এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে ( তৃতীয় খন্ড ) - ৩১

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৮ জুন ২০২৫ | ১০২ বার পঠিত
  • ( ৩১ )

    প্রায় পনের দিন পরে সাগর একবার দেখা করতে এল অলোকেন্দু মিত্রের সঙ্গে। অলোকেন্দুবাবু তার নিজের ঘরে সেই পুরনো আর্মচেয়ারটায় বসে বসেছিলেন হাতে দৈনিক স্টেটসম্যান কাগজটা ধরে। তার চোখ রয়েছে খবরের কাগজের পাতায়। কিন্তু কতটুকু পড়ছেন কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
    সাগর ঘরে ঢুকে মৃদুস্বরে বলল, ' স্যার ... '
    অলোকেন্দু চোখ তুলে তাকালেন।
    ----- ' আরে এস এস ... তোমার কথাই ভাবছিলাম ... '
    ----- ' কেমন আছেন স্যার ? '
    ----- ' কেমন আছি ? কি বলি বল তো ... এই আছি একরকম। জীবনটাই তো পাল্টে গেল যে ...
    শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। ব্লাড প্রেসার ফ্লাকচুয়েট করছে ... তোমার খবর কি ? তুমিও তো কত পাল্টে গেলে ... '
    ----- ' আমার ভিতরটা পাল্টায়নি স্যার। বাইরেটা তো পাল্টাতে বাধ্য। যুগ পাল্টে গেছে। সব কিছু বদলে গেছে ক'বছরে, আর সাগর মন্ডল বদলাবে না ? '
    ----- ' সেই তো ... মনটা ভাল লাগে না। দিনগুলি মোর সোনার খাঁচার রইল না ... বুঝলে। মেয়ে জামাইরা সব বাড়ি ফিরে গেল গত রবিবারে। বলতে পার আমি এখন একদম একা। পরাণ আর ডোমেস্টিক হেল্পরা ছাড়া কেউ নেই বাড়িতে ... '
    ----- ' তা না স্যার ... আমরা অনেকে আছি আপনার সঙ্গে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসবে আপনার খোঁজ নিতে ... আর আপনার ছোট মেয়ে তো কাছেই থাকে ... '
    বলে সাগর একটু থেমে ঘন কন্ঠে বলল, ' তবে আমরা কেউ তো আর মাসীমার অভাব পুরণ করতে পারব না। এসব ফাঁক তো ভরাট হয় না স্যার ... '
    অলোকেন্দুবাবু একটা গভীর শ্বাস ফেললেন। কোলের ওপর কাগজ ধরা হাত ফেলে উদাস চোখে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আকাশে আজ তেমন রোশনাই নেই। কেমন একটা ঘোলাটে ভাব। বাতাসও আছে ঝিম মেরে। বইছে না তেমন। ঘামে ভিজছে শরীর।
    অলোকেন্দু বললেন, ' কাল থেকে কোর্টে বেরব ভাবছি। অনেক মামলা জমে গেছে। পরপর ডেট পড়েছে। আমাদের কি আর বসে থাকলে চলে ? দেখি শরীর যদি পারমিট করে ... না পারলে রেকিউজ করব ভেবে রেখেছি। অন্য কেউ যদি নেয় ... '
    ----- ' দেখুন ... শরীর বুঝে কাজ করবেন। বাইরে বেরোলে অবশ্য মন ভাল থাকবে ... মনের চাপটা অনেক হাল্কা হয়ে যাবে ... '
    ----- ' তা ঠিক ... সুমনা আর প্রতিবিম্বকে বলেছি এখানে এসে কিছুদিন থাকবার জন্য। নাতির অবশ্য স্কুল আছে। তা এখান থেকেই স্কুল করবে ... অসুবিধে কি ? আমরা তো কত দূরে স্কুলে পড়তে যেতাম পায়ে হেঁটে। তখন কি আর স্কুল বাস ছিল নাকি ? আমার বাবা বলত, যে সয় সে রয় ... আমার বাবাও সয়েছে, মাও সয়েছে ... আমার দুটো ভাইই স্বার্থপর, বাবা মা মানুষ করল, তাদের ফেলে ফরেনে চলে গেল। সেখানে মেমসাহেব বিয়ে করল ... বাপ মায়ের সঙ্গে আর কি সম্পর্ক রইল ! লাভ কি হল ? ক'দিন আর কাটালি মেমসাহেব বৌয়ের সঙ্গে ... হ্যাঃ ... ধর্মের কল বাতাসে নড়ে ... কম কষ্ট দিয়েছে বাবা মাকে ... এখন বোঝ। সীতানাথ কাবাসি বড় ভাল লোক ছিল। হাইকোর্টের মুহুরি। বাবার কাছে আসত। বাবা তার সঙ্গে পরামর্শ করত। ম্যালেরিয়া হয়ে মারা গেল ... হ্যাঃ ... কপাল ... '
    অলোকেন্দু মিত্র আরও নানা কথা বলে যেতে লাগলেন অনর্গল।
    সাগর বুঝতে পারছে অলোকেন্দু স্যারের হাবভাবে অনেক পরিবর্তন এসেছে। একটা বলয়ে ঢুকে পড়েছেন। বোঝা যাচ্ছে তিনি ক্রমশ বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন অলোকেন্দু মিত্রের একনাগাড়ে এভাবে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে যাওয়া কিছুদিন আগেও চিন্তা করা যেত না।
    সাগর আর কি বলবে। সে চুপ করে বসে রইল। অলোকেন্দুবাবু জানলা দিয়ে পাঁশুটে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন।

    একতলার সুভাষ, দুর্বাররা মনে হচ্ছে বিভূতিবাবুর বাড়ি ছাড়ার কথা চিন্তাই করছে না। বিভূতিবাবু সব সময়ে অস্বস্তিতে থাকেন। কবে এরা নোটিস দেয়। সব জায়গায় ভাড়াটেরাই ভয়ে ভয়ে থাকে, বাড়িওয়ালা কবে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলে কিংবা ভাড়া বাড়াতে বলে। এখানে ব্যাপারটা উল্টো। ওদের মুখোমুখি হলেই বিভূতিবাবু ভাবেন এই বুঝি কিছু বলল।
    সেদিন সকালের দিকে গেটের মুখে অতীশ আর বিনয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
    ----- ' কি ব্যাপার ... এখানে দাঁড়িয়ে ? অফিস যাওনি ? '
    ----- ' আজ ইদের ছুটি আছে ... '
    ----- অ আচ্ছা ... কোথাও বেরচ্ছ নাকি ? '
    ----- ' হ্যাঁ, ওদিকে যাব একটু ... কাজ আছে ... '
    অতীশ কোনদিকে দেখাল ঠিক বোঝা গেল না।
    বিভূতিবাবুও কোন কৌতূহল প্রকাশ করলেন না।
    বললেন, ' অ আচ্ছা ... ঠিক আছে ... '
    বলে বিভূতিবাবু পা বাড়ালেন। ভাবলেন, যাক ... বাড়ি ছাড়ার কথা টথা কিছু বলেনি।
    এই সময়ে বিনয় বলল, ' বলছি যে আমরা যে এতদিন ধরে এখানে আছি, আপনার কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো মেসোমশাই ? এরকম পরিবেশ তো আর কোথাও পাওয়া মুশ্কিল ... '

    বিভূতিবাবুর ধড়ে যেন প্রাণ এল। মনের মেঘ গলে জল হয়ে গেল।
    বললেন, ' না না...এই দেখ, কি যে বলে... যতদিন খুশি থাক না...এ তো তোমাদেরই বাড়ি...আমি
    কে ?'
    অতীশ আর বিনয় দুজনই ল্যান্ডলর্ডের কাছ থেকে এরকম আন্তরিক আশ্বাস পেয়ে স্বস্তি পেল।
    বিনয় হাসি হাসি মুখে সবিনয়ে বলল, ' কি যে বলেন মেসোমশাই... আপনি আছেন বলেই তো আমরা আছি। এরকম ল্যান্ডলর্ড পেতে ভাগ্যের দরকার ... এটা আমরা সবাই বলি ... '
    অতীশ বলল, ' একদম একদম ... '

    এর মধ্যে একদিন মধুমিতা এসেছিল। তার বিয়ে হয়ে গেছে। বরকে নিয়েই এসেছিল মাসির বাড়ি।
    তখন দুর্বাররা অফিস থেকে ফেরেনি। রাত ন'টা নাগাদ বেরোবার সময় মধুমিতা ওদের ঘরে ঢুকে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গীতে ওদের সঙ্গে দেখা করে গেল।
    ----- ' এই... কেমন আছেন আপনারা ? এই এদিকে এস না একটু। এই যে ... এদের সঙ্গে শিমূলতলায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওঃ ফাটাফাটি ট্যুর হয়েছিল .... '
    মধুমিতা দেখা গেল আগের মতোই উচ্ছল আছে।
    পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবককে দেখিয়ে বলল, ' সম্বিত, আমার হাজব্যান্ড ... '
    সম্বিত হাত জোড় করে সৌজন্যমূলক ভঙ্গীতে মৃদু হাসল। আমেরিকায় যাওয়া সেই ছেলেটার সঙ্গে মধুমিতার যে কাট্টি হয়ে গেছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল।
    দুর্বার মধুমিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ' যাক এখন আর তা'লে ইউনিভার্সিটিতে ইউনিয়নের গন্ডগোলে রোজ রোজ ক্লাস বন্ধ হয়ে যাবার ঝঞ্ঝাট থাকল না ... মাসির বাড়ি চলে আসারও কোন গল্প নেই ... তাই তো ? হাঃ হাঃ ... '
    সুভাষ ভ্রু কুঁচকে বিরক্তির দৃষ্টিতে দুর্বারের দিকে তাকাল।
    মধুমিতা কি বুঝল বা কি ভাবল কে জানে সে হঠাৎ হো হো করে হেসে বলল, ' ওঃ ... দারুন বলেছেন ... আপনি কিন্তু একটুও বদলাননি, আগের মতোই আছেন ... '
    সম্বিত তাড়া দিল, ' এই চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা রাস্তা যেতে হবে ... সেই টালিগঞ্জ... '
    ----- ' হ্যাঁ চল চল ... এই আসলাম ... ভাল থাকবেন সবাই ... ' মধুমিতা বলল।
    দুর্বার ভাবল, সে আগের মতো থাকলে কি করে চলবে। নিজেকে বদলাতে না পারলে তার দায়ভার কি অন্য কেউ নেবে নাকি ? সারা দুনিয়া বদলে যাচ্ছে প্রতিদিন, আর সে কিনা ... হাস্যকর ...

    ( চলবে )

    ***********
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন