সীমান্ত হত্যা পৃথিবীর নানা জায়গায় হয়। অনেক বৈরি সীমান্ত রয়েছে। দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক এমন যে মনে হবে সব সময়ই বুঝি যুদ্ধ চলছে দুই দেশের মাঝে। সেই সব দেশের সীমান্তে গুলি চলে, মানুষ মরে। কিন্তু পৃথিবীর বুকে সম্ভবত বাংলাদেশ ভারত সীমান্তই একমাত্র সীমান্ত যেখানে দুই দেশ বড় গলা করে দাবি করে তারা বন্ধুপ্রতিম দেশ এবং নিয়ম করে সীমান্তে মানুষ মরে দুই বন্ধু দেশের সীমান্তে। মানুষ মরে এবং আশ্চর্য খবর হচ্ছে এরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। স্পষ্ট করে বললে সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের হাতে অকাতরে প্রাণ যায় বাংলাদেশীদের। অনেক ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে পারতাম। কিন্তু সত্য হচ্ছে এটাই। দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমরা যারা দুই বাংলাকে এখনও বাঙালির জন্য এক বলে মনে করি, যারা কাঁটাতারকে অস্বীকার করে বলতে চাই আমরা ভাগ হলেও আসলে আমরা এক তারা অবাক হয়ে লক্ষ করি এমন একটা ন্যকারজনক ঘটনা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে চলে আসলেও ওইপাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। তারা ঠিকঠাক জানেই না ঠিক কতজন মারা যায় সীমান্তে! এই নীরবতা আমাদের কষ্ট দেয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতা একটা বড় অস্ত্র। এখানে একটা পক্ষ যত্ন করে ভারত বিরোধিতা জিইয়ে রাখতে চায়। এই বিরোধিতা শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই। যুদ্ধ পরবর্তী সরকারকে সমানে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছে। বলা হয়েছে তাজউদ্দীন আহমেদ গোপন চুক্তি করে দেশ ভারতের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। বলা হয়েছে আমাদের টাকা ভারত ছাপাচ্ছে, সব জাল নোটে দেশ সয়লাব। পাকিস্তানের কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে ভারতের কবলে পড়ছে বাংলাদেশ, এমন নানা কথা বলে, নানা কাজ করে ভারত বিরোধিতাকে ধরে রাখা হয়েছে এখানে। যদিও আজ পর্যন্ত কেউ সেই গোপন চুক্তি দেখাতে পারেনি। কিন্তু দেশ বিক্রি করে দিয়েছে এই তকমা ঠিকই রয়ে গেছে।
সময় গেছে কিন্তু অবস্থার উন্নতি হয়নি। উপমহাদেশে নানা উত্থান পতন হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে দুই দেশের সম্পর্কে। নব্বইয়ে বাবরি মসজিদ ভাঙা, পরবর্তীতে এমন নানা কাণ্ড এখানকার মানুষ যারা ভারতকে শত্রু দেশ হিসেবে চিহ্নিত করতে তৎপর তারা খুব ভালো করে এগুলাকে কাজে লাগিয়েছে।
ইন্টারনেটের যুগে শিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলের হাতে যখন যন্ত্র চলে আসল তখন হল আরও বড় বিপদ। মানুষ সত্য মিথ্যা নির্ণয় করার চেষ্টাও করে না। যা দেখে তাই বিশ্বাস করে বসে থাকে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা খুব ভালো তা বলা সম্ভব না। তার ওপরে আমাদের গড় আইকিউ দুনিয়ার গড় আইকিউ থেকে কম! ফলাফল এই কিছুদিন আগেই দেখা গেল, মানুষ কুমিল্লা ফেনির বন্যার জন্য এক তরফা ভারতকে দোষারোপ করে গেল। বাধের বিপরীতে বাধ দিবে এমন হাস্যকর গল্পও সামনে আসল।
সীমান্ত হত্যা নিয়ে লিখতে বসে এগুলা বলার একটা কারণ আছে। অহেতুক ভারত বিরোধিতার বিরুদ্ধে আমরা যখন আওয়াজ তুলতে চাই তখন আমাদের কিছু জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াতে হয়। অনেক গুলো কারণের মধ্যে সীমান্ত হত্যা হচ্ছে বড় একটা কারণ যা নিয়ে কিছু বলার থাকে না। ন্যায্য পানি, অসম নানা চুক্তি এগুলা আমাদের প্রশাসনিক, কূটনৈতিক ব্যর্থতা বলে বুঝা যায়। দর কষাকষিতে হেরে যাওয়া, নতজানু পররাষ্ট্র নীতি, সদ্য গদি হারানো আওয়ামীলীগের অতিরিক্ত ভারত নির্ভরতার কারণে নানা সময় ন্যায্য কথা বলতে না পারা, এগুলা বুঝা যায়। এগুলা আমাদের হাতে, আমরা ইচ্ছা করলেই এই সবে ভালো করতে পারব। ভারতকে চাপ দিতে পারব। নিজের হিস্যা বুঝে নিতে পারব। কিন্তু সীমান্ত হত্যা? এইটার দায় পুরোটাই ভারতের! আমরা শুধু বলতে পারি আমাদের সরকার কড়া করে প্রতিবাদ কেন জানায় না! কিন্তু এইটা ওষুধ না, সীমান্তে হত্যা ভারতকেই বন্ধ করতে হবে, এর কোন বিকল্প নাই।
আচ্ছা, কোন ধারনা আছে ঠিক কতজনের আলাপ করছি এখানে আমি? কতজন মারা গেছে এই শুধু গত বছর? আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী গত বছরের অর্ধেক যেতেই ১৫ জন মারা গেছে ভারতের সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে! কেন এই প্রাণহানি? ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয় সব চোরাকারবারি! মুশকিল হচ্ছে যে কোন জায়গায় চোরাকারবারিকেও গুলি করে মারা যাবে না, সীমান্তে তো যাবেই না, এইটা ভারত বাংলাদেশ মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। একমাত্র যদি কাওকে হুমকি বলে মনে হয়, মনে হয় সে অস্ত্র বহন করছে, তখন আত্মরক্ষায় গুলি চালাতে পারে। তবে আগ্নেয়স্ত্র ব্যবহার না করাই উত্তম। এগুলা বলা হয়েছে দুই দেশের মাঝে সাক্ষরিত যে প্রটোকল তাতে। এ রকম দ্বিপক্ষীয় দুটি প্রটোকল হলো— জয়েন্ট ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ গাইডলাইনস ফর বর্ডার অথোরিটিজ অব দ্য টু কান্ট্রিজ, ১৯৭৫ ও দ্য ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ কো-অর্ডিনেটেড বর্ডার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান, ২০১১।
এই দুই প্রটোকলে দেখা যায় স্পষ্ট করেই বলা আছে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না। কিন্তু দেখা যায় ভারত এই সব কিছুই মানে না। নির্বিচারে মানুষ মেরেই চলছে।
গত বছর ১৫ জন মারা গেছেন। বেসরকারি মানবাধিকা সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাবে ২০০৯ সাল থেকে ২০২০, এই ১১ বছরে সীমান্তে ৫২২ জন বাংলাদেশী নাগরিক। আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী ২০২১, ২০২২, ২০২৩ সালে সীমান্তে হত্যা করা হয় যথাক্রমে ১৮,২৩ ও ৩১ জন! এইটা জেনে গা শিউরে উঠে না? আমাদের উঠে! ভারতের সীমান্তরক্ষীদের হাতে এত গুলো প্রাণ গেল, ভারত সরকার কোনদিন একটা হত্যাকাণ্ডের বিচার বা তদন্ত করে দেখেছে? না। যে মৃত্যু নিয়ে খুব তোলপাড় হয়েছিল সেই ফেলানি হত্যাকাণ্ডের বিচার বাংলাদেশ চেয়েছিল, ভারতের কোর্ট বেকসুর খালাস করে দেয় সেই আসামিকে, সুপ্রিম কোর্টে সেই বিচার এখনও চলমান!
৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার স্থল সীমান্ত ভারত বাংলাদেশের। পৃথিবীর বুকে পঞ্চম বৃহত্তম সীমান্ত আমাদের এই সীমান্ত। এই দীর্ঘ সীমান্তে চাইলেও নিছিদ্র করা সম্ভব হয় না। দুই দেশের আছে এক থাকার ইতিহাস। দুই পাশের মানুষ কথা বলে এক ভাষায়। এমন ভাবে সীমান্ত ভাগ করা হয়েছে যে মানুষের জীবন দুই ভাগ হয়ে গেছে। বাড়ি একদিকে, রান্নাঘর আরেক দিকে, ক্ষেত খামার আরেকদিকে। এমন হচ্ছে পরিস্থিতি। গ্রামের মানুষের গরু চলে যায় হেঁটে হেঁটে ওই পাশে, ধান চাষ করে এই পাশে এমন অনেক আছে। আমাদের সীমান্তে আমরা ছোট থেকে দেখে আসছি সীমান্ত পিলারের ওইপাশে মানুষ আসছে যাচ্ছে! আমরা দুঃসাহসিক কাজ করছি দেখানোর জন্য সীমান্ত পিলারের দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি, কেউ একটু হেঁটে আসছে ওইপাশ থেকে! কীভাবে সম্ভব? কারণ পিলার পড়েছে নদীর এই পাশে। ঐতিহাসিক ভাগের সময় এগুলা হিসাব করে নাই রেডক্লিফ। তাই এদিকে সব বাংলাদেশর অংশ কিন্তু পিলার পড়েছে এখানে! এখন পিলারে উঠলে গুলি মেরে দিলে কী হত? সিলেটের বেশ কিছু জায়গায় এমন। দুইদেশের মানুষ হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় এসে যাচ্ছে। জাফলং গেলে দেখা যায় বিজিবি আর বিএসএফ এক সাথে দাঁড়িয়ে আছে। ওইপাশ থেকে কেউ একটু বাংলাদেশ থেকে ঘুরে আসি বলে এদিকে আসতে চাচ্ছে, বিএসএফ ধমক দিয়ে ঠেকাচ্ছে, এদিকে বিজিবিও তাই করছে। আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য বলে এমনই হওয়ার কথা আমাদের সীমান্তের অবস্থা। কিন্তু তা আর হয় কই? সব জায়গায় তা আর হয় না।
গত বছর মার্চে ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৪তম সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় সীমান্তের বিষয়ে নানা কথা বলা হয়। সম্মেলন শেষে সংবাদ সম্মেলনে বিএসএফ মহাপরিচালক নিতিন আগারওয়াল বলেন সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয় না! তিনি সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনা হবে বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না হলে এই মানুষ গুলো মরলে কীভাবে? উত্তর নাই! রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কথা দিয়ে কথা না রাখলে কী করা যায়? আমার জানা নাই, কেউ হয়ত জানে! বিএসএফ মহাপরিচালক থেকে শুরু করে স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী সীমান্তে আর কোন হত্যা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন একাধিকবার এবং ফলাফল মৃত্যুর মিছিল থামে নাই একটুও। ব্যাপারটা কী এমন যে আমাদেরকে বলা হচ্ছে গুলি করা হবে না আর সীমান্ত রক্ষীদের বলা হচ্ছে চালায় যাওয়া গুলি? আমরা আবার বন্ধু রাষ্ট্র বলে দাবি করি!
বিএসএফ থেকে সোজা বলে দেওয়া হয় যারা গুলি খেয়ে মারা গেছে তারা সবাই চোরাকারবারি! তাহলে ধরেন, ধরে বিচার করেন। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কবে থেকে ভারতে বৈধ হয়ে গেল? আর চোরাকারবারি ব্যাপারটা আসলে কীভাবে ঘটে? বাংলাদেশ থেকে কেউ ওইপাশে যায়, গিয়ে সস্তায় গরু কিনে পরে সীমান্ত পারি দেয়? তখন গুলি খায়? ব্যাপারটা তো এমন না। বাংলাদেশে থেকে কেউ একাএকা গরু বা অন্য কিছু চোরাকারবারি করতে পারবে না। গরু সব সীমান্তবর্তী এলাকায় বসে থাকে না যে বাংলাদেশী কেউ গিয়ে নিয়ে চলে আসবে। এই গরু গুলা আসে দুই আড়াই হাজার মাইল পারি দিয়ে। পাঞ্জাব, হারিয়ানা থেকে আসে এই সব গরু। এই লম্বা পথে কেউ তাদেরকে আটকায় না, জিজ্ঞাস করে না। ভারতের মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের ( মাসুম) সচিব কিরীটি রায় ডয়েচে ভেলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে (বাংলাদেশকে চাপে রাখতে সীমান্ত হত্যা? - ডয়চে ভেলে, ২৯/১২/২০২২) বলেছিলেন এই লম্বা পথে যে কেউ তাদেরকে আটকায় না তার বড় কারণ হচ্ছে সবাই ভাগ পায়। সীমান্তে গুলি তখনই হয় যখন ভাগ বাটোয়ারার হিসাব মিলে না! ডেয়েচে ভেল থেকে তুলে দিচ্ছি, "এই সীমান্ত হত্যার পিছনে যে গল্প ফাঁদা হয় তাও ঠিক না। তারা বলে সীমান্ত দিয়ে গরু চোরাচালান হয়। চোরাচালনিদের হত্যা করা হয়। মনে হয় যেন সীমান্তে গরু জন্ম নেয় আর তা বাংলাদেশে পাচার করা হয়। বাস্তবে এইসব গরু আনা হয় ভারতের অভ্যন্তরে দুই-আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে হরিয়ানা, পাঞ্জাব থেকে। গরুগুলো হাঁটিয়ে, ট্রাক, ট্রেনে করে আনা হয়। তখন কেউ দেখে না! তারা আটকায় না। কারণ তারা ভাগ পায়। এখানে আসল কথা হলো দুর্নীতি, ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে সব করা হয়। যখন ভাগ-বাটোয়ারায় মেলেনা তখন বিএসএফ হত্যা করে।” এটাই হচ্ছে চরম কুৎসিত সত্য। যা ভারত সরকার কখনই স্বীকার করেন নাই।
শুধু গরু না। অন্য অনেক কিছুই চোরাকারবারি হয়। মজার বিষয় হচ্ছে এইটা সব সময় ভারত থেকে আসার সময়ই ধরা পরে। কিন্তু প্রকৃত দৃশ্য এমন না। এদিক থেকেও ভারতে নানা জিনিস যায়। ভারত থেকেও আসে মানুষ। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে তারা আজ পর্যন্ত কেউ গুলি খেয়ে মরেনি! কেউ কোন দিন ধরাও পড়েছে বলে শোনা যায়নি। যেহেতু এমন কিছু হয়নি তাই এর সত্যতা নির্ণয় করা কঠিন। কিন্তু এইটা তো সাধারণ বিষয় যে এক তরফা এগুলা হয় না। হওয়া সম্ভব না। এখানে এক তরফা হয় শুধু মৃত্যু, বাংলাদেশীদের সীমান্তে মৃত্যু!
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ‘ট্রিগার হ্যাপি: এক্সেসিভ ইউজ অব ফোর্স বাই ইন্ডিয়ান ট্রুপস অ্যাট দ্য বাংলাদেশ বর্ডার’ নামের ৯ ডিসেম্বর, ২০১০ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয় ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে মারা যাওয়াদের সবাই ছিল নিরস্ত্র, তাদের কাছে বড়জোর লাঠি, কাস্তে, ছুড়ি থাকে। এই অস্ত্র মোকাবেলার জন্য তারা গুলি করে মেরে ফেলে মানুষ। ভারতের বৈরি সীমান্ত বলে যাকে মনে করা হয়, সেই পাকিস্তান বা চিন সীমান্তে এমন করে মানুষ মরে? মারে?
ইউরোপে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অবৈধ ভাবে যাওয়াকে গেম মারা বলে। এই গেম দেওয়া এখানেও প্রচলিত আছে। নানা কারণে অনেকে বৈধ ভাবে যেতে পারে না ভারতে। বর্তমান পরিবর্তিত অবস্থার দিকে নজর দিলেই দেখা যাবে যে আওয়ামীলীগের বহু নেতা কর্মী ভারতে চলে গেছে। তারা সবাই অবৈধ পথেই গিয়েছে এইটা চোখ বন্ধ করেই বলা যায়। আমাদের শহরের নেতারা যে বেশিরভাগ তাই গিয়েছে তা নিশ্চিত। আগেই লিখেছি, এখানের সীমান্ত অনেকটাই খোলামেলা। স্বর্ণা দাসের মৃত্যুও অবৈধ ভাবে যাওয়ার কারণেই হয়েছে। ওই পথে গেম মেরে যাওয়ার জন্য খরচ অনেক কম। দালালরা দুই এক হাজার দিয়েও সীমান্ত পার করিয়ে দেয়। এবং তারা সবাই ভারতীয় দালাল! যারা কোনদিনই ধরা পরে না।
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভোরে গুলি খেয়ে মরে ফেলানি খাতুন। ফেলানির বয়স ছিল ১৫ বছর! ফেলানি খাতুন কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে বাবার সাথে ভারত থেকে ফিরছিল সেই সময় গুলি খেয়ে প্রাণ হারায়। দীর্ঘ সময় ফেলানির লাশ কাঁটাতারে ঝুলে থাকে! সেই সময় কাঁটাতারে ফেলানির লাশ খুব আলোড়ন তৈরি করে। দেশ বিদেশের গণমাধ্যমেও বেশ জায়গা পায় এই ছবি। তখন যে তীব্র ঘৃণার জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশীদের মনে তা ভারতবাসী কতখানি বুঝে ছিল জানি না। আমরা আশা করেছিলাম অন্তত পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা প্রতিবাদ করবে এমন একটা ন্যকারজনক হত্যাকাণ্ডের জন্য। কিন্তু তা আর হয়নি। এরপরে কোথাও যে খুব বেশি কিছু হয়নি তা বুঝতে পারা গেছে সহজেই। কারণ অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সব আগের মতোই। এবং ১৩ বছর পরে গত বছর ১ সেপ্টেম্বর রাতে ১৪ বছর বয়সই স্বর্ণা দাস মারা গেল গুলি খেয়ে! স্বর্ণা দাস মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্ত দিয়ে তার মায়ের সাথে ত্রিপুরায় থাকা ওর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিল। বেচারি মা নিজে বাঁচতে পারলে বাঁচাতে পারেনি ছোট্ট কিশোরী স্বর্ণা দাসকে! আত্মরক্ষায় গুলি কোন ক্ষেত্রেই খাটে না। স্বর্ণা দাস, ফেলানি খাতুন কেউই অস্ত্র তাক করেনি বিএসএফের দিকে যে তাকে গুলি করে মেরে ফেলতে হবে।
আমাদের দায় শুরুতে নাই বলেছি। তা আসলে সত্য না। আমাদের দায়ও আছে। আমাদের এখানে সবচেয়ে বড় দায় বিজিবির। ওই পাশে যাওয়ার পরে গুলি খাচ্ছে, আসার সময় গুলি খাচ্ছে এদেরকে যদি আগেই আটকে দেওয়া যেত তাহলে এমন অনেক মৃত্যুই ফেরানো যেত। বিজিবি টাকা খেয়ে এমন কাজ হতে দেয়। বিজিবিকে না জানিয়ে এই ব্যবসা করা সম্ভব না। তারা খুব ভালো করেই জানে এবং নিজের হিস্যা বুঝেই তারা যেতে দেয়। এবং যখন একটা কাণ্ড ঘটে যায় তখন সব দোষ ভারতের দেওয়া হয়। বিজিবি শক্ত হলে মৃতের সংখ্যা অনেক কমিয়ে আনা যেত, এইটা সত্য। কিন্তু তবুও শেষ পর্যন্ত টিগারটা টিপে বিএসএফ, যা আসলে কোন ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝানো সম্ভব না। এই দায় তারা এড়াতে পারবে না কোনদিন।
ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে পার্থক্য কী? ভারত পেয়েছে ভালো প্রতিবেশী আর বাংলাদেশ...
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।