লাগে একটু সাহস।”
     
    দারিদ্র্য, রাজনীতি, ঋণ কষ্ট—
    সব পেরিয়ে এক বাবা তার মেয়ে কে চুপচাপ স্বপ্নগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার গল্প বলে।
     
    কারণ জীবনের মাপ
    দেশের মাপ এক নয়
    বরং মেয়ের হাতের উষ্ণতাই বলে দেয়—
    এটাই আমার আসল ইডেন।
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • লোপামুদ্রা | 2409:40e1:c1:b0ec:8000::***:*** | ২০ নভেম্বর ২০২৫ ১৬:২৯735964
  • অদ্ভুত সুন্দর সংলাপ নাটকীয়তা অনুভূতি সেন্টিমেন্ট মিকচার মাটনকারী র মত
  • :( | 46.105.***.*** | ২০ নভেম্বর ২০২৫ ১৬:৪৬735965
  • আমার তো চিকেন ভিন্দালুর মতন লাগল।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন