মাইলস্টোন ম্যাসাকার!
এ ছাড়া আর কিছুই মাথায় আসল না আমার। জাতি হিসেবে এই এক বছরে আমাদের অবস্থান যে গতিতে নিম্নমুখী তা যেন ত্বরিতগতি পেল এবার। সব কিছু অতিক্রম করে গেল এবার। গতকালের ঘটনা। যদিও এখন পুরো দুনিয়াই জেনে গেছে তবুও একটু আমি বলি। ঢাকা উত্তরায় মাইলস্টোন নামে একটা স্কুল এন্ড কলেজ আছে। আমার ভাইগ্না এখান থেকে এইচএসসি পাশ করেছিল। আমার ঢাকা জীবনের লম্বা সময় আমি এই স্কুলের পাশে কাটিয়েছি। তো এই স্কুলের একটা ক্যাম্পাসে এফ সেভেন নামের এক যুদ্ধ বিমান বিধ্বস্ত হয়। আমি খবরটা জানা মাত্র ঢাকায় আমার এক বন্ধুকে নক দেই। আমি জানি ও এই স্কুলের কাছেই থাকে। আমি ওর কাছে শুনলাম আরও ভয়াবহ খবর। ওর মেয়ে ওই স্কুলেই পড়ে! রক্ষা হচ্ছে ও স্কুল থেকে বের হয়ে গেছিল। আমার যে বন্ধুর কথা বলছি ও বিয়ে করছে আমাদেরই এক বান্ধবীকে। মানে ওরা দুইজনই আমাদের বন্ধু। তো ওদের ব্যাপারটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিলাম আমরা। থরথর করে কাঁপছে ওরা। বলল ২০০ গজের মত আসতে পারছিল ওর মেয়ে। এর মধ্যেই এই কাণ্ড।
এরপরেই যা হল তাকে কিছু দিয়েই ব্যাখ্যা করতে পারছি না। মানুষ ভেঙে পড়ল উদ্ধারের জন্য। তারচেয়ে বেশি মানুষ আসল ভিডিও করার জন্য। আমি ভিডিও গুলাতে ঢুকার সাহস পাচ্ছিলাম না। কখন কী দেখে ফেলব পরে অসুস্থ মনে হবে নিজেকে। তাই সযত্নে এড়িয়ে গেছি আমি। কিন্তু ছবি আসতেছিল অনেক। তা দেখেই আমি শিউরে উঠতে থাকি। ফুলের মত কোমল বাচ্চাগুলো আগুনে ঝলসে গেছে, দৌড়ে বের হয়ে আসছে! কেউ তার ছবি তুলেছে! পরে শুনলাম ভিডিওও আছে অনেক। আমার বমি পেতে লাগল। কেউ শিশু গুলাকে বাঁচাতে এগিয়ে না গিয়ে ভিডিও করল? এইটা সম্ভব? এতই ভিউয়ের কাঙ্গাল হয়ে গেলাম আমরা? শুধু এখানেই আমাদের নষ্টামি থামল না। দিয়াবাড়ি থেকে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালের দূরত এক কিলোমিটার না। এই দূরত্বে আসতে সিএনজিচালিত অটো গুলো ১০০০ করে নিয়েছে! ক্যান্টিনে পানির বোতলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল স্বয়ং মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষ!
ফেসবুকে অতি সরকার প্রেমিকেরা গীত গাওয়া শুরু করে দিল। এইটা চীনের বিমান, লীগ সরকার চীনকে খুশি করতে এই সব বিমান কিনেছে! এবার তার খেসারত দাও! আমাদের অর্থনীতি কেমন? আমাদের পক্ষে কোন বিমান কেনা সম্ভব? এই সব কোন যুক্তির ধার ধারা হল না। বলে দেওয়া হল একটা কথা যা হোক!
আর্মি বৈমানিককে হিরো বানিয়ে ফেলল অতি দ্রুত। তিনি বিমান বাঁচাতে গিয়েছিলেন। বাঁচাতে গিয়েই জীবন দিয়েছে! বাহ! দারুণ না? হুট করেই সামনে আসল শেখ হাসিনার নাম। শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউট। এইটাকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতাল। যখন রোগী নিয়ে যাওয়া হল দেখা গেল কাগজে কলমে নাম পরিবর্তন হলেও হাসপাতালের গায়ে শেখ হাসিনার নাম এখনও রয়ে গেছে! যদিও এই হাসপাতালের যে প্রাণ ভোমরা সেই সামন্ত লাল সেনকে মামলা দিয়ে দৌড়ের উপড়ে রেখেছে মহান ইন্ট্রিম! তার মত ডাক্তার এক বিরল জিনিস। কিন্তু আগে তো রাজনীতি, তাই না?
মানুষ সেখানেও ভিউয়ের জন্য ভিড় করা শুরু করল। এদিকে কোন অজ্ঞাত কারণে, মানে আমার কাছে অজ্ঞাত এখন পর্যন্ত, সেনাবাহিনী লাশের সংখ্যা প্রকাশ করতে দিতে দিচ্ছিল না। এই নিয়ে ক্ষোভ জমা হওয়া শুরু। আমি এইটা এখন পর্যন্ত বুঝতে পারি নাই এইটা কেন করবে? আর এরাই বা লাশের সংখ্যা কম বলবে এই সন্দেহ কেন করছে? এখন লাশের সংখ্যা কম বলে পার পাওয়া সম্ভব? তাও স্কুলের ছাত্রদের? কতজন ছাত্র, কতজন শিক্ষক মারা গেছে এইটা তো সহজেই বের হয়ে আসবে? এটা লুকানো সম্ভব? ছাত্ররা ক্যামেরার সামনে বলতেছিল যে কয়েকশ মারা গেছে। আর্মি এসে ধুমধাম চালায় দিছি লাঠি! এর জের গতকাল পর্যন্ত টেনেছে সরকার। আরও লাঠি, আরও মার, আরও রক্ত!
মানুষের স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। মানুষ জম্বি হয়ে যাচ্ছে হয়ত। এমনেই কমন সেন্স বলতে কিছু নাই আমাদের। তার মধ্যে যার যত কমনসেন্স কম সে তত ভিউ বেশি কামাই করতে পারে। উল্টাপাল্টা একটা কাজ করে ফেলবে, মানুষ হুমড়ি খেয়ে দেখবে সেই ভিডিও। কামাই আর কামাই!
ভাইরাল হওয়ার জন্য বুদ্ধি দরকার? কত বুদ্ধি আছে ভাই। এমন এমন সব কাজ করবেন যা কোনদিন কেউ করে নাই। মায়ের দাফনের সময় ডিজে পার্টির আয়োজন করলেন, ভালো ক্যামেরায় সব ধারণ করে ছোট ছোট রিলে মুক্তি দিলেন অনলাইনে! কিংবা আবহ সংগীত সহ বাপের লাশ দাফন! মিউজিক ভিডিওর মত করে বাপের লাশ নামানো দেখাইলেন, কোটি কোটি ভিউ! বা ধরেন কেউ আপনার বোনের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করছে, আপনি বাধা দিবেন? না। আপনি ভিডিও করুন। ভিডিওতেই রাগ করুন প্রচণ্ড, ওকে পাইলে ছিঁড়ে ফেলবেন, মাথা ভেঙ্গে দিবেন ইত্যাদি বলতে থাকুন। ভিউ নিশ্চিত। টাকা কামাই করা হচ্ছে মূল কথা, বাকি সব গৌণ। তার জন্য যদি আগুনে পোড়া শিশুকে দিশেহারা হয়ে দৌড়াতে দেখেন তখন দ্রুত ক্যামেরা চালু করুন, ভিডিও করুন। এই ভিডিও ক্লিপই আপনার ভাগ্য বদলে দিবে। কয়জনের কাছে আছে এমন ভিডিও? ভাগ্য দেবতা আপনাকে আজকে এখানে মোবাইল সহ উপস্থিত করেছে, আপনি তো ঘুমায় থাকতে পারতেন, বা আপনার মোবাইলে সময় মত চার্জ নাও থাকতে পারত, পারত না? সব মিলিয়েই তো মোক্ষম সুযোগটা পেয়েছেন আপনি, ভিডিও করবেন না? ছবি তুলবেন না? আশ্চর্য!
আরও দুরহ কোন এঙ্গেলের চেষ্টা করবেন এরপরে এমন সুযোগ পেলে। বাচ্চাটা দৌড়ে কই গেল? আপনি পিছনে পিছনে যাবেন না? আর গেলেনই যদি তাকে দুই একটা প্রশ্নও করতে পারতেন? তার অনুভূতি কেমন যদি জিজ্ঞাস করে ফেলতে পারতেন তাহলে ভাবুন একবার আপনার কী হত আজকে? দুই ছক্কা পাঞ্জা না একবারে? এগুলা ভুল আর করবেন না। যারা কাজ করছে তাদেরকে ভুলে যাবেন না দয়া করে। ক্যামেরা ধরুন তাদের দিকেও। মরা লাশ নিয়ে যাচ্ছে? জিজ্ঞাস করুন কই থেকে আসল এই লাশ? লাশের ওজন কেমন? মরে গেলে যে ওজন বেড়ে যায় বলে শোনা যায় তা সত্য কি না জানতে চাইতে পারেন, সে কী ক্লান্ত? খেয়ে আসছে বাসা থেকে? এখানে কী খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করছে কেউ? ফালতু মনে হচ্ছে? আরে নাহ! এখন এই দেশে ফালতু বলে কিছু নাই। কে কী বলল না বলল তাতে বসে থাকলে আপনি পিছিয়ে গেলেন, লস আপনার। এরা কেউ এনে দিবে না আপনার সাবস্ক্রিপশন বা ভিউ। পাছে লোকে কিছু বলবেই, আজীবনই বলে, এই সব শুনে দমে গেলেই লস, ভিউ লস, টাকা লস।
না, আপনার কোন দোষ নাই। মনের মধ্যে এইটা নিয়া কোন দ্বিধা রাখবেন না। রাষ্ট্রও একই ধারায় চিন্তা করে এখানে। এখানে যে কাজের কাজ করে সে দৌড়ের উপরেই থাকে। সে মরে। তার জন্য কিছুই নাই। তাই যে বৈমানিক মারা গেল তার জন্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের ব্যবস্থা। আর যে মহিলা অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা না করে আক্ষরিক অর্থেই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার দফন হয় নীরবে, নিভৃতে। তাই কাজের কাজ করার চিন্তা করে লাভ নাই। মধ্যে থেকে জীবনটা বেঘোরে যাবে। এরচেয়ে দুইটা ভিউ কামায় করে নিতে পারলে ক্ষতি কী?
বৈমানিকের বীরত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না, হয়ত তিনি বীরত্বের কাজ করেছে হয়ত করে নাই। আমরা জানি না। আমরা জানি না ওই রকম মুহূর্তে একজনের মনে কী কাজ করে। আমরা জানি না মাখ টু আসলে কী! আমরা জানি না কত দ্রুত একজন বৈমানিকের কত গুলা সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সিদ্ধান্ত নিতে হয়। একচুল এদিক সেদিক হলে সব শেষ। তাই তাকে প্রশ্ন করা আমাদের সাজে না। যারা বিশেষজ্ঞ তারা সেই কাজ করুক। কোন পর্যায় গেলে একজন এমন কাজ করতে পারে তা আমরা জানি না। কিন্তু আমরা জানি এমন একজন বীরের কথা যে নিজের চিন্তা না করে আগুনে ঝাপ দিলেন, যিনি আগুন থেকে বাঁচিয়ে আনলেন কতগুলা শিশুকে। আমরা জানি তিনি নিজের সন্তানদের চিন্তাও করেন নাই, জীবনের চিন্তা করেন না। আমরা সেই বীরকে সম্মান দিতে পারলাম না, কারণ আমাদের রাষ্ট্র আপনার মতই মোবাইল ধরে ফুটেজ নেওয়াতে ব্যস্ত। যেহেতু রাষ্ট্রয় ব্যাপার স্যাপার তাই তারা ফুটেজ নিতে অতি দক্ষ। ছাত্ররা উল্টাপাল্টা আন্দোলন করে সব নষ্ট করেছে। না হলে দেখতে পেতেন ফুটেজ কাকে বলে, কয় প্রকার এবং কী কী! ভিউয়ের চিন্তা তাদের আপনার থেকে বেশি। পুলাপান গুলাই যত নষ্টের মূল, সব গুবলেট করে দিল!
তবে এইসবের বাহিরে একটা আলদা হিসাব আছে। মহাকালের হিসাব। সেখানে সব তুচ্ছ হয়ে যাবে। আজকে কে কী করল না করল, কে কাকে সম্মান দিল না দিল, কাকে ঠকিয়ে গেলেন তার আলাদা একটা হিসাব হয় মহাকালের হিসাবে। সেই হিসাবের সময় সব তুচ্ছরা বাতিল হয়ে যায়। টিকে যায় তারাই যারা মহাকালের গায়ে আঁচর কেটে যেতে পারে। হাজার বছরও সেখানে কিছু না। কীর্তিমানের মৃত্যু নাই, জানেন তো? জানেন তো - নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান- ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই!
মেহেরীন চৌধুরী, আপনি অমর হয়ে রইবেন। রাষ্ট্র আজকে কী করল না করল তার অনেক ঊর্ধ্বে আপনার চলাফেরা। কুর্নিশ আপনাকে। মহাকাল আপনাকে মনে রাখবে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।