এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে ( তৃতীয় খন্ড ) - ৩ 

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ২২ মার্চ ২০২৫ | ৬০ বার পঠিত
  • | | | | | | | | | ১০
    ( ৩ )

    লোকে বলে পৃথিবীটা গোল। চেনা জানা কারও সঙ্গে ঘুরে ফিরে ঠিক দেখা হয়ে যাবে কখনও না কখনও। যেমন অমলের সঙ্গে রাত্রির দেখা হয়ে গেল শ্যামবাজার ট্রামডিপোর সামনে, যেখানে তাদের শেষ সাক্ষাৎকার ঘটেছিল প্রায় দশ বছর আগে।
    রাত্রি বলল, ' আরে, কি খবর ? কতদিন পরে দেখা হল ... '
    --- ' তা ... প্রায় পাঁচ বছর হবে ... ' অমল সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল। রাত্রি লক্ষ করল অমলের চোখে মুখে বেশ বয়সের ছাপ পড়েছে। শরীরে মেদও জমেছে।
    কথাটা বলে অমল চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বোধহয় বলবার মতো কিছু কথা খুঁজছে। জীবনের কোন কোন বাঁকে দাঁড়িয়ে কথা খুঁজে পাওয়া মুশ্কিল হয়ে যায়।
    রাত্রি বলল, ' সঞ্চারীর কি খবর ? শুনেছি বিয়ে করেছে। যোগাযোগ তো রাখে না। ওর বর বোধহয় ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ... না ? '
    অমল দায়সারা ভঙ্গীতে বলল, ' হ্যাঁ ... ওই ... লাভ ম্যারেজ। বুধাদিত্য মুখার্জী, ইকনমিক্সের ... ইয়ে ... '
    বলে আবার চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল অমল। বোধহয় আবার কথা খুঁজতে লাগল। সরস সজল রোমান্টিক ছাঁদের অমলের এহেন ধরণ ধারণ দেখে রাত্রির বেশ খারাপই লাগতে লাগল।
    সে পরিস্থিতি মসৃন করার জন্য বলল, ' তোমার গীটারে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর বাজছে তো অমলদা ... '
    অমল বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না।
    বলল, ' নাঃ ... আর তেমন ... ব্যস্ত থাকি ... সময় পাই না ... ', বলে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।
    অমলের দিবারাত্র কিসের এত ব্যস্ততা সে ব্যাপারে রাত্রির কৌতূহল থাকলেও অমলকে কিছু জিজ্ঞাসা করল না।
    শুধু বলল, ' ও ... '
    দুজনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অমলের বোধহয় কিছু বলার নেই, মানে বলার ইচ্ছে নেই। ' কিছু বলব বলে এসেছিলেম ' -এর অমল আর এই অমল একই মানুষ ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে যেন বাধ্য হয়ে ভদ্রতার খাতিরে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। রাত্রি স্পষ্টই বুঝতে পারল সে বিশেষ কথাবার্তা বলার মুডে নেই। হয়ত সাংসারিক কোন ঝঞ্ঝাট বা চাপ তার মনে একটা অচলতা তৈরি করেছে।
    রাত্রি অমলকে বিব্রত করতে চাইল না।
    বলল, ' ঠিক আছে অমলদা ... আবার দেখা হবে। সঞ্চারীকে আমার কথা বলবেন। যাব একদিন সময় করে আপনাদের বাড়ি ... '
    অমল যান্ত্রিক ভঙ্গীতে ঘাড় নেড়ে বলল, ' আচ্ছা ...'

    বলে উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল। রাত্রি ভাবল, জীবনের অনেকটা পথ হাঁটা হয়ে গেছে। আরও কতটা বাকি কে জানে। সে মোড়ের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগল সাগরও কি বদলে গেল। এক এক সময়ে মনে হয় সে যেন ' সুখি গৃহকোণ শোভে গ্রামাফোন' মার্কা একটা মানুষ হয়ে যাচ্ছে। তার ভিতরের বারুদে কি জল পড়েছে ? গড়পড়তা কোন বাঙালিবাবুর সঙ্গে তাহলে তার তফাত কি রইল। তার চেনা সাগরের প্রখর ঢেউ কতদিন উঠতে দেখেনি সে। সাগরের ঢেউ হারিয়ে গেলে সে তো মরা নদী বা মজা পুকুর হয়ে যায় এক সময়ে। ভাবতেই রাত্রির মনে ম্লান বিষণ্ণতা নেমে এল। স্রোতহীন নদী বা মজা পুকুরের নির্বিকার ও নিস্তরঙ্গ শান্তি পাবার জন্য তো সে সাগর মন্ডলের মতো উদ্দাম তরঙ্গের আধারকে বেছে নেয়নি। সে চেয়েছিল সাগরের বাঁধভাঙা ঢেউ আছড়ে পড়া দেখবে সারা জীবন ধরে। তাতে ঝুঁকি থাকে থাক। এবার এটাও ভাবে, ভাবের ঘরে চুরি করে তো লাভ নেই।

    সংসারের বাঁধনে বাঁধা পড়ার পর আর কি জীবনকে বাজি রাখা যায়। হয়ত বিবেকের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে রাখাই ভাল। রাত্রি ভাবল, আবার কবে আচমকা কোন ঝঞ্ঝা ঘনিয়ে আসে আর সাগরের ঢেউ ফুঁসে ওঠে কে জানে। একটা গভীর অনুভূতি সহসা জেগে উঠলেও বুকের ভেতরটা কেমন সিরসিরিয়ে কেঁপে উঠল।

    বিভূতিবাবুর বাড়ির একতলার ভাড়াটে চার জন আজকাল একত্রিত হলেই তুমুল তর্কাতর্কি করে।
    রাজনীতি নিয়ে তর্ক। আর পাঁচটা বাঙালীর মতো এরাও ঘরের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে তর্কের তুফান তোলে। তর্কবাগীশদের মধ্যে দক্ষিণপন্থী বামপন্থী ভাগাভাগি থাকলে তর্কের তাপ আরও চড়া থাকে। এদের মধ্যে দুর্বার কট্টর বামপন্থী এবং জ্যোতি বসুর অন্ধ ভক্ত। ওদিকে সুভাষ কংগ্রেসী কৃষ্টিতে আস্থাশীল। বিনয় আর অতীশ কখন কোন দলের হয়ে কথা বলে বলা মুশ্কিল।
    সুভাষ বোসকে কম্যুনিস্টরা কবে যেন কুইসলিং এবং তোজোর কুকুর বলেছিল সেই নিয়ে দুজনের উচ্চৈস্বর বাদবিতন্ডা শুরু হল। দুর্বার ক্রমাগত ভারত ভাগ এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংক্রান্ত ব্যাপারে গান্ধী এবং নেহেরুর বিরুদ্ধে তার স্টকের ট্রেডমার্ক মিশাইলগুলো নিক্ষেপ করতে লাগল। বিনয় খানিকটা ফ্লোটিং ভোটারের স্টাইলে কখনও কখনও এর পক্ষে কখনও ওর পক্ষে ধুনো দিতে লাগল। ঘুমকাতুরে অতীশ তাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে মাঝে মাঝে জায়গা বুঝে বলতে লাগল, তা ঠিক ... তা ঠিক। তার মতে, কোন পক্ষ ঠিক তা বোঝা মুশ্কিল এবং সেটা কেউ বোঝার চেষ্টাও করে না।

    সে যাই হোক দীর্ঘস্থায়ী তর্কাতর্কির উচ্চ নিনাদ যখন লেলিনের পাশ কাটিয়ে স্ট্যালিনে এবং এদিকে জহরলাল পেরিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর ' ইমারজেন্সি' - তে নিয়ে এসে কাটাছেঁড়া শুরু হয়েছে এমন সময় ঘরের দরজায় হঠাৎ একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল। হাসি হাসি মুখে বলল, ' আসব ? '
    নিমেষে কথা কাটাকাটির শোরগোল থেমে গেল। বিষয়টা দুর্বারের কাছে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থা আরোপের চেয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ মনে হল। সে ব্যস্ত ভঙ্গীতে বলল, ' আরে ... এস এস ... '
    সুভাষ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে।

    মেয়েটার নাম মধুমিতা।

    ( চলবে )
    ********************************************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | | | | ১০
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন