এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে ( তৃতীয় খন্ড ) - ৩৭

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৭ জুন ২০২৫ | ৪৩ বার পঠিত
  • ( ৩৭ )

    পুজো এগিয়ে আসছে। শেষ রাতের দিকে গাছের পাতায়, মাঠের ঘাসে, বাড়ির ছাদে হিম পড়ছে। কুমোরটুলির কারিগরদের এখন নিশ্বাস ফেলার ফুরসত নেই। বৃষ্টি অবশ্য এখনও পুরোপুরি ধরেনি। মাঝে মাঝে এক পশলা ঝরবার পরে আকাশ ঝলমলে হয়ে উঠছে। আলো জড়ানো চমরী গাইয়ের মতো মেঘের টুকরো অলস ভ্রমণে বেরিয়েছে আকাশের নীলাভ চত্বরে। বাতাসে কেমন সদ্য দোয়ানো দুধের গন্ধ।
    ইন্দ্রাণী তিনতলার ছাদে উঠল সকাল নটার সময় জামা কাপড় মেলার জন্য। আলসের ওপর দুহাত রেখে বেথুন কলেজের ওপর দিয়ে দূরের বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। এখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। তাদের সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতেও ছাদে উঠলে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যেত। একদিন বিকেলবেলায় সাগরকে নিয়েও ছাদে উঠেছিল। পড়ন্ত বেলার রোদ এসে পড়েছে তখন ছাদের ওপর। ইন্দ্রানী বলল, ' ওদিকের আকাশটা দেখ, কি সুন্দর লাগছে ...না ?'
    সাগর বলল, ' তুই কোনদিন রামধনু দেখেছিস ? '
    --- ' না ... তুই দেখেছিস ?
    --- ' হ্যাঁ, একদিন দেখেছিলাম ... বৃষ্টির পরে। বৃষ্টির পরে রামধনু দেখা যায়, জানিস তো ? '
    --- ' হ্যাঁ, তা জানি ... '
    দুজনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে নীচে রাস্তার লোকজন দেখতে লাগল।
    একটু পরে ইন্দ্রাণী বলল, ' চল নীচে যাই। সন্ধে হয়ে আসছে। কে আবার কি বলবে ... '
    সাগর অবাক হয়ে বলল, ' কেন, বলবে কেন ? '
    ইন্দ্রাণী বলল, ' ও আছে ... তুই বুঝবি না, তুই তো একটা মাথামোটা ... '
    --- ' কেন ? '
    ---' না কিছু না ... চল চল ... '

    এত বছর পরে এই মানিকলালবাবুর বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে নীচের রাস্তায় লোকজন দেখতে দেখতে বহুযুগ আগেকার এক টুকরো স্মৃতি ঝিলিক দেওয়ায় ইন্দ্রাণী আপন মনেই ফিক করে
    হেসে ফেলল। ভাগ্যিস এখানে কেউ নেই, তাহলে তাকে নির্ঘাত পাগল ভাবত। ইন্দ্রাণী অবশ্য ক্রমশ বাস্তববাদী হয়ে আসছে। অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে দিন কাটানোটা যে কোন কাজের কথা নয় তা অনেক দেরিতে হলেও তার মাথায় বসে গেছে। শুধু বাৎসল্যস্নেহের আকাঙ্খা থেকে নয় ইন্দ্রাণী ভবিষ্যতের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে একটা সন্তান পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। মানিকবাবুর বয়স হয়েছে। তার শ্বাশুড়ি সৌদামিনীদেবীর বয়স হয়েছে। তিনি আজ আছেন কাল নেই। তার পরে মানিকবাবুর কথা ভাবলে তার একটু বুক দুরদুর করে। এত বড় বাড়িতে সে একা হয়ে যাবে। একতলায় অবশ্য খুড়তুতো দেওর কাঞ্চন আছে।

    কিন্তু তার ওপর ভরসা করে তো থাকা যায় না। নিজের একটা অবলম্বন চাই। ইন্দ্রাণী দেখল নীচে ডানদিকে ওই হেদুয়ার মোড়ের দিকে একটা ছোটখাট জটলা তৈরি হয়েছে। এত দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে ক'জন লোক খুব উত্তেজিতভাবে হাত নেড়ে নেড়ে কথা কাটাকাটি করছে। তাদের ঘিরে অনেক লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। ইন্দ্রাণী দেখতে পেল মানিকলালবাবু ওদিক দিয়ে আসছেন। জটলা দেখে তিনি একপাশে দাঁড়িয়ে গেলেন। বোধহয় ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন। খানিকক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে বোধহয় চেঁচামেচির কারণটা আন্দাজ করার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু সেটা বোঝা হল কি হল না ইন্দ্রাণী ছাদে দাঁড়িয়ে অনুমান করতে পারল না। সে দেখল মানিকবাবু আবার বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করেছেন। সেও সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে থাকল।

    মানিকবাবু ওপরে উঠতেই ইন্দ্রাণী জিজ্ঞাসা করল, ' কি হচ্ছে গো ওখানে ? '
    --- ' কোথায় ? '
    --- ' ওই যে ওই মোড়ে। ছাদ থেকে দেখছিলাম ... '
    --- ' ও ... ওখানে ? ঠিক বুঝতে পারলাম না। একজন বলল, ' পলিটিক্যাল ব্যাপার ... ভোট এগিয়ে আসছে তো ... এসব হবে এখন ... বুঝলে তো ... মিটে যাবে, যাবে ... '
    মানিকবাবু ঘরে ঢুকে গেলেন। মানে, তিনি পরিষ্কারভাবে কিছুই জেনে আসেননি। তিনি এসব পার্টি টার্টির ব্যাপার তেমন বোঝেন না। কোন আগ্রহও নেই। যেই দেশ চালাক তাতে তার কি। যেই আসুক তার কোন অসুবিধা হবে না। তিনি যেমনি আছেন তেমনি থাকবেন। তার স্বামীর এই ধরণটা ইন্দ্রাণী ভালরকমই বুঝে গেছে। তাই সেও নিরাসক্তভাবে বলল, ' ও ... '
    ইন্দ্রাণী ছাদ থেকে জামাকাপড় তুলে এনেছে। সেগুলো ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখতে লাগল। মানিকবাবু গা থেকে জামা খুলে খাটের ওপর বসলেন।
    বললেন, ' আজ কিন্তু বেশ গরম আছে ... ঘাম হচ্ছে। ও হ্যাঁ ... রাস্তায় সাগরের সঙ্গে দেখা হল ... '
    ইন্দ্রাণী ঘাড় ঘোরাল এদিকে।
    --- ' তাই নাকি ... কিছু বলল ? '
    --- ' না, তেমন কিছু না ... এই ... আমরা কেমন আছি জিজ্ঞেস করছিল। তোমার কথাও জিজ্ঞেস করছিল ... '
    --- ' তাই ? কি জিজ্ঞেস করছিল ? '
    --- ' তেমন কিছু না, শরীর টরীর ঠিক আছে কিনা, মেজাজ ঠান্ডা আছে কিনা ... এইসব ... '
    --- ' ও বাবা ... আবার মেজাজের খবর নেয় ... '
    --- ' হ্যাঁ ... সাগরের ছেলে নাকি পড়াশোনায় খুব ভাল হয়েছে। এবারে নাকি ফার্স্ট হয়েছে ক্লাসে ...'
    ইন্দ্রাণী একগাল হেসে বলল, ' তাই বুঝি ? বাঃ বাঃ ... ভাল তো হওয়াই উচিত ... অত ভাল বাবা মা ... হবে নাই বা কেন, শুনেও আনন্দ ... এসব খবর শুনলে মন ভাল হয়ে যায় ... '
    ইন্দ্রাণীর উচ্ছ্বাসের মাত্রাটা যেন একটু বেশি মনে হল মানিকবাবুর।
    তিনি বললেন, ' সাগরের বউ তো খুব উচ্চশিক্ষিত।
    পড়াশোনার কালচার আছে ... '
    --- ' হমম্ ... বুঝলাম। তবে বীজটাও তো উন্নতমানের হওয়া চাই। আমাদের যে কবে ওসব হবে ... '
    বলে মাথা চুলকোতে থাকে ইন্দ্রাণী।
    --- ' ওঃ ... এত খুসকি হয়েছে না ... কাল একটা খুসকি পরিষ্কার করার শ্যাম্পু এনো তো ... '
    --- ' আচ্ছা ঠিক আছে। চা করবে নাকি ? '
    --- ' বুলবুলকে বলেছি, করে আনছে ... মেয়েটা ভাল ... ভদ্রবাড়ির মেয়ে, নেহাত কপালের ফেরে লোকের বাড়ি কাজ করছে ... '
    --- ' অ ... তা হবে। এরকম তো কতই আছে ... '
    --- ' দেখ, তোমায় একটা কথা বলছি ... কাঞ্চনের বউ কিন্তু মোটেই সুবিধের মেয়ে নয় ... '
    --- ' কেন, ও আবার কি করল ? '
    --- ' সে আছে ... পরে বলব'খন ... '
    --- ' হমম্ ... দেখি কাগজটা একটু দাও তো। একটু চোখ বোলাই। সারাদিন সময় হল না ... সোনার দাম আর কমবে না মনে হচ্ছে ... '
    --- ' বলছি যে ... একদিন ডাক্তারের কাছে চল না ... অনেকদিন তো হয়ে গেল ... কিছু সমস্যা থাকলে ডাক্তারই তো ধরতে পারবে ... '
    --- ' আরে দাঁড়াও দাঁড়াও ... তুমি দেখছি একেবারে পাগল হয়ে উঠেছ ... ওঃ ... পারও বটে। রাতদিন শুধু এক চিন্তা ... '
    --- ' ঠিক আছে ... দেখি কতদিনে তোমার ঘুম ভাঙে ... জেগে ঘুমোলে কিন্তু জাগানো যায় না ... '
    বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ইন্দ্রাণী। বোধহয় রান্নাঘরের দিকে গেল।
    মানিকলালবাবু তাকিয়ায় হেলান দিয়ে ঘরের সিলিং-এর দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার পরিচিত ভঙ্গীতে আপনমনে বললেন, ' খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল ইয়ে ... কি বলে ... কি হ্যাপা কি হ্যাপা ...'

    পুজো এসে পড়ল দোরগোড়ায়। ভোরের শারদ বাতাসে সাঁতরায় পুজোর গন্ধ। মানিকবাবু ভাবলেন, ঘরদোরে রঙ করার দরকার। বড়ই বাসি বাসি লাগছে। অনেকদিন রঙ পড়েনি বাড়ির দেয়ালে।

    ( চলবে )

    ******
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন