এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে ( তৃতীয় খন্ড ) - ১ 

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ২০ মার্চ ২০২৫ | ১২৬ বার পঠিত
  • ( ১ )

    শীত প্রায় বিদায় নিয়েছে বলা যায়। রোদ অবশ্য এখনও তেমন তেতে ওঠেনি। সকাল সন্ধেয় ঠান্ডার হাল্কা পরশ লেগে থাকে হাওয়ায়। গঙ্গাপ্রসাদ দোকান খুলে বসেছে সকাল সাতটায়। গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়ানো। সুরেশ্বর মল্লিক তিনটে থলে হাতে নিয়ে মানিকতলা বাজারের দিকে এগোচ্ছিলেন গুটিগুটি। গঙ্গার দোকানের সামনে আসতে মল্লিকবাবুকে চোখে পড়ল গঙ্গার।
    --- ' আরে দাদা ... এত সকাল সকাল ? এত সকালে তো আপনাকে কোনদিন বাজারে যেতে দেখিনি ... এখনও তো আপনার মাঝরাত... '
    --- ' আর বলিস না ... '
    --- ' মেয়ে জামাই আসবে নিশ্চয়ই ... '
    --- ' হ্যাঁ রে ... ' খুশিতে ডগমগ হয়ে বললেন সুরেশ্বর।
    --- ' তবে ? ঠিক ধরেছি ... তা ভাল ... '
    --- ' হ্যাঁ, দেখি বড় সাইজের গলদা চিংড়ি পাই কিনা। জামাই খুব ভালবাসে ... '
    --- ' ও আচ্ছা। নাতির বয়েস কত হল মল্লিকদা ? '
    --- ' এই তো দু বছরে পড়ল ... '
    --- ' ভাল ভাল ... '
    --- ' হুঁ ... এগোই আমি ... '
    মল্লিকবাবু হাঁটতে থাকেন।
    গঙ্গাপ্রসাদ ভাবল, সেই মল্লিকবাবু আর আর এই মল্লিকবাবু ! আগেকার দিনে হলে ওনার সঙ্গে এত কথা বলা যেত ... কি মেজাজ তখন ওঃ ... বয়েস বেড়ে গেলে মানুষ কত বদলে যায় ...।
    দোকানে দুজন খরিদ্দার এসে দাঁড়িয়েছে। একজনকে বিউড়ির ডাল দিচ্ছিল পাল্লায় ওজন করে। সে বলল, ' আজকাল বিভূতিবাবুকে তেমন দেখতে পাই না। শরীর টরির ঠিক আছে কিনা কে জানে ... '
    আর একজন, মানে অরুণ পাল বললেন, ' আ...র চিরকাল কি আর একভাবে চলে ... বয়েস তো হচ্ছে ... আমারই তো পঁয়তাল্লিশ হতে চলল। বিভূতিদা আমার চেয়ে কত বড় ... কত থিয়েটার দেখার শখ ছিল ওনার, সিনেমাও দেখতেন খুব, একা একাই। ছোটবেলা থেকে দেখছি। সে সব দিন গেছে ... ' বলে অরুনবাবু একটা হ্রস্বশ্বাস ফেললেন।
    তারপর বললেন, ' ভাল গোবিন্দভোগ আছে নাকি, পায়েস করার মতো ... ছোট ছেলের জন্মদিন... ওই একটু ... '
    --- ' এ ক্লাস চাল আছে ... খেয়ে বলবেন ... মারকাটারি পায়েস হবে ... '
    --- ' ঠিক আছে, দে পাঁচশ ... দেখি কেমন হয় ? '

    নিতাইবাবুর মেয়ে শ্রীলেখা একদিন পাঁচ বছরের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে এসে হাজির হল বিকেলের দিকে। বিভূতিবাবু, রমাদেবী তো ওদের দেখে আহ্লাদে আটখানা।
    রমাদেবী বললেন, ' আরে ... কার মুখ দেখে উঠেছি আজকে ! এতদিনে মনে পড়ল ? এখান থেকে চলে গিয়ে আমাদের ভুলে গেলি একেবারে ... তোর ছেলেটা কি সুন্দর হয়েছে রে ... কি নাম রেখেছিস রে ? '
    শ্রীলেখা এখন রীতিমতো গিন্নীবান্নি হয়ে উঠেছে। সে বলল, ' বিশ্বরূপ, ডাক নাম চিন্টু। কি করব বল জেঠিমা, সংসারে জড়িয়ে পড়েছি ভীষণভাবে। মার কাছেই তেমন আসতে পারি না ... তোমাদের কথা সব সময়ে মনে পড়ে, বিশ্বাস কর ... '
    --- ' তোর বরকে নিয়ে একদিন আসিস না ... ভাল করে তো আলাপই হল না ... '
    --- ' হ্যাঁ জেঠিমা ... নিশ্চয়ই আসব। আমি তো আমাদের এই পাড়া, এই বাড়ি, এখানকার সবকিছুর গল্প করি সব সময়। সে সব দিন তো আর কোনদিন ফিরে আসবে না। তোমাদের কথা শুনতে শুনতে ওর মুখস্ত হয়ে গেছে একেবারে ... এখানে আসলে শুনবে ওর কাছে। আমাকে বলে হেদোর মেয়ে ... হাঃ হাঃ ... '
    রমাদেবী হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন শ্রীলেখার দিকে। ভাবতে লাগলেন, ' এই সেদিনের স্কুলে পড়া ছোট মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে। '
    বিভূতিবাবুর দুচোখেই ছানি কাটানো হয়েছে। করে তেমন সুবিধে কিছু হয়নি। সবসময়ে জল পড়ে। এর মধ্যে ডান চোখটা মোটামুটি আছে। ওটা আগেই করা হয়েছিল। বিভূতিবাবু তার উঁচু পাওয়ারের চশমার অস্বচ্ছ কাঁচের পিছন থেকে জলকাটা চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন শ্রীলেখার দিকে। তার যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না এই সেই শ্রীলেখা। বিভূতিবাবুর মনে রঙমহলের রিভলভিং স্টেজের মতো স্মৃতির ফেলে আসা 'সিন' গুলো ফের উল্টোদিকে ঘুরপাক খেয়ে তার চোখের সামনে এসে দাঁড়াতে লাগল। অনেক দিন আগের থিয়েটার নিয়ে পাড়াসুদ্ধু লোকের সেই সব পাগলামির কথা মনে পড়তে লাগল। মনে পড়তে লাগল সেই রিহার্সালের হুজুগের কথা। নিমেষে মনে পড়ে গেল তাদের 'প্লে' -র এলেমদার ডিরেক্টর ছোকরার কথা। তার নামটা কি যেন ... বিভূতিবাবু আজকাল হামেশাই লোকজনের নাম টাম ভুলে যান। স্মৃতিযন্ত্রে বয়সের মরচে পড়ছে।
    যতক্ষণ না নামটা ঠিকঠাক মনে পড়ছে একটা অস্বস্তি সুড়সুড়ি দিতে থাকে মাথার মধ্যে।
    শ্রীলেখা দেখল, বিভূতিবাবু জলকাটা চোখে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন তার দিকে।
    শ্রীলেখা তাড়াতাড়ি খাটের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, ' ভাল আছেন জেঠু ? '
    স্মৃতিসমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া বিভূতিবাবু সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে বললেন, ' ওর নামটা কি যেন ? '
    --- ' কার নাম জেঠু ? '
    --- ' ওই যে আমাদের থিয়েটারের রিহার্সাল করাতো... ডিরেক্টর ছেলেটা ... '
    শ্রীলেখা মাথা নীচু করে অস্পষ্ট স্বরে বলল, ' ও ... '
    বিভূতিবাবু অধৈর্য স্বরে আবার বললেন, ' হ্যাঁ ... কি যেন নামটা ... '
    শ্রীলেখা আবার অস্পষ্ট স্বরে বলল, ' অসিত ... '
    বিভূতিবাবুর যেন দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি ঘটল।
    তিনি সোৎসাহে বললেন, ' হ্যাঁ হ্যাঁ ... ঠিক ঠিক ... অসিত অসিত ... ওঃ মুন্সীয়ানা ছিল বটে ছোকরার... এটা মানতেই হবে ... '
    তিনি স্মৃতি সমুদ্রে সাঁতার কাটতে লাগলেন আবার।
    তিনি শ্রীলেখার দিকে তাকিয়ে মহা উৎসাহে বললেন, ' তোর মনে আছে তো ছেলেটাকে ... সেই যে আমাদের নাটকের ডিরেক্টর... '
    শ্রীলেখা আবার স্পষ্ট স্মৃতি অস্পষ্ট স্বরে পেশ করল --- ' হ্যাঁ জেঠু ... মনে আছে ... '

    ( চলবে )

    ****
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে প্রতিক্রিয়া দিন