এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে ( তৃতীয় খন্ড ) - ৩৪ 

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৭ জুন ২০২৫ | ৭৫ বার পঠিত
  • ( ৩৪ )

    সুমনা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ভদ্রলোকের দিকে। পরিচিত মানুষ ছাড়া একজন মহিলার দিকে কেউ এভাবে তাকিয়ে থাকে না। ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা অস্পষ্ট স্মৃতি, আবছা মুখের রেখা আঁকা হতে হতে আবার মুছে যেতে লাগল। মনে হচ্ছে একে কোথাও দেখেছে, কিন্তু তেমনভাবে দেখেনি। কেমন যেন চেনা মানুষ মনে হচ্ছে, কিন্তু ঠিক ধরা যাচ্ছে না স্পষ্ট।
    প্রায় আধ মিনিটের বিভ্রান্তির অবশেষে নিরসন হল। ভদ্রলোক একাই ছিলেন। তিনি মৃদু পায়ে সুমনার দিকে এগিয়ে এলেন। সুমনার সামনাসামনি এসে দাঁড়ালেন সঙ্কোচজড়িত ভঙ্গীতে।
    ভদ্রলোক বললেন, ' আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না, না ? সেটাই স্বাভাবিক ... অনেকদিন হয়ে গেল তো। আমি আপনাকে মনে রাখলেও, আপনারও আমাকে মনে থাকবে এটা তো আশা করা যায় না ... '
    সুমনা বেশ বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে গেল। সে সলজ্জভাবে বলল, ' যদি একটু ধরিয়ে দিতেন... আমি ঠিক প্লেস করতে পারছি না ... মানে, কিছু মনে করবেন না ... '
    ---' না না, মনে করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। আপনার একেবারেই কোন দোষ নেই কারণ আপনি আমাকে ভালভাবে দেখেনইনি ... '
    --- ' ঠিক বুঝতে পারলাম না ... '
    --- ' আমার নাম শঙ্খ। বিয়ের সম্বন্ধের ব্যাপারে আপনার দিদিকে দেখতে গিয়েছিলাম আপনাদের বাড়ি। ওখানে আপনাকে দেখি ... তারপর কি হয়েছিল মনে হয় আপনি সবই জানেন ... '
    সুমনার মন থেকে বিস্মৃতির ধোঁয়াশা এক লহমায় সরে গেল।
    আচমকা এরকম সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এক সাক্ষাতের মুখোমুখি হয়ে সুমনা রীতিমতো কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। সে ভেবে পাচ্ছিল না তার ঠিক কি ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখান উচিত। যদিও এখন সে আর সেই অল্প বয়সের মেয়ে নেই। এখন সে এক সংসারী গৃহিনী। ও সব বহু বছর আগের ঘটনা। জীবনের এরকম কত টুকরো টাকরা অংশ অনবরত কালস্রোতে ভেসে যাচ্ছে যেগুলোর বেশির ভাগের গায়েই আজ গুরুত্বহীনতার মরচে পড়ে গেছে।
    সুমনার মনে হল, শঙ্খবাবুর মনে হয়ত সুমনার স্মৃতিটা ডুবে যাওয়া জাহাজের মাস্তুলের মতো আজও বিস্মৃতির তরঙ্গের ওপর অটুট জেগে আছে।
    সুমনা মুখে ভদ্রতাসূচক হাসি ফুটিয়ে বলল, ' হ্যাঁ ... বুঝতে পেরেছি ... ভাল আছেন ? '
    ভদ্রলোক অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বললেন, ' হ্যাঁ। আপনি ভাল আছেন ? '
    --- ' হ্যাঁ ... আছি একরকম ... ' সুমনা সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল। তারপর বলল, ' এখানে কোথায় ? '
    --- ' এখানে এক রিলেটিভের বাড়ি এসেছিলাম। ওই যে ওখানে ... ওর সঙ্গেই এই দোকানে এসেছি। এখানে আপনার দেখা পেয়ে যাব আশা করিনি ... '
    সুমনা বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না।
    সৌজন্যতার হাসি হেসে বলল, ' সে..ই ... কখন যে কার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ... '
    শঙ্খ বলল, ' আপনার মা বাবা ভাল আছেন ? '
    --- ' না ... মা রিসেন্টলি মারা গেছেন। বাবাও এখন একটু উইক হয়ে পড়েছে ... '
    --- ' ও আচ্ছা ... ভেরি স্যাড ... কি বলব আর ... সবই মেনে নিতে হয়, সবই মেনে নিতে হয় ... ওনাদের কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। অথচ ক'দিনই বা দেখা হয়েছে ? বড়জোর দুদিন। একদিন তো আপনার দিদিকে দেখতে গিয়ে, আর একদিন আমি গিয়েছিলাম ... ওই যে ... আপনার বাবার সঙ্গে কথা হয়েছিল ... আপনার ওসব মনে নেই নিশ্চয়ই। মনে না থাকাই স্বাভাবিক ... '
    --- ' হ্যাঁ ...পরে শুনেছিলাম বোধহয় ... '
    শঙ্খবাবু এবার বললেন, ' ঠিক আছে, আপনাকে আর ডিসটার্ব করব না। ওই যে ... কৌশিকের বোধহয় হয়ে গেছে ... আমি যাই ... ভাল থাকবেন ... '
    সুমনা বলল, ' আপনিও ভাল থাকবেন। একদিন আসুন না ... বাবার সঙ্গে দেখা করে যাবেন ... '
    --- ' আ... চ্ছা, দেখি ... ইচ্ছে রইল ... আসলাম ... '
    শঙ্খ ওদিকে চলে গেল। সুমনা গেল কাউন্টারে জিনিসের দাম মেটাতে। আশ্চর্যের ব্যাপার কেউই কাউকে তাদের বৈবাহিক অবস্থার ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করল না। নানা চিহ্ন দেখে শঙ্খ নিশ্চয়ই সুমনাকে দেখে বুঝতে পেরেছে সে বিবাহিতা। কিন্তু সুমনার কিছু জানা হল না সে ব্যাপারে। সুমনা দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তার ওপারে গিয়ে দাঁড়াল ট্রাম ধরার জন্য। ভাবল, ওসব জেনেই বা তার হবেটা কি। অর্থহীন ব্যাপার। সে দুম করে বলে বসল, এখন বাড়িতে এসে হাজির না হলেই বাঁচা যায়। এরকম না বললেই হত।

    অশোক পাল শিয়ালদহ স্টেশনে গিয়েছিল সস্তায় একটা খাট কেনার জন্য। শীতকাল আসছে, মেঝেতে শোয়া কষ্টকর হবে। খাটের দাম অনেক দরাদরি করার পর একটা কিছু স্থির হল। খাটের অংশগুলো বাড়িতে নিয়ে গিয়ে জোড়া লাগাতে হবে। সেটা সাগরের কোন লোকের সাহায্য নিয়ে করে নেওয়া যাবে বলে ভেবে রাখলেন অশোক পাল। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেল খাটের অংশগুলো বাড়িতে পৌঁছে দেবার খরচ নিয়ে। দোকানদার বলল, একশ টাকা লাগবে, এর এক পয়সা কমে হবে না। অনেকটা রাস্তা ... '
    --- ' আরে দাদা ... কোথায় অনেকটা রাস্তা, এই তো মানিকতলা পার হইয়া এই এট্টুখানি গেলেই... ' --- ' ওটা কি কম হল নাকি। আমাদের একটাই লোক। এর কমে হবে না ... দেখুন কি করবেন। ঠিক করুন ... জানিয়ে যাবেন দু একদিনের মধ্যে ... বেশি দেরি করবেন না কিন্তু ... মাল পড়ে থাকবে না, বিক্রী হয়ে যাবে ... '
    --- ' হ, বুঝসি বুঝসি ... দুই এক দিনের মইদ্যেই আসুম। দরকার তো আমারই ... বোঝলেন কিনা ... আসসা, আসি এখন খাটটা রেইখেন কিন্তু ... '
    দোকানদার কোন উত্তর দিল না। নিজের কাজে মন দিল।

    অশোককৃষ্ণ আনমনে নানা চিন্তা করতে করতে শিয়ালদহ স্টেশনের উল্টোদিকে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসল। বেশ চালু দোকান মনে হচ্ছে। অনেকেই দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চে বসে চা খাচ্ছে তারিয়ে তারিয়ে। দু একজন দাঁড়িয়েও খাচ্ছে। বেশির ভাগই খুব সম্ভবত শিয়ালদা স্টেশনে নামা লোকাল ট্রেনের প্যাসেঞ্জার। এখানে বসে একটু গলা ভিজিয়ে নিচ্ছে গন্তব্যে যাওয়ার আগে।
    একটা ছেলে এসে অশোক পালকে চায়ের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে গেল।
    পালবাবু বললেন, ' এই যে শুন শুন ... একখান নোনতা বিস্কুট দিও ... '
    পালবাবুর পাশে এসে বসল একজন বছর পঁয়তাল্লিশের লোক। ময়লা জামা প্যান্ট পরা। কাঁধে বাস কন্ডাকটরদের ব্যাগ। জামার ওপরের তিনটে বোতাম খোলা। চায়ের গ্লাসটা হাতে নিয়ে মাথা নীচু করে কি ভাবছিল। নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ' সকালবেলাই সত্তর টাকা ঝাড় হয়ে গেল ... শালা হারামি ... '
    বলে গ্লাসে একটা ছোট চুমুক দিয়ে আবার কি চিন্তা করতে লাগল।
    আবার কি বিড়বিড় করতে লাগল। অনেকের স্বভাব থাকে এরকম নিজের মনের কথা বিড়বিড় করে বাইরে বলতে থাকা।
    অশোক পালের কানে এল, ' ফালতু কেস দিয়ে দিয়ে চাকায় কাঁটা পরিয়ে দিল। মালিক বহুত ঘাওড়া ... কি বলে আবার ... কপালটাই খারাপ ...'
    অশোক পাল বুঝতে পারল লোকটা প্রাইভেট বাসের কন্ডাকটার। কোন কারণে এখানেই কাছাকাছি কোথাও পুলিশের কেস খেয়েছে। গাড়ি মনে হয় রাস্তায় সাইড হয়ে গেছে। এখন লালবাজারে গিয়ে গাড়ি ছাড়াও।
    লোকটা এবার চুপ করে চা খেতে লাগল একদিকে তাকিয়ে থেকে।
    হঠাৎ নিজের কাঁধে হাত বুলিয়ে বলল, ' কাঁধের ব্যথাটা কিছুতেই কমছে না শালা ... কম পয়সা তো গেল না ডাক্তারের পিছনে ... বউটাও হয়েছে তেমনি খয়রানি ... '
    বকবক করেই যেতে লাগল নিজের সঙ্গে নিজে। অশোককৃষ্ণ ভাবলেন, বোধহয় সাংসারিক নানা ঘোটালায় পড়ে লোকটার মাথার স্ক্রু ঢিলে হয়ে গেছে।
    পালবাবু লোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ' দাদার কোন রুটের বাস ? '
    --- ' অ্যাঁ, কি ? ও ... সেভেন্টি এইট রুটের ...
    --- ' ও আচ্ছা ... ব্যারাকপুর থেকে বাবুঘাট ? '
    --- ' হ্যাঁ হ্যাঁ ... বহুত ঝামেলা ... '
    কিসের ঝামেলা ঠিক বোঝা গেল না। বোধহয় ট্রাফিক পুলিশের ঝামেলার কথা বলছে।
    পালবাবু প্রায় সব জায়গায় প্রযোজ্য এরকম একটা কথা বললেন, ' হ্যাঁ ... তা আর কইতে লাগে ... '
    পালবাবু চায়ের গ্লাসে আর একটা চুমুক দিলেন ধীরে সুস্থে। কন্ডাকটরের দিকে একটু ঘেঁসে এলেন। বললেন, ' কোথায় থাকা হয় আপনার ? এমনে কইত্যাসি আর কি ... '
    --- ' ওই ওদিকে ... ঘোলায়, চেনেন ? '
    --- ' হ্যাঁ, নাম শুনসি ... ব্যারাকপুরের ওদিকে বোধহয় ... '
    --- ' হ্যাঁ হ্যাঁ ... '
    --- ' যাওয়া হয়নি ওদিকে ... তেমন দরকার পড়ে না তো। দরকার পড়লে যাইতে হইব বই কি ... '
    --- ' সে..ই ... ওঃ ... ' বলে কন্ডাক্টর ভদ্রলোক যন্ত্রনাকাতর মুখে কাঁধে আর ঘাড়ে হাত বুলোলেন ... '
    অশোক পাল এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। তিনি চায়ের গ্লাসে শেষ চুমুকটা মেরে 'গেলাস'টা পাশে রেখে দিলেন।
    বললেন, ' শরীলে ব্যথা ব্যাদনা থাকলে কিসুই ভাল লাগে না ... হেইডা ঠিক কথা ... '
    একটুখানি থামেন তিনি। তারপর বললেন,
    ' আসসা ... আপনার এ ব্যথাটা কতদিনের মোটামুটি ... '
    --- ' ও সে অনেকদিনের ... কি বলব ... অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। এখন আর ক্ষমতা নেই অত খরচা করার ... '
    --- ' হ বুঝসি। কিসু যদি মনে না করেন আমি একটু চিষ্টা কইরা দেখুম ? '
    কন্ডাকটার ঘাড় ঘুরিয়ে পালবাবুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
    অশোক পাল বেঞ্চ থেকে উঠে কন্ডাক্টরের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সে পালবাবুর দিকে ঘুরে দেখবার চেষ্টা করতে পালবাবু বললেন, ' আপনে বসেন, আপনে বসেন ... কোন চিন্তা কইরেন না ... পাঁচ সাত মিনিটের ব্যাপার ... কোন অসুবিধা হইব না ...'
    কন্ডাকটর ভদ্রলোক কি ভেবে কে জানে স্থির হয়ে বসলেন।
    অশোককৃষ্ণ পাল মশায় তার দু কাঁধের ওপর দুহাতের চারটে করে আঙুলের ডগা চেপে ধরলেন স্নায়ুর বিশেষ কোন সন্ধিস্থলে। সেই সঙ্গে ঘাড় এবং কাঁধের সংযোগস্থলে দুটো বুড়ো আঙুল দিয়ে আলতো করে চাপ দিতে লাগলেন বারবার। এই প্রক্রিয়া মিনিট দু আড়াই চলার পরে কন্ডাকটর দাদার চোখ আবেশে বুজে আসল।

