১
লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ার পর মনে পড়ল, রুম নম্বর জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গেছি। আই সি ইউ, থার্ড ফ্লোর, ব্যস। একবার ভাবলাম নেমে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে আসি। ভাগ্যিস নামিনি। লিফট থেকে নেমে যত এগোলাম, ফিনাইল আর স্যানিটাইজার ফিকে হয়ে ফুলের গন্ধ জোরালো হল।
মার্বেলের মেঝেতে ঘড়ঘড়ানি তুলে স্ট্রেচার আসছে উল্টোদিক থেকে। স্ট্রেচারে একটা বুড়ো, চোখ বোজা, হাতে স্যালাইনের সূচ। ফুলের গন্ধের সঙ্গে এখন পারফিউম। রাঙাকাকিমার অট্টহাসি। আনমিস্টেকেবল। এই বয়সে শোধরানো কঠিন। কিন্তু আনন্দানুষ্ঠানে রাঙাকাকিমার মতো কেউ না থাকলে জমে না। আর আজ আনন্দের দিন।
বাঁদিকে ঘুরলাম। দরজা-ওপচানো ভিড়ের সীমান্তে উঁকিঝুঁকিরত জিষ্ণু। ওর নতুন কোলাপুরির নিচে আলপনা।
'ছোড়দা!' বুলটির গলা উলু ছাপিয়ে। নিমরাজি ভিড় ঠেলে ঢুকছি বাড়ির লোকদের ইনার সার্কেলে। শাঁখে ফুঁ দিচ্ছে রাঙাকাকিমা। বাঁ গালের ঘা বিস্ফারিত। ঘামে, মেক আপে দগদগে। মায়ের চিবুক তোলা মুখ। হাত হাওয়া হাতড়াচ্ছে আমার হাতের খোঁজে। মায়ের হাত হাতে নিই।
‘মারাত্মক মাঞ্জা দিয়েছ তো।’
'কোন পাঞ্জাবীটা পরেছিস?'
'আকাশি রঙেরটা।’
মা আমার বুকে হাত বোলায়। ‘মিন্টিকে কেমন সাজিয়েছে রে?'
‘কেন, পছন্দ না হলে বাতিল করবে বুঝি? টু লেট, মা।’
‘ধুৎ। বল না।'
যমজ সন্তানদের মধ্যে টেলিপ্যাথিক টানের ব্যাপারটা সত্যি মনে হয়। না হলে হট্টগোলের মধ্যে আমি তাকানোমাত্র মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল কী করে বুবুল? ডিজাইনার ধুতিপাঞ্জাবী, কপালে চন্দনের টিপ, চোখমুখ চকচকে। নার্ভাসনেসে, খুশিতেও নিশ্চয়। আমাদের বিয়ের দিন আমাকে এ রকম দেখতে লাগবে তার মানে। হুম্ম্।
জীবনপুরুত মন্ত্র পড়ছে। আমার আর বুবুলের মুখেভাতের ছবির থেকে একটা চুলও এক্সট্রা পাকেনি, একটা বলিরেখাও বাড়তি গজায়নি। ভুঁড়ি, পৈতে, গোঁফ, টাক যেমন কে তেমন। হ্যান্ডেলওয়ালা ইউ এফ ও-র মতো একটা জিনিস গুঁজে দিচ্ছে বুবুনের হাতে।
পেছন থেকে ধাক্কা। মাকে সামলাই। মাথার ওপর গামবাট ক্যামেরা তুলে ধরে এগোনোর চেষ্টা করছে বেঁটে ফোটোগ্রাফার। ঘর্মাক্ত মুখেচোখে বিরক্তি। জায়গাটা সত্যি কাজ করার পক্ষে বড় কম।
বুবুল চাকা গড়িয়ে দিল মিন্টির কপালে। ফ্ল্যাশলাইট ঝলসে উঠল, উলু ছিটকে উঠল, শাঁখ গর্জে উঠল। লালে লাল হয়ে গেল মিন্টির সিঁথি, কপাল, বোজা চোখের পাতা। গয়না, গোলাপে মোড়া নিঃসাড় শরীর।।
বুকের ভেতরটা কেমন করে। তোমাকে কবে এ সাজে দেখব, ক্রান্তি?
মায়ের কানে কানে মিন্টির বর্ণনা দিই। মায়ের চোখের কোটর ছাপিয়ে জল গড়ায়। জীবন বুবুলের হাত মিন্টির ন্যাতানো হাতে বাঁধে, অংবংচং মন্ত্র পড়ে, খোলে। হুইলচেয়ারে বসা জেঠিমার কোলের ঝুড়ি থেকে গোড়ের মালা বুবুলের হাতে তুলে দেয় রাঙাকাকিমা। মিন্টির বুকের ওপর সে মালা পাতা, বুবুলের গলায় ফেরত পরানোর গোটা প্রক্রিয়াটায় জীবন আর রাঙাকাকিমা মিলে মিন্টির হাত ছুঁইয়ে রাখে মালায়। জিষ্ণুর সিটিতে ভিড় হেসে ওঠে, বুল্টি পিংপং বলের মতো লাফায়।
জীবন ইশারা করে। যতটুকু সম্ভব, হয়ে গেছে। বেশি কিছু সম্ভব হল না। সাতপাক হল না। শুভদৃষ্টি হল না। অন্তত কোমাটা কাটুক, বলেছিল অনেকেই। আমারও মত তাই ছিল, কিন্তু তুমি জান, রাদার এখনও জান না, জানবে একসময়, আমি বাড়ির কথাবার্তায় যথাসম্ভব কম থাকার চেষ্টা করি। তাছাড়া বুবুল গোঁ ধরেছিল এখনই বিয়ে করবে। সেক্ষেত্রে উল্টো মতামত প্রকাশের প্রশ্ন নেই। কাজেই এই নাম কা ওয়াস্তে বিয়ে। যজ্ঞের আগুনও জ্বালাতে দিতে রাজি হচ্ছিলেন না প্রথমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সমস্ত সাবধানতা অবলম্বন করার মুচলেকা বারংবার দেওয়া সত্ত্বেও। শেষে আশ্রম থেকে ফোন করাতে হল। গুরুদেব নিজে কথা বললেন। বিয়ের পর যখন দীক্ষা হবে তোমার, দেখবে সামনে থেকেও সমান ম্যাগনেটিক। সমান পাওয়ারফুল।
সিনে না থাকলেও গুরুদেব কী বলেছিলেন আন্দাজ করতে পারি।
বিজ্ঞান বিজ্ঞানের জায়গায় থাকবে, ধর্ম ধর্মের জায়গায়। দুটোর মধ্যে আসলে তো কোনও বিরোধ নেই, ম্যাডাম। আপনি ঘটাতে চাইছেন কেন? তাছাড়া যজ্ঞ হলে অন্য রোগীদেরও মঙ্গল হবে। নার্সিংহোমের সামগ্রিক কল্যাণ। না করবেন না।
কেমন করে বলেছিলেন সেটাও কল্পনা করতে পারি। যেমনভাবে চ্যানেলে ইন্টারভিউ দেন। গলা তোলেন না। হাসি মোছেন না। জরুরি বাক্যগুলোর শেষে অল্প বিরতি নেন। হাসি মোছে না। পেশী নড়ে না। শুধু আদেশ অগ্রাহ্য করার পরিণামের আভাস বাতাসে ভাসতে থাকে।
ভিড় বেরোচ্ছে ঘর থেকে। লেহেঙ্গার ওড়না সামলাতে সামলাতে হাত ধরে টানছে বুল্টি। মিন্টির মাথার পাশে কনুইয়ে ভর দিয়ে বসেছে বুবুল, জিষ্ণু ফোন তুলেছে আকাশের দিকে, ঘাড় ঝুঁকিয়ে ফ্রেমের ভেতরে ঢুকছি। বুল্টি চেঁচাচ্ছে, ওয়ান সেক! পাজামাপাঞ্জাবি গায়ে বছর দশেকের ন্যাড়ামুণ্ডি বালক, দরজার পাশে সিঁটিয়ে। সবিতার ছেলে। বুল্টির আহ্বানে দাঁতের ফোঁকর উন্মুক্ত করে এগিয়ে আসছে। ছেলেটাকে টেনে নিয়ে দুকাঁধের দুপাশ দিয়ে ঝুলিয়ে দিই, হাতদুটোর হিল্লে হয়। বুল্টি চেঁচায়, সে চিইইইইইজ, জিষ্ণু বলে, সে মানিইইইইই।
সম্মিলিত অট্টহাসির মধ্যে মিন্টি চোখ বুজে শুয়ে থাকে।
মিন্টির জায়গায় একদিন তুমি থাকবে, ক্রান্তি। না না, মিন্টির জায়গায় নয়। কী সব ভাবছি। সাজানো কোনও হলে বা বাড়িরই একটা ঘরে, মেবি তিনতলার ঘরটায় - যেটার দরজার ফ্রেমে আমার আর বুবুলের লম্বা হওয়ার কম্পিটিশনের খাঁজ কাটা, দেওয়ালে পাঞ্জার ছাপ, ক্রাফট প্রোজেক্টের ল্যাজওয়ালা ফানুস - জানালার দিকে মুখ করে আমরা দাঁড়াব। আলো এসে ভাসিয়ে নেবে আমাদের। আমি ধুতিপাঞ্জাবী, তুমি বেনারসী, আমাদের ঘিরে বুবুল, জিষ্ণু, বুল্টি, সবিতার ছেলে, সিংহবাড়ির যত লতায়পাতায় ভাইবোনেরা, যাদের আই সি ইউ-র খুপরিতে আঁটানো গেল না বুবুলের তাড়াহুড়োর ঠেলায়, সকলের উল্লাসের ভেতর জিষ্ণুর ফোনের সেলফিতে আমিতুমি চিরদিনের মতো বন্দী হয়ে যাব। আমাদের ভালোবাসা চিরকালের মতো অমর হয়ে যাবে।
জীবন আর জীবনের সহকারী জিনিসপত্র গুছোচ্ছে। সাহায্যের প্রস্তাব ছেলেটা হেসে প্রত্যাখ্যান করল। বুবুলের দিকে ফিরে ‘চল তাহলে?’ বলতে গিয়ে থমকালাম। বুবুল মিন্টিকে দেখছে।
আর আমার ভীষণ দুঃখ হল জান, ক্রান্তি, এমন দুঃখ যে ভয় হল কেঁদে না ফেলি বুবুলের সামনেই। মিন্টির কোমার জন্য না। মিন্টির জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিনটা যে এসে চলে গেল ওর অজ্ঞাতে, সে জন্যও না। কান্না পেল বুবুলের অমন দৃষ্টি মিন্টি দেখতে পেল না বলে। ও জানল না বুবুল ওর দিকে এমন করে তাকাতে পারে। বুবুল ওকে কতখানি ভালোবাসতে পারে মিন্টি জানল না।
তুমি জানো ক্রান্তি? আমি তোমাকে কতখানি ভালোবাসতে পারি?
মিন্টি। মাধুর্য মিত্র। আজ থেকে সিংহ। তোমাকে সামনাসামনি বলব না কক্ষনও, ডায়রিতে লিখছি। মিন্টিকে ভালোবাসতাম ছোটবেলায়। রাগ করলে না তো? এখন আর বাসি না, প্রমিস, গা ছুঁয়ে বলছি। বাসতাম। পাস্ট টেন্স। বা হয়তো ভালোবাসতাম না, ভালো লাগত। খেলতে যেতাম শুধু ওকে দেখতে পাব বলে। ছোট ছিলাম, মনে মনে ওটাকেই ভালোবাসা ভেবেছিলাম। যেদিন থেকে জানলাম বুবুলেরও মিন্টিকে পছন্দ, সরে এলাম। বুবুলের সঙ্গে কোনও প্রতিযোগিতাতেই পারিনি কোনওদিন, প্রেমেও পারতাম না। হারার আগেই সরে এসেছি।
তোমাকে যদি কেউ নিয়ে নিতে চায়, সরে আসব না। খুন করে ফেলব। তোমাকে রক্ষা করব। প্রাণ দিয়ে হলেও।
লিফটের মুখে কাকুকাকিমা বিদায়কালীন লৌকিকতা সারছেন। মিন্টির অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে এই প্রথম ওঁদের মুখে রিলিফ। বুবুল ছাড়া ওঁরাও বিয়েটা এখনই করিয়ে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। স্বাভাবিক। আইন অনুযায়ী বুবুল বিয়ে করতে বাধ্য; তবু আইনের ওপর ভরসা রাখতে পারে না সাধারণ মানুষ। আর কাকুকাকিমা সাধারণই। ভালোমানুষ, কিন্তু সাধারণ মানুষ। কাকু তথ্যসংস্কৃতি বিভাগে মাঝারি পদে আছেন। সিংহদের টাকাকড়ি, প্রতিপত্তি, কানেকশনের সঙ্গে তুলনাতেই আসেন না। বুবুল মিন্টিকে বিয়ে করতে অস্বীকার করলে বাবা বুবুলের পক্ষ নিতেন, আশ্রমে, পার্টি অফিসে ফোন যেত এবং বুবুলের গায়ে আঁচড়টি পড়ত না। সে সব যে কিছুই হয়নি, বুবুল যে নিজে থেকেই অনারেবল রাস্তা নিয়েছে সে জন্য কাকুকাকিমার রিলিফ বোধ করাই স্বাভাবিক।
আমাকে দেখে হাত নাড়ছেন কাকিমা। মিন্টি সুন্দর কিন্তু কাকিমার ধারে কাছে না। মুখের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া দাগটা সত্ত্বেও বোঝা যায় কাকিমা একসময় কী দেখতে ছিলেন। ইন ফ্যাক্ট, ওই দাগটা আরও বেশি করে মনে করায় কাকিমা কী দেখতে ছিলেন। যেমন মিন্টির নিষ্প্রাণ শুয়ে থাকা আরও বেশি করে মনে করাচ্ছে মিন্টি কত উচ্ছ্বল ছিল, মায়ের চোখের কোটর মনে করায় বাল্য, কৈশোরের প্রতিটি ছবিতে মায়ের চোখে কেমন কাজল টানা থাকত, রাঙাকাকিমার দগদগে গাল মনে করায় রাঙাকাকিমার ত্বক কী মোমের মতো হতে পারত।
প্রণাম করি। কাকিমা চিবুক ধরে চুমু খান। আলাপ করিয়ে দেব, দেখবে কী ভালো লোক কাকুকাকিমা। তোমাকে ওঁদের বাড়ি নিয়ে যাব। কাকিমা দারুণ রান্না করেন। কাকু হেসে হেসে বলেন, কেমন বুদ্ধি করে যা করার সব মুখের ওপর করেছি, হাতটা ভেঙে দিইনি। মিন্টিও খুব রসিয়ে কথা বলতে পারত। খেলার মাঠে, ক্লাসে ওর বলা জোকে কত হেসেছি। মিন্টি আর কোনওদিন জোক বলতে পারবে কি না কে জানে।
আশাহত হওয়ার এখনই কারণ নেই। গুরুজি বলেছেন, এই যে যজ্ঞ হল এর একটা পজিটিভ এফেক্ট থাকবে। তিনি নিজে আলাদা করে আশীর্বাদ পাঠিয়েছেন। তুমি হয়তো এ সবে বিশ্বাস কর না। আমি করি নাকি শিওর নই। শুধু মনে হয় বিশ্বাসঅবিশ্বাসের ক্ষেত্রে মন খোলা রাখা জরুরি। কীসে কী হয় কে বলতে পারে। তাছাড়া গোটাটাই যদি মনের শান্তির জন্য হয় তাতেও তো অসুবিধে নেই। ক্ষতি তো কিছু হচ্ছে না।
আমি চাই স্বস্ত্যয়নে কাজ দিক। গুরুদেবের আশীর্বাদ মির্যাকল ঘটাক। ভালো হয়ে উঠুক মিন্টি।
শোনো না, আই সি ইউ থেকে বেরোনোর সময় এক বয়স্ক মহিলার সঙ্গে প্রায় কলিশন হচ্ছিল। গায়ে ল্যাব কোট, গলায় স্টেথো, হাতে প্রেসক্রিপশনের ফাইল। নির্ঘাত মিন্টির ডাক্তার। যিনি যজ্ঞটজ্ঞ নিয়ে ঝাম দিয়েছিলেন। মুখটুখ দিব্যি অক্ষত। গলার বাঁদিকের গর্তটা আবিষ্কার করতে অভদ্রের মতো চার সেকেন্ড চোখ চালাতে হল। চারপাশের চামড়া কালো হয়ে কুঁচকে প্রায় বুজিয়ে দিয়েছে। উদ্বিগ্ন চোখমুখ। সম্ভবত অপেক্ষা করছিলেন ঘর খালি হওয়ার। পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে আসার উপক্রম করলেন, জীবন হাত তুলল, থমকে গেলেন। সেই সুযোগে ব্যাজে নামটা পড়ে নিলাম। মিসেস (ডঃ) লাবণ্য মজুমদার।
লটবহর নিয়ে জীবন আর জীবনের চ্যালা লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। আমি আর বুবুল সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম। গ্রাউন্ড ফ্লোরে প্রচুর সাজাগোজা মানুষ। বাতাসে আতর। চোখে সুর্মা। আজ অ্যাসিড ওয়ার্ডেও একটা নিকাহ্ আছে নাকি।
২
মাঝরাত পেরিয়েছে অনেকক্ষণ। বাড়ি পর্যন্ত আসা আত্মীয়প্রতিবেশী ফিরে গেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। রোজই থাকি। শহরের আলো নিভে এলে আকাশের গায়ে এরোপ্লেনদের খসে পড়া তারার মতো লাগে। পোড়া ডিজেল সরে গেলে কাঁঠালচাঁপারা ঘনায়। বড়রাস্তায় একটার সঙ্গে আরেকটা হর্নের ক্রমশ বেড়ে ওঠা দূরত্বের মাঝে আমপাতা বাতাসের আলাপচারিতা জমে।
সেই আঁধারে তুমি জ্বলজ্বল কর। নীরবতায় তোমার হাসি লুপে চালিয়ে শুনি। কাঁঠালচাঁপাকে গোহারা হারিয়ে তোমার গায়ের গন্ধ আমাকে ঘিরে ধরে।
ওয়েভলেংথটেংথ বাজে কথা। পৃথিবীর দুটো মানুষের মধ্যবর্তী টান আসলে একে অপরের শরীরনিঃসৃত ফেরোমোনের গন্ধের টান। পাড়ার দোকানের দেড়শোটাকার পারফিউমেরও না, শপিং মলের শ্যানেল নাম্বার ফাইভেরও না। একদিন বাসে করে তোমার ঠিক পেছনে, উল্টোদিক ফিরে দাঁড়িয়ে তোমার স্টপ অবধি গিয়েছিলাম। তোমার অত কাছাকাছি আগে কোনওদিন দাঁড়াইনি। আচমকা ব্রেকে পিঠ ঠেকে যাওয়ার সম্ভাবনায় সমস্ত স্নায়ু টানটান ছিল। ডিজেল, ঘাম, ক্লান্তি ছাপিয়ে শুধু তোমার গন্ধ। শরীরময় শুধু তোমার শরীরের আঁচ। যেন পিকটাইমের পঁয়তাল্লিশ নয়, রাত্রির জলে ভেসে ওঠা চরে আমিতুমি মুখোমুখি।
উল্টোদিকের জানালায় হলুদ আলো। ড্রেসিংটেবিলে বসা রাঙাকাকিমা। গালে আঙুল বোলাচ্ছে। আঙুলের ডগায় নীল নয়তো সবুজ টিউবের ক্রিম। যার অ্যাসিডক্ষত - যত পুরোনোই হোক না কেন - মসৃণ করে দেওয়ার ক্ষমতার দাবিসম্বলিত ব্যানার পড়েছে শহরের মোড়ে মোড়ে, হাইরাইজের মাথায় মাথায়। যা কি না তৈরি হয়েছে হিমালয়ের অভ্যন্তরে সনাতন ল্যাবরেটরিতে বিস্মৃত শিকড়বাকড় দিয়ে। মিনিস্ট্রি অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের রিপোর্ট অনুযায়ী গত দু’দশক ধরে অ্যাসিডের দাগ মেলানোর ক্রিম টার্ন ওভারে ফেয়ারনেস ক্রিমকে হারাচ্ছে। সত্যি সত্যি অ্যাসিডের দাগ মেলায় কি না সে নিয়ে অবশ্য সংশয় আছে। রাঙাকাকিমা নিজেই বলে, ‘সব চিটিংবাজি। কত দেখলাম।‘ কিন্তু টিভিতে নতুন ক্রিমের অ্যাড আসার দিনদুয়েকের মধ্যে সবিতা চটি ফটফটিয়ে বাজার করতে বেরোলে ওর আঁচলের খুঁটে বাঁধা ফর্দর নিচে রাঙাকাকিমার গোটা গোটা হাতের লেখায় সে ক্রিমের নাম থাকে।
রঙ্গিলা, রঙ্গিলা, রঙ্গিলা রে।
মায়ের ঘর থেকে শচীন দেব বর্মণের খোনাগলা অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে। মায়ের ঘরে ড্রেসিংটেবিল অবান্তর। মা বসে খাটের ওপর ওষুধের বাক্স মেলে। অভ্যস্ত আঙুলে খোপ থেকে ছোট শিশি নিয়ে তুলোর ওপর কাত করেই সোজা করে নেয়। চেপে চেপে কোটরের পুঁজ মোছে।
রঙ্গিলা রঙ্গিলা রঙ্গিলা রে, রঙ্গিলা। আমারে ছাড়িয়া রে বন্ধু কই গেলা রে।
আমার রঙ্গিলা, কী করছ তুমি? নিজেকে দেখছ আয়নার সামনে বসে? চোখের কোল থেকে কাজল মুছে নিচ্ছ? ঠোঁট টিপে ধপধপে ক্রিমের টিপ পরছ কপালে, গালে, গলায়?
ক্যাঁচকোচ, ক্যাঁচকোচ।
জেঠিমার হুইলচেয়ার ঘুরছে। এটা তুলছে, ওটা সরাচ্ছে। গোলাপকাঠের আলমারিটার সামনে থামছে। ‘পালকির দরকার কী ছিল, আলমারিতে পুরে পাঠালেই পারত,’ ঠাকুরদার ঠাকুরদার পুঁটলিমার্কা পাঁচবছরের বউকে বরণ করতে করতে নাকি বলেছিল শ্বশুরবাড়ির লোকজন। ডানদিকের তিন নম্বর ড্রয়ার থেকে অ্যালবাম বেরোচ্ছে। হুইলচেয়ার এগোচ্ছে সেই প্রাচীন বালিকারই তত্ত্বে আসা পালংকের দিকে, বর্মাদেশের কোনও অরণ্যের মহাসেগুন প্রাণ দিয়েছে যার জন্য। জেঠিমাকে চাগিয়ে সবিতা তুলে দিচ্ছে বিছানায়। শ্বাসের একমুহূর্তের রুদ্ধ হওয়া ছাড়া সবিতার আর কোনও বিচলন ঘটছে না। জেঠিমা পালকের মতো, সবিতাও খ্যাংরাকাঠিই। সব প্র্যাকটিস। সবুজ রিডিং ল্যাম্প বাদে সব আলো নিভিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সবিতা। লালচামড়া বাঁধাই অ্যালবাম উন্মোচিত হচ্ছে।
অ্যালবামে আমাদের কারও ছবি নেই। আমার না, বুবুলের না, জিষ্ণুর না, বাবা, রাঙাকাকা - কারও না। এ অ্যালবাম সিংহবাড়ির মেয়েদের পূর্বাশ্রমের। যখন সবার মুখশ্রী মসৃণ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অটুট। চেনা লোক শুরু হতে হতে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ পাতা। বাবার ঠাকুমা শোভনাসুন্দরী দেব্যা, ডাকনাম সন্দেশ। গোল গোল চোখ, মোটা মোটা গাল। টুলে বসা পা দুলছে হাওয়ায়। প্রথমবার ছবিটা দেখে নাকি বলেছিলাম এই মেয়েটাকে বিয়ে করব। যখন শুনলাম ছবিটা শোভনাসুন্দরীর, বিশ্বাস করিনি। আজন্ম দেখেছি মহিলার সাতকাল গিয়ে এককালে, চোয়াল বাকি মুখের থেকে আলগা। সে ঝুলন্ত চোয়াল নেড়ে খনখন হাসলে প্রতিবেশী বাচ্চারা কেঁদে ওঠে। র, ল, ত, চ-রা ভাঙা চোয়ালের গোলকধাঁধায় পথ হারায়। অনভ্যস্ত অতিথিরা দেখা করতে এসে অস্বস্তিময় হেসে দাঁড়িয়ে থাকেন, আমরা এদিকওদিক থেকে দেব্যার বক্তব্য রিপিট করে দিই।
কিন্তু গল্পরা স্রোতের মতো বয়। দুষ্টু মন্ত্রী খিড়কিদুয়ার খুলে দেয়, হু হু করে রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়ে শত্রুরাজ্যের সেনা, পশুশালার খড়ের গাদায় উড়ে এসে পড়ে জ্বলন্ত মশাল, দেখতে দেখতে আগুন প্রাসাদের দেওয়াল বেয়ে দাউদাউ, পালংকে ঘুমন্ত রাজকন্যা ছাই হয় হয়, মোমবাতির আলোয় দেওয়ালে ছায়ারা কাঁপে, আমরা ঘেঁষে ঘেঁষে বসি।
সাতসাগর পারের রাজপুত্র সদাগরপুত্র যখন শেষমেশ রাক্ষসদের মেরে ভাগিয়ে, সোনার কাঠি ছুঁইয়ে রাজকন্যার ঘুম ভাঙিয়ে, মন্ত্রী আর দুষ্টু রানিকে শূলে চড়িয়ে ঘাম মুছছে, শ্রোতাদের অর্ধেক অচেতন, অর্ধেকের চোখের পাতায় বাটখারা, কেউ না কেউ বলে ওঠে, ডাইনি বুড়িটার কী হল?
ডাইনিবুড়ির শনের মতো চুল, ঈগলের মতো নাক, ভাঙা চোয়াল। একটা জঙ্গলে সে থাকে আরও অনেক ডাইনির সঙ্গে। তাদের কারও শরীরময় সিগারেটের ছ্যাঁকা, কারও অর্ধেক মুখ অ্যাসিডে গলে গেছে। চোয়ালভাঙা ডাইনি এই পচাগলা ডাইনি সাম্রাজ্যের রানি। বুদ্ধিবলে তো বটেই, অভিজ্ঞতাবলেও। পূর্বাশ্রমেও আমাদের ডাইনি রানি ছিল। আলমারিভর্তি শাড়ি, লকারভর্তি গয়না, বাড়িভর্তি দাসদাসী ছিল। তারা রানির চানের জলে অগরু ঢালত, চুলে বিলি কেটে দিত ধূপের ধোঁয়া, একজন ডান একজন বাঁ হাত মালিশ করে দিত।
এই জায়গায় এসে দেব্যা দু’হাত বাড়িয়ে দিতেন, জাগ্রত শ্রোতাদের দু’জন হাই চাপতে চাপতে তাঁর দুই হাত মালিশ করতে লাগত। চোয়াল আবার নড়ে উঠত। রানিকে কুটো ভেঙে দুটো করতে হত না। উড়ে বামুন রান্নাবান্না করত, দাসদাসীরা রাজার সামনে পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়ে দিত। রাজার কেবল একটি আবদার ছিল, খাওয়ার সময় রানিকে সামনে বসে থাকতে হবে। রানি গ্ল্যাডলি সে আবদার রাখতেন, ঝমঝমিয়ে রাজার সামনে এসে বসতেন এবং ‘মাথা খাও মাছের মুড়োটা না খেয়ে উঠো না’ ইত্যাদি মনোরম ভাষ্যে রাজার মন ভালো রাখতেন।
একদিন ভুল হয়ে গেল। রানির না। রাঁধুনিবামুন আর আর্দালির কোঅর্ডিনেশনের। খেতে বসে রাজামশাই আবিষ্কার করলেন ডালের বাটি ঠাণ্ডা। তেমন তেমন নিড়বিড়ে রাজা হলে ওই রুম টেম্পারেচার ডালই ভাতে ঢেলে খেয়ে নিতেন – কল্পনা করেও শোভনা দেব্যার ঠোঁটের কোণ বক্র হত - কিন্তু আমাদের রানির রাজা সে রকম ছিলেন না।
প্রতাপশালী প্রতাপবিক্রমের হাত ঠাণ্ডা ডালের বাটিতে পড়ল যেই, বাটি উড়াল নিল। কক্ষপথ থেকে দাসদাসীরা ঠিক সময়ে ছিটকে গেল, রানি গুনগুন করতে করতে সাতলহরী হার আঙুলে প্যাঁচাচ্ছিলেন, যথাসময়ে মাথা সরাতে ব্যর্থ হলেন, কাঁসার জামবাটি রানির চোয়াল ছুঁল। কড়াৎ। হাড় এবং বাটির সংযোগের সেই কড়াৎ গোটা রাজ্যে কিংবদন্তীতে পরিণত হল। বাটির ডাল দশচক্রে এ পাড়ায় মোচার ঘণ্ট ও পাড়ায় পাঁঠার ঝোল হল, সকালবেলায় রাজামশাই মাতাল হলেন বিকেলবেলায় রানি ব্যভিচারিণী, খালি কড়াৎ রয়ে গেল অব্যয় অক্ষয়।
পাতাবাটাটাটা দিয়ে রানির চোয়াল মুড়ে দিয়ে গেলেন কবিরাজমশাই। কিন্তু সে আর আগের মতো হল না। রানির রানিত্ব ঘুচে ডাইনিত্বে অভিষেক হল। যথাসময়ে ন্যাতাকানি পরিয়ে জঙ্গলে ছেড়ে আসা হল।
ডাইনির দুঃখ হল? ততদিনে চোয়ালভাঙা ডাইনির প্রতি মায়া জন্মেছিল। যেন সে নিজেদেরই লোক। তার দুঃখ হলে যেন আমাদেরও দুঃখ হবে। চোয়াল ভাঙে ভাঙুক, মন যেন না ভাঙে।
শোভনাসুন্দরী দেব্যার অষ্টাবক্র মুখে হাসির জ্যোৎস্না ফুটত। হয়েছিল। রানিগিরি হারানোর দুঃখ, রূপ যাওয়ার শোক, আর কখনও কারও কামনার ধন হয়ে উঠতে না পারার আতংক। চব্বিশঘণ্টা চোখের জল পড়ত। কিন্তু চোখের জলের সুবিধে হচ্ছে একটা সময় ফুরিয়ে যায়। তখন কাঁদতে গেলে শুকনো চোখ চড়বড় করে, সে বড় যন্ত্রণা। তারপর একদিন ঘুম ভেঙে আর কান্না পায় না। খিদে পায়, তেষ্টা পায়। হাসি, রাগ, হিংসে সব হইহই করে পায়। কান্না পায় না। এবং রানি আবিষ্কার করেন, চোখ মটকে দাবি করতেন দেব্য্যা, ডাইনিবুড়ির জীবন রানিসাজা জীবনের থেকে অনেক বেশি ফুর্তির।
৩
আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে ঘরে এসেছি। ডাইরি টেবিলের ওপর খোলা। মা এসেছিল। মা যে দেখতে পাবে না, মনে পড়ল ঘরে ঢোকার পর। মায়ের আসার কোনও কারণ নেই। তবু রোজ আসে। জগে জল ভরা আছে কি না, অল আউট জ্বালানো হয়েছে কি না, মশারি টাঙানো হয়েছে কি না।
মনে পড়েছে। গলার ফুটো। তোমার মনে থাকার কথা নয়, আমারও জন্মের আগে। মারাত্মক হইচই হয়েছিল। লাবণ্য মজুমদার, তখন অন্য কিছ ছিল নিশ্চয়, সদ্য ডাক্তারি পাস করে ইন্টার্নশিপ করতে ঢুকেছিল সেন্ট্রাল কলকাতার এক হাসপাতালে। হাসপাতালের এক ক্লাস ফোর স্টাফ মহিলার প্রেমে পড়ে। পড়ে মানে হাবুডুবু। বিয়ে করতে চায়। পুলিস বন্ধুর সার্ভিস রিভলবার চুরি করে লোকটি লাবণ্যকে প্রোপোজ করতে যায়। লাবণ্য প্রত্যাখ্যান করে। লোকটি গুলি চালায়।
ভয় দেখিয়ে প্রেম বা বিয়ের সম্মতি আদায় করার অংশটুকু নিয়ে কেউ ভুরু তোলেনি, কারণ তার অনেক আগে আদালতের রায় বেরিয়ে গেছে। ধর্ষণ বা অন্য কোনও জোরাজুরি করতে গিয়ে মহিলার শারীরিক ক্ষতিসাধন হলে দোষী পুরুষটির মহিলাটিকে বিয়ে করা বাধ্যতামূলক। না হলে জরিমানা এবং দীর্ঘ সশ্রম কারাদণ্ড। আইনের উদ্দেশ্য ছিল লাঞ্ছনাপরবর্তী একঘরে হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সামাজিক অপমানের হাত থেকে বাঁচিয়ে মহিলাটিকে মর্যাদাপূর্ণ জীবনের সুযোগ দেওয়া, কিন্তু যে কোনও জরুরি রায়ের মতো এ আইনেরও কিছু ইন্টারেস্টিং স্পিলওভার এফেক্ট গজায়।
যার মধ্যে প্রধান হচ্ছে বিয়ে বা প্রেমের প্রোপোজাল দিতে গিয়ে ভয় দেখানোর ব্যবহার। পাত্রী সোজা কথায় ঘাড় না পাতলে শাসানো যে এবার তার শারীরিক ক্ষতিসাধন করা হবে এবং করলেই বিয়েটা আর অপশন থাকবে না, বাধ্যতামূলক হয়ে যাবে। পরিবারের, সমাজের, সর্বোপরি আইনের আশীর্বাদ নিয়ে হইহই করে বিয়ে হয়ে যাবে। আর যদি বিয়ে হয়েই যায় তাহলে খোঁড়া, কালা, অন্ধ বউ হয়ে জীবন কাটানোর থেকে পূর্ণাঙ্গ শরীরওয়ালা স্ত্রী হয়ে থাকাই বুদ্ধিমানের না?
লাবণ্য মজুমদারের কেসে হইচই হয়েছিল অন্য কারণে। ভয় দেখানোটা ততদিন পর্যন্ত মূলত চড়চাপাটি, লাথিঘুঁষি, বড়জোর ছোরাছুরিতেই সীমাবদ্ধ থাকত। রড, চেন এত জলভাত হয়ে ওঠেনি। রাঙাকাকুর মতো হাতে গোনা ডাকাবুকোরা অ্যাসিডফ্যাসিড নিয়ে যেত। সে জায়গায় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রোপোজ করতে যাওয়া এবং সে অস্ত্র ব্যবহার করা মানে প্রাণে মেরে ফেলার উদ্দেশ্য নিয়ে যাওয়া। তাহলে এটা শারীরিক লাঞ্ছনার বদলে অ্যাটেম্পটেড খুন বলে গণ্য হবে না কেন বলে গোল তুলেছিল ইউজুয়াল সাসপেক্টসরা।
দুটো কারণে তাদের পালে হাওয়া কম পড়ে। এক, মোটিভ। লাবণ্য মরে গেলে লোকটার আর্থিক বা সামাজিক কোনও লাভ নেই। হ্যাঁ, প্রতিহিংসা মোটিভ হতে পারে। কিন্তু মেসের সহবাসী, হাসপাতালের সহকর্মীরা সাক্ষ্য দেয় যে লোকটার মনে লাবণ্যর প্রতি প্রেমই ছিল, প্রতিহিংসা নয়। লোকটা রোজ নেশা করে লাবণ্যর নাম ধরে কাঁদত। একবার ঠাকুরের আসনে লাবণ্যর ছবি রেখে পুজোও করেছিল নাকি।
লোকটা নিজে দাবি করে খুন নয়, লাবণ্যকে স্রেফ ভয় দেখানোই তার উদ্দেশ্য ছিল।
তাহলে গলা লক্ষ করে গুলি চালিয়েছিলে কেন? নিরাপদতর প্রত্যঙ্গ যেমন গোড়ালি লক্ষ করে কেন চালাওনি?
অশ্রুসজল চোখে লোকটা স্বীকার করে যে লাবণ্য প্রত্যাখ্যান করলে লাবণ্যকে খুন করে আত্মহত্যা করার প্ল্যান ছিল তার। সে কান্নাভেজা মুখের ছবি টিভি, কাগজ, সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখে, লোকটার স্বীকারোক্তি শুনে, পড়ে, জনমানসে আলোড়ন জাগে। গুরুদেব ন্যাশনাল টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দেন। দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা করেন, প্রেমের জন্য যে অন্যের প্রাণ নিতে এবং নিজের প্রাণ দিতে রাজি, অভিপ্রায়ের পবিত্রতা প্রমাণের দায় সে অতিক্রম করেছে।
ভ্যালেন্টাইন’স ডে-র মোকাবিলায় চালু হওয়া মদনরতি দিবসের আশেপাশে বাজার ভরে যায় পোস্টারে, দেখেছ? ‘ক্ষতচিহ্ন নয়, আঘাতের আড়ালের ভালোবাসাই আমার অলংকার’ জাতীয় কোটেশনে ভর্তি? সব ওই সময়ের গুরুদেবের ভাইরাল বক্তৃতার প্যারাফ্রেজ। সেন্টিমেন্ট গভীর হলেও পোস্টারগুলো হাস্যকর। গোধূলির আকাশে উড়ে যাওয়া বকের সারিতে নারীর মুখের সিল্যুএট। বুল্টির পড়ার টেবিলের ওপর সাঁটা আছে একটা।
তবু প্রশ্নটা থেকেই যায়। লোকটা মিথ্যেও তো বলতে পারে। ব্যাকগ্রাউন্ড, শিক্ষাদীক্ষা সুবিধের নয়। ভাংচুর, গুণ্ডামোর পুলিস রেকর্ড আছে। বিশ্বাসযোগ্য বা সৎ কোনওটাই লোকটাকে বলা যাবে না। আর ঠিক এই দোলাচলে লাবণ্য মজুমদারের কেসটা ভারতীয় বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে ল্যান্ডমার্ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
রাজনৈতিক, সামাজিক বা আইনি ইস্যুতে অচলাবস্থার উদয় হলে অনেক ক্ষেত্রেই যে রাস্তাটা আজকাল প্রথম নেওয়া হয়, একটা গণতান্ত্রিক দেশে প্রথম বা শেষের বদলে যেটা একমাত্র রাস্তা হওয়া উচিত বলে নাগরিকদের ক্রমবর্ধমান অনুপাত বিশ্বাস করছে, সেটার গোড়ার দিকের অন্যতম সফল কেস স্টাডি এই লাবণ্য মজুমদার নিগ্রহ।
গণভোট।
ভারতবর্ষের যাবতীয় প্রিন্ট, অডিও, ভিস্যুয়াল এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে ভোট নেওয়া হয়। বাড়ি বাড়ি প্রশ্নপত্র নিয়ে পৌঁছয় সরকারি এবং বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবকের দল। প্রশ্নের ফরম্যাটটা মোটের ওপর হয় এই রকম।
বন্দুক নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে যাওয়ার পেছনে ছেলেটির উদ্দেশ্য ছিল -
ক) লাবণ্যকে খুন করা
খ) প্রত্যাখ্যাত হলে লাবণ্যকে খুন করে আত্মঘাতী হওয়া
সাতানব্বই দশমিক ছয় সাত শতাংশ ভোট পায় খ। অ্যাটেম্পটেড খুনের অভিযোগ থেকে লোকটি মুক্তি পায়। লাবণ্যকে বিয়ে করে আইনানুগ খালাস পায়। হ্যারাসমেন্টের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ফান্ডরেইজার আয়োজন করে দেশের বিবিধ সমাজসেবী সংস্থা এবং নাগরিক মঞ্চ। আশ্রম থেকেও সংবর্ধনা দেওয়া হয়, টাকা তোলা হয়। মিডিয়া কভার করে কী অক্লান্ত অহোরাত্র সেবায় লোকটি লাবণ্যকে সুস্থতায় ফিরিয়ে আনে। লাবণ্যকে আবার ডাক্তারি করার অনুমতি দেয়। ওই একই হাসপাতালে যেখানে সে নিজে ক্লাস ফোর স্টাফ হিসেবে কর্মরত। ভাবতে পার? আমার চেনা আচ্ছা আচ্ছা প্রগতিশীল পুরুষ, যাদের মধ্যে কেউ কেউ এখনও প্রকাশ্যে নিজেদের নারীবাদী দাগানোর স্পর্ধা করে, এ সাহস দেখাতে পারবে না। সে জায়গায় ওই ক্লাসের লোকের কাছে, ফ্র্যাংকলি, এ আচরণ আশাতীত।
লাবণ্য মজুমদারের কেসটা নিয়ে একটা বই আমাদের বাড়িতে আছে। বেশিরভাগটাই গণহুলাবিলা ও মিডিয়া সার্কাসের বিবরণ। কিছুটা সমকালীন পত্রপত্রিকা, সেমিনারে সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও আইনে লাবণ্য মজুমদারের কেসের আশু এবং সুদূরবর্তী প্রভাব নিয়ে ডিসকোর্স।
গোটা বইটার সবথেকে ইন্টারেস্টিং প্রবন্ধে, লেখকের নাম ভুলে গেছি, দুটো বেসিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছিল। যাবতীয় ক্রাইসিসের অন্তে, সমস্ত তত্ত্ব, চাপানউতোর ফুরিয়ে গেলে যে প্রশ্নদুটো পড়ে থাকে।
ঘটনাটা ঘটল কেন? এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত?
লেখকের হাইপোথেসিস ছিল লোকটা যদি এমন কোনও মেয়েকে প্রোপোজ করতে যেত যার সঙ্গে সে কলোনির মাঠে খেলেধুলে কিংবা প্রাইমারি স্কুলে একসঙ্গে পড়ে বড় হয়েছে, সম্ভবত একটা তেলমাখানো ডাণ্ডা নিয়ে যেত, বড়জোর একটা মাংস কাটার ছুরি। লাবণ্যর ডাক্তার হওয়ার সঙ্গে নিজের স্ট্রেচারবাহক হওয়ার অনতিক্রম্য ফারাকটা লোকটার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের বাড়াবাড়িরকম খামতির জন্ম দেয়। যা তাকে চরমপন্থা গ্রহণে প্রণোদিত করে।
পুরুষের আত্মবিশ্বাসের খামতিজাত হতাশা থেকে নারীদের রক্ষা করতে, তাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই, নারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং পেশাজনিত প্রতিষ্ঠার মাত্রা বেঁধে দেওয়া উচিত কি না, ভেবে দেখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন লেখক।
আমি জানি তুমি পি এইচ ডি-তে এনরোল করার কথা ভাবছ। আমার আপত্তি নেই। শিক্ষিত, অ্যাম্বিশাস মেয়েদের আমি পছন্দ করি। বিউটি উইদাউট ব্রেনস আমাকে টানে না। বুবুলকে টানে। ওর শেষমেশ মিন্টিকেই বিয়ে করার সিদ্ধান্তে আমি অবাকই হয়েছিলাম। কারণ বুবুলের রুচি, শিল্পসাহিত্য হোক বা নারীসংক্রান্ত, চড়া। ক্যাটকেটে। হি ইজ নট সেরিব্রাল।
আমার বক্তব্য একটাই। একজন সেভেন্থ ইয়ার ডক্টরাল ক্যানডিডেট হিসেবে এ জীবনের চাপ আমি জানি। আমি যে স্ট্রাগলটার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি সেটার মধ্যে দিয়ে তুমি যাও আমার ইচ্ছে না। কী দরকার ক্রান্তি? আমি তো আছি। তুমি পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করবে, জেঠিমা, মা, রাঙাকাকিমার সঙ্গে সিংহবাড়ির অন্দরে রাজত্ব করবে। তাছাড়া পি এইচ ডি করলে সেটা কাজে লাগানোর জন্য আবার চাকরি করতে ইচ্ছে করবে। করাই উচিত। এত কষ্টের ডিগ্রি নষ্ট করার মানে হয় না। কিন্তু তোমার নিশ্চয় বাচ্চারও ইচ্ছে হবে। মেয়েদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, মা হওয়ার বয়স এবং প্রজননক্ষমতার সম্পর্ক নিয়ে ইদানীং গ্রাউন্ডব্রেকিং কাজ হচ্ছে। চাইলে কয়েকটা পেপার ফরওয়ার্ড করতে পারি। ইন ফ্যাক্ট, আমার কাজটাও এর কাছাকাছি বিষয় নিয়ে। কোনওদিন বিশদে বলব।
গ্যারেজে গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে। বাবা বেরোচ্ছে। জেঠু, রাঙাকাকা আগেই বেরিয়ে গেছে। বুল্টুও বেরোবে আর একটু বাদে।
ঘরভর্তি অন্ধ, ল্যাংড়া, অ্যাসিডপোড়া সহধর্মিণীদের সম্মান ও সৌজন্য প্রদর্শন শক্ত নয়। কিন্তু আরও কিছু প্রয়োজন থাকে পুরুষের। যা মেটাতে লাগে একটা ফুললি ফাংশনিং শরীর, যার হাত পা নাক চোখ ঠোঁট দাঁত যেখানে যতখানি থাকার আছে। সে রকম শরীরওয়ালা মেয়েদের পাঁচিলঘেরা একটা পাড়া আছে শহরের মাঝখানে। পাঁচিলের ওপর কাঁটাতার দিয়ে বারো মাস তিরিশ দিন চব্বিশ ঘণ্টা হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ খেলে। রাত গভীর হলে গোটা শহরের পুরুষরা, যাদের নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর প্রিভিলেজ আছে, সে মিনি শহরের দিকে চিনির দানার প্রতি পিঁপড়ের একাগ্রতায় মিছিল করে। পাড়াটা শহরের নর্দমা না সেফটি ভাল্ভ সে নিয়ে কাজিয়া এখনও মেটেনি; যেটাই হোক শহরের স্বাস্থ্যের পক্ষে অপরিহার্য।
আমি কখনও যাব না ওই প্রয়োজনের পাড়ায়, ক্রান্তি। তুমি সুন্দরী থাকো না থাকো, তোমার শরীর নমনীয় এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আজ্ঞাবহ থাকুক না থাকুক। আমার পৌরুষ নিয়ে যে যতই সন্দেহ প্রকাশ করুক। আমার নিড়বিড়েপনায় বুবুল যতই হাসুক। আমি সারাজীবন তোমার এবং নিঃশর্তভাবে তোমার থাকব, ক্রান্তি।
তোমার নামটায়, রাগ কোর না, বড় বেশি যুদ্ধ যুদ্ধ গন্ধ। সিংহবাড়ির লোকজনের নামের বাহার খুব। নিজের নামটা আমার ঠাট্টার মতো লাগে, কিন্তু মেয়েদের নামগুলো কী সুন্দর। শোভনাসুন্দরীর কথা তো বললামই। জেঠিমা লাবণ্য সিংহ। মা সুরূপা সিংহ। রাঙাকাকিমার নামটা সবথেকে গ্র্যান্ড এবং আমার ফেভারিট। প্রিয়দর্শিনী। বুল্টির নাম কোমল।
জেঠিমার অ্যালবামের শেষ ছবিটা বুলটির। নরম, নিটোল। কোথাও ভাঙাচোরা, ছেঁড়াফাটা, থেঁতলানো নেই। ওর এ রকমই থেকে যাওয়া নিশ্চিত করার জন্য যাবতীয় সতর্কতা অবলম্বন করছে রাঙাকাকু রাঙাকাকিমা। আমরাও নজর রাখি। কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে। স্কুল আর দুয়েকটা এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাকটিভিটি, ব্যস। যতটা সম্ভব আনওয়ান্টেড এলিমেন্টসদের নজরের বাইরে রাখা। একা বা বন্ধুদের সঙ্গে ছাড়া হয় না। ড্রাইভার ছুটি নিলে হয় রাঙাকাকা, নয় আমি, জিষ্ণু, বাড়ি থাকলে বুবুল, এদিকওদিক নিয়ে যাই। চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, প্ল্যানেটোরিয়াম। খুব ভালোবাসে হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে।
ধরিত্রী নামটা তোমার কেমন লাগে? শুনলেই একটা বিস্তৃত শান্তি মনের ভেতরটা ছেয়ে ফেলে না? বিয়ের পর তোমার নাম রাখব ধরিত্রী। ক্রান্তিটাও থাকবে না হয় মিডল নেম হিসেবে। ধরিত্রী ক্রান্তি সিংহ। তন্বী নামটার মধ্যেও একটা ফুরফুরে ব্যাপার আছে। তোমার সঙ্গে যাবে খুব। কিংবা বিনীতা। আমার ভীষণ পছন্দের নাম। তুমি যদি ফাইন্যালি বিনীতা নামটাই পছন্দ কর তাহলে ‘বিন্তু কেমন আছ’ লাইনটা ফোনের রিংটোন রাখব।
বাড়ি তো বটেই, পাড়া, শহর, বোধ হচ্ছে গোটা পৃথিবীটাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার ঘুম আসছে না। তুমি কী করছ? তুমি কি আর্লি টু বেড, নাকি এখনও বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছ? টেবিল ল্যাম্পের আলোয় কপালের চারপাশের কুচো চুলেরা চকচক করছে?
ফোনটা বার করি। আনট্রেসেবল হলেও নিতান্ত অসহ্য না হলে ব্যবহার করি না। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট, গ্র্যাজুয়েট, প্রফেসর, অফিসকর্মী - ইউনিভার্সিটির সমস্ত মহিলার ফোননম্বর ক্যাম্পাসে পা রাখার আটচল্লিশঘণ্টার মধ্যে আপলোড হয়ে যায় ডেটাবেসে। সেখান থেকেই তোমার নম্বর পেয়েছি।
রিং হচ্ছে। পুরোনো দিনের পাঁচকেজি লালনীল ফোনগুলোর ক্রিং ক্রিং ক্রিং। ক্যান্টিনে, করিডরে বাজতে শুনেছি। সেদিন বাসেও বেজেছিল। ফোন তুলে বলেছিলে, “এই তো বাসে।” তুমি কবে আমাকে ফোন করবে ক্রান্তি? ফোন তুলে বলব, “এই তো সিগন্যালে। আর পাঁচ মিনিট।”
হ্যালো? তোমার ঘুমজড়ানো গলা আশিরনখ বয়ে যেতে দিই।
হ্যালো? গলায় ঘুমের সঙ্গে এবার বিরক্তি। ফোন কেটে দাও।
জেঠিমার অ্যালবামটার মতো আমার মাথার ভেতর একটা অ্যালবাম আছে। যে অ্যালবামে তুমি ছাড়া কেউ নেই। কখনও ছিল না। কখনও থাকবে না। ক্লাসে ঢুকছ, বেরোচ্ছ, লাফিয়ে পাঁচিলে উঠে বসছ, লাফিয়ে পাঁচিল থেকে নেমে জামা ঝাড়ছ, সেমিনার শুনছ ভুরু কুঁচকে, মাঠে বসে ঘাস ছিঁড়ছ, করিডর দিয়ে হেঁটে আসছ। ক্রমশ আমাদের মধ্যবর্তী শূন্যতা কমছে, ক্রমশ উজ্বল ও অসহনীয় হয়ে উঠছে নীল কুর্তার ভি-কাটের মসৃণতা।
প্রথমদিন তোমাকে পাশ কাটিয়ে যেতে লেগেছিল হার্ডলি সাঁইত্রিশ সেকেন্ড, কিন্তু মাথার অ্যালবামে পজ বাটনের প্রিভিলেজ আছে।
কারও রসিকতায় হেসে ওঠার মুহূর্তটায় তোমাকে স্থির করে দিই। ঠোঁট নয়, গলা নয়, শরীরের ভরকেন্দ্র থেকে ঘূর্ণি তুলে বেরিয়ে এসেছে তোমার হাসি যেমন আসে, কক্ষপথ থেকে ছিটকে দেয়, পতন সামলাতে তোমাকে আশেপাশের কাউকে বা কিছুকে আঁকড়ে ধরতে হয়। এগিয়ে যাই। এত কাছে যাতে আমার নিঃশ্বাসে তোমার ঘাড়ে লেপ্টে থাকা চুল উড়তে পারে। প্রদক্ষিণ করি। মনোযোগ দিই গ্রীবার বাঁকে। বোজা চোখের পলকে। দাঁতের সুসংবদ্ধ শুভ্রতায়। জিভের গোলাপি আভায়।
কাঁপুনি ধরে প্রতিটি রোমকূপে। শরীরের ভেতর আরেকটা শরীর জাগে। জানালার ওপারে আমগাছের মাথায় গনগনে চাঁদ। পূর্ণিমা আসন্ন, বা সদ্য গত। সে গলন্ত সোনার আঁচে শুয়ে তোমার কথা ভাবতে ভাবতে ছাই হয়ে যাই।
৪
‘উদিত!’
পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি, পঁচাশি কেজি শরীরের তুলনায় হিমাংশুর গলাটা বাড়াবাড়িরকম মিহি। সেটা অফসেট করার জন্য ও যা-ই বলে জোরের সঙ্গে বলে। এই যে আমাকে ডাকল, ডাকল না, হাঁকল।
ওকে প্রথম দেখেছিলাম ফ্রেশার্সে। গ্যালারিতে, ভিড়ের সামান্য ওপরে বসে ছিলাম। হিমাংশু ঢুকেই হাঁকডাক শুরু করল। গলার আওয়াজ ওই রকম হলে আমি পারতপক্ষে মুখ খুলতাম না। হিমাংশু ননস্টপ কথা বলে গেল। ও-ও নতুন, কিন্তু সবাইকে চেনে। এদিকওদিক হাত নাড়ছে, এর ওর পিঠ চাপড়াচ্ছে, চুটকি বলে দ্রুত দৃষ্টি বুলিয়ে আনছে দরজার কাছ ঘেঁষা বেঞ্চিগুলোর দিক থেকে যেগুলোতে মেয়েরা ঝাঁক বেঁধে বসেছে।
ফার্স্ট বেঞ্চের মেয়েটির সর্বাঙ্গ ঢাকা। মেয়েরা বিভিন্ন কারণে নিজেদের ঢাকে। ধর্মের ভয়ে, গায়ের রং বাঁচাতে, আত্মরক্ষার্থে। মুখের এবং বোতলের ঢাকনা সরিয়ে মেয়েটা জল খেল। উপস্থিত প্রায় সমস্ত ছেলের চোখ বা আড়চোখ মেয়েটার দিকে। বোতল নামিয়ে মুখের ঢাকা ফেলতে যাবে, দু’হাতের পাঞ্জা বেঞ্চের ওপর পেতে, শরীর ঝুঁকিয়ে হিমাংশু দাঁড়াল।
‘উইল ইউ ম্যারি মি?’
তখনও না গেলা চুমুকের জল ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল মেয়েটার নাকমুখ দিয়ে। সাড়ে তিন সেকেন্ড পর গোটা গ্যালারির উৎকণ্ঠা চূর্ণ করে হিমাংশু হেসে উঠেছিল, আড়াই সেকেন্ড পর যোগ দিয়েছিল বাকিরা, ভূপতিত স্টিলের বাটির মতো গ্যালারির দেওয়ালে দেওয়ালে সে হাসি বেজেছিল।
মিনিট দশ বাদে উঠে এসেছিল আমার কাছে। সিটের খোঁজে কিংবা ওর রসবোধে গ্যালারির একমাত্র কে ঘায়েল হল না মেপে দেখতে।
‘হাই, আয়্যাম হিমাংশু। হিমাংশু রয়।‘ হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।
‘উদিত।‘ হাত বাড়ানোর উদ্যোগ দেখাইনি।
ভুরু এক সেন্টিমিটার তুলে অপেক্ষা করেছিল হিমাংশু। উহ্য রাখার অর্থ পদবীটা লুকোনোর মতো। নিমরাজি ভঙ্গিতে গোটা নামটা প্রকাশ্যে এনেছিলাম।
‘উদিতবিক্রম সিংহ।‘
অমনি গবাদিপশুপম দূরত্বে স্থিত হিমাংশুর দুই চোখের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন মনসবদারি নিয়ে রাজপুতানা থেকে শহরে এসে পৌঁছনো সাতফুট উচ্চতা এবং চার মণ ওজনের বিক্রমসিংহ। তলোয়ারআঁটা কোমরবন্ধ, পাগড়ি, নাগরাজুতো পরে বৈঠকখানার লাইফসাইজ পোর্ট্রেট থেকে ভুরু কুঁচকে যিনি আমাদের অহোরাত্র জাজ করছেন। পিছু পিছু গেলেন জমিদারি, জাহাজ, মশলা এবং যুদ্ধের বাজারে লোহালক্কড়ের ব্যবসাদাররা। গেলেন শহরের বর্তমান মেয়র এবং আশ্রমের বোর্ড প্রেসিডেন্ট জেঠু মলয়বিক্রম, দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রিয়েল এস্টেট ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির মালিক এবং আশ্রমের বোর্ড সেক্রেটারি বাবা প্রলয়বিক্রম, পূর্ব ভারতের অন্যতম মিডিয়া এন্টারটেনমেন্ট ব্র্যান্ডের কর্ণধার, সর্বভারতীয় লিটারেচার মিটের হোতা এবং গুরুদেবের আশ্রমের সাংস্কৃতিক সেক্রেটারি রাঙাকাকা, বলয়বিক্রম। মিছিলের অন্তে এসে দাঁড়াল রাঙাকাকার ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠরত ছেলে জিষ্ণু, অপারবিক্রম, আমার থেকে চার মিনিট সতেরো সেকেন্ডের বড় এবং জাতীয় বিমানবাহিনীর অন্যতম তরুণ স্কোয়্যাড্রন লিডার বুবুল, অমিতবিক্রম, এবং সবশেষে দাঁড়ালাম সেভেন্থ ইয়ার পি এইচ ডি ক্যান্ডিডেট আমি, উদিতবিক্রম।
আমার ছয় দুইয়ের হিলহিলে দেহ, ফ্যাকাশে রং, কোঁকড়া চুল, চিবুকের খাঁজ এবং নাকের ঢিবি দেখতে দেখতে নিশ্চয় নিজেকে শাপশাপান্ত করেছিল হিমাংশু। এতগুলো টেল-টেল লক্ষণ ও এড়িয়ে গেল কী করে?
সেদিনের পর থেকে গোটা এম এ, এম ফিল, পি এইচ ডি জুড়ে চিবোনো চুয়িংগামের মতো সেঁটে থেকেছে হিমাংশু। সিংহবাড়ির ছেলেরা এ ধরনের আচরণে অভ্যস্ত এবং এটা হ্যান্ডেল করার নিজস্ব ধরন আছে আমাদের সবার। বুবুল যেমন ব্যাপারটা এনজয় করে। ছোটবেলা থেকে ওর পেছনে ধূমকেতুর ল্যাজের মতো ছেলের দল ঘুরত। জিষ্ণু করে না। অপারবিক্রম সিংহ-র বদলে সর্বত্র জিষ্ণু সিংহ হিসেবে নিজের পরিচয় দেয়। তেমন বুঝলে সিংহও হাওয়া করে।
আমি অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিই। আমাকে চিনতে না পারার দোষটা পুরোটা হিমাংশুর নয়। বছরের পর বছর পছন্দঅপছন্দ প্রকাশ না করে, দরকার ছাড়া মুখ বন্ধ রেখে, আবার এতটাও নয় যে নৈঃশব্দ্য অপরপক্ষের অস্বস্তির জন্ম দেয়, অবশেষে আমি নিজেকে প্রায় অদৃশ্য করে ফেলতে সক্ষম হয়েছি। বুবুল যত জ্বলজ্বলে হয়েছে আমি তত মিলিয়ে গেছি। গ্যারান্টি দিতে পারি, আমি যে তিন বছর ধরে করিডরে, ক্যান্টিনে তোমার পিছু নিচ্ছি, বাসে করে তোমার স্টপ পর্যন্ত গেছি, তুমি আমাকে দেখোনি। তোমাদের বাড়ির যে কাজের মহিলা কাপড় শুকোতে ছাদে বেরিয়েছিলেন, দড়িতে অন্যান্য জামাকাপড়ের সঙ্গে মেলে দিলেন তোমার নীল কুর্তি, যাঁর দৃষ্টিপথে রাস্তার উল্টোদিকের ঝুপড়িতে বসে উদাসমুখে চা প্রজাপতি বিস্কুট খাচ্ছিলাম, তিনিও দেখেননি। যাঁর ঝুপড়ি, সম্ভবত তিনিও আমাকে মনে করতে পারবেন না।
তবু হিমাংশুর মতো ছেলেরা পালে পালে এসেছে। বন্ধুত্বের প্রত্যাশায়। প্রতিফলিত গৌরবে গৌরবান্বিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। ভবিষ্যতে ঘনিষ্ঠতা ভাঙিয়ে করে খাওয়ার ভিক্ষায়। অধিকাংশের সঙ্গেই খারাপ ব্যবহার করেছি। খারাপ ব্যবহার বলতে বুবুল যা বোঝে, ঝাঁঝিয়ে ওঠা, ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে তাচ্ছিল্য প্রকাশ, নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন, সে সব না। এ সবের থেকে শৈত্য অনেক বেশি কার্যকরী। প্রিয় হয়ে ওঠার প্রাণপণতায় জল ঢেলে দিয়েছি, কষ্টকল্পিত রসিকতায় মুখের পেশী অনড় রেখেছি, দৃষ্টিকে চালিয়ে দিয়েছি মাথা ফুঁড়ে। তাকিয়েছি, কিন্তু দেখিনি। হিমাংশুর সঙ্গেও করতে পারতাম, করিনি। দুয়েকটা সঙ্গী থাকা ভালো। একেবারে একাবোকা ঘুরলেও দৃষ্টি আকর্ষণের সম্ভাবনা।
কাজেই হিমাংশুর হাঁক শুনে পেছন ফেরার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মেজাজ ফুরফুরেই ছিল, যতক্ষণ না হিমাংশুর পাশে বসে থাকা লোকটা নজরে এল। পাঁচফুট পাঁচ। ওজন টেনেটুনে পঞ্চান্ন কেজি। চিবুক নেই। চোখজোড়া দরকারের থেকে বেশি কাছাকাছি, দরকারের থেকে বেশি কোটরগত। চুলের সামনেটা অলরেডি ফাঁপা হতে শুরু করেছে। বুবুলের বা আমার নাম শুনলে লোকজনের যে প্রতিক্রিয়াটার কথা বললাম তোমাকে, সেটা নব্বই শতাংশের। শুভম ঘোষ বাকি দশ শতাংশে পড়ে।
হুগলী জেলার ইন্টিরিয়রে বাড়ি, সাতপুরুষ চাষী, টিপসই। শুভম ফার্স্ট জেনারেশন হাইস্কুল। বোর্ড পরীক্ষায় মহকুমাতে, জেলাতেও হতে পারে, স্ট্যান্ড করেছিল। তারপর শহর। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। হড়কানোর শুরু। সেকেন্ড ইয়ারের সেকেন্ড সেমেস্টার ঢুকতে ঢুকতে সবক’টা পেপারে সাপ্লি নিতে হচ্ছে। শেষমেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে ইকনমিক্স। এখন পি এইচ ডি করছে।
শুভম টাইপের ছেলেদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিজের জীবনের কোনও দুর্ঘটনার দায়িত্ব না নেওয়া। ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ধ্যাড়ানোর মূলে শহরে এসে মাথা ঘুরে যাওয়া না, দায়ী সিনেমাহলের মাইলপ্রতি ঘনত্ব। পছন্দমতো পি এইচ ডি প্রোগ্রামে চান্স না পাওয়ার দায় পড়াশোনা ডকে তুলে স্লোগান দিয়ে বেড়ানো না, সংরক্ষণ। আন্ডারপ্রিভিলেজড বাড়িতে জন্ম এবং তৎপরবর্তী যাবতীয় স্ট্রাগলের দায় ওর কপালের না, সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো আমার মতো ছেলেদের।
পি এইচ ডি-টা ধোঁকার টাটি, শুভমের আসল সময় কাটে নেতাগিরি করে। ওর লক্ষ্য অভ্রংলিহ। ক্যাম্পাস থেকে রাজ্য, রাজ্য থেকে কেন্দ্র। সেটা সফল করার জন্য শুভম যে পরিমাণ পরিশ্রম করে ভাবা যায় না। সাধারণ লোক বাদ দাও, কলেজ ইউনিভার্সিটির পাইকারিদর ছাত্রনেতার পক্ষে গুরুদেবের নাগাল পাওয়া প্রায় অসম্ভব। জেড ক্যাটেগরি সিকিউরিটি চব্বিশঘণ্টা, প্রতিটি গাড়ি বুলেটপ্রুফ। মন্ত্রীরা পর্যন্ত অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া দেখা করতে পারেন না। সে জায়গায় শুভম ঘোষ গত বছর লিঙ্গভৈরবী মহোৎসবে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে গুরুদেবের গলায় মালা দিয়ে এসেছে।
মুশকিলটা হচ্ছে সেটা করতে ওকে অন্তত পঁচিশটা মিছিল অর্গ্যানাইজ করতে হয়েছে, রোদে ঘুরে কালো রং আরও কালো করতে হয়েছে, আশ্রমের বড় মেজ ছোট কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভালো লাগুক বা না লাগুক নুয়ে পড়ে কথা বলতে হয়েছে। তাতেও মালা গুরুদেবের গলা পর্যন্ত পৌঁছয়নি, বাউন্সার হাতিয়ে গুরুদেবের ব্যক্তিগত সচিব চৌবের হাতের ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলেছে। গুরুদেব শুভমের দিকে হাসিমুখ ফিরিয়েছেন বা ফেরাননি, মাথায় আশীর্বাদের হাত ছুঁইয়েছেন বা ছোঁয়াননি, সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে মূল বিল্ডিং-এ ঢুকে গেছেন। কালো সাফারি সুট, কালো চশমা সিকিউরিটি পা ফাঁক করে শুভমের রাস্তা আটকেছে। গুরুদেব লিফটে চড়ে তিনতলার ব্যক্তিগত অ্যাপার্টমেন্টে উঠে এসেছেন, যার লিভিংরুমের লেদার সোফায় বাবা, রাঙাকাকা, বুবুল, জিষ্ণু, আমি অপেক্ষা করে আছি। ফাইন চায়নার কাপে শিষ্যের বাগানের ফার্স্ট ফ্লাশ চা, প্লেটে ইমপোর্টেড ড্রাই ফ্রুটস। গুরুদেব ঢুকেছেন, আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি। নিজেদের প্রণাম সেরে, আপনা থেকেই করব জানা সত্ত্বেও বাবা রাঙাকাকা আদেশ করেছে, প্রণাম কর। করেছি। মাথায় হাত বুলিয়ে, গালে আলতো চড় মেরে গুরুদেব বুবুলের পোস্টিং সম্পর্কে খবর নিয়েছেন, পি এইচ ডি শেষ করে কবে আমি সমাজের রিয়েল কাজে লাগব জানতে চেয়েছেন, জিষ্ণুকে দেখে চোখ কপালে তুলেছেন। এটাও এত লম্বা হয়ে গেল? চৌবের দিকে ফিরে বলেছেন, বাচ্চারা আজ খেয়ে যাবে।
শুভম আমাকে ওর শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে ঘৃণা করে।
‘রিসার্চ কেমন চলছে?’ শুভমের কুতকুতে চোখ আমার ওপর স্থির।
দিনকে দিন অখাদ্যতর হচ্ছে ক্যান্টিনের চা। কাপ ঠোঁট থেকে নামিয়ে দূরে ঠেলে দিই।
‘চলছে।‘
‘প্রিলিমিন্যারি রেজাল্ট পেলে কিছু?’ প্রশ্নটায় কৌতূহল এবং কৌতুক ফিফটি ফিফটি।
অ্যাগ্রেশন, রুথলেসনেস, লক্ষ্যে পৌঁছনোর গ্রেসলেস হাঁকপাঁক ছাড়া শুভমকে অপছন্দ করার আরও একটা কারণ আছে আমার। আর কারও কাছে না করলেও তোমার কাছে স্বীকার করতে লজ্জা নেই।
শুভমের উপদেশ মানলে আমার পি এইচ ডি এতদিনে অন্য চেহারায় থাকত। শেষ হয়ে যেত সম্ভবত।
বলা বাহুল্য, শুভমকে আমার রিসার্চের উপদেষ্টার জায়গা দেওয়াটা আমার আইডিয়া না। হিমাংশুর। ও যে আমার জিগরি সেটা শুভমের কাছে প্রমাণ করতে, এই ক্যান্টিনেই, আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার পর আগ বাড়িয়ে আমার রিসার্চের খবরও দিয়েছিল।
‘উদিতের টপিকটা মারাত্মক ইন্টারেস্টিং। অ্যান্ড ইম্পরট্যান্ট। মায়েদের চাকরি এবং সন্তানদের স্বাস্থ্যের কোয়ালিটির নেগেটিভ কোরিলেশনশিপ এমপিরিক্যালি এস্ট্যাব্লিশ করছে ও।‘
‘এস্ট্যাবলিশ না, এক্সামিন।‘ শুধরে দিয়েছিলাম। ‘নেগেটিভ কি না সেটা রেজাল্ট না বেরোলে বোঝা যাবে না।‘
‘অফ কোর্স, নেগেটিভ।‘
রুপোবাঁধানো রংবেরঙের গ্রহরত্ন শোভিত দুই হাতের আঙুল একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে টেবিলে রেখে বলেছিল শুভম।
‘কনভেনশনাল উইসডমকে অগ্রাহ্য করাটা মিডিওকার রিসার্চের প্রেরোগেটিভ। এই মুহূর্তে সমস্ত রেসপন্সিবল রিসার্চারের উচিত আমাদের সনাতন জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতালব্ধ শাশ্বত সত্যগুলোকে পাশ্চাত্যের সামনে প্রতিষ্ঠা করা। ওদের অ্যাকসেপ্টেড মেথড ফলো করেই। তবে মায়েদের বাড়িতে থাকা আর ছেলেদের সুস্বাস্থ্যের সম্পর্কটা সূর্য পূর্বদিকে ওঠার মতো। সেটাকে আবার ঘটা করে প্রমাণ করার মেরিটটা আমি বুঝি না। রিসার্চ শুড অলওয়েজ অ্যাড টু দ্য হিউম্যান নলেজ পুল। না হলে হোয়াটস দ্য পয়েন্ট অফ অরিজিন্যাল রিসার্চ?’
জীবনে কিছু কিছু মুহূর্তে, বুঝলে ক্রান্তি, আফসোস হয় কেন আমি বুবুল হলাম না। হলে ওই মুহূর্তে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে পারতাম, অন্তত একটা কিছু অপমানজনক বলতাম, নিদেনপক্ষ গলার ভেতর একটা ধ্বনিবাচক অব্যয়ে কিংবা ঠোঁটের কোণের মোচড়ে ওর সঙ্গে আমার ফারাকটা এমন প্রকট করে তুলতাম যে সারাজীবন আর ঘাড় সোজা করে দাঁড়াতে পারত না শুভম ঘোষ। চোখের ওপর চোখ রাখতে পারত না।
‘প্রাইমারি ডেটা জোগাড় করছ?’
‘সেকেন্ডারি।‘
‘কাদের?’
আমার রিসার্চের খুঁটিনাটি নিয়ে শুভমের কাঁচকলা, ও চায় আমার রিঅ্যাকশন। সে টোপ গেলার প্রশ্নই নেই।
‘সবাই যাদেরটা করে।‘ ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের ডেটাবেসের নাম বলেছিলাম।
‘হোয়াই? কাজ যখন আমাদের দেশের পপুলেশন নিয়ে, ইন্টারন্যাশনাল ডেটা কেন? আমাদের দেশের স্ট্যাটিসটিকাল আর্কাইভে এত রিচ, এক্সটেনসিভ ডেটা মেন্টেন করা হচ্ছে এখন। আমরা সকলে সেই ডেটা নিয়েই কাজ করছি।‘ হিমাংশুর দিকে হাত নেড়ে বহুবচন জাস্টিফাই করেছিল শুভম।
হিমাংশুর টপিকটাও শুভমেরই সাজেসশন। ইন্টারভিউ, এফ জি ডি ইত্যাদি থেকে কনটেম্পোরারি, আর মিনিস্ট্রির আর্কাইভ থেকে হিস্টোরিক্যাল ডেটা নিয়ে প্যানেল অ্যানালিসিসে হিমাংশু দেখাচ্ছে ভারতীয় ট্র্যাডিশনাল পোশাকআশাক, পশ্চিমি পোশাকআশাকের তুলনায় নারীদের নিরাপত্তা অধিকতর সুনিশ্চিত করে। প্রিলিমিন্যারি ফাইন্ডিংস অলরেডি জাতীয় স্তরের নামকরা কাগজে অপ-এড হয়ে বেরিয়েছে। ‘বয়েজ উইল বি বয়েজ’ শিরোনামে।
শুভমের রিসার্চ নিয়ে প্রত্যুৎসাহ দেখাইনি। কিন্তু হিমাংশু অপ্রতিরোধ্য।
‘শুভমের থিসিসের লক্ষ্য হল নারীদের উচ্চশিক্ষার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে দেশের জন্মহার কমার সত্যিটা হাইলাইট করা। রুর্যাল এবং আর্বান ডেটার টাইম সিরিজ। ভেরি রিগরাস।‘ মুখচোখ অর্গ্যাজমিক করে জানিয়েছিল হিমাংশু।
‘এ রিসার্চও গ্রাউন্ডব্রেকিং কিছু না।‘ শুভম কাঁধ ঝাঁকিয়েছিল। ‘এ সমস্ত সত্যিই যুগ যুগ ধরে মানুষ জানত। সুচিন্তিতভাবে ঘুলিয়ে এবং ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখনও প্রচুর স্টেট মেয়েদের উচ্চশিক্ষা অ্যাকটিভলি পুশ করছে। স্টাইপেন্ড, হ্যানা প্রকল্প ত্যানা প্রকল্প। এ সব করে শিক্ষাক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য প্রোমোট করা যদি ছেড়েও দাও, ডেটা স্পষ্ট দেখাচ্ছে যে সব স্টেট এই সব পপুলিস্ট ইনিশিয়েটিভস নিচ্ছে সে সব স্টেটে জন্মহার ধড়াদ্ধর কমছে।‘
‘এই একই প্রশ্নের ইউনিট অফ অ্যানালিসিস কমিউনিটিও হতে পারে। এবং আমি শিওর রেজাল্ট একই বেরোবে। যে সব কমিউনিটি পশ্চিমের পিঠচাপড়ানি পাওয়ার হ্যাংলামিতে এই সুইসাইডটা করছে না, মেয়েদের বাড়িতে রাখছে, প্রোটেক্ট করছে, তাদের জন্মহার হু হু করে বাড়ছে। উই কান্ট অ্যাফর্ড টু বিকাম মাইনরিটিজ ইন আওয়ার ল্যান্ড। ক্যান উই?’
শুভমের রোঁয়া ফুলে উঠেছিল।
‘রিসার্চ ইজ মিনিংলেস যতক্ষণ না সেটা পলিসিতে প্রভাব ফেলছে। পি এইচ ডি-র পর রাস্তায় নেমে এটা নিয়ে মুভমেন্ট করব। প্যানইন্ডিয়ায় নাম রাখব #হোমওয়ার্ডবাউন্ড, বাংলায় #ঘরেরমেয়েঘরে।‘
ক্যান্টিন কাঁপিয়ে হেসে উঠেছিলে তুমি। দৃষ্টিসীমার বাইরে ছিলে, তবু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। তোমাদের দলটা ক্যান্টিনে ঢুকেছে। কুলারের সামনে দাঁড়িয়ে বোতলে জল ভরছে কেউ কেউ। ভরা হলে অর্ডার দেওয়া হবে। সবাই চা, ঢ্যাঙামতো ছেলেটার দুধচিনি ছাড়া। ব্রেড রোল, কোনও কোনওদিন কাটলেট। ছয় থেকে দশজনের গ্রুপ। ছেলেমেয়ে মেশানো। মেয়েরা সকলেই অনাবৃত। ছেলেরা এমন ব্যবহার করে যেন বন্ধুত্ব ছাড়া আর কোনও গোপন উদ্দেশ্য নেই। হাসতে হাসতে তোমরা একে অপরের পিঠ চাপড়াও যেন স্পর্শে আলাদা করে কোনও শিহরণ জাগে না। তোমাদের ফোননম্বর যে কেউ যখনতখন অ্যাকসেস করতে পারে, হিমাংশুর মতো কেউ যখনতখন এসে তোমাদের প্রোপোজ করতে পারে, উত্তর পছন্দ না হলে ঠেঙিয়ে পাট করে দিতে পারে, আজীবনের মতো কুৎসিত, পঙ্গু এবং অকেজো করে দিতে পারে - এ সমস্ত সত্যি পৃথিবীর সবার কাছে স্পষ্ট হলেও তোমাদের চেতনায় কোনও ছাপই ফেলে না। যাবতীয় বাস্তবতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তোমরা ঠা ঠা হাসো, যার সঙ্গে খুশি মেশো, যেখানে খুশি যখন খুশি চলে যাও। নির্ভয়ে।
হিমাংশু বলে, ‘ভয় কীসের? কোনও সুস্থমস্তিষ্কের ছেলে ও মালদের প্রোপোজ করবে না। দলের মধ্যে ইনব্রিডিং ভবিতব্য।‘
আমি শুভমকে দেখছিলাম। শুভমের কপালের রগ দপদপ করছিল। ওর হ্যাশট্যাগের আইডিয়া এতদূর থেকে তোমার কানে পৌঁছয়নি, নিজেদের মধ্যে কোনও রসিকতাতেই হেসে উঠেছ। কিন্তু সে হাসি শুভমের বক্তৃতার খেই ছিঁড়ে দিয়েছে।
তুমি শুভম টাইপের লোকজনকে চেন না, ক্রান্তি। ওরা সিরিয়াস ক্ষতি করে দিতে পারে। সাবধান হও, ক্রান্তি। অত জোরে হেসো না। নিঃশব্দ হও। আড়ালে যাও।
৫
অন্যদিন বারান্দায় মিন্টি থাকে। হুইলচেয়ারে বসে, হেডরেস্টে ঘাড় হেলিয়ে। রাঙাকাকিমা বাটি থেকে চামচে করে দুধচিঁড়ে মুখে গুঁজে দেয়। গোঁজার সময় নিজেও হাঁ করে। কিছুটা গন্তব্যে পৌঁছয়, কিছুটা পৌঁছয় না। ন্যাতা রেডি থাকে মিন্টির ঠোঁটের পাশ, চিবুক পরিষ্কার করার জন্য। অনর্গল বকে রাঙাকাকিমা। পাড়ার কেচ্ছা, সিংহবাড়ির শৌর্যবীর্যের লিজেন্ড।
পালানোর চেষ্টা একেকদিন ব্যর্থ হয়। রাঙাকাকিমা চেঁচায়, ‘অ্যাই টুবুল!’
‘এই চশমাআঁটা শেয়ালপণ্ডিতটা কে বল দেখি মিন্টি?’
মিন্টির চিবুকে চটকানো চিঁড়ে। চোখে আকাশ।
‘তোর বর না কিন্তু। বরের মতো দেখতে। তোর দেওর। হবু ছেলের খুড়োমশাই।‘
দুধচিঁড়ের অনপচয় সুনিশ্চিত করতে স্টিলের বাটিতে চামচ চালিয়ে কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত করার উপক্রম করে রাঙাকাকিমা।
‘সবেরই ভালো দিক আছে, বুঝলি টুবুল। এই যদি মিন্টির জ্ঞান টনটনে থাকত খাটনি কত বাড়ত ভাব দেখি। তিনদিন অন্তর অন্তর একই গল্প চালানো যেত না।‘
কোনও কোনওদিন দৃশ্যে বুল্টি থাকে ন্যাতার দায়িত্ব নিয়ে। বৌদির ঠোঁট ঘষে দেয় ঘন ঘন। বিনুনিতে টান দিয়ে চলে আসি।
আজ বারান্দা ফাঁকা। জেঠিমার ঘর থেকে উল্লাস। টিভিতে পছন্দসই সিনেমা হচ্ছে সম্ভবত। যাবতীয় মহিলামহল জুটেছে, মাশুদ্ধু। ‘ভালো বই দিয়েছে, বৌদি’ বলে সবিতা নিয়ে গেছে।
হাসি ও হাততালির বহরে মনে হচ্ছে আজ বই ফুর্তির। কিন্তু এখন তো সিনেমার সময় নয়, খবরের . . . রাইট। পরকীয়ার খবর। ফলো করছ নিশ্চয়? না করে উপায় নেই। দুটো সেমি-পাবলিক ফিগার, আইনত এখনও অন্যান্য লোকজনের সঙ্গে বিবাহিত, হাত ধরে নাচছে, গাইছে, ভিডিও বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাড়ছে। লোক্যাল মিডিয়ায় আর কোনও ইস্যু নেই ইদানীং। কয়েকটা চ্যানেল তো এই খবর কভার করার জন্যই খোলা হয়েছে আমি শিওর।
বুবুল বলে, যে কোনও সৎ দেশে এই সব কেসে কালপ্রিটদের প্রকাশ্য রাস্তায় পাথর ছুঁড়ে মারা হত। আমাদের দেশে গ্রামের দিকে পাথর ছুঁড়ে মারা না হলেও গাছে বেঁধে মারা বা মাথা ন্যাড়া করে ঘোরানো ইত্যাদি হয় শুনেছি। শহরে সে সব ঘটে না। দুজন প্রাপ্তবয়স্কের জীবনাচরণ, মূল্যবোধ ইত্যাদি তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার - প্রগতিশীলতার এইসব ভড়ং পথ আটকে দাঁড়ায়।
পাথর ছুঁড়ে মারাকে সমর্থন করার কলজে আমার নেই। ব্যভিচারী ব্যভিচারিণীদের গাছে বেঁধে ডিসপ্লে করা বা গ্রাম ঘোরানো, আমার সেনসিবিলিটির পক্ষে সেটাও টু মাচ। তবু চাই এদের শাস্তি হোক। পরকীয়া করেছে বলে নয়। পরকীয়া অনেকেই করে। চিরকাল করেছে। ডান থাকলে বাঁ থাকে, বিয়ে থাকলে পরকীয়া থাকবে। মানুষ ইন্দ্রিয়দাস, দুর্বল। একটিমাত্র মানুষের সঙ্গে শারীরিক ও মানসিকভাবে আজীবন থেকে যাওয়ার মতো প্রেম ছেড়ে দাও, ভয়ও জোগাড় করা তাদের পক্ষে দুষ্কর। এদিক ওদিক খেপ খেলে বেড়ায়।
কিন্তু লুকিয়ে খেলে। খেলাটা যে অন্যায়, পাপ, সেটা তাদের চেতনে, আচরণে স্পষ্ট থাকে। থাকে বলেই বিবাহের প্রতিষ্ঠানকে পরকীয়া থ্রেটেন তো করেই না, উল্টে পুষ্টি জোগায়। যারা লুকোছাপাটুকু পর্যন্ত উড়িয়ে দেয়, তারা পরিবারের সংজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করে। একটি পুরুষ, একটি নারী, একটি বিবাহ। মানবসভ্যতার এই কেন্দ্রকোষটিকে এরা অগ্রাহ্য ও ধ্বংস করতে চায়।
সেটা হতে দেওয়া চলে না। মানুষ দৃষ্টান্তে বিশ্বাস করে। আজ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে থাকা একজোড়া মানুষকে বুক ফুলিয়ে বেড়াতে দেখলে ভয় কেটে যাবে, লজ্জা ঘুচে যাবে, পাপবোধ উবে যাবে। যারা ভয় পায় না, তারা সবথেকে বেশি ভয়ংকর। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দরকার আছে। ডিভোর্স করে নাও বলাটা সমাধান নয়। সেটা বিয়েকে কাঁচকলা দেখিয়ে পালিয়ে যাওয়ারা রাস্তা করে দেওয়া। শাস্তিটা তার বেশি কিছু হওয়া দরকার। আইনের পথে হলেই সবথেকে ভালো। জেল, জরিমানা।
যতদিন না সেটা করা যাচ্ছে, অন্য রাস্তা দেখতে হবে। আমি সোশ্যাল মিডিয়ার ভক্ত নই, ব্যবহারও করি না। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার একটা সুবিধে স্বীকার করি। আড়াল। সেই আড়াল যা বুবুলের উল্লিখিত ভড়ংগুলোকে ঝেড়ে ফেলার সুযোগ দেয়। ময়ূরপুচ্ছ পরে ঘোরার দায় থেকে মুক্তি দেয়। প্রাপ্তবয়স্ক, ব্যক্তিগত, স্বাধীনতা - এ সমস্ত মুখের কথা, মনে মনে কেউ এ সব চায় না। নিজের জন্যও না। লোকে বন্ধন চায়। নিজের ভেতর মুক্তিকামনার বীজাণুর কিলবিলানি সকলে সর্বক্ষণ টের পায়। সঙ্গের লোকটিকেও যে একই কীট দংশাচ্ছে সর্বক্ষণ সেটার আন্দাজও সকলেই করতে পারে। নিজের ওপর ভরসা নেই, সঙ্গীর ওপর আরও কম। কাজেই নিজেদের থেকে শক্তিশালী কারও শরণ নিতে হয় সেই কিলবিলানি দমন করার জন্য। সমাজের থেকে শক্তিশালী কী আছে পৃথিবীতে?
কাউকে সে দমনের তোয়াক্কা না করতে দেখলে মানুষের আতংক হয়। পাছে সেই বদ্হাওয়ার ছোঁয়া লেগে তার নিজের এবং সঙ্গীর দমনে ফাঁকি পড়ে। ঝড় ওঠে। সে ঝড় প্রবল সুখ যেমন দেবে, ছত্রখানও করবে। পরকীয়ার প্রতি ঘৃণা আসে এই ভয় থেকেই। ‘বিয়েকে যারা মুখ ভ্যাংচায় তাদের জিভ টেনে ছিঁড়ে দেওয়া দরকার’, এ ঘোষণা চোখে চোখে রেখে করতে পারবে না অনেকেই , কিন্তু ঘরের ভেতর সোশ্যাল মিডিয়ার আড়ালে বসে টাইপ করে দিতে পারবে। আমি চাই পরকীয়ারোধে সোশ্যাল মিডিয়া আরও সক্রিয় ভূমিকা নিক, আরও বিদ্রূপ হানুক, আরও ঘৃণা বর্ষাক। নিভৃত চ্যাট স্ক্রিনশট হোক, ঘনিষ্ঠ মুহূর্তদের ভিডিও ভাইরাল। পুরুষটির চাকরি যাক, মেয়েটির চরিত্র।
গুমোট হয়ে রয়েছে চারধার। আকাশে মেঘ। রাতে বৃষ্টি হলে ভালো। নিশীথরাতের বাদলধারার মধ্যে একটা রোম্যান্স আছে, তাই না? আজ মায়ের ঘরে দেবব্রত বিশ্বাস। গোধূলিগগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা, আমার যা কিছু ছিল হয়ে গেল হারা।
শুভমের কথাগুলো মাথায় ঘুরছে। ওর সঙ্গে সময় কাটানোটা এই জন্য বিরক্তিকর। রেশ রেখে যায়। শুভম টাইপের লোকেরা, যা সত্যি বলে ভাবে, বিশ্বাস করে, সেটার জন্য লড়ে যায়। সে সত্যিটা ক্ষতিকারক হতে পারে, বিধ্বংসী হতে পারে, অ্যাট অল সত্যি নাও হতে পারে, তাতে ওদের কিস্যু এসে যায় না। এরা দ্বিধামুক্ত, সংশয়হীন। এই অন্ধত্বের ফোর্সটাকে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব।
ডেটা যা-ই দেখাক, সত্যিটা, শুভমের ভাষায় যা ইউনিভার্সাল ট্রুথ, কি সত্যিই আমার অজানা? বাড়িতে থাকা মায়েদের হাতের, বা অন্তত সক্রিয় তদারকির, রান্নাবান্না খেয়ে বড় হওয়া বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের সঙ্গে ন-টা পাঁচটা মায়েদের সন্তানদের স্বাস্থ্যের তফাৎ কি আমরা সকলেই প্রত্যক্ষ করিনি? বাড়িতে? পাড়ায়? তাছাড়া প্রশ্নটা শুধু রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়ার না। প্রশ্নটা সামগ্রিক লালনপালনের। মায়ের মতো কে পারে? বাবাও না। আমাদের মতো একান্নবর্তী পরিবার এখন আঙুলে গোনা। অধিকাংশ পরিবার নিউক্লিয়ার। সেখানে মায়ের চাকরি করতে যাওয়া মানে বাচ্চার ভরণপোষণ আয়াজাতীয় কর্মচারীর হাতে ছেড়ে দেওয়া। টাকার বিনিময়ে সে কর্মচারীরা কতখানি বাৎসল্য জোগাড় করে উঠতে পারবে বা আদৌ করা সম্ভব কি না সে সব ছেড়ে দিলেও একটা গুরুতর প্রসঙ্গ ছাড়া চলে না। প্রতিদিন পিলপিল করে লোক্যাল ট্রেনে করে চাকরি করতে আসার সময় নিজেদের শ্রেণী ও পারিপার্শ্বিকতার ভ্যালুজ, ভাষা ইত্যাদিও তো এরা সঙ্গে করে নিয়ে আসে। বাড়িতে রেখে আসে না। সেগুলো একটি শিক্ষিত বাড়ির বাচ্চার চেতনায় প্রোথিত হয়ে যায় জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে। পরিবারের পক্ষে তো বটেই, সমাজের পক্ষেও এ ব্যাপার চিন্তার।
আইনত এখনও মেয়েদের বাড়িতে থাকা বাধ্যতামূলক করা যায়নি। দেশের ভেতরে লবিবাজি আছে, বাইরে আন্তর্জাতিক আঙিনায় মুখরক্ষার দায় আছে। আইন ছাড়াও অবশ্য অন্যান্য উপায় আছে সমাজের গতিপথ বদলানোর। আইনের থেকে বেশি এফেক্টিভ। যেমন জনমত গঠন। হলে সিনেমা শুরুর আগে প্রাক্তন নায়িকাদের দিয়ে বলানো, বাচ্চার জন্ম দেওয়ার পর কেরিয়ার ছেড়ে তাঁরা একটুও আফসোস করছেন না। চটুল বিনোদনের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নিজের দিনের বারোঘণ্টা নষ্ট করার থেকে একজন সুনাগরিক তৈরিতে করাতে জীবন উৎসর্গ করা অনেক বেশি ফুলফিলিং। পাপারাৎজির ক্যামেরার ফ্ল্যাশের থেকে অনেক রিওয়ার্ডিং সুস্থ ও সুখী সন্তানের মুখের হাসি। আশ্রমের দীক্ষিত মহিলাদের অ্যাকটিভলি এনকারেজ করা হয় চাকরি ছাড়তে। পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ না করে সনাতন আদর্শে বাচ্চা লালনপালন করার টিপস অ্যান্ড ট্রিকস নিয়ে নিয়মিত ওয়র্কশপ পরিচালনা করেন নারীকল্যাণ শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত সাধ্বীরা। উন্নততর ম্যাটারনিটি লিভ বা মহিলাদের ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর সুবিধে দেওয়াটা একটা বিকল্প, যার সম্ভাবনা আমাদের মতো দেশে এখনও করা যায়নি, অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সে অজুহাতে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে হেলাছেদ্দা করা নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারা।
জনমত দিয়ে নীতিনির্ধারণের সফল উদাহরণ আছে আমাদের দেশে। প্রতিপক্ষ ছিল বিশ্বের তাবড় পুঁজিবাদী কর্পোরেশন। যারা চকচকে বিজ্ঞাপন দেখিয়ে জনগণকে, বিশেষ করে মেয়েদের, বুঝিয়েছিল, স্তন্যপানের তুলনায় বেটার বিকল্প ফর্মুলা। তারপর ফর্মুলার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা হল। লিফলেট, বিজ্ঞাপন, পথনাটিকা। পাড়ায় পাড়ায় ‘ফর্মুলা ফাইটারস’ নামে স্বেচ্ছাসেবীর দল। স্থানীয় দোকানগুলোর পুরোনো স্টক গঙ্গায় ফেলে দিতে বাধ্য করা হল, নজর রাখা হল নতুন স্টক না আসার দিকেও।
জোগান বন্ধের থেকেও বেশি জরুরি চাহিদার নিয়ন্ত্রণ। নাগরিকদের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বাড়িতে জমানো ফর্মুলার স্টক স্বেচ্ছায় স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে তুলে দেওয়ার। মায়ের দুধের প্রশংসায় জাতীয় কবিরা গান বেঁধেছিল, জাতীয় সুরকারেরা সুর দিয়েছিল। মিউজিক ভিডিও তৈরি করেছিল জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালকরা। সেই গান গেয়ে পাড়ায় পাড়ায়, হাউসিং-এ হাউসিং-এ হারমোনিয়াম ঢোল সহযোগে ফাইটারসদের প্রভাতফেরি বার হত। রাঙাকাকা ছিল আমাদের পাড়ার ফাইটারস গ্রুপের ফাউন্ডার মেম্বার। গানের গলা এখনও ভালো, তখন চমৎকার ছিল। কাশফুলের ডাঁটার মতো শরীর নিয়ে গান গাইতে গাইতে রাঙাকাকা যখন পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে ঘুরত, মহিলাদের বুকের রক্ত ছলকাত নিশ্চয়। কিন্তু রাঙাকাকিমার কপাল খারাপ, রাঙাকাকু ততদিনে টার্গেট সেট করে ফেলেছে। জড়ো করা ফর্মুলার টেটরাপ্যাক, টিন জোগাড় করে মাঠে জড়ো করে আগুন দেওয়া হয়েছে, আগুনের বিন্দু পটপট ফাটছে বটগাছটার মাথা ছাড়িয়ে, পটপট ফাটছে আগুনের প্লাস্টিকের পোড়া গন্ধ, গলন্ত টিনের ঝাঁজের নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়ানো ভিড়ের উল্লাস, এখনও আবছা আবছা স্মৃতিতে আছে।
এখন ঢিলে হয়ে গেলেও শুরুর দিকে শ্যেনদৃষ্টিতে নজরদারি চলত। মুদির দোকান থেকে কেউ কালো প্যাকেট হাতে ফিরছে দেখলেই তল্লাশি। প্যাকেট থেকে হয় স্যানিটারি ন্যাপকিন বেরোত, নয় ফর্মুলা। ন্যাপকিন বেরোলে, ‘বউদিকে দেশী কাপড় ব্যবহার করতে বলুন, এগুলো নারীদের স্বাস্থ্যের পরিপন্থী ইত্যাদি ফ্রেন্ডলি পরামর্শ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হত।‘ ফর্মুলা বেরোলে পরিস্থিতি কঠিন হত। বামালসহ মহিলা ধরা পড়লে শাস্তি কম। কারণ চকচকে বিজ্ঞাপনের শিকার মেয়েরা বেশি হবে প্রত্যাশিত। বাধ্যতামূলক মেম্বারশিপ গ্রহণ, আশ্রমে শ্রমদান, রোজ পাঠে যাওয়া ইত্যাদির ওপর দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হত। পুরুষদের ভোগান্তি বেশি কারণ দোষও। এক, আশ্রমের নির্দেশ অগ্রাহ্য করা, দুই, স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। ব্যাকওয়ার্ড এলাকায় শাস্তি গণপিটুনিতে গড়াত, শহরের দিকে হালকা চালের এবং মারধোরের থেকে ঢের বেশি এফেক্টিভ। কান ধরে ওঠবোস কমন ছিল। কোথাও কোথাও লোকটিকে বসিয়ে কিনে আনা ফর্মুলা খাওয়ানো হত। প্রতি পাড়াতেই কোনও না কোনও খবরের কাগজের, টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদক থাকত, তারা ছবি, ভিডিও তুলত গোটা প্রক্রিয়ার। নামধাম সহ সে ছবি, ভিডিও প্রচার হত।
এখনও ফর্মুলা চলে, ব্ল্যাক মার্কেটে। দাম। যারা অ্যাফর্ড করতে পারে ব্যবহারও করে নিশ্চয়। কিন্তু এই যে একটা পণ্যকে আইন কিংবা বাজারের সাহায্য ছাড়া সাধারণের জীবনাচরণের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া, সেটা বিপ্লবের সাফল্যের ধ্রুবক বলে আমি মনে করি।
ঘুম পাচ্ছে। শুয়ে পড়ি। তোমার গলাটা শুনতে ইচ্ছে করছে। সংযমপালন করছি। পরশুই ফোন করেছিলাম। রিস্ক হয়ে যাবে। তাছাড়া আজ বিকেলে দেখা হল তো। গেটের মুখে দাঁড়িয়ে ছিলে। পাশের দোকানটায় চুইয়িংগাম কিনছিলাম একাগ্র ভঙ্গিতে। দলবল ছিল না, খালি তুমি আর ওই ঢ্যাঙা ছেলেটা। ঝড় উঠবে উঠবে করছিল। একটা শুকনো পাতা উড়ে তোমার চুলে আটকাল, ছেলেটা একমুহূর্ত দ্বিধা করল, তারপর নিজেই হাত দিয়ে তুলে ফেলে দিল পাতাটা।
৬
অন্যদিন ঘরে ঢোকার পর মা আসে চায়ের খোঁজ নিতে। বা সবিতাকে পাঠায়। পনেরো মিনিট পরেও কেউ এল না। বারান্দা ফাঁকা। জেঠির ঘর শব্দহীন। মায়ের ঘর অন্ধকার গুহা। গেট দিয়ে ঢোকার সময় পাঁশুটে রঙের ওয়াগন-আরটা বেরোচ্ছিল। মিত্রকাকু স্টিয়ারিং-এ, পাশে কাকিমা। দুজনেরই মুখ থমথমে। আমার হাত নাড়া কেউই দেখতে পাননি সম্ভবত।
চারতলায় গেলাম। জিষ্ণু থাকবে কি না জানি না। চারতলাটা বেসিক্যালি ছাদ, চিলেকোঠাটাকে জিষ্ণু গাজোয়ারি ঘর বানিয়েছে। নিচের তলাগুলোয় অন্তত দুটো বেডরুম খালি থাকা সত্ত্বেও। সিংগল খাট, চেয়ারটেবিল, বুককেস। জামাকাপড় রাখার দেওয়াল আলমারি। ‘আর কিচ্ছু লাগবে না’ চেঁচামেচি করেছিল জিষ্ণু কিন্তু গ্রীষ্মে তেতে থাকবে বলে বাবা জোর করে এসি লাগিয়ে দিয়েছে। তবে ভরদুপুর ছাড়া এসি লাগে না। দরজা খুললে ছাদ। জানালা খূললে বাগান পেরিয়ে পুকুর। দরজা জানালা দুটোই খুলে দিলে হাওয়া হইহই করে যাতায়াত করে। নিচের ক্যালরব্যালর ওপরে পৌঁছয় না। জিষ্ণুর উপস্থিতির আভাসও নিচের নাগালের বাইরে থাকে।
আমার ধারণা জিষ্ণু আমাদের মধ্যে সবথেকে বুদ্ধিমান। সবথেকে লম্বাও। এত লম্বা যে কুঁজো হয়ে গেছে। বডি মাস ইন্ডেক্স সম্ভবত সিংগল ডিজিট। দরজা খুলে ‘পরে কথা বলছি’ বলে মোবাইলটা কাটল। যে রকম ষড়যন্ত্রমূলক ভঙ্গি, সম্ভবত গার্লফ্রেন্ড। ভাইবোনদের আড্ডায় ছোটরা প্রচুর ঝোলাঝুলি করেছে ওর গার্লফ্রেন্ডের পরিচয় বার করতে, জিষ্ণু ঘাড় পাতেনি। ‘আমার সঙ্গে কে প্রেম করবে বস্’ বলে করুণ মুখ করেছে।
মশারির দুটো খুঁট পার্মানেন্টলি দেওয়ালে বাঁধা। খাটে, টেবিলে, বইখাতা ছত্রাকার। আমার পি এইচ ডি শেষ হওয়ার আগে জিষ্ণু ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যাবে নির্ঘাত। দেওয়ালে নানাবিধ পোস্টার। সিনেমার, কবিতার। খাটের ফাঁকা দেড়ফুট আমাকে ছেড়ে দিয়ে জামার বান্ডিল মেঝেতে ছুঁড়ে চেয়ারে বসল।
‘শুনেছ তো?’
চেকআপের রিপোর্ট এসেছে। মিন্টি কোনওদিন মা হতে পারবে না।
‘কোনওদিন না?’
‘নেভার।‘
তিনটে বই উল্টে চার নম্বর বইয়ের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট উদ্ধার করল জিষ্ণু। নেব না জানা সত্ত্বেও অফার করে নিজে ধরাল।
‘এই গোটা ফিয়্যাসকোটা অ্যাভয়েড করা যেত। ওইরকম পাখি মার্কা মেয়ে, হার্ডলি সাতচল্লিশ কেজি, দু’চারটে চড়থাপ্পড় মারলেই কাজ হয়ে যেত। তা না, একেবারে রডফড চেনফেন নিয়ে চড়াও হয়েছে।‘
‘বুবুলটার চিরদিন মাথা গরম।‘
‘মাথাগরম না হাতি। এ সব ওই হারামি পিন্টুর কাজ। গোটা প্ল্যানটা ও বড়দার মাথায় ঢুকিয়েছে।‘
মাঠের ওপারের লাইনবাড়িতে থাকত পিনটু। আই গেস, এখনও থাকে। মায়ের সঙ্গে। দুটো না তিনটে দিদিও ছিল সম্ভবত। পিন্টুর মা আমাদের বাড়ি কাজ করত। বাবা বিভিন্ন কারণে জেলে যেত, বেরোত, বিভিন্ন মহিলাদের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে থাকত। রোটেশনে পিন্টুর মায়ের ঘরেও আসত কখনওসখনও রাতেবিরেতে, মাতাল হয়ে। আমার বুবুলের থেকে বয়সে ছোট ছিল পিন্টু। রোগাপ্যাংলা অপুষ্ট চেহারা, খেলার মাঠে মার খেত খুব। পরের দিন আবার আসত। এখন পিন্টু আর মার খায় না, মারে। পার্টি করে। গোড়াতে প্লেন গুণ্ডামি করে বেড়াত। তোলাবাজি ইত্যাদি। গতবছর একটা খুনের মামলায় জড়িয়েছিল। আপাতত যুবশাখার কী যেন একটা পোস্ট পেয়েছে। খেলার মাঠে বুবুলের হাতে সবথেকে বেশি মার খেয়েছে, কিন্তু বুবুলকে প্রায় পুজো করে। প্রায়ই আসে বাড়িতে। বন্ধুদেরও নিয়ে আসে মাঝে মাঝে। দরজা বন্ধ করে বুবুল দামি স্কচ খাওয়ায়।
‘ও তো পলিটিক্সে ঢুকেছে জানতাম। এ সবে ইন্টারেস্ট রাখে জানতাম না তো।‘
‘যে কোনও ভায়োলেন্সে পিন্টু ইন্টারেস্ট রাখে। কী বলছি তোমাকে? টোটাল সাইকো।‘ জিষ্ণু গম্ভীর মুখে সিগারেট টানে। আমরা চুপ করে বসে থাকি।
আর বাড়িটা বদলে যায়, বুঝলে ক্রান্তি। ওপর ওপর বৈঠকখানায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ভিড়, রান্নাবান্না, হাসাহাসি, টিভি দেখাদেখি, রাত বাড়লে মায়ের ঘর থেকে গান, গ্যারাজ থেকে একে একে গাড়ির নিষ্ক্রমণ। তলে তলে চাপ জমাট বাঁধে। মিন্টি বাপের বাড়ি যায়। গত মাসে একবার, এ মাসে দু’বার। আগের মাসে সাতদিন থেকে ফিরে এসেছিল, এবার দু’সপ্তাহ হতে চলল, এখনও ফেরেনি। রাঙাকাকিমা, মা, জেঠি, সবিতা, বুলটি দল বেঁধে গিয়ে দেখে এসেছে। এসে বলেছে, ‘আহা একমাত্র মেয়ে, কাছে থাকলে বাবামায়ের মন ভালো থাকে।‘
বুবুলের সঙ্গে লাস্ট কবে দেখা হয়েছে মনে করতে পারি না। আমিও যতক্ষণ পারি ক্যাম্পাসে থাকি। বাড়িতে থাকলে দরজা বন্ধ করে ঘরে শুয়ে থাকি, নয়তো ডায়রিতে তোমার সঙ্গে কথা বলি। কোনওটাই ইচ্ছে না করলে চারতলায় যাই। জিষ্ণুর পরীক্ষা লেগেই থাকে। ‘সরি’ বলে চলে আসার উপক্রম করলে জোর করে বসায়। ও পড়ে, আমি ল্যাপটপে সিনেমা দেখি, গল্পের বই পড়ি। একদিন, ‘দেখবে একটা জিনিস?’ বলে গুঁড়ি মেরে খাটের তলা থেকে একটা ট্রাংক বার করল। ট্রাংক, জিষ্ণু, দুজনেরই সর্বাঙ্গে ঝুল। ডালা খুলতে আমি হাঁ। ভেতরে আমার আর বুবুলের যাবতীয় খেলনা। কমিক্সের তাড়া। ভাগাভাগি নিয়ে শত সংগ্রামের সাক্ষী। আঁকার কম্পিটিশনে প্রাইজ পাওয়া আমার জলরং-এর সেট, স্পোর্টসে একশো মিটার রানে বুবুলের কাপ। জিষ্ণু অংক করে, আমি কমিক্স পড়ি। জিষ্ণুর ফোন বাজে, কমিক্সে ডুবে থাকার ভান করি, আড়চোখে আমাকে দেখে ‘এক মিনিট’ ফিসফিসিয়ে ছাদে বেরিয়ে যায় জিষ্ণু। দরজা দিয়ে জুঁইয়ের গন্ধ আসে।
কোনও কোনও সন্ধেয় তেলেভাজা নিয়ে ফিরি। সবিতা চা মুড়ি দিয়ে যায়। ‘ছোড়দা, পি এইচ ডি ঝটপট শেষ কর, তারপর দেশ ছাড়। আমি তো কাটছি। ফাইন্যাল পরীক্ষা হয়ে গেলেই আই অ্যাম আউট অফ হিয়ার।‘ ঠ্যাং নাচাতে নাচাতে মুড়ি মুখের ভেতর ছুঁড়ে ফেলে জিষ্ণু।
জিষ্ণুকে তোমার কথা বলতে ইচ্ছে করে মাঝেমাঝে।
জিষ্ণু অংকে ফিরে যায়, আমি যা করছিলাম সেটা করার ভান করতে করতে ভাবি, সত্যি, কাটতে হবে। বাইরে অ্যাপ্লাই করব পোস্ট ডকের। একটা কিছু কি পাব না? তোমাকে নিয়ে চলে যাব। হিমাংশু, শুভম, গুরুদেব, আশ্রম, শত শত বছরের জং ধরা ঝুল পড়া সিংহ ক্ল্যানের মুখে লাথি মেরে আমিতুমি ডানা মেলে উড়ে যাব।
একদিন বৈঠকখানার পাশ দিয়ে পাস করছি, দৃষ্টিকোণে একঝলক সাদা। বাবা। সাদা গেঞ্জি, সাদা ধুতি। মাথার চুল, যা এখনও প্রচুর বাবার, কারণ আমাদের বংশে টাক নেই, সেই চুলেও সাদা। দরজার দিকে পিঠ। দুই হাত পেছনে জড়ো। মুখ, পশ্চিমের দেওয়ালের দিকে উত্থিত। তিন দেওয়াল ভরে বিভিন্ন রকম বিক্রম সিংহের পারমুটেশন কম্বিনেশনের পর ওই ফাঁকা দেওয়ালে জায়গা নেবে জেঠু, বাবা, রাঙাকাকা। তারপর বুবুল, আমি। জিষ্ণু আশা করা যায় আরেকটু সময় পাবে মাটিতে থাকার।
তারপর?
বুবুলের সন্তান হবে না। আমি বাবার খরচের খাতায়। আমি ডাকাবুকো হতে পারিনি, আমি সায়েন্স নিয়ে পড়িনি, আমি বুবুল হতে পারিনি। বাবা চুপ করে থেকেছেন, কিন্তু আমার নাম ক্রমাগত তাঁর প্রত্যাশার লিস্ট থেকে কেটে দিয়েছেন। জিষ্ণু হয়তো পারবে আরও একটা বিক্রমের জন্ম দিতে, কিন্তু প্রলয়বিক্রমের লিনিয়েজ এখানেই শেষ।
মুখোমুখি পড়া সর্বদা এড়াতে চেয়েছি। কাজেই সাদায় আবৃত বাবার ওই পিঠ, ফর্সা আজানুলম্বিত হাত, জড়ো করা কবজিতে কালো চামড়ার ব্যান্ড অজস্রবার দেখেছি। যতবার এসে দাঁড়িয়েছেন বারান্দায়। নীরবে সংসারের ওপর চোখ বুলিয়েছেন। সবিতা কথা বন্ধ করেছে, রাঙাকাকিমা হাসেনি, বুলটির বেড়াল নেত্যকালী সুট করে গলে গেছে।
কিন্তু ওই পিঠ, কাঁধ, মাথার কাঁচাপাকা চুল থেকে অমন পরাজয়, অমন অসহায়তা বিকীর্ণ হতে আগে কখনও দেখিনি।
বুবুল বাবাকে হতাশ করেছে। আমি করব না, ক্রান্তি। আমি বাবার মুঠো আলগা হতে দেব না। বাবাকে শূন্য দেওয়ালের সামনে হেরে যাওয়া পিঠ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেব না। তোমাকে বিয়ে করব। আমার ঔরস গর্ভে ধারণ করে তুমি সিংহবাড়ির উত্তরাধিকারীর জন্ম দেবে।
তোমাকে বলব। শিগগিরই। ডায়রিতে নয়, সশরীরে গিয়ে সামনে দাঁড়াব। গত তিন বছর ধরে ধরে শয়নে, জাগরণে, আনন্দে, শোকে যত কথা বলেছি তোমাকে মনে মনে, চোখের দিকে তাকিয়ে বলব সব। আমার সমস্ত অপেক্ষার অবসান হবে।
৭
বাকিরা বেরিয়ে গেলে অফিসের ডিপ্রেসিং টিউবলাইট নিভিয়ে দিই। আজও দিয়েছি। আপাতত বসে আছি ল্যাপটপের নীল আভায়। চোখ জ্বলছে। কনভেনশনাল উইসডম যা-ই বলুক, শুভম যা-ই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করুক, এপাড়া ওপাড়া থেকে আমি যতই অ্যানেকডোটাল এভিডেন্স জড়ো করে আনি না কেন, ডেটা বলছে সন্তানের স্বাস্থ্যের ওপর মায়েদের চাকরি করার প্রভাব ইনসিগনিফিক্যান্ট। সমাজের শিক্ষার লেভেল, অ্যাকসেস টু হেলথকেয়ার, নিউট্রিশন প্রোফাইল সমস্ত কিছু স্ট্রং সিগনিফিক্যান্ট প্রভাব ফেলে ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্যের ওপর, মায়েদের চাকরি নয়। অনেক টর্চার করেছি, ডেটা কনফেস করেনি। কোনও কোনও ইটারেশনে অ্যাকচুয়ালি পজিটিভ এসেছে। মায়ের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা শিশুর স্বাস্থ্যের পক্ষে মঙ্গলজনক।
চকচক করছে ক্যাম্পাস। পুকুরপাড়, ঝোপের আড়াল, গলিঘুঁজি উদোম করে রেখেছে ত্রিশূল আলো। যাতে এক ইঞ্চি গোপনীয়তা না থাকে কোথাও, কোনও কোণে অসনাতন মূল্যবোধের চাষ না হয়। পুকুরের ওপর ছোট্ট লাভার্স ব্রিজ আলোতে ফটফট করছে। কোনও লাভারের সাধ্য নেই ও ব্রিজে পা রাখার।
একসময় ভরে থাকত লাভার্স লেন, লাভার্স ব্রিজ। সিঁড়িতে সিঁড়িতে, ফাঁকা ক্লাসরুমে, ঝোপের ধারে লাভের চাষ হত। শহরের পার্করা বিখ্যাত ছিল প্রেমের গন্তব্য হিসেবে। সে সব ছবি দেখেছি আমি। দিবালোকে হাত ধরাধরি করে ঘুরছে ছেলেমেয়েরা, এমনকি দুটি ছেলে বা দুটি মেয়েও জুটি বেঁধে। ট্রামে বাসে ট্রেনে ঠোঁটে ঠোঁট। সংস্কৃতির পীঠস্থানের ফোয়ারা ঘিরে প্রেমের সার্কাস। প্রেমিকপ্রেমিকাদের একটি প্রকাণ্ড শিকল তৈরি হয়েছে, কার সঙ্গে কে বোঝা দুষ্কর। পার্কে পার্কে ঝোপ নড়ছে, ছাতার আড়ালে নারকীয় উদযাপন চলছে প্রেমের।
ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে পড়ি। আমি জানি না এই রেজাল্ট নিয়ে আমি কী করব। দেশের পলিসি নির্ণয়ে কোনও কাজে লাগবে না, পাবলিশ হওয়ার সম্ভাবনাও কম। কিন্তু আমি আর কেয়ার করি না। এমনিও যুগান্তকারী কিছু রিসার্চ করছি না যে পাবলিশ না হলে বিরাট কিছু ক্ষতি হয়ে যাবে। আমার কেরিয়ারের কিংবা মানবসভ্যতার নলেজ পুলের। নেক্সট ছ’মাসে এ গর্ভযন্ত্রণা র্যাপ আপ করছি। ফ্যাকাল্টির প্রোফাইল, পাবলিকেশনস ঘেঁটে অলরেডি কয়েকটা ইউনিভার্সিটি শর্টলিস্ট করেছি বাইরের। এবার অ্যাপ্লাই করা শুরু করব।
অফিস বন্ধ করে বেরিয়ে আসি। বিল্ডিং ফাঁকা। ভুতের ভয় থাকলে এতক্ষণ কাজ করা কঠিন হত। গ্রিন ক্যাম্পাস মুভমেন্টে শনি রবি চব্বিশঘণ্টা, সোম টু শুক্র রাত আটটা টু সকাল আটটা লিফট বন্ধ। সিঁড়ির ধাপে জানালার খোপকাটা ছায়া। ফোর্থ ফ্লোর। থার্ড ফ্লোর। তোমাদের ডিপার্টমেন্ট। নোটিসবোর্ডে অনেকসময় ডিপার্টমেন্টাল সেমিনার ইত্যাদির পোস্টার, ছবি সাঁটা থাকে। সেই রকম একটা ছবিতে হলুদ টপ আর নীল জিন্স পরা তুমি ছিলে। নোটপ্যাডের ওপর উদ্যত পেন, মনোযোগী মুখ সামান্য ওপরে তোলা। ছবিটা জমিয়ে রেখেছি আমার অ্যালবামে।
তোমাদের অফিসঘরের দিকে এগোতে এগোতে ফোনটা বার করি। আজকাল ওটা ক্যারি করি। যবে থেকে মিন্টির খবরটা পেয়েছি, বাবাকে আবিষ্কার করেছি বৈঠকখানায়, যখন থেকে স্থির করেছি তোমাকে নিয়ে চলে যাব, তোমার কাছাকাছি থাকার ইচ্ছে তীব্র হয়েছে। সর্বক্ষণ দেখতে ইচ্ছে করে, সর্বক্ষণ গলা শুনতে ইচ্ছে করে। রিস্কি জেনেও সামলাতে পারি না। অবশ্য রিস্ক কীসের। আর তো ক’টা দিন। এত হেরে যাওয়া, এত না-পারার পর অবশেষে সুখ। লালনীল সংসারে আমি আর তুমি। এই বিশ্রী শহরে না, ওই বিষণ্ণ বাড়িতে না। বরফচুড়ো পাহাড়ের ব্যাকগ্রাউন্ডে তিনকোণা ছাদ বাড়ি হবে আমাদের। ধপধপে রেলিংঘেরা সবুজ বাগানে আমাদের ছেলে ছুটোছুটি করবে। ছুটিতে বাড়ি আসব। সুটকেস ভর্তি গিফট, জেঠি, মা, রাঙাকাকিমা, বুল্টি, সবিতা, সবিতার ছেলের জন্য। জিষ্ণুর জন্য লেটেস্ট এডিশন প্লেস্টেশন। প্রণাম করে উঠলে বাবা আমার দিকে তাকাবে। আমার দিকে, তোমার দিকে, আমাদের মাঝখানে দাঁড়ানো আমাদের ছেলের দিকে। স্কুলের প্রাইজ নিয়ে আসার পর, সার্ভিস ইউনিফর্ম পরে দাঁড়ানোর পর, যেমন করে বুবুলের দিকে তাকিয়েছে আজীবন।
তোমার নম্বর ডায়াল করি। বাইরে গিয়ে করলে হত। করিডোরগুলোতে অনেকসময় নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না।
গেছে। রিং হচ্ছে। করিডরময় ব্লিচের গন্ধ। আরেকটা রিং বাজছে কোথাও এই ফ্লোরেই। আমি ছাড়াও কেউ আছে নাকি? ফোন কেটে দিই। রিং থেমে যায়।
আবার ডায়াল করি। রিং শুরু হয়। একটা কানে। একটা কানের বাইরে। ফোন কানে চেপে দ্বিতীয় রিং-এর উৎসের দিকে হাঁটি। দুপাশে অন্ধকার ক্লাসরুমের সারি। তুমি কি ফোন ফেলে রেখে গেছ কোনও একটায়?
কানের ভেতরের রিংটা বন্ধ হয়ে যায়। বাইরেরটাও।
ডানদিকের ক্লাসরুমটা যতটা অন্ধকার থাকার কথা, ততটা অন্ধকার নয়। যতটা খালি থাকার কথা ততটা খালি নয়।
‘ধরে নাও। জরুরিও তো হতে পারে।‘
বলার ভঙ্গিতে স্পষ্ট যে বক্তা আদৌ মনে করে না ফোনটা জরুরি। বা জরুরি হওয়া সত্ত্বেও ফোনটা কেটে দেওয়ায় সে খুশি।
‘ধুস। যতসব স্প্যাম। আসতেই থাকে। সকাল, দুপুর, সন্ধে, মাঝরাত্তির।‘ তুমি আশ্বাস দাও।
করিডরের এই প্রান্তের টিউবলাইট খারাপ। ওই প্রান্তের টিউব সে খামতি বোজানোর চেষ্টাও করেনি। রুমের বাইরে সরাসরি কোনও স্ট্রিটল্যাম্প নেই। অন্ধকার রুমে খালি তোমাদের শরীরের আভাস। হাড় মাংস প্রবৃত্তি জরজর দুটো ছায়া। দরজার পাল্লার আড়ালে সেঁটে যাই, হৃদপিণ্ডের শব্দটুকু চাপা দিতে পারলে ভালো হত। কান খাড়া করি।
কিন্তু তোমরা আর কিছু বল না। দুটো ছায়া দলা পাকায়। ছাড়ে। আবার জোড়ে। ঠোঁট ত্বক শোষে। বেঞ্চ ক্যাঁচ করে ওঠে। আউচ। হাসি। ভুতের মতো দাঁড়িয়ে শুনি। আমার দৃষ্টি অন্ধ, আমার চেতনা লুপ্ত, কেবল তোমাদের শরীরের ওঠাপড়া, বেঞ্চের আর্তনাদ, ব্যথা এবং আদর, চুমু এবং হাসি, হাসি এবং চুমু, যন্ত্রণা কিংবা উল্লাসের গোঙানি ফুলে ফেঁপে ওঠে আমাকে গ্রাস করে, আমি ডুবে যাই, বুকের ভেতর রুদ্ধ শ্বাস ফুলে ওঠে, ফুলে ওঠে, ফুলে ওঠে, বাঁচার শেষ চেষ্টায় হাঁ করি, ছেলেটার ভেতর থেকে একটা দীর্ঘ, আর্ত আআআহ্ বেরিয়ে আসে।
৮
পিন্টুর পাঁচফুট পাঁচ শরীরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, কিন্তু হচ্ছে। ফুটপাথের অর্ধেক দখল করা স্টলগুলোর বইয়ের থাককে সমীহ করতে হচ্ছে পাছে শরীরের ধাক্কা লেগে পড়ে যায়, উল্টোদিক থেকে আসা ঘর্মাক্ত ভিড়ের স্পর্শ এড়াতে সিঁটিয়ে যেতে হচ্ছে, ঠেলাগাড়ির দুপাশ থেকে উঁচোনো বাঁশ থেকে আত্মরক্ষা করতে গলির মুখে থমকাতে হচ্ছে, অতর্কিতে উড়ে আসা চেটে নেওয়া শালপাতা ডজ করতে হচ্ছে।
পিন্টু গটগট করে হেঁটে চলেছে। যেন গোটা শহরের মালিকানা ওর।
এ দিকটায় এসেছি আগে, হিমাংশুর সঙ্গে, কফি খেয়েছি, বইপত্র নেড়েছিচেড়েছি, ফিরে গেছি। গলিঘুঁজি ঘুরে দেখিনি। বাড়ি, স্কুল, ইউনিভার্সিটি, আশ্রম, সিনেমাহল ছাড়া জন্মাবধি কাটানো একটা শহরের কিছুই চিনি না।
ঠিক যেমন জানি না, জীবনের প্রবলেম সল্ভ করতে। দেশদশের যাবতীয় সমস্যা নিয়ে সকালবিকেল রাজাউজির মারি। ওয়েল, লোকজনকে মারতে শুনি বসে বসে এবং মুখে না বললেও নিজের মাথার ভেতর অবলীলায় সে সব সমস্যার সমাধানেও পৌঁছই। অথচ পিন্টুর নাগাল কোন পথে পাব স্থির করতে কেটে গেল কতগুলো সপ্তাহ। বুবুলের সঙ্গে দেখা হয় না, হলেও জিজ্ঞাসা করতাম না। বাড়িতে এই মুহূর্তে একজনের সঙ্গেই সত্যিকারের যোগাযোগ আছে, জিষ্ণু। ওকে জড়ানোর প্রশ্নই নেই।
প্রথম দুটো সপ্তাহ কিছুই করিনি। পারিনি, রাদার। শরীরের মতো মনেরও যে প্যারালাইসিস হয়, জানলাম। মাথার ভেতর, বুকের মধ্যে কোনও সাড়া ছিল না। ক্যাম্পাস যাইনি। ডায়রি লিখিনি। মাথার ভেতর তোমার অ্যালবামও খুলিনি। ঘর থেকে বেরোতে হয়েছে স্বাভাবিকতার সেমব্লেন্স রক্ষার্থে। না হলে খাচ্ছিস না কেন, কথা বলছিস না কেন, হাসছিস না কেন-র সুনামি ফেস করতে হত। যেটুক ভাবতে চাই, ভাবা দরকার, বিঘ্নিত হত।
শুধু পিন্টুর নামটা মনে পড়েছিল।
ওই রাস্তায় যাইনি অন্তত কুড়ি বছর। মাঠ ছিল। একটা পুকুরের আভাস স্মৃতিতে। সব বুজিয়ে বাড়ি উঠেছে। বাড়ির থেকেও বেশি ঝুপড়ি। তবু গলিগুলো নির্ভুল বাঁকছিলাম। ডান, বাঁ, আবার বাঁ, ডান। মাসল মেমোরি। পিন্টুর মা কামাই করলে খোঁজ নিতে আসত সবিতা, আমি আর বুবুল সঙ্গ নিতাম। পানের দোকান ছিল একটা, ফেরার পথে দিলখুশ কিনে দিত সবিতা। দিত মানে আমরা ঝোলাঝুলি করতাম। গজা আর শোনপাপড়ির হাইব্রিড, সস্তা, লোক্যাল প্রোডাক্ট। এখন খেলে অখাদ্য লাগার চান্স হাই, তখন অমৃত মনে হত। স্বর্গসুখ দীর্ঘায়িত করার আশায় আমি ভীষণ অল্প অল্প করে খেতাম, বুবুল পারলে গোটাটা একেবারে মুখে পুরত। দুই গাল ফুলিয়ে প্রাণপণ চিবোত, ঠোঁটের চারপাশে গুঁড়ো।
একটা গোয়াল ছিল না? পানের দোকানের মতো সেটাও উধাও। গরু মনে পড়ছে না, তবে গোবর আর ধুনোর গন্ধ নাকে লেগে আছে। এখন ওপচানো নর্দমার টক। মোড় ঘুরে ডানদিকে লাইনবাড়িগুলো। সন্ধে নেমে গিয়েছিল। অন্ধকারে লুকিয়ে আসব বলেই এসেছি কিন্তু ল্যাম্পপোস্টের নিচে পাথরের স্ল্যাব, তিনটে মোটর সাইকেল, পাঁচটা ছেলে। চিৎকার করে কথা বলছিল, আমাকে দেখে গলার আওয়াজ নামতে নামতে নিস্তব্ধতায় ঠেকল।
পিন্টুর সাম্প্রতিক উত্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওর মায়ের ঘর অট্টালিকা হয়ে উঠবে এই রকমের একটা ভেগ কল্পনা মাথার মধ্যে ছিল বোধহয়, সারিবদ্ধ ঘরগুলোর মধ্যে ওদের ঘরটা একবারে চিনে ফেলে হতাশ লাগল। তফাতের মধ্যে দরজার মাথাটা এখন আমার নাকের উচ্চতায় নেমে এসেছে। বাইরে ক্ষয়া চপ্পলের ভিড়, ভেতরে কান ফাটানো টিভি।
শিকল ধরে নাড়ালাম। একবার, দু’বার, তিনবার। টিভিতে চূড়ান্ত কিছু ঘটছে। উল্লাসে কাঁপছে আকাশবাতাস।
ছেলেগুলোর দৃষ্টি আমার ওপর স্থির।
দরজা খুলল। পিন্টুর মা। প্রথমটা আমাকে ঠাহর করতে পারেননি। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা দৈত্য মনে হয়েছে নিশ্চয়।
‘পিন্টু আছে?’
মাথা দুদিকে নড়ল।
যাক। চেষ্টা করার ছিল, করেছি। বাড়ি ফেরা যাক।
‘কখন থাকবে? একটু দরকার ছিল।‘
‘আপনাকে আসতে হবে না। বলে দেব বাড়ি গিয়ে দেখা করে আসতে।‘
চিনেছেন তার মানে। ছোটবেলায় আমাদের বুবুলটুবুল বলে ডাকতেন মহিলা। চেপে গেলাম। আপনি বলছেন কেন, আগের মতো নাম ধরে ডাকুন, ইত্যাদি ভদ্রতা আলগা শোনাবে।
‘ না না। বাড়ি যেতে হবে না।‘ দ্রুত মাথা নাড়ি। মোড়ের মাথার প্রতিটি ঘাড় এখনও এদিকে ঘোরানো।
‘একটু ভেতরে যাওয়া যাবে?’
ওইটুকু ঘরে এত জিনিস এবং এত লোক ধরেছে কী করে রহস্য। ঘরের তিন চতুর্থাংশ জোড়া তক্তপোষে একটা শুঁটকো মতো, লুঙ্গিপরা বুড়ো শুয়ে আছে। নির্ঘাত পিন্টুর বাবা। মেঝেতে কয়েকজন মহিলা বসে টিভি দেখছেন। নীল চলটা ওঠা দেওয়ালে সাঁটা টিভিটা পিন্টুর সাফল্যের সাক্ষ্য দিচ্ছে। প্লাজমা। প্রায় তক্তপোষের সমান। গেম শো চলছে। বল ছুঁড়ে জলের বোতল ফেলে মহিলারা প্রেশার কুকার জিতছেন।
পিন্টুর ফোন নম্বর নিয়ে নিলাম। ফেরার পথেও ছেলেগুলো তাকিয়ে রইল।
বাড়িতে ডাকিনি, বলা বাহুল্য। ক্যাম্পাস থেকে একটু দূরে একটা কফি শপ আছে, বেশি চলে না। সেখানে এসেছিল পিন্টু দেখা করতে।
শুনেটুনে পিন্টু দাঁত বার করল। ‘কনগ্র্যাচুলেশনস। বিয়েতে নেমন্তন্ন কোরো কিন্তু। বুবুলদার মতো ফাঁকি দিয়ো না।‘
ভাবা যায়? যার কথা পৃথিবীর কাউকে বলিনি, হিমাংশুকে না, মাকে না, জিষ্ণুকে পর্যন্ত না, সেই তোমার কথা সবার প্রথম পিন্টুকে বলে দিলাম। একটা লো লাইফ গুণ্ডাকে। ভেবেছিলাম নামটাম উহ্য রাখব। যতখানি না বললে নয়, ততটুকু বলে কাজ সারব। তারপর দেখলাম সবই বলে দিলাম। নামধাম, ডিপার্টমেন্ট। শক্ত হল না।
কেন হল না? কেন আমি আমার জীবনের সবথেকে নিভৃত, অমূল্য অনুভূতিকে এমন একজনের কাছে উন্মুক্ত করে ফেললাম যার জীবনাচরণ, মূল্যবোধ, চেতনাকে মনপ্রাণ দিয়ে ঘৃণা করি? তার মানে কি সেই সন্ধের পর থেকে তোমার প্রতি আমার প্রেম কমে গেছে?
না। কিন্তু রকম বদলেছে। আগে তোমার প্রতি যেটা বোধ করতাম সেটা ইয়ার্নিং। লংগিং। লাইব্রেরির এপার থেকে তোমাকে দেখব। রাতে একা বিছানায় শুয়ে তোমার কথা ভাবব। ফোন করে চুপ করে তোমার গলা শুনব। যেন তুমি গাছের উঁচুতম ডালে ফুটে থাকা একটা ফুল, কিংবা দিগন্তে জেগে থাকা পর্বতচূড়া। কোনওদিন ফুলটা পাড়ব, কোনওদিন পাহাড়টায় চড়ব। কবে, কীভাবে সে সব নিয়ে মাথা ঘামাইনি।
এখন ঘামাই। ইয়ার্নিং-এর জায়গা নিয়েছে ডিটারমিনেশন। তোমাকে পেতে চাই না আর, তোমাকে পাব। কপোলকল্পনা শেষ। এবার অ্যাকশন। এজেন্ডা। ব্লুপ্রিন্ট। ডায়রি লেখাও কমে গেছে ওই কারণেই। এত কথা কল্পনার তুমিকে বলে কী হবে? আর ক’দিন পরেই তো তুমি আমার নাগালে, সশরীরে। তখন যা কথা হওয়ার হবে। তোমাকে নাগালে আনার প্রক্রিয়ায় আমাকে সাহায্য করবে পিন্টু। কাজেই ওকে এই কদিনের জন্য সহ্য করে নিতে হবে। ফলাফল সুনিশ্চিত করতে যা যা তথ্য দেওয়ার দিতে হবে।
পিন্টু বলেছে, ‘প্রজাপতি কিট নিয়ে নাও। রেজাল্ট গ্যারান্টি।‘
পিন্টুর পিছুপিছু এখন প্রজাপতি কিটের খোঁজে যাচ্ছি। এখনও আইডিয়া নেই জিনিসটা কী। পিন্টুও রহস্য করেছে। প্রথম মিটিং-এর দিন থেকেই ওর চোখেমুখে উত্তেজনা। যদি জিষ্ণুর কথা মেনেও নিই যে উত্তেজনার কারণ আসন্ন হিংসার সম্ভাবনা, আমার বিশ্বাস আমাদের মধ্যেকার আজন্মের দাতাগ্রহীতার সমীকরণের অবস্থান বদলে যাওয়াটাও একটা কারণ। প্রথমে বুবুল, তারপর আমি। খেলার মাঠে অত রং নিলেও জীবনের অন্যতম একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে আমাদের পিন্টুর শরণ নিতে হয়েছে।
বিয়ের কার্ডের দোকানগুলোর জটলা পেরিয়ে এসেছি অনেকক্ষণ। প্রজাপতি সংক্রান্ত জিনিসপত্র সে সব দোকানেই পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনা। অবশেষে পিন্টু থামল। এটাও একটা কার্ডেরই দোকান। বড় রাস্তার ওপরের দোকানগুলোর তুলনায় দাপট কম। বোর্ডে ক্যালিগ্রাফিতে ‘প্রজাপতি’। বাইরে থেকে ফালিমার্কা হলেও ভেতরটা চকচকে, এসি। দেওয়াল, সিলিংজোড়া কাচ। প্রচুর হলুদ আলো। দেওয়াল জুড়ে কার্ডের স্যাম্পল। শোকেসের কাচের নিচেও কিছু।
বিলিং কাউন্টারে বসা লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত জড়ো করে কোমর ঝোঁকালো পিন্টুর উদ্দেশে। লোকটা পিন্টুর থেকে অন্তত চল্লিশ বছরের বড়। দড়িপাকানো শরীরে ধুতিপাঞ্জাবী, হাসিতে ছ্যাতরানো ঠোঁটের ভেতর থেকে এবড়োখেবড়ো জর্দাখাওয়া দাঁত।
বাঁ হাতটা পকেট থেকে বার করে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তুলল পিন্টু। সোজা হেঁটে চলল।
পর্দার আড়ালে আরও একটা ঘর। মূল দোকানের তুলনায় বড়। কম আলোতেও দেওয়ালের শেলফে বিভিন্ন আকৃতি ও আয়তনের কাচের শিশি স্পষ্ট। টেবিলের ওপারে টুলে চোয়াড়ে মতো একটা ছেলে বসে আছে।
পিন্টুকে চেনে। উঠে দাঁড়িয়েছে। কথা বলছে। দেওয়ালের শিশিবোতলের দিকে এগিয়ে যাই। লেবেল না থাকলেও বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। উল্টোদিকের দেওয়ালে নানচাকু, বিভিন্ন দৈর্ঘ্য ও ডিজাইনের ছুরি।
‘ছোড়দা।’
টেবিলের ওপর এখন একটা সাদা বাক্স। চার কোণে সোনালি কল্কা, উত্তরপূর্বের কল্কার নিচে লালহলুদ টিপ। মাঝখানে সোনালি বর্ডারের প্রজাপতি। পিন্টু বাক্সটা খুলল। বাঁ খোপে স্বচ্ছ শিশিতে তরল, ডান খোপে বেঁটে ফলার ছুরি। টেবিলের ওপর থেকে ঝোলা ল্যাম্পের আলোয় চিকচিকাচ্ছে।
‘স্ট্রং। আধশিশিতেই কাজ দেবে।‘ বাঁ খোপের দিকে তাকিয়ে সার্টিফিকেট দিল ছেলেটা।
পিন্টু ভুরু কুঁচকে শিশিটা তুলে চোখের সামনে ধরল একবার। ঝাঁকাল। নামিয়ে রাখল খোপে। টেবিলে ডান হাতের তর্জনী টোকা মারছে।
প্রিমিয়াম এসেছে?
ছেলেটা ভুরু কুঁচকে ভাবছে।
‘আগের সপ্তাহে ছিল না।‘
‘জানি। সেই জন্যই জিজ্ঞেস করছি। খোঁজ করে ফিরে গেছি।‘
এ ঘরের দেওয়ালে আরেকটা পর্দা। ছেলেটা অদৃশ্য হল। তিননম্বর ঘরের দেওয়ালে কী কী ডিসপ্লে করা থাকা সম্ভব ভাবছি, গালি দিল পিন্টু। ‘বাঙালির এই জন্য ব্যবসা হবে না। মেড়ো হলে পাঁচটা কিটের সিল খুলে ডেমো দেখিয়ে দিত। এখানে মাল স্টকে আছে কি না জানে না।‘
ছেলেটা বেরিয়ে এল মিনিটতিনেক পর। দুই হাতে ধরা বাক্সটা সসম্ভ্রমে নামিয়ে রাখল টেবিলে।
আগের বাক্সটার প্রায় দ্বিগুণ। সাদা রঙের পোঁচ আগেরটার বাক্সটার এঞ্জিনিয়ার্ড উড চাপা দিতে পারেনি। এটা স্পষ্ট টিক। ঘন বাদামীর ওপর ধূসর কফি রঙের গ্রেন। মসৃণ, উজ্জ্বল বার্নিশের গাম্ভীর্য মাটি করেনি কল্কার ছেঁদোমি।
বাক্সের বার্নিশকে পাল্লা দেওয়া চকচকে মুখে সোনালি ক্লাস্প খুলতে গিয়ে থমকাল পিন্টু। বাক্সটা এগিয়ে দিল আমার দিকে। ছেলেটাও উৎসাহী মুখে তাকিয়ে।
খুললাম। এটায় তিনটে খোপ। বাঁ খোপের শিশিটা আগের বাক্সটার - যার নাম পিন্টু আমাকে জানিয়েছে, প্রজাপতি ডিলাক্স - শিশিটার থেকে ছোট। আই গেস হাফ বোতলও লাগবে না, দু’ফোঁটাতেই কাজ দেবে। ডান খোপের ছুরির বাঁট মিরর ফিনিশ, আর্গোনমিক। বাঁকানো ফলা অনেক বেশি আলো ফিরিয়ে দিচ্ছে।
যে আইটেমটার জন্য আগেরটা ডিলাক্স এবং এটা প্রিমিয়াম সেটা মাঝের খোপে। বেঁটে নল, ট্রিগার, ট্রিগারের ওপর থেকে উঠে থাকা ছোট টিকির মতো ব্যাপারটা মেটালের। হাতলটা কাঠের। অন্তত কাঠের ফিনিশ।
হাতের পাঞ্জায় রেখে রিভলভারটার ভার মাপল, আঙুল ঢুকিয়ে ট্রিগারে রাখল পিন্টু। চোখের কাছে এনে এমন কিছু পরীক্ষা করল যা আমার জ্ঞানের বাইরে। ছেলেটার সঙ্গে আলাপচারিতা শুরু করল ক্যালিবার, রিকয়েল, গ্রিপ, ফিল, রিলোডিং নিয়ে যেগুলোর প্রতিটি বিষয়ে মাস্টারক্লাস নেবে পরে পিন্টু আমার, কিন্তু তখনও হিব্রু এই সব শব্দ আমার কানের পাশ দিয়ে উড়ে গেল।
চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। ওইটুকু পুঁচকে ব্যাপার, একটা তাসের থেকে অল্প বড় হবে কি হবে না, কী অসম্ভব ক্ষমতা ধারণ করে রেখেছে নিজের মধ্যে। আমাকে তো দূর, পিন্টুকে পর্যন্ত খতম করে ফেলতে পারে। বাগে পেলে গুরুদেবকেও। কোনও স্বস্ত্যয়ন বাঁচাতে পারবে না।
কিন্তু জিনিসটার বাকি ক্ষমতা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। জানা দরকার ও তোমাকে আমার কাছে এনে দিতে পারবে কি না।
জবাব দেওয়ার দরকার মনে করল না পিন্টু। ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল শুধু।
প্রজাপতি প্রিমিয়াম কিট এখন আমার ডেস্কের ড্রয়ারে। ডায়রিটার ওপর। ডায়রি লেখা হয় না, কিটটা রোজ একবার করে খুলে দেখি। দিনে দিনে পরিচয় বাড়ে। খোদ অ্যামেরিকার বানানো। এইট শট, ডাবল অ্যাকশন। ওই টিকিটাকে বলে হ্যামার। কয়েকদিন প্র্যাকটিস করলে কুড়ি গজ দূর থেকে পারফেক্ট হিট করতে পারবে আমার মতো বিগিনাররাও।
প্র্যাকটিস চলছে। পিন্টু নিয়ে যায় ওর চেনা এক ক্লাবে। সোজা পথে ঢোকার যা লাইন তাতে নেক্সট দু’বছরে চান্স নেই, কিন্তু ঘোরা পথ জানা আছে পিনটুর। শনিরবি জায়গা পাওয়া যায় না। অধিকাংশ তরুণ। তরুণীও কিছু আছে। আমরা উইকডেজের সন্ধেয় যাওয়ার চেষ্টা করি।
আজকাল ঘুমোনোর আগে একটা ছবি দেখি। যেটা এখনও আমার অ্যালবামে নেই। থাকবে, শিগগিরই। ক্লাস শুরুর আগের করিডর, মোস্ট প্রব্যাবলি ফার্স্ট হাফ। বিস্তর ভিড়। রোদঝলমল। হাঁটতে হাঁটতে টের পাচ্ছি করিডরটা বদলে যাচ্ছে, দিনের আলো নিভে যাচ্ছে, হাওয়া হয়ে যাচ্ছে চারপাশের ভিড়। একা হতে হতে হেঁটে যাচ্ছি সামনের দিকে, দুপাশে ঘরের সারি জনহীন, শেষ কার্যকরী আলোর উৎস পেছনে ফেলে এসেছি, সামনে আমার থেকেও লম্বা আমার ছায়ার মাথা ঢুকে যাচ্ছে অন্ধকারে। ফোনের রিং বাজছে কোথাও, শরীরের ভারে নুয়ে যাচ্ছে খালি ক্লাসরুমের প্রাচীন বেঞ্চ, দূরে অন্ধকারে কিছু একটা নড়ছে। এগোচ্ছি। তিরিশ গজ, কুড়ি গজ, দশ গজও নেই আর। কোনও ফোঁকর দিয়ে স্ট্রিটলাইট চুইয়ে ঢুকছে। নীল কুর্তির আভাস। হাত তুলছি, তাক করেছি, মোটা বেঁটে নলের মুখোমুখি ভেসে উঠেছে তোমার মুখ। তুমি হাসছ। বোজা চোখ। খোলা মুখ।
হ্যামারে হাত রাখি। সারা শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়।
৯
সোমবার সাড়ে ন’টায় তোমার ক্লাস থাকে। এস ডি-র ক্লাসে সবথেকে শেষে ঢোকেন এস ডি। তারপর দরজা বন্ধ। আটটা পঁয়তাল্লিশ থেকে সাতচল্লিশের মধ্যের বাস না ধরলে সাড়ে ন’টায় পৌঁছনো যায় না। সাড়ে আটটায় বেরোলে ধীরেসুস্থে হাঁটো। বুড়ো আঙুল ফোনের স্ক্রিনে। কোনওদিন গোবর পাড়াতে পাড়াতে বাঁচো, কোনওদিন উল্টোদিক থেকে আসা সাইকেলের ধাক্কা খেতে খেতে। আটটা সাঁইত্রিশ পেরিয়ে বেরোলে, কোনওদিন হাতে ফোনের বদলে পাউরুটি, কোনওদিন চুলের ব্যান্ড। সেদিন সামনে পড়লে বিপদ সাইকেলের। এগারোটা পর্যন্ত ক্লাস। পনেরো মিনিটের ব্রেকে ক্যান্টিন। দলবল। চা। যেদিন আটটা চল্লিশের পর এবং ব্রেকফাস্ট না করে বেরোও, হাতে পাউরুটির বদলে চুলের ব্যান্ড থাকে, চায়ের সঙ্গে ব্রেড রোল। সাতদিনের পুরোনো তেলে ভাজা। বিয়ের পর আমিতুমি দুজনেই আশ্রমের ডিটক্স রিট্রিটে ভর্তি হব। দু’সপ্তাহ স্রেফ লাউয়ের রস খাইয়ে গোটা বডির টক্সিন ঝেড়ে দেবে। এগারোটা পনেরো থেকে বারোটা পঁয়তাল্লিশ ক্লাস। লাঞ্চ। আবার ক্যান্টিন। কোনও কোনও দিন ব্যাগ থেকে টিফিনবাক্স বার কর, কোনও কোনও দিন আধলা ইটকে লজ্জা দেওয়া ক্যান্টিনের ইডলি, কোনও দিন ক্যাম্পাসের গেটের বাইরের ঠেলার চাউমিন। প্রায় প্রতিদিনই ফুচকা। কী খারাপ জল দিয়ে বানায় ওগুলো জানো তুমি? দিনে আধবারও হাত ধোয় কি না সন্দেহ। এর মধ্যে তিন দিন ব্যাম্বু গার্ডেন গেছ। সঙ্গে ছেলেটা ছিল।
বুধ, শুক্র, ডিটো।
মঙ্গল, বৃহস্পতি ফার্স্ট হাফে ক্লাস থাকে না। তবু সকালে আসো। লাইব্রেরিতে। আগে হয়তো পড়ার জন্যই আসতে, এখন শিওর নই। কারণ ছেলেটাও আসে। টিফিনের পর দুটো ক্লাস। শেষ হয় সাড়ে পাঁচটা। আড্ডাটাড্ডা মেরে বেরোও সোয়া ছ’টা থেকে সাড়ে ছ’টার মধ্যে। অবভিয়াসলি, রোজ বেরোও না। কোনও কোনওদিন রাত পর্যন্ত থেকে যাও ক্যাম্পাসে। মাথার ভেতর কতগুলো দৃশ্য ও শব্দ ধনুকে ছিলা পরাতে শুরু করে, দ্রুত বার করে দিই।
‘ক্যাম্পাস ভুলে যাও। বৌদি বাইরে কোথায়, কখন যায় সেটা বল।‘
পিন্টুর মুখে সম্বোধনটা শুনলে শরীর এবং মনের যাবতীয় শক্তি খরচ সংযত হতে হয়, পাছে ওর দাঁত ভেঙে দিই। মনে করতে হয় পিন্টু আমার কত কাজে লাগছে। নিজের কাজ ফেলে এমনকি পার্টি অফিসে যাওয়াও ঠেকিয়ে আজকাল দেখা করতে আসে।
তাছাড়া ও ঠিকই বলছে। ক্যাম্পাস হবে না। তুমি সর্বদা পরিবৃত। আমাকে সবাই চেনে।
বাইরেও তুমি যাও ঘনঘনই। শনিরবি সকাল থেকে টইটই। শ্যাডো করার কাজটা পিন্টু শাকরেদ দিয়ে করাবে বলেছিল। অ্যালাউ করিনি। নিজেই করেছি। গত তিন মাসে তিনদিন হোল ফ্যামিলি বেরিয়েছ। তুমি, তোমার বাবা মা, ইলেভেনে পড়া বোন। একদিন তেঘরিয়ায় মাসির বাড়ি, একদিন বাঁশবেড়িয়া, কার বাড়ি জানি না, এক সন্ধেয় নাটকের শো। ক্রিটিক্যালি অ্যাক্লেইমড নাটক। সেলেব্রিটি অভিনেতার একটিও সম্পূর্ণ বাক্যের উচ্চারণ উদ্ধার করতে পারিনি। আমি জানি কেউই পারেনি। তবু মুগ্ধ মুখ করে বসে ছিল। তোমার বাড়ির সবাই, তুমিও। তিন মাসে পাঁচটা সিনেমা দেখেছ। পাঁচটাতেই ছেলেটা সঙ্গে ছিল। কনুইয়ে কনুই জড়িয়ে হলে ঢুকে গেলে। যেদিন সবুজ শাড়ি পরেছিলে, আমিও ঢুকেছিলাম। হলিউডি অ্যাকশন-কমেডি। খুব হাসছিলে দেখতে দেখতে। বাড়ি এসে অম্রুতাঞ্জন লাগাতে হল। পরের সিনেমাগুলোতে আর হলে ঢুকিনি।
‘এও তো গ্যাঞ্জাম। চেনা রুটের বাইরে বল। রাতের দিকে পাওয়া যাবে না? একলা?’
ভাবলাম। পিন্টুর বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করার মুহূর্ত থেকে যে ভাবনাটা বারংবার মাথায় ঘাই মারছে। যদি বলে উঠি, ‘না পাওয়া যাবে না।‘ পিন্টুকে, নিজেকেও, কথা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে উঠে পড়ে, জিনস ঝেড়ে বাড়ি চলে আসি? ড্রয়ার থেকে প্রজাপতি প্রিমিয়াম কিট বার করে ছুঁড়ে পুকুরে ফেলে দিই? বুড়বুড়ি মিলিয়ে যায়, শ্যাওলারা ফিরে আসে আর স্বপ্ন হয়ে যায় এই সমস্ত কিছু? ফোনটাও ফেলে দেব। তোমার নম্বর ডায়াল করিনি অনেকদিন। ডায়রিটাও। গত তিন মাসে ক’পাতাই বা আর লিখেছি। তার থেকে একশোগুণ ভালো লাগে জিষ্ণুর সঙ্গে আড্ডা মারতে। জিষ্ণু কথাটা তুলল সেদিন, যেটা আমার মাথাতেও ঘুরছিল বেশ কিছুদিন ধরে। একদিন রাঙাকাকিমাকে নিয়ে মিত্রকাকুদের বাড়িতে যাব। বলব, অনেকদিন তো থাকল এখানে মিন্টি, এবার একটু ও বাড়িতেও চলুক। আবার বারান্দা ভরে উঠবে। পি এইচ ডি শেষ করে বুবুলের হাতে সিংহসাম্রাজ্যের সিংহাসন ছেড়ে দিয়ে পালাব। কিংবা রয়ে যাব। দিনের শেষে বারান্দায় দাঁড়াব, মায়ের ঘর থেকে হেমন্ত কিংবা সন্ধ্যা আসর জমাবেন, উল্টোদিকের জানালায় রাঙাকাকিমা ক্রিমের টিউব হাতে নিয়ে সাধনায় বসবে। খোলা অ্যালবাম থেকে জেঠিমার স্বপ্নে ঘুরে ঘুরে যাবে শোভনা, সুরূপা, প্রিয়দর্শিনীরা। নিটোল, অটুট। সাতসাগরের পার থেকে, হয়তো ওর সকাল তখন, জিষ্ণু ফোন করে বলবে, ‘ছোড়দা, শুয়ে পড়েছিলে নাকি?’ বলব, ‘এখনই কী রে?’ ওর সঙ্গে কথা সেরে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ব। সলিড ঘুমে রাত কাবার হবে।
পিন্টুকে বলি, ‘বৃহস্পতিবার ইউনিভার্সিটির পর দুটো বাচ্চাকে পড়াতে যায়। বেরোতে বেরোতে সাড়ে ন’টা হয়ে যায় বেশিরভাগ দিন।‘
১০
‘তুমি একা এ সব পারবে না, ছোড়দা, তোমরা পড়াশোনার লাইনের লোক।‘ শেষের বাক্যাংশটা গালির মতো উগরে দেয় পিন্টু মাঝে মাঝেই।
উত্তর দিইনি। পিনটুও কথা বাড়ায়নি। ও বদ, বোকা না। বুবুল ফালতু হাতে রাখে না ওকে।
বাসস্টপ থেকে মাত্র দশ মিনিট হাঁটাপথে একটা শহরের চেহারা যে এতখানি বদলে যেতে পারে প্রথমবার অবিশ্বাস্য লেগেছিল। বাড়ির থেকে ফাঁকা জমি বেশি। পুকুরের পাশ দিয়ে গলি ধরে গিয়ে তোমার ছাত্রদের বাড়ি। একজন ছাত্র, একজন ছাত্রী। সাইজ দেখে মনে হয় ক্লাস থ্রি ফোর হবে।
একটা বড় মাঠ রাস্তার ডানদিকে। গরানের মাঠ বলে এদিককার লোক। ধানফান হত এককালে, এখন মাঠ। বেশিদিন থাকবে না, ইতিউতি বাড়ি উঠেছে তিন চারটে, বাকি মাঠে আসন্ন বসতবাটিরা উঁচুনিচু পাঁচিলের হুমকি রেখে গেছে।
মাঠের কিনারের পাঁচিলটায় ঠেস দিয়ে দাঁড়াই। বিকেলের দিকে ঝড়বৃষ্টি হয়ে ভ্যাপসা বেড়েছে। সেটা খারাপ। ভালোটা হচ্ছে ঝড়ে এদিকের ট্রান্সফরমার উড়ে গেছে। গা ঢাকার সুবিধে। তার থেকে বড় সুবিধে যেটা টের পাচ্ছি এই মুহূর্তে সেটা হল মেঘচাপা জ্যোৎস্নাটা ভালো খুলেছে। বৃষ্টি নামতে ভয় হয়েছিল তুমি বোধহয় আসবে না। কিন্তু এসেছ। পুকুরের ওপারের জানালায় এমারজেন্সি লাইটের আলো। ক্লাস থ্রি ফোরের সিলেবাসে কী ছিল মনে করার চেষ্টা করলাম। বাংলায় কাতুকুতু বুড়ো কবিতাটা ছিল, ক্লাস ফোরে। অংকে ঐকিক নাকি সিঁড়িভাঙা, মনে পড়ল না।
চাঁদটা মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসছে মেঘ থেকে, যেটা ভালোই। একদম অন্ধকারে তুমি আমাকে দেখতে পাবে না।
পকেটে হাত দিই। গ্রিপ সহজ হয়ে এসেছে। প্রজাপতির দু’নম্বর ঘরের আবছায়ায় প্রথম আলাপের আড়ষ্টতা কেটে গেছে। এখন বন্ধুত্বের আশ্বাস।
আরাম হচ্ছে বেশ। অল্প ভেজা হাওয়ায় সামান্য ফুলে উঠছে শার্টের পিঠ। ঘাম শুকোচ্ছে। শরীর ছেড়ে আসছে। তুমি পড়াও কতক্ষণ পড়াবে। তাড়া নেই। দাঁড়াতে ভালো লাগছে বেশ। হারমোনিয়াম বাজছে মাঠের কোনও একটা বাড়িতে। কোনও বেসুরো বালিকার রেওয়াজ। দূর থেকে তাও মায়াবী। একটা চেনা গান শুরু হয়েছে এবার। দারুণ অগ্নিবাণে রে, হৃদয় তৃষায় হানে রে।
ঠোঁট নড়তে শুরু করেছে অজান্তেই। শুষ্ক কাননশাখে ক্লান্ত কপোত ডাকে, করুণ কাতর গানে রে, গা-আ -আ-আ-আ-আ-নে। এখনও ভার্বাটিম মনে আছে কী করে? বাইশ তেইশ বছরে গানটা আধবারও শুনিনি, গাওয়া দূর অস্ত।
ভয় নাহি, ভয় নাহি-ই, ভয় নাহি। না-এর ভঙ্গিতে ছোট ছোট দুই হাত নাড়াচ্ছে বুবুল, কবজিতে বেলফুলের মালা। চোখে কাজল, মাথায় ফুলের মুকুট। বুবুলের দিকে আড়চোখ রেখে নাহি নাহি হাত নাড়ছি আমিও। আমার কবজিতেও মালা পরিয়ে দিয়েছে রাঙাকাকিমা। পঁচিশে বৈশাখ, চাতালে চাদর খাটিয়ে ঋতুরঙ্গ হচ্ছে। গাইয়েদেরও বিচিত্র সাজ। পরের নাচটা হয়তো তাদের, বাকিরা গাইবে। দর্শকাসনে বাড়ির মহিলারা।
জানি ঝঞ্ঝার বেশে, দিবে দেখা তুমি এসে। গান শেষের পথে। আমি আর বুবুল এবার ঘুরে ঘুরে নেমে যাব স্টেজ থেকে। আমরা দুজন ছাড়া বাকিরা হাততালি দেবে, গাইয়েরা শুদ্ধু। সবথেকে জোরে হাততালি দেবে রাঙাকাকিমা।
এমারজেন্সি আলো জানালা থেকে সরে দরজার সামনে। কচি গলার টা টা বাই বাই। সোজা হয়ে দাঁড়াই। ‘দাদা এগিয়ে দিয়ে আসুক না বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত?’
‘কোনও দরকারই নেই। এইটুকু তো রাস্তা। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে চলে যাব।‘
‘শিওর?’
‘শিওর।‘ হাসি হাসি গলায় বল তুমি।
আলো সরে যায়। দরজা বন্ধের শব্দ। গলির ও প্রান্তে একটা সরু ক্ষীণ আলো জ্বলে ওঠে। আমার দিকে এগোয়। পকেটে হাত ঢুকিয়ে তোমার দিকে এগিয়ে যাই।