বর্তমান বাংলাদেশ সরকার এই ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই ইতিহাস আমরা যেন ভুলে না যাই!বাংলাদেশের কুলদা রায় বর্তমানে আমেরিকায় আছেন। তাঁর লেখায় ফুটে উঠল একাত্তরের রক্তাক্ত স্মৃতি। পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকারদের ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্ত লেগে আছে!
এঁদের কথা ভুলবো না, ভুলতে দেবোনা!
----------------------------------------------------------
তাঁর নাম ছিল ভোলানাথ বসু। ছিলেন অতি দরিদ্র। ব্যবসা করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। রাজনীতি করতেন না। বাগেরহাট শহরে বাসা। ঘরে বুড়ি মা। স্ত্রী। সন্তান। মানসিক রোগাক্রান্ত ভাই। একজন নেপালি লোক। আর পথ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া কয়েকটি কুকুর। এই তাঁর সংসার। তাঁর মেয়ে ঝর্না বসু হালদার লিখেছেন--
'২ জ্যৈষ্ঠ, ১৭ মে সোমবার, ১৯৭১। ভোরের আকাশ লাল হওয়ার আগেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছি। একটা অস্থিরতায় ভুগছি সবাই। সকাল সাতটার দিকে মা স্নান করে রান্না বসিয়েছেন। বাবা নিচ থেকে উপরে এলেন। ঘরে অনেক কিছু দরকার, জগন্নাথকে বাজারে পাঠাবেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে বারো বছরের ভাই জগন্নাথের বাইরে বেরুনো কিছুটা নিরাপদ। ফর্দ আর টাকা নিয়ে জগন্নাথ বাজারে গেল। বাবা আবার নিচে নেমে গেলেন। খোলা বারান্দায় বসে রইলেন প্রহরীর মতো। আমি দোতলা থেকে নেমে সিড়ির দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এলাম।
কতোক্ষণ হবে জানি না, পনেরো মিনিট বা আধঘণ্টা। কান ফাটানো বন্দুকের আওয়াজ আর বাবার আর্তচীৎকার—“ভাই আমার একটা কথা'' ধ্বনিতে হতভম্ব হয়ে গেলাম। দোতলার জানালা দিয়ে উঠোনে তাকিয়ে দেখলাম উদ্যত রাইফেলধারী জল্লাদ বাহিনী উল্লসিত হয়ে ফিরে যাচ্ছে। উঠোনে সটান পড়ে আছেন দাদা। জল্লাদের কাছে বাবার প্রাণভিক্ষা চাইছিলেন। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মা।
না, পাকসেনারা সেদিন ক্যাম্প ছেড়ে তখনও বের হয়নি। বাসাবাটির স্বনামধন্য মাওলানা তার পুত্রকে মালাউন হত্যার সওয়াব নিতে অস্ত্রসহ নেতৃত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। সঙ্গে হত্যাকারী, অশিক্ষিত বর্বর লোভী ধর্মান্ধ একজন রাজমিস্ত্রি এনায়েত, ডাকনাম কুটি। বাসাবাটির প্রান্তসীমায় নাগেরবাজারের কাছাকাছি জায়গায় এদের বাড়ি। দৌড়ে নিচে এলাম। বারান্দায় পড়ে আছেন রক্তস্নাত বাবা, শান্ত, স্থির, খোলা চোখ। মুখের কাছে মুখ নিয়ে চিৎকার করে ডাকলাম—বাবা! চোখ দিয়ে ইশারা করে বললেন—ডাকিস না।
আমার মা একেবারে স্তব্ধ। কোনো অনুভূতি নেই, অভিব্যক্তি নেই। শিল্পীর আঁকা ছবি দেখেছি, সাবিত্রীর কোলে সত্যবানের মাথা। তেমনি শুধু বাবার মাথাটা তার কোলে। একটা হাতপাখা নেড়ে নেড়ে রক্তের গন্ধে ছুটে আসা মাছিগুলো তাড়িয়ে চলেছেন। বাবার সবটুকু রক্ত শরীরে মেখে নিয়েছে তার মা। আর মাটি। আর জনশূন্য এলাকায় সদ্য পিতৃহীন হতভাগ্যদের বেদনার্ত চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে। সঙ্গে সমানে আর্তনাদ করে চলেছে বাবার প্রিয় কুকুরের দল। পাশে বসে সমবেদনার হাত ধরার মতো একজনও কোথাও নেই।'
ভোলানাথ বসু নিজেকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন। কিন্তু তাঁকে হিন্দু হিসেবে মেরে ফেলা হয়েছিল।
এটা সত্যি। সত্যি ঘটেছিল। একাত্তরে। আমরা ভুলে গেছি। ভুলে যেতে ভালোবাসি আমরা। ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমাদেরকে সম্পূর্ণভাবে স্মৃতিহীন করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে চলেছে ইউনুস সরকার।