শ্রীনন্দ রাখিল নাম নন্দেরই নন্দন। / যশোদা রাখিল নাম যাদু বাছাধন।। …
কান্ত বৈষ্ণব খঞ্জনি বাজিয়ে কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম গাইতে গাইতে আমাদের উঠোনে ঢুকলেন। আমার ঘুম ভেঙে গেলো।
গায়ে সাদা উড়ুনি, মাথার চুল পিছনে টেনে আঁচড়ানো, পরিস্কার কামানো সৌম্য মুখ কান্ত বৈষ্ণবের। ভোরবেলা এখনও সব পাখিরা জেগে ওঠেনি। আকাশে জ্বলজ্বল করছে শুকতারা। একটু পরেই পশ্চিম দুয়ারী ঘরের চালের ওপারে সে আড়াল হয়ে যাবে। তারও অনেকটা পরে ঠিক ঐখান থেকেই আাকাশের ডিমের খোল ভেঙে অস্ফুট লাল কুসুমবর্ণ সূর্য উঠে আসবে।
সপ্তাহে দুদিন তিনি আসেন। কৃষ্ণের নাম গান করতে করতে গ্রামে সবার বাড়ি ঘুরে তবে তাঁর নিজের বাড়িতে ফিরবেন। গুনগুন করতে করতে নেমে যাবেন আলপথে। সকালের নরম আলোয় স্নান করে পরম প্রশান্তিতে উন্মুক্ত ওই ঈশ্বরের মাঠ পেরিয়ে চলে যাবেন তিনি। আজ এ গাঁয়ে, কাল আবার অন্য গাঁয়ে নাম গান করতে যেতে হয় তাঁকে। মাস পোহালে ধামা চ্যাঙারি নিয়ে সিধে সংগ্রহ করতে বেরোন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করেন। কেউ তাঁকে নিয়োগ করেনি একাজে। কবে যেন তিনি কোন যুবক বয়সে প্রান্তরের বাধা অতিক্রম করে এসে পৌঁছেছিলেন এ গাঁয়ে খঞ্জনি বাজিয়ে কৃষ্ণের নাম গাইতে গাইতে। তারপর এত বছর পার করে আমার বালিকাবেলায় তিনি প্রৌঢ়।
ঠাকুমার সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা হলে বলবেন, কৃষ্ণই বাঁচিয়ে রেখেছেন। আর কিছুই পারি না মা, শুধু এটাই -!
গ্রীষ্মকালে আমার খুব ভোরে ঘুম ভাঙে সেই ছোটবেলা থেকেই। কেমন যেন অভ্যাসের ভেতর থেমে আছে সময় ও মানুষেরা। একটা দুটো কাক ডাকে। পাশের বাড়িতে বাসনের আওয়াজ ঠুং ঠুং করে। মা -জ্যেঠিমা হয়তো উঠি উঠি করছে। কলতলায় জল পড়ার শব্দ। তখনই কান্ত বৈষ্ণব কৃষ্ণের একশো আট নাম গান করতে করতে আসছেন।
আগের রাতে খুব গরম ছিলো। ঘরের ভেতর মশারী ভেদ করে হাওয়া ঢুকতে পারছিল না। ঠাকুমাও ঘুমোতে পারছে না। তাই দুয়ারে মাদুর পেতে মশারী টাঙিয়ে রাতে চুপিচুপি ডেকেছিল আমায়, “বুড়ি, বাইরে শুবি? ”
আমি তুরুক করে উঠে এসেছি, তারপর ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে আবার ঘুমিয়ে পড়েছি। সেই ঘুম ভাঙলো কৃষ্ণের নাম গানে। ভোরে ঠাকুমা সবার আগে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। আজও উঠে বাইরে কোথাও গেছে।
কান্ত বৈষ্ণব তুলসীতলায় খঞ্জনি বাজিয়ে গাইছেন –
উপানন্দ নাম রাখে সুন্দর গোপাল।
ব্রজবালক নাম রাখে ঠাকুর-রাখাল।।
সুবল রাখিল নাম ঠাকুর কানাই।
শ্রীদাম রাখিল নাম রাখালরাজা-ভাই।।
“ননীচোরা নাম রাখে” – গাইতে গাইতে তিনি পার হয়ে যাচ্ছেন সদর দরজা। এবার হেমন্তদের বাড়িতে ঢুকবেন। ভেসে আসছে লাইনটার শেষ অংশ, “যতেক গোপিনী”। পরের লাইনটা গুনগুন করি আমি, “কালো সোনা নাম রাখে রাধাবিনোদিনী”।
আকাশে-আকাশে জলে – গাছে – পাতায় ঝরে পড়তে লাগলো তাঁর সুরেলা কন্ঠের সুর। কী আকুতি নিয়েই না তিনি গান করেন! সব কেমন সুন্দর হয়ে গেল! আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। অমলিন ওই সুর সঞ্চয় করে নিই সারাদিনের জন্য। একই সুর – একই লয়, তবু একঘেয়ে লাগে না।
কিন্তু আজ কৃষ্ণের নামগান শুনে ঘুম ভাঙল না। ছেলেবেলায় কান্ত দাদুর নামগানে দিন শুরু হত। এখন শুয়ে শুয়ে কাকের ডাক শুনতে লাগলাম। কারও গলা ঝাড়ার শব্দ। ভোরটা কেমন শূন্য লাগছে। বৈষ্ণবদাদুর গান সারাদিন মনে লেগে থাকত সেই সময়। সকালটা মধুর করে দিতে পারতেন যে লোক তিনি আজ এক বুড়ো চা দোকানী। ভেঙে গেছে পরম্পরাও। তাঁর এক ছেলে নিরুদ্দেশ, অন্য এক ছেলে ছোটখাটো কোন কাজকর্ম করে। আর এক ছেলে নাকি পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ নয়, সে কোনো চাকরি-বাকরিতে আছে। আর্থিক অবস্থা ভালো। স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে অন্যত্র থাকে।
যতদিন কান্ত বৈষ্ণব নামগান করতে আসতে পেরেছেন ততদিন নিজে সিধে নিতে আসতেন। দুয়ারে চ্যাঙারি নমিয়ে দিয়ে হাঁক দিতেন, “কই গো মা –! ”
ঠাকুমার কাছে মাসান্তে এরকম দিনগুলোতে এক কাপ চা তাঁর বরাদ্দ ছিল। অন্যদিনে সকালে তাঁর তাড়া থাকে, কিছুতেই একবার পরিক্রমা স্থগিত রেখে চাটুকুও খাবেন না। সিধের দিনে চা খেতে খেতে কথা হত। গ্রামগঞ্জের নানা কথা। দেশের হালচাল। ঠাকুমা গত হলে জ্যেঠিমা যে কবে সেই ভূমিকা পালতে শুরু করেছিল আমি খেয়ালও করিনি।
আমি সেদিন বাড়িতে। হোস্টেল থেকে ফিরেছি। বারান্দায় বইখাতা নিয়ে বসেছিলাম। তিনি এসেছেন দেখে তাঁকে আসন পেতে দিলাম। জ্যেঠিমা এক গ্লাস জল এনে দিল। কাকীমাকে বলল, “ছোটো, চা বসা। ”
ঠাকুমার কাছে এইসব সাধারণ ভদ্রতাগুলো শিখেছিল জ্যেঠিমা। চটপট সিধেটা দিয়ে ছেড়ে দিলেও চলে, বাইরের একটা লোকের জন্য নিজেদের কাজের অসুবিধা করার কোন্ দরকার? তবু রীতিগুলো ধরে রাখে, আর কাকিমাকেও অবহেলা করতে দেয় না। বাড়িতে মুড়ি শেষ হয়ে গেছে। আবার ভাজাতে হবে। আনিদিদি কাজে আসেনি। তাই তার ভাগের কাজের দায়িত্বটা জ্যেঠিমা সারছে। মুড়ি ভেজে দেয় রত্নাকাকিমা। জ্যেঠিমা তার জন্যই চাল ধুয়ে নুন মাখাচ্ছিল। এরপর রোদে দেওয়া আছে, তাই তার হাত জোড়া। নয়তো চা বানানো তার একটা বিলাস। বানানো আর খাওয়াও। এখন বাধ্য হয়ে কাকিমাকে বলা। কাকিমার ব্যাস্ততা ছিল, তবু বড়ো জায়ের কথার অবাধ্য হল না। শান্তার মাও ঠিক এভাবেই বড়দির নির্দেশ মানত। বড় জা তো নির্দেশ চাপিয়ে দেয় না, তার মধ্যে একজন স্বাভাবিক পরিচালক আছে। হৃদয়টা ভালবাসায় টসটস করে। তাই তার নির্দেশ কারও কাছে হুকুম মনে হয় না।
জ্যেঠিমা কান্তদাদুর হাঁড়ির খবর নেবে। তেমনি করেই জানা।
তাঁর ছেলে প্রেমে পাগল। গ্রামে ভটচাজ বাড়ির দুই ছেলে কলকাতায় থাকে। পালপার্বণে আর দরকারে গাঁয়ে আসে। তারা ধনাঢ্য। তাদের এক মেয়ে দাদু-ঠাকুমার কাছে থেকে পড়াশোনা করত। কলেজ ছাত্রী মেয়েটির সঙ্গে প্রাইভেট টিউটর ছেলের আশনাই।
“তারা মেয়েকে জোর করে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দিল, মা! আমি দুর্বল মানুষ। সবদিক থেকেই। আটকাতে পারিনি। ছেলেকেও বোঝাতে পারি না। সে গুম মেরে গেল। কারও সঙ্গে কথা বলত না। পরের দিকে বাড়ি থেকে বেরোলে কখন যে ফিরবে তাই নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হত।”
জ্যেঠিমা সমবেদনায় আফশোসের চুঃচুঃ শব্দ করে। তারপর জানতে চায়, “আপনার ছেলে কোথায় এখন? ”
তিনি যথেষ্ট বুড়োটে মেরে গেছেন। আগের মতো চুল নেই, পুষ্ট সৌম্য চেহারা বয়স আর দুশ্চিন্তার কামড়ে কুঁচকানো কাপড়ের মতো দলামচা। জ্যেঠিমার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। বলেন, “জানি না, মা। বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যেত। ফিরেও আসত। তারপর একদিন বেরিয়ে আর ফেরেনি -! ” একটু থেমে আবার বলেন, “কোথায় আছে কে জানে! বেঁচে আছে কিনা তাও তো জানি না। ” আবার দীর্ঘশ্বাস পড়ে। নিষ্প্রভ চোখ ঝাপসা হয়ে যায় তাঁর।
কান্তদাদুকে সেই শেষ দেখা। ধীরে ধীরে আমার নিজেরও ছেলেবেলাটা কেমন ফুরিয়ে গেলো। অতীতের জাবর কাটার সময় মনে হয় না সব অতীত হয়ে গেছে। যেন ঘটছে সব। যেন গতকালই ঘটেছে! স্মৃতির বোয়াল জ্যান্ত হয়ে লাফিয়ে ওঠে ঘটমান জীবনযাপনে। এই তো দেখতে পাচ্ছি নিজেকে, ওই যে -
রবিবারগুলোতে দুপুরে এক কষ্ট, ঘরে বন্দী থাকতে হয়। দুপুরে আমার একদম শুয়ে থাকতে ভাল্লাগে না। ইস্কুল ছুটির দিন হাতের কাজ সারতে সারতে মা শাসনের গলায় বলবে, “শানু! ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়! ” ঠাকুমাও জোর করে শুইয়ে দেবে, তারপর “ঘুমো ঘুমো” করে মাথা খারাপ করে দেবে একেবারে।
আমিও মটকা মেরে পড়ে আছি। জানি একটু পরে কী হবে। ঠিক তাই! ঠাকুমার মৃদু ফুরফুরে নাক ডাকার আওয়াজ কানে এল। বাইরে মা-জ্যেঠিমারও কোনো সাড়াশব্দ নেই। শুধু নিঝুম দুপুর আরও ঘন হয়ে এল কা -কা ডাকে। থেকে থেকে ঘুঘু-র ডাক।
আমি পা টিপে টিপে দরজা খুলে দে দৌড়। আমার লক্ষ্য তপুদের আমতলা। ওদের সদর দরজা ভেজানো ছিলো। ঠেলতেই খুলে গেলো। বিরাট বিরাট ধানের মড়াই। ইয়াব্বড়ো উঠোন। উঠেনের শেষে মড়াইএর পিছন দিকে প্রাচীর ঘেঁষে দুটো আমগাছ। জায়গাটা জগৎসংসার থেকে বিচ্ছিন্ন। আমগাছে পাতা যতো আমও ততো। থোকা থোকা ঝুলে আছে, গায়ে সাদাটে আস্তরণ, শৈশব পার হওয়া মানুষের যেমন লালিত্য – ঝুলন্ত ডাঁসা আমগুলো দেখে আমার সে কথা মনে হয়। আমি গাছে উঠবো না, ঢিলও ছুঁড়ব না। জায়গাটা আমাকে টানে। মাটিতে পড়ে থাকা আম কুড়োনের থেকেও, হাতের নাগালে পড়ে আছে, এক্ষুনি কুড়িয়ে নিতে পারব – এই অনুভূতিটাই আমার দারুণ লাগে।
ওখান থেকে গেলাম আমতলার বড়মার বাড়ি। বড়মা একা থাকে অত বড়ো বাড়িতে। বয়সের গাছপাথর নেই। সবাই বলে বড়োমা নাকি বেজায় লেখাপড়া করেছে। খুব ফরসা, রোগা, কুঁজো চেহারায় ধপধপে সাদা থান পরণে, গায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে। ছোট ছোট চুল। এ বাড়িতে আসি বড়মার টানে। অন্যদের ভাগিয়ে আমার জন্য আম কুড়িয়ে রেখে দেবে। পড়াশুনার খোঁজ নেবে।
“কী রে, বুড়ি? লেখাপড়া করছিস তো মন দিয়ে? ” আমি ঘাড় নেড়ে বড়মাকে হঠাৎ প্রণাম করে ফেললাম।
বাড়ি থেকে যেমন বেরিয়েছিলাম, তেমনই ঢুকে আমগুলো রেখে বেরোতে যাচ্ছি আবার, কার যেন ছায়া পড়ল। চমকে গেলাম, মা নয়তো! তাকিয়ে দেখি- “ও! মায়া তুই? ” ফিসফিস করে বললাম। মুখে আঙুল রেখে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। ও বলল, “এই, বামনা যাবি? ”
“কেন? ”
“চল না, মজা হবে! ”
বামনায় অনেকগুলো ঘাট। বিরাট পুকুর। গিয়েই ও রসাকাকুদের ঘাটে নেমে পড়ল। গরমে জল খানিক তো কমেই। ঘাটে কালো রঙের বড়ো ঝামা পাথরটা বর্ষাকালে ডুবে যায়। তখন ওটাকে তুলে পাড়ের দিকে আনতে হয়। ওখানে বসে সাবান মাখা, জামাকাপড় কাচা, বসন ধোওয়া – সবই হয়। গ্রীষ্মকালে ওর নীচে জল। সন্ধেবেলা আর দুপুরে পাথরের তলায় ধীরে ধীরে দু হাতের পাতা দুদিক থেকে এগিয়ে নিয়ে গেলে ছোট ছোট মাছ উঠে আসে। পাথরটা এখন খুব তেতে আছে।
মায়া বলল, “হাঁদার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? নেমে আয় – “।
আমি বললাম, “জামা ভিজে গেলে মা বুঝতে পারবে। “
“কোমরে জামাটা গুঁজে নে। একটু ভিজলেও শুকিয়ে যাবে। ” ও বলল।
গামছার এক প্রান্ত ছুঁড়ে দিলো আমার দিকে। আমি ব্যাপারটা বুঝে গেছি।
একটু পরে এক বাটি মতো মাছ ধরা হয়ে গেলো। মায়া খুব চোস্ত। সঙ্গে কোনো পাত্র বা পেতে-টেতে না থাকলেও ও ম্যানেজ করলো। ঘাটের কাছে গর্ত করলো কাদা সরিয়ে। একটা বনকচুর পাতা আনলো। গামছায় মাছ উঠলেই গর্তে রেখে কচুপাতা চাপা দিচ্ছে।
হাত-পা ভালো করে ধুয়ে, মাছ বেছে ধুয়ে কচুপাতায় মুড়ে বাড়ি এলাম। ও শুকনো পাটকাঠি, তিলকাঠি নিয়ে এসে উনুন জ্বালালো। আমি রান্নাঘর থেকে নুন-তেলের জোগান দিলাম। লোহার শিক উনুনের উপর সাজিয়ে বাটি বসানোর মাপে করে নিলো মায়া। তারপর তেল ঢাললো।
সুন্দর একটা মাছ ভাজার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল গোটা ঘরে। মুগ্ধ হয়ে দেখছি যৌথ কীর্তিখানা। মাছগুলো বেশিরভাগই আস্ত নেই। তবে তাদের গায়ে তেলের বুড়বুড়ি কাটছে। ডানপিটে মায়া আমাদের ভাতের হাঁড়ি উটকে একটু ভাত মিয়ে এল। দুজনে সেই অমৃত সমান কুচো মাছের বাটিচচ্চড়ি দিয়ে ভাত চটকে খাচ্ছি। তাড়াতাড়ি। বড়ো বড়ো গ্রাসে। প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এমন সময় মায়ের ঘরের দরজা খুলে গেলো। মা প্রথমে থমকে দাঁড়াল। রাগী রাগী, লাল লাল চোখে তাকিয়ে আছে। নাকের পাটা ফুলছে তার। আমার শান্ত মা রাগে না তো রাগে না, রাগলে ভীষণ। তই শেষ গ্রাসটা মুখে তুলেই রান্নাশাল থেকে দিয়েছি লাফ। দুজনে হাসতে হাসতে ছুট।
বিকেল গড়িয়ে গেলো। আমার হয়েছে শাঁখের করাত। গেলেও মা মারবে, যেতে দেরি করলেও মারবে। ভয়ে হাত-পা হিম করে ফিরলাম। মা রেডি হয়েই ছিলো। কঞ্চিটা তুলে পিঠে হাতে পায়ে সপাসপ -।
ঠাকুমা ছুটে এসেছে। মাকে বকছে। জ্যেঠিমা মায়ের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিলো। আমি কাঁদতে কাঁদতে দুয়ারে পাতা মাদুরে শুয়ে পড়েছি। কিন্তু রাগ করে ঘুমিয়ে পড়ার উপায় নেই। কাকু বাড়ি ফিরে গম্ভীর গলায় ডাকছে, “শানু-! “
আমি সাড়া দিচ্ছি না। কাকু হ্যাঁচকা টানে বসিয়ে দিলো। বলছে, “কায়দা বার করছি তোমার। সারাদিন ট্যাঙোস ট্যাঙোস করে ঘোরা! -“বই নিয়ে আয়। ছোট ভাইকে দেখে শিখতে পারিস না? ”
ভাই খুব বাধ্য। দিদিও আমার মতো বাঁদর নয়। সে পড়াশুনা করে, গান শেখে। প্রতি শনিবার বিকেলে তার গানের মাস্টারমশাই আসেন। বেশ জোর গানবাজনার চর্চা চলতে থাকে। মাস্টারমশাইএর সঙ্গে পর্যায়ক্রমে কাকু তবলায় সঙ্গত করে। আমি এসবের থেকে অনেক দূরে। তবু সুর আমায় টানে। শুনতে ভালবাসি। বাধ্য মেয়ে, আমার দিদি ঘাড় নেড়ে নেড়ে গায় – তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে…। তারপর পিসির পালা আসে। সে গায়, “মধুমালতী ডাকে আয় –” এই করতে করতেই পিসির একদিন বিয়ে হয়ে গেলো। আর দিদিও জুনিয়র হাই স্কুল শেষে ওর মামার বাড়ি গিয়ে ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়ে গেলো।
কাকু বই বের করতে বলেছে। আমি বাংলা বই বের করতেই কাকু বইটা টেনে নিয়ে বন্ধ করে দিলো। গম্ভীর গলায় বলল, “অঙ্কের বই খাতা বের কর। ”
ভয় পেলে আমার যোগ বিয়োগ গুন ভাগ সব গুলিয়ে যায়। সহজ অঙ্কে একটা গুনের জায়গা যথারীতি ভুল করেছি। কাকু জিগ্যেস করছে, চার গুনিতক নয় সমান কত হয়? – আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না। ৪×৯ ছত্রিশ, না তেত্রিশ, নাকি আটত্রিশ? কাকু মারলেও কান্না চলবে না, তাহলে মার দ্বিগুন হবে।
হঠাৎ আমার মাথা মাটিতে ঠেকে গেল। চুলের মুঠি কাকুর হাতে। - চার নয় তেত্রিশ? অ্যাঁ -! পিঠে নেমে এল ভয়ঙ্কর একটা থাপ্পড়।
সকালের একশো আট নামের সুরমাধুর্য, আর কচি আমপাতা বর্ণ দখনো হাওয়া বিরসবেসুরো একটা সন্ধের দিকে এভাবেই গড়িয়ে গেলো।
(ক্রমশঃ)