এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে ( তৃতীয় খন্ড ) - ১৭

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৮ এপ্রিল ২০২৫ | ৪৪ বার পঠিত
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭
    ( ১৭ )

    ঝুলন দেখতে কিন্তু যাওয়া হল না। সেদিন বিকেলবেলায় তুমুল বৃষ্টিতে ভাসিয়ে দিল অনেকের অনেক কিছু। ইন্দ্রাণীর ইচ্ছা এবং জেদটাও জলের তোড়ে ভেসে গেল। সাগর ভাবল, বাঁচা গেল।
    সাগর সেদিন আর বাড়ি থেকে বেরোয়নি। তার পরের দিন সকালে বাজারে বেরোচ্ছিল সাগর। মায়ের জ্বরটা ছেড়েছে মনে হচ্ছে। আর জ্বর না এলে কাল ভাত খাবে মনে হয়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে ঘুরতেই দেখতে পেল ইন্দ্রাণী একটা চাকতি লাটিম সূতোয় ওপর নীচ করছে খুব মন দিয়ে। সাগরকে দেখে বলল, ' ইশশ্ ... কাল যাওয়া হল না ... আর একদিন যাব বুঝলি তো ... '
    ---- ' কোথায় যাবি ? মেলা তো আজকেই শেষ ... '
    ---- ' অন্য কোথাও যাব তা'লে ... '
    স্পষ্টাস্পষ্টি বলে রাখল ইন্দ্রাণী, ' শুধু তুই আর আমি ... আর কেউ না, বুঝলি তো ... '
    ---- ' হুঁ হুঁ ... এখন বাজারে যাচ্ছি ... '
    বাজারেই যাচ্ছিল সাগর, কিন্তু যেতে একটু দেরি হয়ে গেল। ওখান দিয়ে মোটামুটি সাগরের বয়সী দুটো ছেলে যাচ্ছিল। বেশ গাট্টাগোট্টা চেহারা। ধুতি আর শার্ট পরা। সিগারেট খেতে খেতে যাচ্ছিল। ওখান দিয়ে যেতে যেতে একজন ছুঁড়ে দিল, ' আমরা তো আছি ... যেখানে বলবে সেখানে যাব ... '
    কথাগুলো সাগরের মাথায় গিয়ে আচমকা ধাক্কা মারল।
    ছেলে দুটো বেরিয়ে যাচ্ছিল। সাগর কখনও যা করেনি তাই করল। সে বলে উঠল, ' এই শোন শোন ... '
    ছেলেদুটো থেমে গেল এবং ঘুরে দাঁড়াল।
    সাগর একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, ' কি বললি ... আর একবার বল ... '
    ছেলে দুটোর চোখমুখ ক্রূর এবং দুর্বিনীত।
    একজন বলল, ' কেন, কি বললাম শুনতে পাসনি নাকি ? হিরো হবার শখ হয়েছে ? হিরোয়িনটা কিন্তু খাসা ... মওকা পেয়েছিস যখন চালিয়ে যা ... '
    এরপর যেটা ঘটল, সাগরের আজকের এই সাগর মন্ডল হয়ে ওঠার সূচনা বা সূত্রপাত হল বোধহয় তখন থেকেই।
    সাগরের বিখ্যাত বাঁ হাতের একটা প্রচন্ড ঘুসি এসে পড়ল ছেলেটার মুখে। সাত আট হাত দূরে ছিটকে পড়ল ছেলেটা। আর একটা ছেলে বেশ হকচকিয়ে গিয়ে কোনরকমে তার আহত সঙ্গীকে তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি সরে গেল সেখান থেকে।
    দুটো ব্যাপারে সাগর বেশ অবাক হয়ে গেল। প্রথমত অবাক হল তার নিজের ঘুসির ওজন দেখে। এটা সে এই প্রথম জানল। আর দ্বিতীয়ত, সে ঠিক বুঝতে পারছে না কি কারণে সে আচমকা বিস্ফোরিত হল এভাবে।
    বাজারের থলেটা তার হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল। সেটা তুলে নিয়ে বাজারে যাবার জন্য পা বাড়াতে গিয়ে ইন্দ্রাণীর দিকে চোখ পড়ে গেল। দেখল, মুখরা ইন্দ্রাণী নির্বাক হয়ে নির্নিমেষে তাকিয়ে আছে তার দিকে রিং লাট্টুটা হাতের মুঠোয় ধরে।
    সাগর বলল, ' ইয়ে ... দেরি হয়ে গেল ... যাই বাজারে যাই ... '
    ইন্দ্রাণী কোন উত্তর দিল না। শুধু এক অদ্ভুত চোখে নির্নিমেষে তাকিয়ে রইল সাগরের দিকে।
    এরপর থেকে ইন্দ্রাণী কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল। যখন তখন রেগে যাওয়ার ব্যাপারটাও উধাও হয়ে গেছে। কথাবার্তাও তেমন বলতে শোনা যাচ্ছে না। আর কেউ এসব নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাচ্ছে না। মাথা ঘামাবার কথাও নয়। তারা গল্পের বই টই কাড়াকাড়ি করা এবং নিজেদের মধ্যে গুলতুনি করতে ব্যস্ত। তবে সাগর ইন্দ্রাণীর এই চুপচাপ থাকাটা খেয়াল করল। সে ভাবল ওর নিশ্চয়ই শরীর ভাল নেই।
    সেদিন সবাই চলে যাবার পর সাগর ইচ্ছে করে একটু থেকে গেল। ইন্দ্রাণী কি একটা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে।
    সাগর বলল, ' বাড়ি যাবি না ? '
    ---- ' হ্যাঁ ... যাচ্ছি ... '
    ---- ' তোর কি শরীর খারাপ ? '
    ---- ' হ্যাঁ '
    ---- ' কি হয়েছে ? '
    ---- ' ও আছে ... তুই বুঝবি না ... '
    ---- ' কাকাবাবুকে বল ... ওষুধ দিয়ে দেবে ... '
    ---- ' ওষুধ লাগবে না ... '
    ---- ' ও বুঝেছি ... এমনি সেরে যাবে ... ' সাগর আশ্বস্ত হয়।
    ---- ' কিছুই বুঝিসনি ... '
    ---- ' কেন ? '
    ---- ' বড় হ, তারপর বুঝবি ... '
    ---- ' কি যে বলিস ... আমি তোর চেয়ে অনেক বড় ... '
    ---- ' তাই বুঝি ? আরও বড় হ তালে ... নে চল দরজা বন্ধ করব ... '

    দরজা কিন্তু সত্যিই বন্ধ হয়ে গেল একদিন। সাগররা এ পাড়া ছেড়ে উল্টোডাঙায় চলে গেল একটা ছোটখাট বাড়ি করে। সাগরের মাঝেমাঝে এ পাড়ার কথা মনে হলেও নানা কাজে জড়িয়ে পড়ায় সুকিয়া স্ট্রিটে আর আসা হত না। প্রথম দিকে পুরনো পাড়ার জন্য একটা টান অনুভব করলেও পরের দিকে ইচ্ছেটা আবছা হয়ে আসতে লাগল। স্বপন, গোপাল, পঙ্কজদের মতো চোখের আড়ালে থাকতে থাকতে ইন্দ্রাণীও মনের আড়ালে চলে গেল। ঠিক আড়ালে চলে গেল বলা যায় না শ্রাবণের জলদ মেঘে ঢাকা পড়ল বলা যায়।

    যেদিন একটা ছোট লরিতে মালপত্র তুলে নিয়ে সাগররা সুকিয়া স্ট্রিট ছাড়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল ইন্দ্রাণীকে একবারও বাইরে আসতে দেখা গেল না। সাগর ভাবল ওর হয়ত আবার 'শরীর খারাপ' হয়েছে যেটা সে 'আরও বড়' হলে সে বুঝবে। যাক, আবার যখন দেখা হবে তখন নয় ভালভাবে জেনে নেবে সব কিছু।

    বেলা বারোটা নাগাদ এক রোদ্দুর ভরা দিনে মালপত্র এবং মানুষ ভরা সাগরদের গাড়ির চাকা গড়িয়ে গেল সুকিয়া স্ট্রিট ছেড়ে একটু একটু করে। সেই সময়ে তাদের বাড়ির বারান্দায় এসে দাঁড়াল ইন্দ্রাণী। কেন তা কে জানে, আজ সে স্কুলে যায়নি। ক্রমশ দূরে চলে যাওয়া সাগরদের গাড়িটার দিকে তার হাতের মুঠোয় ধরা রিং লাট্টুটা ছুঁড়ে মারল, তারপর একছুটে ঘরে ঢুকে গেল।

    খুব আশ্চর্যের ব্যাপার হলেও এটা ঘটনা যে এত বছর ধরে আর দেখা হয়নি দুজনের। এরকম দীর্ঘস্থায়ী বিচ্ছিন্নতা অতি বিরল ঘটনা সন্দেহ নেই কিন্তু নানা ঘটনা প্রবাহের ঝটকা একজনের থেকে আর একজনকে আলাদা করে রাখে বছরের পর বছর।

    এত বছর পর সাগর মন্ডল মাণিকলাল চ্যাটার্জির বৌভাতের নেমন্তন্ন খেতে এসে নতুন বউয়ের সিংহাসনে দেখা পেল সুকিয়া স্ট্রিটের ইন্দ্রাণীর।
    সাগর ভাবল, এ কি সত্যিই সেই ইন্দ্রাণী, না স্বপ্ন দেখছে সে।
    ---- ' আরে সাগরদা না ... '
    সাগর দেখল ইন্দ্রাণী তাকে 'সাগরদা' বলছে। এর পরে কি বলবে 'কেমন আছেন ' ?
    সাগর এখন ' শরীর খারাপ' -এর মানে শিখে গেছে। সে বলল, ' কেমন ... সব ভাল তো ? '
    ইন্দ্রাণী চুপচাপ তাকিয়ে থাকল সাগরের দিকে।
    তারপর বলল, ' ভালই তো ... খারাপ কি ? '
    ---- ' আচ্ছা ... পরে কথা হবে, এখন আসি ... '
    ইন্দ্রাণীর বলল, ' এস কিন্তু ... '
    সাগরের মনে পড়ে গেল, ' ইশশ্ ... ঝুলন দেখতে যাওয়া হল না .... আর একদিন যাব ... বুঝলি তো ... ', শ্রাবণের জলদ মেঘে ঢেকে থাকা ক'টা কথা।

    ( চলবে )

    ********
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন