

ভূগোলের কথা বলতে গেলেই কেবল বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ আর স্যার ম্যাডামদের কথা মনে পড়ে যায়। ওঁদের দেখানো পথেই তো হেঁটে চলেছি এতদিন। যা হোক এবারে একটু বাংলার বাইরে আরও খানিকটা পূর্ব দিকে ঘুরে আসা যাক। সেবার বল্লরীদি বলল যে আমাদের ব্রহ্মপুত্র নদ দেখাবে। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমাদের মনটাও বেশ ডগমগ হয়ে উঠলো। ‘কবে আসবে দিনটা ম্যাডাম’ - নিজের বুকে ছুরি মেরে ওদের সামনে খুব গম্ভীর হয়ে থাকতে হয় - সামনে তো আর দেখানো যায়না যে আমাদের ভেতরটাও আঁকুপাঁকু করছে। ধীরে ধীরে বল্লরীদি এবারে আসল কথা পাড়লো। ও প্ল্যান করেছে ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে আরও দক্ষিণের একটা গ্রামে এবারে সার্ভে করাবে। যে সে গ্রাম নয় - ও যখন উচ্চারণ করল - টুংটাং মিষ্টি ঘন্টার মতো কানে বেজে উঠল নামটা - মৌলিন্নং বা মাওলাইনং । এশিয়ার পরিচ্ছন্নতম গ্রাম। গুয়াহাটি থেকে শিলং পাহাড় - আবার সেখান থেকে পাড়ি দিতে হবে আরও বেশ কিছুটা, মোটমাট প্রায় ছ সাত ঘন্টার পথ। মেঘালয়ের পূর্ব খাসি পাহাড়ের কোলে নির্জন নিরিবিলি এলাকা। ওখানেই এবারে আমাদের স্নাতকোত্তর ছাত্রছাত্রীদের ফিল্ড সার্ভে হবে। আমার সহকর্মিনী বল্লরীদির নেতৃত্বে আমি, মধুসূদন ও গার্গী প্রস্তুতি শুরু করলাম।
রেলগাড়ি ঝমাঝম
নির্ধারিত দিনে হাওড়া স্টেশন থেকে বিকেল বিকেল রেলগাড়িতে চেপে বসলাম। সরাইঘাট এক্সপ্রেস, ছাড়ল বিকেল তিনটে পঞ্চাশে। বেশিরভাগ সময়েই আমাদের গন্তব্য থাকে হয় ডুয়ার্স, নতুবা উত্তর বঙ্গের পাহাড়, কিংবা সিকিম। তাই একরাত ট্রেনে কাটিয়ে সকাল হলেই নিউ জলপাইগুড়িতে নেমে পড়ি। গত বাইশ বছরে এতবার এসেছি, যে মুখস্থ হয়ে গেছে। এবারে কিন্তু যাত্রা অন্যরকম। ভোরে ট্রেন থেকে নামার চাপ নেই। আধোঘুমের মধ্যেই রাত দুপুরে মানে এই দুটো নাগাদ ট্রেন নিউ জলপাইগুড়ি ছাড়িয়ে পুবদিকে বাঁক নিল। আমি আগে কখনো আসাম দেখিনি। তাই মনে বেশ উত্তেজনা। ভোরবেলা বার্থে শুয়ে শুয়েই এক ছাত্রীর গলা শুনতে পেলাম। বল্লরীদি জিজ্ঞেস করছিল কোথায় এল গো। উত্তর শুনলাম বঙ্গাইগাঁও ম্যাডাম। শুনেই লাফ দিয়ে উঠলাম। আসাম এসে গেছে তাহলে। সেই কোন শৈশবে, প্রাথমিক বিভাগে পড়ি যখন, বাবা এনে দিয়েছিল, হযবরল। সেখানে বিচার সভায় আসাম থেকে একজন এসে পড়েছিল, সেই প্রথম আসাম নামটা জানা। মা, বোন আর মাসিদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম- চামেলী মেমসাব। মনে সুরের রেশ ভেসে আসে ........ আসাম দেশের মেয়ে আমি চা-মে-লী.....যেন গত জন্মের কথা।
দিনটা নয়ই ফেব্রুয়ারি। মাঠে ভোরের শিশির, আর রেলকামরায় জানলার বন্ধ কাচে কুয়াশা, দুটোই এখনো জমাট। জানলা খুলতেই ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝলক লাগে মুখে চোখে। পশমের চাদরের আড়ালে নিজেকে বাঁচিয়ে কুয়াশা ভেদ করে দূরে দেখার চেষ্টা করি। ভোরের আলোয় চোখ জুড়িয়ে যায়। বাংলার মতোই শ্যামল জমি। শুধু তফাৎ হল, এ সবুজ ব্রহ্মপুত্রের দান, আমাদের মতো গঙ্গা-ভাগিরথীর নয়। আমি এখনো ব্রহ্মপুত্র দেখিনি। প্রথম দর্শনের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে আছি। মধ্যে মধ্যে চা বাগান। হঠাৎ কুয়াশার চাদর ছিঁড়ে যায়। দূরে পাহাড়ের শ্রেণী, ধোঁয়া ধোঁয়া। বার বার ঠাহর করে দেখি, ঠিক পর্বত শ্রেণীই বটে। কী পাহাড় ওটা? চলেছি পুবদিকে। ডানদিকের জানলায় অনেক দূরে পাহাড়। সত্যজিতের রয়েল বেঙ্গল রহস্য মনে পড়ে। 'দিক পাও ঠিক ঠিক জবাবে'। জবাব হল উত্তর। উত্তরে পাহাড়। ভূগোলের জ্ঞান বলে ও ভূটান পাহাড় না হয়ে যায় না। তার মানে ভোর ভোর হিমালয় দর্শন। দেবতাত্মা হিমালয়কে প্রণাম করে দিন শুরু করি। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে। সকালের রোদ বেরিয়েছে। রেলকামরার জানলাগুলো এখন সব খোলা। এবারে বাঁদিকের জানলায় পাহাড়। একটানা শ্রেণী নয়। ব্যবচ্ছিন্ন। তবে খুব কাছে। গার্গী চলভাষে গুগল ম্যাপ খোলে। আমরা সবাই ঝুঁকে পড়ে দেখি। আচ্ছা এটা তবে গারো পাহাড়। ম্যাপে দেখি, ব্রহ্মপুত্র আছে, শুধু একটু দূরে। তাই ট্রেন থেকে দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরে রেললাইন আর নদীর দেখা হবে। তখনই আমাদের আশা পূর্ণ হবে। আশা পূর্ণ হল, অনুভব করলাম ব্রহ্মপুত্রের বিশালতা। এরপরে দেখলাম দীপোর বিল। নদীর গতিপথে ছেড়ে যাওয়া বিশাল হ্রদ, ইংরেজি ইউ আকৃতির মত - অর্থাৎ এটিও একটি অক্স বো লেক বা অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ। এখন শীতকাল, জলের সীমানা সঙ্কুচিত হয়েছে, তাও ট্রেন থেকে এত বড় দেখাচ্ছে, তবে বর্ষাকালে কী বিশাল আকার ধারণ করে তা সহজেই বোঝা যায়। ১৯৮৯ সালে আসাম সরকার এই জলাভূমিকে অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন। মূলত জলজ উদ্ভিদের বাস্তুতন্ত্র, নানা প্রজাতির মাছ আর পাখির সমারোহের জন্যই এই বিলের নামডাক। গুয়াহাটির আগে কামাখ্যা জংশন থেকে কামাখ্যা মন্দিরের চূড়া দেখতে পেলাম। গুয়াহাটিতে নামলাম সকাল এগারোটা নাগাদ। বাহনটা এতক্ষণ ছিল রেলগাড়ি, এবার হয়ে গেল দিব্য প্যাঁকপ্যাঁকে হর্ন দেওয়া একটা বাস। একরাত গুয়াহাটিতে কাটিয়ে, পরদিন প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম মৌলিন্নংয়ের উদ্দেশে। এবার যাত্রা সড়কপথে, ডিলাক্স বাসে। তবে গুয়াহাটিতে বসে ছিলাম না মোটেই। নীলাচল পাহাড়ে দেবী কামাখ্যার মন্দির দর্শন করেছি আর গোধূলি লগ্নে সময় কাটিয়েছি ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে। অল্প বয়সে মহাকাল পর্বতের অন্যতম দর্শনীয় স্থান অমরকন্টকে সার্ভে করতে গিয়ে নর্মদা দেবীর মাহাত্ম্যকে অবজ্ঞা করেছিলাম। কেবল ভৌগোলিক নিদর্শন খুঁজতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের দেশ মা, ভারত মাতা সেদিন এক বিশাল থাপ্পড় মেরেছিলেন গালে। আশ্চর্য আমাদের দেশ। এখানে ভূগোল, বিজ্ঞান, প্রকৃতি পূজা, ইতিহাস, ধর্ম, আচার, মন্ত্র সব এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। এ এক সত্যিকারের জাদু বাস্তবতা। অমরকন্টক ছেড়ে আসার আগের দিন এমন এক জিনিস আবিষ্কার করলাম, যে আগে যাত্রাপথে এতগুলো মন্দির পড়েছে, আর আমি বা বল্লরীদি কেউ ভেতরে ঢুকিনি, কেন ঢুকিনি, তবে কথাটা আগেই জানতে পারতাম - আফসোসের সীমা ছিলনা। সেই যে শিক্ষা পেলাম, আর কোনদিন কোন এলাকার প্রচলিত কাহিনী বা ধর্মীয় ধারণাকে অবজ্ঞা করিনি। এখন সব সময়ে এমন কিছু থাকলে খুঁটিয়ে জানার চেষ্টা করি। বিশদে বলব গল্পটা কোন একদিন যদি সুযোগ হয়। বড় কঠিন এসব অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা।
যাই হোক কামাখ্যা মাকে দর্শন করার ইচ্ছে ছিল প্রবল। কারণ প্রকৃতি পুজোর এমন তীক্ষ্ণ নিদর্শন ভারতের মত দেশেও অদ্বিতীয়। নীলাচল পাহাড়ের গায়ে দেবী কামাখ্যার অবস্থান। হিমালয় এখান থেকে খুব দূরে তো নয়, হতেই পারতো নীলাচল সেই নবীন ভঙ্গিল শ্রেণীরই কোন বিচ্ছিন্ন শিরা। কিন্তু মোটেই তা নয়। প্রতিবেশী গারো খাসি জয়ন্তীয়ার মতই নীলাচল আগ্নেয় শিলা দিয়ে তৈরি এক পাহাড়। মানে এখন পাহাড় বটে, আসলে এরা সকলেই প্রাচীন মালভূমির থেকে যাওয়া ব্যবচ্ছিন্ন অংশ। হিমালয়ের নৈকট্য, ব্রহ্মপুত্র বিধৌত সবুজ সমভূমির কোল, মালভূমির প্রান্ত সব মিলিয়ে ভৌগোলিকভাবে এই স্থানটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন এলাকার ভক্তের স্রোত, যাদের চাহিদা এবং সংস্কৃতির প্রভাব এই অঞ্চলে পড়েছে। অমরকন্টকের কথা বারবার মনে পড়ছে কারণ নর্মদা মন্দিরের মতই কামাখ্যা মন্দিরও মনোবাঞ্ছা পূরণের স্থান। এছাড়া ধর্মীয় কারণে এই মন্দির বিখ্যাত তো বটেই, কারণ এটি ৫১ শক্তিপীঠের অন্যতম। কথিত আছে, সতীর দেহত্যাগের পর বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রে দেবীর যোনি ছিন্ন হয়ে এখানে পড়েছিল।কামাখ্যা মন্দিরে চারটি কক্ষ আছে। গর্ভগৃহ এবং তিনটি মণ্ডপ। গর্ভগৃহটি আসলে একটি প্রাকৃতিক গুহা। এখানে কোনও মূর্তি নেই। শুধু একটি পাথরের সরু গর্ত দেখা যায়। গর্ভগৃহটি ছোটো এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন। ভিতরে ঢালু পাথরের একটি খণ্ড আছে। সেটি যোনির আকৃতি বিশিষ্ট। এটিতে প্রায় দশ ইঞ্চি মাপের একটি গর্ত দেখা যায়। একটি ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনের জল বেরিয়ে এই গর্তটি সবসময় ভর্তি রাখে। এই গর্তটিই দেবী কামাখ্যা নামে পূজিত এবং দেবীর পীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ। দেবীর ঋতুচক্র চলাকালীন মন্দিরগৃহ তিনদিন বন্ধ থাকে।
সারা ভারতেই সচরাচর উল্লম্ব আগ্নেয় উদবেধ বা vertical igneous intrusion - অর্থাৎ ডাইক - যেগুলি আবহবিকার ও ক্ষয়ের ফলে ভূপৃষ্ঠে বেরিয়ে এসেছে, সেগুলিকেই শিব বলে পুজো করা হয়। যুগে যুগে মানুষ এই ডাইককে মাটির তলা থেকে বেরিয়ে আসা শিবলিঙ্গ বলে বিশ্বাস করেছে, এবং রাজারা সেটিকেই ঘিরে শিব মন্দির বানিয়েছেন। আমাদের বাংলার বক্রেশ্বর শিবেরও এই গল্প। এইসব উদবেধ যেখানে থাকে, খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে ফাটল তৈরি হয়, এবং ভূগর্ভস্থ জলস্তর থেকে জলধারা চাপমুক্ত হয়ে প্রস্রবণ বা ঝর্না রূপে ভূপৃষ্ঠে বেরিয়ে আসে, কোথাও কোথাও প্রাকৃতিক জলাশয় বা কুন্ড তৈরি হয়। প্রাচীনকালের কৌতূহলী মানুষ লক্ষ করেছিল যে এসব জায়গায় নীরস পাথর থেকে জল বেরিয়ে আসে - এ যে জিওলজি আর হাইড্রোলজির ম্যাজিক - সেটা বোঝার মত বিজ্ঞান তো তখনও আবিষ্কার হয়নি, তাই এই স্থানগুলোকে দেবতার মাহাত্ম্য যুক্ত করে সবসময়েই কোন না কোন পৌরাণিক কাহিনী দিয়ে কার্যকারণ বোঝানো হয়েছে। কামাখ্যা মন্দিরের নারী যোনি সদৃশ পাথর ডাইক নয়। কিন্তু মাঝখানের গর্ত দিয়ে সারাবছর ঝর্না বেরিয়ে আসার জন্য হয়তো ধরিত্রী দেবীর পুজো হত এখানে। ভারতের বহু জায়গায় এইরকম গর্ত দিয়ে জল বেরোনোর পয়েন্টকে কোন মুনির কমন্ডলুর সঙ্গে তুলনা করা হয়। মধ্য ভারতে শ্রাবণ মাসে এসব গর্ত দিয়ে জল বেরোয়। ভক্ত মানুষ মনে করেন বর্ষায় মা গঙ্গা তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আসলে শুখা মরশুমে জলস্তর নেমে যায়, আর বর্ষাকালে উঠে এসে উপচে যায়। কিন্তু কামাখ্যায় টার্নিং পয়েন্ট হল দেবীর ঋতু চক্র এবং অম্বুবাচী। বর্ষায় ঐ ঝর্নার জল লালচে হয়ে যায়। স্থানীয় বিশ্বাস - লালচে জল বেরোনোর সময়ে দেবী রজস্বলা হন। বিশ্রামে থাকেন। পুজো আচ্চা, পালা পার্বণ, ভক্ত সমাগম সব বন্ধ। মন্দিরের বাইরে অম্বুবাচীর মেলা বসে। এসময়ে মাটি চাষ করা নিষেধ। কারণ এই সময়টি পৃথিবীর উর্বরতার প্রতীক। ঠিক যেন আধুনিক যুগের পিরিওড লীভ। বিশ্রামের পরে আবার লাঙ্গল কাস্তের কর্ষণ আর নতুন ফসল ফলাবার দিন আসে। এখন এই লাল জলের রহস্যটা কী? সহজ বুদ্ধিতে যা আসে তাই বলছি। নীলাচল পাহাড় প্রাচীন গন্ডোয়ানা ভূমির অংশ। কাজেই লোহা এখানে আছে। আর একটা জিনিস আছে মারকারি সালফাইডের স্তর। খুব সম্ভবত বর্ষায় জল উঠে ঐ ধরণের কোন স্তর স্পর্শ করে। তাই এই ম্যাজিক। অন্য কোন কারণও থাকতে পারে, আমার জানা নেই।
ফেরার পথে অপার ব্রহ্মপুত্রের জলে সূর্যাস্তের আলো, আকাশে রক্তিম মেঘের সারি, চোখ ফেরানো যায়না - একই নদী তিব্বতে সাংপো, অরুণাচলে ডিহাং, আর বাংলাদেশে যমুনা রূপে বয়ে যায়। কত দেশের মানুষের সাথে তার কত রকম ভাব ভালোবাসা, কত না রাগ অভিমান। অবাক লাগে। মনতোষ স্যারের কথা মনে পড়ে যায়, সিন্ধু আর এই ব্রহ্মার পুত্র দুজনেই হিমালয়ের ওপারে মানস সরোবর থেকে যাত্রা শুরু করেছে। কী অমোঘ, কী কঠিন সেই শক্তি যা হিমালয় কেটে এপারে এসেছে। এই বীরত্বের জন্যই বোধহয় প্রাচীন মানুষ এই দুই জলধারাকে পুরুষ রূপে কল্পনা করেছে। হিমালয়ান জিওলজির লেখক ওয়াদিয়া লিখেছেন এই দুটিই পূর্বগামী বা অ্যান্টিসিডেন্ট রিভার। অর্থাৎ হিমালয় সৃষ্টি হবার আগে থেকেই নদীগুলির অস্তিত্ব ছিল। হিমালয় যেমন যেমন যুগ যুগ ধরে উঁচু হয়েছে, নদীগুলোও তেমন তেমন উঁচু হবার বাড়তি স্থিতিশক্তিটাকে গতিশক্তি বানিয়ে নিয়ে গভীর করে খাত কেটেছে। আমাদের স্যার বলতেন এভাবে হতে পারেনা। শিশু হিমালয়ের দুদিকের ঢালেই নদী তৈরি হয়েছিল। কালক্রমে হেড ওয়ার্ড ইরোশন করে করে দুপাশ থেকে নদী মিশে গেছে। ভারতের দিকে বৃষ্টি হয়, তিব্বতের দিকটা শুকিয়ে গেছে, জল বেশি থাকার জন্য পুরো নদীটাই ভারতের দিকে চলে এসেছে। মনে হচ্ছে যেন হিমালয়ের ওপাশ থেকে পাহাড় কেটে ঢুকেছে। স্যার মজা করে বলতেন অ্যান্টি অ্যান্টিসিডেন্ট থিয়োরি। আমরা বড় হয়ে যখন চাকরি বাকরি করছি, স্যারকে বলতাম - ওয়াদিয়া একটা বই লিখে নিজের অ্যান্টিসিডেন্ট থিয়োরি জনপ্রিয় করেছেন। ইশকুল কলেজে সবাই ঐ জিনিস শিখছে। আপনার বইটা কবে বেরোবে স্যার? স্যার হেসে বলতেন তোমরা তো আছো, যারা আসল খবরটা জানো। মনে মনে ফিস ফিস করে বলি, আমরা এখনও আছি স্যার। কিন্তু আমাদের পরে? জেনারেল ডিগ্রি কলেজে যে আজকাল মেধাবী কেউ ভর্তি হতে চায়না, নতুন জ্ঞানের নির্মাণ করবে কে?
আসাম পেরিয়ে আমরা চলেছি মেঘালয়ের পথে। এই সুন্দর নামটি রেখেছিলেন ভারতের স্বনামধন্য ভূগোলবিদ শিবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বা এস. পি. চ্যাটার্জী। আজও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পাঠদান শুরু হয় এস. পি. চ্যাটার্জী মেমোরিয়াল হলে। আমাদের দীক্ষাও সেখানে শুরু হয়েছিল।
এক ভূতাত্ত্বিক যুগে মেঘালয় মালভূমি, স্রষ্টার অধৈর্য মাথা নাড়ায়, ছোটোনাগপুর মালভূমি থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে তার বিবর্তন হয়েছে ছোটোনাগপুর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জলবায়ু ক্ষেত্রে। তাই আজ তার স্বাভাবিক উদ্ভিদ ও বাস্তুতন্ত্র উৎস থেকে একেবারেই আলাদা। এসব কথা বইয়ে তো কতবারই পড়েছি। কিন্তু বই এ পড়া আর সচক্ষে দেখে অনুভব করা, দুটো তো আর এক নয়। কুয়াশা ঘেরা পাহাড়ি পথে বাস চলেছে, তার বাঁদিকে খাদ। আমি বসে আছি ডানদিকের জানলায়। আমার দিকে পাহাড়ি ঢালে কখনো পাইনের বন, কখনো পাহাড়ি ফার্নের পুরু আচ্ছাদন। পূর্ব হিমালয় দেখা অভ্যস্ত চোখে ধাঁধা লাগে, বুঝি হিমালয়েই আছি। কিন্তু বাঁদিকে তাকালে ধন্ধ কেটে যায়, কারণ খাদের উপত্যকা পেরিয়ে ওপাশের শৈলশিরায় চোখ পড়ে। তা হিমালয়ের মতো শঙ্কুসদৃশ ভঙ্গিল নয়, বরঞ্চ গিরি শীর্ষগুলি সমতল। অর্থাৎ এই পাহাড়ি অঞ্চল কোনো ভঙ্গিল পর্বতের অংশ নয়, বরং ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমির খণ্ড। কিন্তু কি অদ্ভুত। আগ্নেয় পাথরের মালভূমি গায়ে সবুজ মেখলা পরে চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়। বেরিয়েছি সকাল আটটায়, প্রাতরাশ করে। একটানা যাত্রায় একঘেয়েমি আসে। ঘাড়, কোমর ব্যথা করে। কিন্তু প্রকৃতির অসামান্য রূপ সব বেদনাকে ভুলিয়ে দেয়।