ঘুমের মধ্যেও সুকুমণি ভোরের গন্ধ পায়। ভোরের ভেতর পায় ধানসেদ্ধর গন্ধ। সেই গন্ধে তার আলটাগরায় জল উলসে উঠলে জিভ নেড়ে সে জল সে গিলে নেয়। কেমন যেন হাত-পা নিশপিশ করে। আর তখনই তার ঘুমটা পুরোপুরি ভেঙে যায়। এক মুহূর্তের জন্য বিভ্রম হয়, মনে হয় এই বুঝি বেলা হয়ে গেল। কখনই বা পায়খানা চান সারে, কখনই বা রান্না সারে! তারপর তো দুটি পান্তা রাতের বাড়তি তরকারি বা আলুচোখা দিয়ে খেয়ে প্রিয়রঞ্জনের সঙ্গে কাজে যাওয়া! টিনের দরজায় কুলুপ মেরে চাবি রাখত আঁচলের খুঁটে বেঁধে। কিন্তু বিভ্রমটা ওই এক মুহূর্তই। তারপরই হুঁশ হয়। আর টের পায় মিলের কুলিলাইনের ঘরে সে ঘুমিয়ে নেই, সে আছে ঘোষপাড়ায় তার ছিটেবেড়ার কুঁড়েতে। নিঃশব্দ শ্মশানের মতো সেই ব্যারাক অনেক দূরে। তার প্রথম জীবনের স্বামীর ঘরখানার মতোই দূরে। রা-রবহীন নৈঃশব্দ এখানে তার একলার ঘরটিতেও। ভাবে সে। তার দীর্ঘশ্বাসের বাতাসে কুঁড়ের চালের দু-একটা খুচড়ো খড়ও নড়ে, বাতার টিকটিকিটা সঙ্গত করে ডেকে ওঠে একবার।
যতই হোক, কাকভোরে ওঠাটা তিরিশ বছরের অভ্যাস বলে কথা। সে অভ্যাস তার জীবনের সঙ্গী হয়ে গেছে।
এসব নানা ভাবনার মাঝেই কুরুরু কুরুরু করে রাতের শেষ পালার বা দিন শুরুর ঢ্যাড়া-ঘোষণ দিতে প্যাঁচা ডেকে ওঠে। রাইসমিলের পুব দিকের গেটের পাশের আমড়াগাছে একজোড়া কোটরেপ্যাঁচা থাকে। সুকুমণি শব্দ শুনে নির্ভুল দিক গণে দিতে পারে। সেই ডাকে শেষ রাতটা কেমন ঝমঝম করে ওঠে। উসখুশ ভাব জাগে আকাশে বাতাসে।
মিল থেকে লরীর শব্দ আসে। ইঞ্জিন গর্জে উঠে খানিক মকসো করে বেরিয়ে যায় লোড করা চাল নিয়ে কোন হিল্লিদিল্লি। ড্রাইভার খালাসীদের গলা খাঁকারি শোনা যাবে তখন। কারও বা আচমকা জোরে ডেকে ওঠায় কেমন যেন পরিবেশটা সজাগ হয়ে উঠে চোখ কচলে বড় করে তাকাবে। আরও বেশ খানিক পরে মশাগ্রাম থেকে বাঁকুড়াগামী দিনের প্রথম ট্রেনটিও এসে পড়বে হুড়মুড়িয়ে।
তার আগেই অন্যদিন বিছানায় উঠে বসে সুকুমণি। আরও কম বয়সের দিনগুলোর মতো সানসগ্গে হারিয়ে নিথর হয়ে ঘুমোনোর পালা এই আট দশ বছরে সাঙ্গ হয়েছে। প্রিয়ই ঘুম নিয়ে গেছে হয়তো, সে ঠিক বোঝে না। কিছুদিন আগেও গায়ে গতরে খাটত যেমন, তেমনি ঘুমও হতো। জগদ্ধাত্রী মিলের পাশের পুকুরে জলে গা ডুবিয়ে থাকলে যেমন অনুভূতি হয় তার, ঘুমের ভেতরেও তেমনি, গভীর আর গা জুড়োনো ঠান্ডা ভাব। সেই ঘুমও ভোর ভোর ভাব হতে ঠিকই ভেঙে যেত। আড়মোড়া ভেঙে উঠতে গেলে প্রিয়রঞ্জন একবার জড়িয়ে ধরত। বলত, "সারাদিনের মতো এই তো শেষ। আবার সেই রাত হলে তবে তোকে ছুতেঁ পাই।"
কথার উত্তরে ভালোবাসায় প্রিয়র বুকের ভেতর আদুরে বেড়ালের মতো গলে যেতে যেতে বলত, "উঁ! এত ভালোবাসো বলে তো সব্বদা বুঝতে পারি না?"
"সব্বদা মুখে বলতে হয় নাকি? বুঝে নিতে হয় রে!"
সেসব কথা মনে করে নিজের মনে ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসে এখন। সত্যিই সে বোকা, বুঝতে পারেনি প্রিয়কে।
আজ বড্ড গা-খানা ম্যজম্যজ করছে। উঠতে ইচ্ছা করছে না। অথচ না উঠলেও নয়, বেলা পর্যন্ত পড়ে ঘুম মারবে এত লাটসাহেবি তাদের কি চলে? তবু উঠছি উঠব করে শুয়েই থাকে। শুয়ে শুয়ে পুরনো কথা মনে আসে। যখন কুলিলাইনে থাকত, সেখানে বস্তির টানা লম্বা রোয়াকে পরপর ঘরের সারি। সামনে ওপ্রান্ত পর্যন্ত খোলা উঠোন।সেখানে তখনই তোলা উনুনে আঁচ পড়েছে।ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার চারদিক। সেই ধোঁয়ায় লম্বা কুলি লাইন একেবারে নেই হয়ে যেত। উনুন ধরলে নিজের নিজের ঘরে বা ঘরের সামনে বারান্দায় বসে অনেকে দিনের রান্নাটুকু সেরে নিত। মর্জিমতো কেউ কেউ কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসেও দুপুরের খাবার বানিয়ে নিত না তা নয়।সুকুমণির অত ছুটোছুটি পোষাত না। মিলের ধানে পা দেওয়া, ধান ঝাড়াই, ধান সেদ্ধ – হাজার রকমের কাজের ভেতর থেকে এসে রান্না দেখে যাওয়া। বড্ড হুজ্জুতি। প্রিয় বারণ করত, "অত ছেটাছুটি করতে হবে নাকো! হবে একটা তরকারি, তাও যদি পুড়ে যায় একবার এদিক, একবার ওদিক করতে গিয়ে, তবে তো খাওয়াটাই মাটি রে! তার চে বরং ঠান্ডা ভাত তরকারি অনেক ভালো।"
এই ভোরের বেলাটায় এক শ্মশান শূন্যতা বড়ো গরাসে খেতে আসে সুকুমণিকে। প্রায় পঞ্চাশটা ঘরের মেয়েমরদ আর কাচ্চাবাচ্চায় সরগরম ওই জায়গাটা আচমকাই যেন ফুৎকারে নিভে যাওয়া লম্ফ। বিরাট অজগরের মতো ওই টানা খাঁ খাঁ ব্যারাক দিনের বেলা গিলে খেতে আসে। যদি কখনও কোনো কারণে ওদিকে চলে যায় - সে
সহ্য করতে পারে না । পাকা দেওয়াল এখনও টিকে আছে, তবে ছাউনির চাল খড়ের। এই ক’টা বছরে সে খোড়োচাল কত আয়লা আম্পান-জাম্পানে উড়ে গেছে। মাঝে মাঝে চাল পচে গর্তও হয়ে গেছে। কুকুর বেড়াল শুয়ে থাকে, তারাও বোধহয় স্মৃতির জাবড় কাটে মনমরা হয়ে। মিলের পশ্চিম দিকে ওই জায়গাটা এখন বাতিল।
হপার, ধান সেদ্ধর মেশিন এসব অনেক আগেই এসে গিয়েছিল যদিও। তারপরও মিলে কাজের জন্য লোক দরকার হতো। হপারে ঝাড়া ধান সারিয়ে নেবার পর, চিটেটাকেও খানিক ঝাড়াই করা, ধান সেদ্ধ, ধান মেলা, ধান শুকোনো -। ধান থেকে চাল হলে সে চাল ঝাড়ার কাজ, চাল থেকে খুদ আলাদা করা, বস্তা ঝাড়া –। এই সব কাজ ছিল।
রায়েদের মিলের সিমেন্টে মাজা বিরাট চাতালে রাশি রাশি সেদ্ধ ধান পড়ত। মেয়েরা পাশাপাশি সার দিয়ে হাত ধরাধরি করে মেলে দিত, পা চালিয়ে উল্টেপাল্টে দিত ভিজে, আধ শুকনো ধান। একসঙ্গে সুর করে গান গাইতে গাইতে পা চলত তাদের। তেল দিয়ে পরিপাটি আঁচড়ে বাঁধা থাকত তাদের মাথার চুল, শাড়ির আঁচল গাছকোমড়ে জড়ানো। দিনে বেশ কয়েক বার ধানে পা দেওয়ার পর বিকেলে সূর্য পাটে বসার সময় হলে ধান জড়ো করার পালা। লম্বা পাটার দুদিকে দড়ি বাঁধা; সেই দড়ি দুজন দুজন ধরে পাটায় টান দিয়ে ধান জড়ো করত। দুহাতে দুখানা ঝাঁটা দিয়ে বাকি ধান ঝেঁটিয়ে ধানের চূড়োয় এনে ফেলা। তারপর বাঁশের চাঁচ দিয়ে তৈরি বিরাট গম্বুজাকৃতির ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিত চাতাল জুড়ে রাশি পরিমাণ জড়ো করা ধান।
আহা! বড়ো আনন্দ ছিল সেইসব দিনগুলোতে, অভাব তো চিরকালই, কিন্তু সেই কাজে সুখ কম পড়ত না। ধান নিয়ে নাড়াচাড়া, ধানের গন্ধে নেশা। ফুলের বাস আঘ্রাণ করার মতো সে নাক টেনে টেনে ধানের গন্ধ নিত, দুহাতের আঁজলায় ধান নিয়ে – যেন হাত ভর্তি জুঁইবেলি বা শিউলি ফুল। সব মনখারাপগুলো তখন বাসি বাসি লাগত।
মন খারাপ হতো গুসকরার কথা মনে পড়লে।আর পড়তও তো কখনও কেমন! আচমকা কখনও বুকটা ফাঁকা হয়ে যেত, কখনওবা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠত বুকটা। ধনচালের বস্তার মুখ দড়ি দিয়ে যেমন পেঁচিয়ে বাঁধে, মনখারাপ তার মনটাকেও তেমনি পাক দিয়ে দিয়ে প্যাঁচাত। তখন নাক টেনে টেনে ধানসেদ্ধর গন্ধ শুঁকত।অমনি শ্বশুরবাড়ির স্মৃতি হুশ্ করে উপে যেত। শুধু বেটার কথা সে ভোলার চেষ্টা করত না কখনও। কারণ কষ্টটাকে সে সঙ্গী করে নিয়েছিল।আর এমনিভাবেই ব্যাটাকে সে কাছে পাচ্ছে বলে ভাবত।
যখন ছেলের বয়স ছ’মাস, অসুস্থ স্বামী মারা গেল। সুকুমণিরই বা কত বয়স তখন, বড্ডজোর আঠারো-ঊনিশ বছর। সামান্য হলেও চাষবাসের পাট ছিল তাদের। স্টিম ছিল, ব্যবসা করত ওর বর আর ভাসুর। লোকের ধান সেদ্ধ, শুকনো করে চাল বানিয়ে দেবার ব্যবসা। বর মারা যাবার পর সে ব্যবসা ভাসুরের। লোকটা যেন সাপের পাঁচ পা দেখল। কাজেই সারাদিন গাধার খাটনি খাটত সুকুমণি, কিন্তু টাকাপয়সার কোনো দরকার হলে ঘাড় কাত করত না মোটেই। পেটভাতায় কাটত সুকুমণির। এর উপর তার ভাসুরের বাড়তি নোলা। জা কুটুমঘর গেলেই তার ছুঁকছুঁকুনি। গা ঘিনঘিন করত তার, বুদ্ধি করে কাটাতে হতে তাকে। ছেলের পাঁচ বছর বয়সে প্রিয়রঞ্জনের সঙ্গে পালিয়ে এলো। মেশিনের মতো রাতদিন খেটে চলা ছাড়া তার কোনো দাম ছিল নাকি? এর বাইরে যা দাম তা শরীরটার। সে দাম স্বামী না থাকার খেসারত সমাজে অনেক সুকুমণির। তা নেওয়া, দেওয়ার প্রস্তাব কানে শোনা, ইঙ্গিতে বোঝাও বড়ো ঘেন্নার।
রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে লোকটার সঙ্গে জুটে গেল একসময়। তার সঙ্গে ইট বালি আর বাড়ি তৈরির মশলা বইতে বইতে সেও দিন দিন ঢালাই খুঁটিটি হয়ে যাচ্ছিল। সারা গায়ে শুধু ইটবালিসিমেন্টের গন্ধ। পরাণটা তার আই ঢাই করতে লাগল। একদিন ভাসুর সন্ধান পেয়ে এসে হাজির। ভাসুরও একদিকে ঢুকল মসলন্দপুরের ছোট বস্তিটায়, আর অন্যদিক দিয়ে তাকে নিয়ে প্রিয়রঞ্জনও কাটিতং একেবারে এই জগদ্ধাত্রী রাইসমিলে। এখানে এসে সে ধানের গন্ধ পেয়ে বাঁচল যেন। মাছ যেমন জল ছাড়া বাঁচে না, তারও তেমনি দশা হয়েছিল।
তবে মেয়েমানুষ মেয়েমানুষই। খাটনেবালা মেয়েও পুরুষের অধীন। যতই তাকে ভালোবাসুক, প্রিয়রঞ্জন নিয়মিত নিজের গ্রামের সংসারে ঠিক যেত। সেই দিনগুলো তাকে বড্ড জ্বালিয়ে মারত৷ বৌএর থেকে বেশি অধিকার সুকুমণির যে নেই, প্রিয়রঞ্জনের না থাকাতে হাড়ে হাড়ে টের পেত। হিংসেয় অপমানে অসহায়তায় ছটফট করত সে।
একলা খোপড়িতে শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে ভাবত, হুঁ! মাগভাতারে সোহাগ হচ্ছে! এমন কল্পনায় নিজের জায়গাটা যত নড়বড়ে ঠেকত ততই ফেলে আসা গ্রামের সংসারটাকে মনে পড়ে কাঁদত। এমনও ভাবত, আর নয়। এবার প্রিয় আসুক, এলেই সব ছেড়েছুড়ে চলে যাবে এখান থেকে। কিন্তু সে ফিরে আসার পর রাগে দুঃখে নতুন বিডিআর রেলগাড়ির মতো তার হুল ফোটানো কথা ছুটত, ''পয়সা দিয়ে পোষা মেয়েমানুষের যতটা অধিকার, তার থেকে একচুলও বেশি অধিকার আমার যে লয়, তা জানি গো! তোমরা সব পুরুষমানুষই মনে করো বে' করা ইস্তিরির সন্মানই আলাদা। সেই সংসারের তরে কত্ত গব্ব! যতই দিনের পর দিন পিরীতের লোকের সঙ্গে কাটুক না ক্যানে, সে হলো পেরায় বেশ্যা! ওই রায়বাবুর রাইসমিলের ধানের মতো। যত খুশি গন্ধ নাও, যত খুশি পরিচয্যা করো আর ভালোবাসো না ক্যানে, সে ধান রায়বাবুর ছাড়া কারও লয়।"
প্রিয় কিন্তু বুদ্ধিমানের মতো চুপ করেই থাকত। সুকুমণির নিজের তরফে এক পশলা ঝড়বৃষ্টির পর শান্ত হলে দুটো শরীর মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। সোহাগ আর ভালোবাসায় প্রিয় এমন ভরিয়ে দিত যে রাগ গলতে সময় নিত না। খুশিটা মনের ভেতর থেকে তখন উথলে এসে ঠোঁটের দুই কোণে, চোখে গড়িয়ে যেতে যতক্ষণ, তারপরই ভাবতে ভালো লাগত যে প্রিয় শুধু কর্তব্য করতেই বৌ-ছেলের কাছে যায়। মন তার বাঁধা আছে তারই আঁচলের চাবির সঙ্গে।
ইদানীং ভাবনাতেই দিন কেটে যায় সুকুমণির। কথাবার্তা ও চিরকালই কম বলত, ইদানীং আরও কম। কিন্তু ভাবনাতে সময় থেমে থাকে না। জোর করে উঠে ঝুপড়ির বাইরে আসে সে। কালিপুজো পার হতেই হাওয়ায় গা শিরশিরে ঠান্ডা। আঁচলটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে পঞ্চায়েতের কল থেকে বালতি ভরে জল নেয়। ঘর থেকে সাবান নিয়ে এসে শৌচালয়ের ঝাঁপটা বন্ধ করে দেয় সে। রতন, বিমলা আর মিলনের পরিবারের সঙ্গে সেও এই শৌচালয় ব্যবহার করে। পঞ্চায়েতেরই সহায়তায় তৈরি এটা। অন্যরা উঠে পড়ার আগে সে উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে নেয়। আগে প্রায় মাঠের মাঝে যোগাদ্যে পুকুরের পাড়, মাঠঘাটে প্রাতঃকৃত্য সারতে হতো। মিলের অত লোকের ভার একই সময়ে ওই দু একটা শৌচালয় বইতে পারত না। রায়পুকুর তো মিলের চৌহদ্দির ভেতর। তাতে চান করত আর রান্নার জল নিত।
বাকিঘরের লোকজনও উঠে পড়েছে। পাকারাস্তার পুব গায়ে দোকানঘরগুলোর পিছনে তাদের এই ক'টি ঝুপড়ি। সে কলতলায় বসে হুড়হুড় করে মগ নিয়ে গায়ে জল ঢালল। ভিজে কাপড়ের আঁচল নিংড়ে গা মুছছে, বিমল নিমডাল ভেঙে দাঁতন করতে করতে বলল, “কাকি, আজ গালসিস্কুলে দুয়ারে সরকার। তোমার ভোটারকাডে স্বামীর নামে যে গন্ডগোল আছে, সেটা ঠিক করিয়ে নিতে পারবে। তারপর আধারের সঙ্গে সব লিঙ করাতে হবে। সকাল সকাল চলে যেয়ো। নাহলে ভিড়ের ঠেলায় লাওয়াখাওয়া সিকেয় উঠবে বলে দিনু, আর ঘর আসতে দুকুর গড়াবে। বুঝলে?”
কথা না বলে সুকুমণি মাথাটা দুবার ওপর-নীচ করে সম্মতি জানিয়ে ঘরে আসে। ঘরের সামনে তুলসীগাছে জল দেয়, পুবমুখে দাঁড়িয়ে সূর্যপ্রণাম করে। এই অভ্যেস সে ছাড়তে পারল না কোনোদিন। ব্যারাকে থাকার সময়ও এটা ছিল, অনেকে ঠোঁট টিপে হাসত।
মিনি, চাঁপি প্রায়ই বলত, "তুই ফিরে যা, সুকি! এখেনে তোকে কেমন যেন মানায় নে! জা-কে ভাসুরের কথা বলে দিবি, সে ঠিক তার মরদকে সামলে লেবে। তুই চলে যা তোর ছেলের কাচে।"
"আর হয় না, রে! এত দিন হয়ে গেচে, এখন আর কেউ মেনে নেবে না। পিয়ই কি ছাড়বে? ছেলেও হয়তো ঘেন্না করবে, সেটা সইতে পারবুনি। আর জায়ের কতা বলচিস? নিজের সোয়ামীকে বাদ দিয়ে সে আমাকে ক্যানে বিশ্বাস করবে, ক'দিকিনি? বলবে, আমি ভাগ নুবো বলে এতদিন পরে গেচি, আর মিচিমিচি তার ঘরের লোকের বদনাম করচি।"
শেষ দুপুরে একটু অবসরে চাতালের পাশে বসে চুল শুকোতে শুকোতে মিনি, চাঁপি সায় না দিয়েও পারল না তার কথায়। "তা বঠে! তুই ঠিকই বলচিস লো!"
মিনির মরদ রহমত চুপ করে শুনছিল। ওই চারজন ছিল বন্ধু। চাঁপির বর হরুও সুকুমণি আর প্রিয়র পেয়ারের লোক। রহমত বলল, "সুকি কি তোদের মতুন বুকা?"
এই জীবনে আর সে গেরস্তবাড়ি ফিরে পাবে না। অনেক দূরের সে। পাকা রাস্তার ওপারে ওই মিলের গেট পেরিয়ে ভেতরে গেলেও যেমন ওই মিলে এখন ও বাইরের লোক, তেমনই। দীর্ঘশ্বাস পড়ে তার।
ছাঁটাই হওয়া বেবাক লোক দেশঘরে ফিরে গেল। যত লোক কাজ করত মিলগুলোতে তার অর্ধেকের বেশি লোকই ছাঁটাই। যন্ত্রের সঙ্গে পারবে কেন মানুষের হাড়? হরু চাঁপি মিনি রহমতরা পাশে পাশের ঘরের বাসিন্দা। ওরা ফিরে গেল পুরুলিয়ায়। আবার অনেককে রেখেও দিল বাবুরা মিলের কাজে। অনেকে বস্তা সেলাইএর কাজ শুরু করল। কেউ কেউ আশেপাশের বাজারে অন্য কোনো কাজ খুঁজে নিলো, যে কাজে তারা তত পটু নয়। তবে ব্যারাকের দিক থেকে তারা আস্তে আস্তে সরে এলো। এদিক ওদিক ঝুপড়ি তুলেটুলে থাকতে শুরু করল মিলের চৌহদ্দির বাইরে। সে ফিরে যেতে পারেনি। কোথায় যেত? ভাসুরের সংসারে? নাকি প্রিয়র সঙ্গে? প্রিয় আর তার কোনো ছেলেপিলেও যে কেন হলো না কে জানে! অথচ প্রিয়র দুই ছেলেমেয়ে আছে বলে সে জানে। মেয়ের তো বিয়েও দিয়ে এলো একবার এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে গিয়ে।
ছাঁটাই হয়ে এখানে এই ঝুপড়িরটা তুলেছিল।একাই। কারণ প্রিয় ফিরে গেল তার রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজে। তা সে প্রস্তাবও কি প্রিয় দিয়েছিল নাকি তাকে? বলেছিল নাকি, “চল, আবার আমরা জোগাড়ে লেগে পড়ি?” বলেনি।অবশ্য বললেও সে বালিসিমেন্ট ঘেঁটে দু’হাতে লেগে থাকা ধানের গন্ধ কিছুতেই খোয়াতে পারত না। রুজিরোজগাড়ের কী হবে সে নিয়ে কোনো আলোচনাই করল না প্রিয়! মানুষটা দুদিন গুম হয়ে ভেবেছিল একা একা। তারপর “চলনু” বলে ফিরে গেল তার সংসারে। এমনভাবেই যাওয়া যেন সে এতে মুক্তিই পেল! কারণ সে তো আর তার বিয়ে করা বৌ নয়, নেহাতই ফুসলে আনা মেয়ে মানুষ। যখন ইচ্ছে ছাঁটাই করা যায়, যখন ইচ্ছে মিলের বাবুরা যেমন ছাঁটাই করতে পারে। কোনো ওকালতনামা কি ছিল মিলের ধানচালের কাজ বা মানুষের সঙ্গে, মনের টানটুকু ছাড়া?
তাদের ঝুপড়ি কটার সামনে দিয়ে একটা সরু মোরাম রাস্তা। তার গায়ে বিজয় ঘোষের বাড়ি।মোরাম রাস্তাটা বেড় দিয়ে পুবদিকে গেলে বিজয়দের খামার। ওদের ধান সেদ্ধর স্টিম পুরনো দিনগুলো তাকে কিছুটা ফিরিয়ে দিয়ে সুকুমণিকে আরও একবার বাঁচিয়ে দিয়েছিল। এই কাজটায় বেশি খাটনি তার নয়। ধান সেদ্ধর সময় উনুনে জ্বাল ঠেলে দেওয়া। দুপুরে মেলা ধান পাহারা দেওয়া। ঘোষেরা বড়লোক, মানুষও ভালো। দেখাশোনা করে তার, খোঁজখবর নেয়। ওদের বাড়িতেই সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত আজ আট দশ বছর কেটে গেলো। টুকটাক বাড়ির কাজও সে ভালোবেসে করে দেয়।
ঘরে কাপড় ছাড়তে ছাড়তে সে আধার লিঙ্ক করাতে না যাবার কথাই ভাবল। বিমলকে এই কথাগুনো বলবে নাকি, "শোন বিমল, এসবে আমার আর পেয়োজন কী? ভোটার কাডে স্বামীর নাম ছিল অনন্ত ঘরামী। তারপর আধার কাড হলো। সেখানে স্বামীর নামের জায়গায় বসল প্রিয়রঞ্জন। তারপর দুটো কাডের কোনোটাতেই ভুল সংশোধন হয়ে উঠলোনি। ত্যাত গাগোছ ছিলুনি । স্বামীত্ব ফলালেও স্বামী কি আমার সত্যিই ছিল কেউ?"
প্রিয়কে সে স্বামীই ভাবত বটে, কিন্তু সে তো তা ভাবেনি! অনন্তর স্বামীত্ব সে স্বেচ্ছায় ত্যাগ দিয়েছে। তাই কোনটা ভুল, কোনটা ঠিক সে নিজেই কি বোঝে? কাগজটাগজের পরিচয় নিয়ে তার আর কাজ নেই। তাছাড়া আজ শরীরটা যেন বশে নেই। পিঠে, পাঁজরে একটা বেদনা মতো হচ্ছে।
দুপুরে ধান পাহারা দিচ্ছিল। তখন যত পায়রা ঘুঘু শালিখ ছাতাড়ে ধানের গন্ধে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে নেমেছে বিজয় ঘোষের খামাড়ে। কোত্থেকে ভুলে যাওয়া মুখের মতো দু-একটা চড়ুইও এসে হাজির! আসবে না কেন, মিলে তো আর আগের মতো ধান মেলা হয় না! পশ্চিম দিকে ব্যারাকের পাশে যে বড়ো বটগাছটা ছিল, সেটা কেটে দিয়ে আর ব্যারাক ভেঙে সে জায়গায় ও শুনেছে নতুন কিছু তৈরি হচ্ছে নাকি! পাখিগুলো তাই উপবাসী ও উৎখাত হওয়া। সবাই কি পুরনো জায়গা ছেড়ে যেতে পারে?
মিষ্টির দোকানের শান্তি বলে ছেলেটা বোধহয় পুকুরে চান করে ফিরছিল। সে দেখল, সুকুমণি আমতলার ছায়ায় পা ছড়িয়ে বসে আছে, আর বেবাক পাখি ধান খাচ্ছে। সে বলল, "ও পিসি! পাখিতে সব ধান যে খেয়ে ফেললে! কী পাহারা দিচ্ছ তুমি?"
সে তবু তাড়াল না ওদের। বরং বলল, "এইসব কাঙালেরা এক খামার ধান থেকে গোটা কতক করে খেলে বিজয় ঘোষের কমে যাবে নাকি রে?"
শান্তি আর কিছু না বলে তাকে দেখতে দেখতে চলে গেল। সুকুমণি জানে, এইসব পাকপক্ষী একসময় এলাকার যতো রাইসমিল ছিল সেখেনে মেলা ধান খেয়ে যেত। ওদের দেখলে সে দিব্যি চিনতে পারে। ওরা প্রত্যেকদিন আসে, ধান খায়, চাল খায়। বড়ো শান্ত ভাবে - খায়, যতটুকু না খেলে প্রাণ বাঁচবে না ততটুকুই।
ও মনে মনে কথা বলে ওদের সঙ্গে। ওরাও তো অনেক কিছুরই সাক্ষী। মিলের ছুটি ফেরতা যত লেবার গিয়ে জুটত অমলির ভাঁটিখানায়, সরষেখেতের রূপে অন্ধ মানুষের মতো। যা নয়, তার ভেলকি দেখায় ওই ক্ষেত। তাই ছোট ছোট কাচের গেলাস পাতলা ঘোলের মতো একটি জিনিসে ভর্তি হয়, আর পলক না পড়তে খালি। বারবার। গেলাস ভরতি, আর খালি। খালি আর ভরতি। নিরিহ চেহারার আড়ালে ভূত-ভবিষ্যত আর চলমান জীবনকে নাচিয়ে ছাড়ে সে জিনিস। সেই জীবন গুলজারের ভেতর রাণী মৌমাছির মতো পটের বিবিটি হয়ে গেলাস ভরে ভরে দেয় অমলিমাগী। কী তার রঙ ঢঙ! এই যে রাইসমিলের অর্ধেকের বেশি লেবার – সেই রইরই লোকজন রইল না, তার জন্য অমলির ঠাটবাট কি কিছু টসকেছে? খদ্দেরের লাইন ঠিকই আছে।
মিলে এখন মেশিনেই ধান সেদ্ধ, শুকোনো, ধান ঝাড়া – এমনকি ধান থেকে চাল পর্যন্ত হয়ে বেরুচ্ছে মেশিনের পোঁদ থেকে। চাল, খুদ সব আলাদা হয়ে যাচ্ছে। কাজ করতে আর ততো লোক লাগে না। বিহারের দুমকা থেকে, পুরুলিয়া- বাঁকুড়া থেকে, সাঁওতাল আর বাউড়িরা আসত এ কাজে। বাঙালী মেয়ে কমই থাকত। ইদানীং মিলের কাজে মেয়েরা খুবই কম। এ দিগরে চারহাত ছাড়া একটা করে রাইস মিল। আর সেখানে উড়ে লোকেরা দলে ভারী।
বর্ষাকালটা রাইসমিলে অফ সিজেন। ও সময়টা বাদ দিলে ভকত উড়িষ্যা থেকে একচেটিয়া লোক জোগান দেয় মিলগুলোতে। পুরুষরা অনেকে পরিবার নিয়ে চলে আসে। ভকত গাছেরও খায়, তলারও কুড়োয়। মিল থেকে, আবার লেবারদের থেকে কমিশন। সবাই বলে লাল হয়ে গেল ভকত জগদেব।
বিমল, রতনরা বলে, কাকী, তুমি স্বামীর নামের ভুলটা সংশোধন করালেই বার্ধক্যভাতাটা পাবে।এদিকে দু'ট্যাকা কেজি চাল পাচ্ছ, কাজ না করেও জব কাডের ট্যাকা ঢুকে যাচ্ছে। স্বামীর নামটা ঠিক হলেই বার্ধক্যভাতার ট্যাকাও পেলে বলে! তার উপর ঘোষেরা আছে। তুমি তো লাল হয়ে যাবে, কাকী?
বেশি লাল হলে সুগার হয় ভকতের মতো।দরকার নেই। তার অল্পেই খিদে মেটে। বিজয়ের বৌ বলে, পাখির আহার।
গল্প শুনতে শুনতে পাখিরা তার চারপাশে ঘন হয়ে এসেছে। নানা পাখি নানা সুরে সায় দেয় তার কথায়। হঠাৎ কোথাও একটা 'ঠাঁই ঠাঁই' শব্দ উঠতে পাখিদের সাথে সুকুমণিও চমকে উঠল। পাখিরা সভয়ে একসাথে উড়ে পড়ল।
মায়াভরে সে তদের ডাকল, আয় আয়! ও কিছু লয়। বিজয়ের লাতি কিছু ঠোকাঠুকি করছে দুষ্টুমি করে। পাখিরা অনুচ্চে একটা চক্কর কেটে আবার ধানে এসে বসল।
দুপুর পার হতে চলল। এবার ধান গুটোনোর পালা, কিরষেনরা এসে যাবে। পাখিরাও তা জানে। তাই শেষ দুকুরে খামারে নেমে এলো আরও এক ঝাঁক পাখি। সুকুমণিকে ঘিরে রয়েছে পাখিগুলো। ওকে আর দেখা যাচ্ছে না, পাখিদের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে।
কেউ যেন আসছে মনে হলো। পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। পাখিরা পাখসাট তুলে উড়ান দিল একসঙ্গে। আর সেইসব পাখির সঙ্গে একটা বড়ো পাখি বিরাট একজোড়া ডানা মেলে উড়ে চলল পশ্চিমের দিকে। পশ্চিম আকাশে ধূসর একটা মেঘখন্ডের ভেতর হারিয়ে গেল পাখির ঝাঁকটা। অস্তমান সূর্যের করুণ আলো ছড়িয়ে পড়তে লাগল জলে ডাঙায় গাছে। তারপর মেঘের গায়ে সোনালি কমলা গোলাপি লাল রঙগুলো জমতে শুরু করল।