ইডেনের পাঁচদিন : এক বাবা–মেয়ের শীতের সিরিজ
অয়ন মুখোপাধ্যায়
১. দাওয়াতনামা
কাল সকালের খবরের কাগজে প্রথম খবর
ইডেনের মাঠে ভারতকে হারিয়ে দিল সাউথ আফ্রিকা
কিন্তু আমার কাছে ওটা কোনো খবরই নয়।
আমার খবর হলো—
সামনের শীতকালে মেয়েকে নিয়ে যাব ইডেন গার্ডেন্সে।
আমার কাছে ইডেন শুধু স্টেডিয়াম নয়—
একটা দেশ, গোটা ভারতবর্ষ,
তার রাজনীতি, তার সংস্কৃতি, আর ড়াইয়ের মানচিত্র।
এই কথাটা বলতেই
আমাদের বারান্দায় পাড়ার লোকেদের
ভিড় জমে গেল।
একজন মজা করে বলল—
“সারা বছর ধুলো খেয়ে কাটাস,
আর স্বপ্নগুলো মাথার ওপরে উড়ে বেড়ায় ?”
আমি হেসে বললাম—
“ধুলো মানুষকে ছোট করে না,
শুধু চোখটা কে একটু জ্বালা ধরায়
ওরা কি জানে—
আমার মেয়ের চোখে একটা ছোট্ট দিগন্ত লুকিয়ে আছে,
যেটার রঙ এখনো পুরো পুরোপুরি বেরোয়নি;
শুধু টুপটুপ করে অপেক্ষার আলো জ্বলে।
ইডেনে ঢুকতে টিকিট লাগে—
ঠিক আছে।
কিন্তু মেয়ের হাত ধরে
স্বপ্নের ভেতর ঢুকতে
কোনো গেটম্যান থাকে না
কোনো লাইন নেই, আমাকে কোন দাম দিতে হয় না।
আমাদের কিছুই নেই শুধু স্বপ্নে ঢোকার স্বাধীনতাটাই একমাত্র অবশিষ্ট যা আমাদের জন্য সব চেয়ে সস্তা, সবচেয়ে উজ্জ্বল।
তাই সামনের শীতে
মেয়ে, বউ, সবাইকে নিয়ে যাব ইডেনে গার্ডেন্সে
আর হাঁটতে হাঁটতে গাইব—
“আ চল কে তুঝে ম্যায় লে কে চলু
এক দূর গগন কি তলে
২. মাইনে, বাজেট আর ব্যাট–প্যাড
মাসশেষে এ.টি.এমের সামনে দাঁড়ালেই
সবচেয়ে আগে মেয়ের মুখটাই ভেসে ওঠে।
দায়বদ্ধতার অঙ্ক—
অর্ধেক পারি, অর্ধেক পারি না।
ব্যালান্স দেখে স্ত্রী বলল—
“টাকা এত কম কেন?”
আমি মজা করে বললাম—
“দেশ তো উন্নতি করছে…”
মেয়ে সব শুনে হেসে বলল
“তা হলে তোমার পকেটে উন্নতি ঢুকছে না কেন?”
এক লাইনেই
সারা অর্থনীতির আবরণ খসে পড়ল।
ইডেনের টিকিটের দাম—
আকাশের মতো উঁচু।
আমার মাইনে—
মাটির মতো স্থির, নড়েও না, বাড়ে ও না।
আমি বললাম—
একটা ব্যাট থাকলে
সব সমস্যাগুলো কে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিতাম
মেয়ে শান্ত গলায় বলল—
বাবা, যারা আমাদের জীবন নিয়ে খেলে,
ওদের হাতে কিন্তু কোনো ব্যাটই নেই
তবুও আমরা মাঠের বাইরেই থেকে গেলাম।
৩. ভোট আর ভিড়
ইডেনের ভিড় আর ব্রিগেডের ভিড়—
এই শহর বহুদিন ধরে দেখতে অভ্যস্ত।
ভিড়ের কথা বলতে গিয়ে মেয়েকে বললাম—
“ওরা সবাই দল দেখে না,
দেখে আলো, দেখে উল্লাস,
মেয়ে চুপ করে জিজ্ঞেস করল—
“তবে ভোটের সময় আলো নিভে যায় কেন?”
মনে পড়ল আমার বাবার কথা—
“আলো দেখার চোখ তো অনেকের থাকে,
কিন্তু আলো জ্বালানোর সুইচটা
কার হাতে থাকে—
সেটা দেখতে আরেকটা চোখ লাগে"
হয়তো আমাদের সেটা নেই।
ইডেনে স্ট্যান্ডের রঙে মিশে
মানুষ মানুষই থাকে।
ভোটের দিনে শুধু রঙ বদলে যায়—
লাল, সবুজ, কমলা…
আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকি আমরা,
যাদের পকেটে কোনো রঙ নেই।
মেয়েকে গর্ব করে বললাম—
দেখ একমাত্র খেলা যেখানে কোন রাজনীতি হয় না
মেয়ে বলল—একমাত্র রাজনীতিই যেখানে সবচেয়ে বেশি খেলা হয়।
৪. বাদাম, বাজনা, বর্ণমালা
টিভির সামনে বসলে
গ্যালারির বাদামভাজার গন্ধও
যেন ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে।
চা, চিৎকার, উল্লাস—
একদিনের জন্য ক্লান্তি পিছনে সরে যায়।
মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল—
“তুমি ছোটবেলায় ইডেনে গেছিলে?”
আমি বললাম—
“ইডেন তখনো খুব বড় ছিল,
আর আমরা আরো ছোট ছিলাম।
মাঠের দাম কম ছিল,
আর আমাদের সামর্থ্য ছিল তার চেয়ে আরো কম।”
এই দেশে স্বপ্ন দেখারও ভাগ আছে—
কেউ মাঠে গিয়ে দেখে,
কেউ টিভিতে দেখে,
আর আমরা— স্বপ্ন দেখতে হয় বলে
স্বপ্ন দেখি।
মেয়ে কে বোঝালাম যার বাবা যত গরিব
তার মেয়ের সোয়েটার তত বেশি গরম রাখতে হয়।
এই অঙ্ক কোনো বইয়ে শেখানো হয় না।
এটা বুঝতে কোন বিশ্লেষক কে দরকার পরে না
কিন্তু প্রতিটি বাবা এটা নীরবে জানে।
-
৫. খেলা শেষের গল্প
টিভির পর্দায় খেলা শেষ
জীবনের পর্দা আবার আমাদের নতুন ম্যাচ শুরু হয়।
মেয়ের চোখে ধীরে ধীরে আলো নেমে আসে।
সে বলল—এবার তো পারলে না সামনের শীতে আমরা কি যাব ইডেন গার্ডেনসে?
পাড়ার লোকজন জিজ্ঞেস করল—
“সামনের বার নাকি তোরা ইডেনে যাচ্ছিস?”
আমার অনিশ্চয়তা।হেসে বলল
“আমার তো হলো না—তোমাদের যেন হয়।
তারপর মেয়ের কানে আস্তে আস্তে বললাম—
“তোর চোখে ভেতরেই আমি ইডেন উদ্যান দেখতে পাই
এই পৃথিবীতে সেরকম ইডেন কোথাও নেই রে।”
রাতে হাঁটতে হাঁটতে
মেয়ে আবার জিজ্ঞেস করল—
“আমরা কবে যাব, বাবা?”
আমি বললাম—
“দেশ ভালো থাক বা না থাক,
সামনের শীতে আমরা সবাই মিলে ইডেন গার্ডেন্সে যাব
স্বপ্ন দেখতে কোনো ঘোষণাপত্র লাগে না—
লাগে একটু সাহস।”
দারিদ্র্য, রাজনীতি, ঋণ কষ্ট—
সব পেরিয়ে এক বাবা তার মেয়ে কে চুপচাপ স্বপ্নগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার গল্প বলে।
কারণ জীবনের মাপ
দেশের মাপ এক নয়
বরং মেয়ের হাতের উষ্ণতাই বলে দেয়—
এটাই আমার আসল ইডেন।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।