    অমল বিমল কমল এবং ইন্দ্রজিৎ ...

    বাদল সরকার নক্শাল আমলে অনেক নাটক তৈরি করেছেন। তবে শতাব্দী নামে তার নিজস্ব নাটকের গ্রুপটা তৈরি করেছেন এই হালে।
    শুধু হলের মধ্যে স্টেজে উঠে নাটক করতে হবে তার কোন মানে নেই। হলের মধ্যে বাঁধা স্টেজ ছাড়াও রাস্তাঘাটে, বাজারে, পার্কে যে কোন জায়গায় নাটক নামানো যেতে পারে। বিদেশে নাট্যশিল্পের এই ধরণ অনেকদিন আগেই চালু হয়েছে। কিছু কিছু লোক বলছে এটার নাম নাকি থার্ড থিয়েটার।
    এবং ইন্দ্রজিৎ ছাড়াও, বাদল সরকারের আরও চারটে নাটক পাগলা ঘোড়া,সার্কাস, মিছিল, বাকি ইতিহাস অভিনীত হবে একাডেমিতে। পাঁচদিনে পাঁচটা নাটক ছাড়াও ষষ্ঠদিনে অভিনীত হবে কবিকাহিনী।
    বিভূতিবাবু থার্ড থিয়েটার টিয়েটারের নামই শোনেননি। শোনার প্রয়োজনও বোধ করেন না।
    ব্রাত্য পত্রিকার অর্কপ্রভ মৈত্র কিন্তু তা না। তিনি বাদল সরকারের পরম গুণগ্রাহী। নাটকের লাইনের লোক না হলেও অর্কপ্রভ বাদলবাবুর ভাবশিষ্য। তিনি এই সুযোগে অ্যাকাডেমিতে বাদল সরকারের সঙ্গে পরিচয় করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন।
    সেদিন ঘটনাক্রমে অমিতাভ আর কাবেরী একসঙ্গে এল। দুজনের কোথায় একটা দেখা হয়ে হয়ে গিয়েছিল ঘটনাক্রমে। ব্যস, দুজনে মিলে হাজির হয়ে গেল ব্রাত্যর ঠেকে। অমিতাভ আজই তার কবিতাটা দেবে অর্কপ্রভর কাছে। আমন্ত্রিত কবি, খারিজ নিশ্চয়ই করতে পারবে না। চিঠিটাও তো আজকেই দেবে বলেছে।
    হ্যাঁ তা দিল। অমিতাভর ওখানে গিয়ে পৌঁছতেই, ' এই তো এসে গেছিস তোরা ... বস বস ... এই যে, তোর চিঠিটা নে ... কবিতা এনেছিস তো ... '
    অমিতাভ চিঠিটা নিয়ে তার বুক পকেটে রাখল। কোন লেখকের কাছে আমন্ত্রণপত্র অতি মূল্যবান বস্তু।
    --- ' এ হল কাবেরী, আমাদের নৈঋতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল ... ', বলে দুম করে বলে বসল, ' কাবেরী নিজেও খুব ভাল লেখে ... '
    কাবেরী কথাটা শুনে হাসবে কি কাঁদবে বুঝতে পারছে না।
    অর্কপ্রভ বলে উঠলেন, ' বা বা ... দারুন ব্যাপার, জানা রইল...ছাড়ছি না ওকে, লাগবে লাগবে ... এই শোন না ... চল, অ্যাকাডেমিতে চল। বাদল সরকারের নাটকের শো হবে ছদিন ধরে। বাদলবাবুর সঙ্গে আলাপ করে ব্রাত্যর জন্য একটা ইন্টারভিউয়ের ডেট নেবার টার্গেট আছে আমার ... দেখি কি হয় ... যাবি তো ? টিকিটের জন্য ভাবিস না। আমি অ্যারেঞ্জ করব ... '
    অমিতাভ বলল, ' থার্ড থিয়েটারের জন্য আর ক'টা লোক হবে ? টিকিট গেলেই পাবে ... '
    অর্কপ্রভ হাত নেড়ে নেড়ে বলল, ' না না জানিস না, রোজ হাউস ফুল হচ্ছে ... টিকিটের ডিম্যান্ড আছে। তাছাড়া অ্যাকাডেমিতে তো সিট কম ... রোজই হাউস ফুল ... '
    কাবেরী মনে মনে ভাবল, আঁতেল তো আর কিছু কম নেই কলকাতায় ...

    অর্কপ্রভ করিতকর্মা লোক। সে ফাঁকতালে বাদলবাবুর সঙ্গে দেখা করে একটা ইন্টারভিউয়ের ডেট ঠিক আদায় করল। সেদিন 'এবং ইন্দ্রজিৎ' -এর শো ছিল। লোক গিজগিজ করছে হলের বাইরেও। কাবেরী তো থার্ড থিয়েটারের জন্য এত লোক দেখে অবাক। শো-এর পর অর্কপ্রভ হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেলেন।
    কাবেরী বলল, ' উনি কোথায় গেলেন আবার ? এই তো ছিলেন ... '
    অমিতাভ বলল, ' আরে দূর ছাড় তো। আবার কোন মহারথী পাকড়াও করতে গেছেন হয়ত ... পোষায় না ... চল আমরা যাই ... প্ল্যানেটোরিয়ামের ওখানে গিয়ে বাস ধরি। তুই যে এখানে আমার সঙ্গে এসে এতক্ষণ কাটালি তোর বর কিছু মনে করবে না তো ? '
    ---' আরে ছাড় তো, আমি ওসব কেয়ার করি না। বিয়ে হয়েছে বলে কি কেনা বাঁদি হয়ে গেছি নাকি ? মনে করা নিয়ে পড়ে থাকলে কি আর আমার সঙ্গে ঘর করতে পারত। আমি ওসব পরোয়া করি না। দেখিস, আমাকে আবার ফেমিনিস্ট টেমিনিস্ট বলিস না। ওসব আঁতলামি আমার সহ্য হয় না। এলার্জি আছে দামড়া মেয়েগুলোর ওইসব ফরফরানিতে ... '
    অমিতাভ ভাবল, এ মেয়েটা যে ঠিক কোন মশলায় তৈরি আজও বুঝতে পারলাম না।
    বলল, ' নে চল এখন ... পরে তোর লেকচার শুনব ... '
    দুজনে হাঁটতে লাগল রবীন্দ্রসদনের সামনে দিয়ে প্ল্যানেটোরিয়ামের দিকে।
    যেতে যেতে কাবেরীকে জিজ্ঞাসা করল, ' এবং ইন্দ্রজিৎ কেমন লাগল ? '
    --- ' রাঁধুনির রান্নার হাত পাকা। কিন্তু কেমন যেন আলুনি আলুনি। তরকারিতে নুন কম হলে যেমন হয় ... '
    কাবেরীর সঙ্গে একমত না হয়েও অমিতাভ ভাবল, এরকম চাঁচাছোলা, সংক্ষিপ্ত, বেপরোয়া রিভিউ দেওয়া একমাত্র কাবেরীর পক্ষেই সম্ভব।

    ওদিকে শিয়ালদা স্টেশনের সামনে চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসা স্পন্ডাইলোসিস আক্রান্ত কন্ডাকটার দাদা যেন স্বপ্নের ঘোর ভেঙে বেরিয়ে এলেন। কাঁধ, ঘাড়, মাথা দুহাত নাড়িয়ে চাড়িয়ে এদিক ওদিক করে পরখ করে নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে অশোক পালের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
    ---' ইয়ে মানে, কিছু নেই দেখছি ! কত ... '
    অশোক পাল বরাভয় ভঙ্গীতে এক হাত তুলে বললেন, ' না না ... কিছু লাগবে না। শুধু আমার ঠিকানাটা রেখে দিন। যদি কখনও দরকার হয় ... '
    তিন চারজন লোক সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এল। একজন এক চিলতে কাগজ আর একটা ডটপেন বাগিয়ে ধরে বলল, ' হ্যাঁ হ্যাঁ ... বলুন তো বলুন তো দাদা ঠিকানাটা ... '

    ( চলবে )

    *********************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় প্রতিক্রিয়া দিন