এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে ( তৃতীয় খন্ড ) - ৪১

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ২২ জুলাই ২০২৫ | ২১ বার পঠিত
  • ( ৪১ )

    আজ সরস্বতী পুজো। কিশোরী বালিকারা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে উজ্জ্বল গাঁদা ফুলের গুচ্ছের মতো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
    হেদুয়ার ওপর দিয়ে সারা দিনমান বসন্তের বাতাস বয়ে যাচ্ছে থেকে থেকে। অলস নিষ্কর্মা গুচ্চের লোক হেদোর বেঞ্চে বসে বসে হাওয়া খাচ্ছে আর ঠ্যাং দোলাচ্ছে। দুর্বারদের ঘর বন্ধ। ওরা কেউ নেই। মাঝখানে একটা সি এল নিলে শনি রবি নিয়ে চার দিন ছুটি হয়ে যাচ্ছে একটানা।
    রাত্রি সকাল আটটায় বেরিয়ে গেল। স্কুলে পুজো আছে। সাগর বাড়িতে রইল। ছেলে স্কুলে গেল সকাল নটা নাগাদ। স্কুলে পুজো হচ্ছে। সাগর ওকে এখন একাই যেতে দেয়। তাকে একটু পরে গিয়ে দোকান খুলতে হবে।
    সরস্বতী পুজোর দিনে উন্মন হাওয়া দোলে নীল আকাশের নীচে। মোড়ের মাথায় বাসন্তী রঙে ছোপানো জামা কাপড় পরে দুই নবীন কিশোর কিশোরী পরস্পরের দিকে হাসি হাসি চোখে একটা রম্য ভাল লাগা নিয়ে তাকিয়ে আছে। কোন কথা মনে হয় খুঁজে পাচ্ছে না। শুধু তাকিয়ে আছে। গানের ওই লাইনটার মতো, ক্ষণিকের মুঠি দেয় ভরিয়া আর কিছু নাহি জানে ....

    অমিতাভকে তীর্থমোহন সেন বললেন, ' দেখ, ঝড় একটা আসছে বলে মনে হয়। একটা ওলোটপালোট হবে বলে মনে হচ্ছে। সেটা ভালর জন্য হবে, না খারাপের জন্য হবে জানি না। সে যাক, ব্রাত্যয় তোমার কবিতাটা পড়লাম। বেশ ভাল। আমাদের বৈশাখ সংখ্যার জন্য একটা কবিতা দাও না। আজকাল ভাল কবিতা পাওয়া খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে। যে ছেলেগুলো এতদিন চুটিয়ে লিখছিল, তারা লেখা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে বলা যায় .... '
    --- ' তীর্থদা আমিও তো সেই দলেই পড়ি। নানা কারণে লেখালেখি আর চালাতে পারছি না। মোটিভেশনের কোন সোর্স নেই। যারা গদ্য লেখে তাদের কথা আলাদা। কবিতার বইয়ের বাজার নেই। আমাদের মতো যারা কাগজ করত সব বসে গেছে। সঠিক বিপণন ছাড়া সব প্রোডাক্ট অচল... ' অমিতাভ বলল।
    তীর্থ বরাট বললেন, ' কথাগুলো অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই। সমস্যা হল, অন্য সব জঁরের মতো কবিতার তো কমার্শিয়াল হবার কোন জায়গা নেই। তার ক্যাপটিভ সাবস্ক্রাইবার ইজ ভেরি স্মল। সে যাক, যে কদিন বেঁচে আছি বিয়ে করা বউয়ের মতো একে ছাড়তে পারব না। একে সঙ্গে নিয়েই মরতে হবে ... কবিতা একটা দিও কিন্তু ...একটা বিষ্ণু দে টাইপের কবিতা দাও না। ওই যে .... জনসমুদ্রে লেগেছে জোয়ার হৃদয়ে আমার চড়া ... '
    --- ' ও বাবা ... বিরাট দায়িত্ব চাপিয়ে দিলে। চেষ্টা করব ... '
    --- ' কর কর .... ছেড়ে দিও না ... বুঝলে ছেড়ে দিও না ... '
    --- ' হমম্ ... জনসমুদ্রে লেগেছে জোয়ার হৃদয়ে আমার চড়া ... সত্যিই চড়া পড়েছে ', অমিতাভ ভাবল।

    ভাবল কাবেরীর সঙ্গে একবার দেখা হলে ভাল হত। হৃদয়ের চড়া অংশ প্লাবিত হলেও হতে পারত সাময়িকভাবে। অমিতাভ ভাবল, কাবেরী কি একইরকম আছে ? অনর্গল অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে যাওয়া। কারো কোন পরোয়া নেই। বিয়ের আগেও যা পরেও তাই। হৃদয়ে কখনো চড়া পড়তে দেবে না। তারপর ভাবল, কি সব আবোলতাবোল ভাবছে। সামাজিক চেতনার মগ্নতাকে কাবেরীসুলভ উচ্ছলতায় এনে ফেলল সে। কি বোকা বোকা।
    কবিতার ক'টা শব্দ কোথা থেকে যেন এসে গেল মাথায়।
    গীতালি মধু মাস রোদ্দুর
    যে যার কুঠুরিতে খুঁজি সুখ
    খাতায় কাটাকুটি অঙ্ক
    দেখি হাঁটি হাঁটি যেতে পারি কদ্দুর।

    ভাবছি না একটুও ঘুমিয়ে বা জেগে
    কত আছে ভরা প্রাণ দু:সহ মাপে
    ফুসফুস ফেটে যায় কি বিষ বায়ুচাপে !
    সেই দিন— দিন রাত হল পার
    সুড়ঙ্গে শুধু ভয় আঁধারের কম্বল
    মানুষ একদল ধোঁয়া ধোঁয়া,
    মৃত্যুর সাথে লড়ে পাঞ্জা,
    প্রতি পল বারবার
    নোটবুকে যদিও লেখা নেই মন্ত্র
    হারবার।

    পরের লাইনগুলো রাত্তিরে সাজাতে হবে, অমিতাভ ভেবে রাখল।

    ভোটের দিন ঠিক হয়েছে জুন মাসে। সি পি এম-এর পার্টির জনতা পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত ভেস্তে গেল নানা গাঁয়ের আটকে গিয়ে। সি পি এম, আর এস পি, ফরওয়ার্ড ব্লক, সি পি আই এবং আরও দু একটা ছোট পার্টিকে নিয়ে একটা জোট করল ভোটে লড়ার জন্য। এরা ঠিক করল নিজেরাই লড়বে দু'শ চুরানব্বই আসনে, কারো সঙ্গে কোন আসন সমঝোতা না করে। ক্ষমতায় না আসা যাক নিজেদের সাধ্যমতো লড়াই তারা দেবে। জনতা পার্টির সঙ্গে গাঁটছড়া খুলে যাওয়ায় অনেকের মুখে মুচকি হাসি দেখা দিল। মনোরঞ্জন মজুমদার কিন্তু মুচকি হাসল না। সে সাগরের দোকানে বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে উদাস ভঙ্গীতে সিগারেট টানতে টানতে বলল, ' লেফট ফ্রন্ট দু'শ কুড়ি ওপর সিট পাবে, মিলিয়ে নিস। কিচ্ছু করার নেই ... '
    --- ' আচ্ছা ! একা লড়ে ? '
    --- ' হ্যাঁ তাই। দেখতে পাবি। জমানা বদলে গেছে ... '
    --- ' এটা কি ইন্দিরা গান্ধীর ইমার্জেন্সি লাগানোর প্রতিক্রিয়া ? '
    --- ' আমার তা মনে হয় না। এটা পুরোপুরি প্রদেশ কংগ্রেসের ভাঙাচোরা সংগঠনের এফেক্ট হতে চলেছে ... ' মোনাবাবু টুসকি মেরে সিগারেটটা ফেলে দিলেন সামনের ল্যাম্পপোস্টের গোড়ায়।
    সাগর নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে বলল, ' ও ... তা হবে ... '

    সাবিত্রী সেদিন স্কুলের টিফিনের সময়ে বলল, ' ছেলেগুলোকে আর দেখা যায় না জান। দুনিয়াটা হল শক্তের ভক্ত ... '
    --- ' হ্যাঁ ... সে তো একশবার ... ' রাত্রি একমত হয়।
    --- ' হ্যাঁরে, দাদা কেমন আছে ? ইলেকশান এগিয়ে আসছে ... '
    --- ' ওসব নিয়ে তো ও মাথা ঘামায় না। আসলে ও হল নিখিল ব্যানার্জী স্যারের খাঁটি শিষ্য। এই সিস্টেমেই বিশ্বাস করে না। যেই ক্ষমতায় আসুক সে তো এই সিস্টেমেরই ইন্টিগ্র্যাল পার্ট হবে। অস্তিত্ব বজায় রাখতে এই কাঠামোরই দাসত্ব করতে হবে ... '
    সাবিত্রী রাত্রির মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।
    বলল, ' ও বাবা, এত ভারি ভারি কথা আমার মাথায় ঢোকে না। ভোট দিতে যেতে হয় তাই যাই। বিশেষ বুঝি টুঝি না কিছু ... '
    --- ' সেটাই তো আসল সমস্যা। এরকম ফ্লোটিং ভোটই তো ডিসাইসিভ হয়ে যায় ... ' রাত্রি মৃদুস্বরে বলল।
    সাবিত্রী বলল, ' কি বললে ? '
    --- ' না, কিছু না ... '

    ইন্দ্রাণীর মন বেশ খুশি খুশি। এ মাসে শরীর খারাপের ডেট পেরিয়ে গেছে। ডাক্তারবাবু বলেছে ইউরিন করাতে।
    ডাক্তারকে ইউরিন রিপোর্ট দেখিয়ে বিবেকানন্দ রোড থেকে রিক্শা করে বাড়ি ফিরছে মাণিকলাল আর ইন্দ্রাণী।
    ইন্দ্রাণী বলল, ' আজ দিনটা সব দিক দিয়েই ভাল গেল, বল ... মা শুনলে খুব খুশি হবে ... '
    --- ' হ্যাঁ, তা বটে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেল ... '
    --- ' আরে ওই দেখ, সাগর যাচ্ছে .... এই সাগর, এই সাগর ... '
    সাগর অনেকটা দূর দিয়ে যাচ্ছিল। রাস্তায় গাড়ির প্রচুর আওয়াজ। সাগর মনে হয় ইন্দ্রাণীর গলা শুনতে পেল না। সে বিবেকানন্দর মোড় পার হয়ে সোজা চালতাবাগানের দিকে চলে গেল।
    মানিকবাবু বললেন, ' শুনতে পাচ্ছে না বোধহয় ... ছেড়ে দাও এখন ... পরে হবে ... '
    ইন্দ্রাণী হাত ঝাঁকিয়ে বলল, ' ধ্যাত্তেরিকার ! সাগরটা একটা যাচ্ছেতাই ... '

    ***** *****

    চার মাস বাদে মোনা মজুমদারের কথা ফলে গেল। বামেরা পেল দু'শ একত্রিশটা সিট। জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন একুশে জুন। একটা নতুন শাঁখে ফুঁ পড়ে যেন এক নতুন স্বরতরঙ্গ বাংলার চারদিকে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। এক নতুন যুগ সন্ধিক্ষণে এ শঙ্খধ্বনি মঙ্গলময় অনুরণন হয়ে জেগে থাকে কিনা তা মহাকালই জানে।

    ( আগামী পর্বে সমাপ্য)

    **********
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন