জীবনকে ভালবাসার জন্য জীবনের উদ্দেশ্য না জানলেও চলে। কারণ জীবনই জীবনের বড় উদ্দেশ্য। কেবল জীবনের স্বরূপটুকু ওলঢাল করে বুঝে নিতে হয়। তুমি কী, এর উত্তর তো তোমারই জীবনের ভেতর। মাঝে মাঝে আঁতিপাঁতি খুঁজি জীবনের বৈশিষ্ট্য। কিছুই নজরে পড়ে না। নিতান্ত সাধারণ এক গাছ, পথের পাশে যা আকছার চোখে পড়ে। কোনো বনষ্পতি হয়ে ওঠার সাধ্যই নেই!
রবিবারগুলোতে সন্দীপন সাধারণত না এলেও একেবারেই যে আসে না তাও নয়। তবে আগের দিন যেভাবে ফিরে গেছে-! যৌথযাপনে প্রিয় নারীকে শরীরে চাওয়া পাপাচার হতে পারে না জানি। কিন্তু আমি অন্ধ, যুক্তিহীন।
বাসাবাড়িতে ছুটির দিনে অখন্ড অবসরে বাক্স খুলে পুরোনো জিনিস তোলাপাড়ার মত নিজের ঊনত্রিশ বছরের জীবনকেও-। প্রবৃদ্ধ মানুষের মত স্মৃতিচারণায় বসি।
নিশ্ছিদ্র মানসিক অবসর কি আমাকে বড়মার মত করে ফেলেছে? ঠাকুমার মাসিকে দেখেছি, সে বুড়ি ঠ্যাং ছড়িয়ে বিছানায় বসে থাকত সারারাত। কখন যে ঘুমোয় বুঝতে পারতাম না। যখনই বসে ঠ্যাং ছড়ানো। বসে বসে সামনে পিছোনে দুলবে, আর যত পুরোনো দিনের কথা বলতে থাকবে। কেউ শুনল, কি শুনল না – তার পরোয়া নেই।
একটু পিছনের দিকে তাকাতে গেলে দেখি, কত কিছুই মনে পড়ে না! স্মৃতিশক্তি এত দুর্বল হয়ে গেল! বিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণা বলছে, স্মৃতিভ্রংশের জন্য নাকি জীবনযাপনের পদ্ধতি দায়ী। হবেও বা! এখনকার পৃথিবীতে সুস্থির থাকাটা একটা শিল্প, আর সে শিল্প সবাই কি রপ্ত করতে পারে? খুব ছোটবেলার যে স্মৃতিটা মনে করতে পারি, হতে পারে ওটাই প্রথম স্মৃতি। একা থাকতে থাকতে নানান কথা মনে করার চেষ্টা করি। তবু যেন আগে-পরে গুলিয়ে যায়।
দুপুরে পুব-দুয়ারী মাটির ঘরে খেতে বসেছি আসন পেতে। কাকু, পিসি, দিদি, ভাই আর আমি। না, ভাই হয়তো তখন সবার সঙ্গে বসে খাবার মত বয়সে পৌঁছেয়নি।
ঠাকুমাই কি পরিবেশন করছিলেন? স্পষ্ট জ্ঞান হলে ঠাকুমাকে তাঁর আমৃত্যু খাবার পরিবেশন করতে দেখেছি বলে ঠাকুমার কথাই মনে হচ্ছে, এমনও হতে পারে। কাকু আর জ্যেঠু আসনে বসে সবসময় বাঁ-হাতটা সামনের দিকে মাটিতে থালার পাশে টানটান রেখে সামান্য ঝুঁকে বসে খেত। এখনও তাই। বাবার খেতে বসার কথা তেমন মনে পড়ে না। আসলে বাবা তো ছুটির দিনগুলো বাদ দিলে দুপুরে বাড়ির সবার সাথে খেতে বসার সুযোগ পেত না। তাই হয়তো-! কাকুর খেতে বসার ধরণটা স্পষ্ট মনে করতে পারছি। সব্বাই মিলে যখন খেতে বসা হত, জ্যেঠু আর কাকু খুব মজা করত। আমাদের সেই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে সাধারণ খাদ্যদ্রব্যগুলো হাসিঠাট্টার মিশেলে খুবই উপাদেয় হয়ে যেত।
সেদিন মা আমাকে ভাত মেখে দিল। টুকটাক কথা বলছে সবাই। খাওয়ার মাঝপথে মা আমাকে জিগ্যেস করছে, “আর একটু ভাত নিবি?” মা দু-তিনবার জিগ্যেস করেছে। বছর চার-পাঁচ বয়সের আমি তখন একমনে কলতলার পাশে আমগাছের দিকে তাকিয়ে আছি। ওখানেও তখন একটা লাঞ্চ সিন চলছিল। একটা কাক তার বাচ্চার মুখে ঠোঁট দিয়ে খাবার গুঁজে দিচ্ছে। আর একধরণের আওয়াজ করছে।
আগে মনে করতাম বড় কাকটা ছোট কাককে মারছে। পিসিকে জিগ্যেস করেছিলাম। পিসি বলেছিল, না রে বোকা! মারবে কেন? মা-পাখি বাচ্চাদের জন্য চঞ্চুতে খাবার নিয়ে আসে। সেটা খাইয়ে দেয় ওইভাবে। ওদের তো হাত নেই, তাই ওদের ঠোঁট বাচ্চার মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে খাবারটা ঢেলে দেয়।
আমি সেই খাওয়ানো দেখছি। দেখতে দেখতে মনে হল, কেউ আমায় কিছু বলছে। কিন্তু আমি একমনে দেখে যাচ্ছি মা-মেয়ের ব্যাপারখানা। আচ্ছা, মা-ছেলেও তো হতে পারত? বাচ্চা-কাকটা যে মেয়েই তা কীকরে জানলাম? তবু আমার মা-মেয়েই মনে হয়েছিল কাক দুটোকে দেখে। হঠাৎ আমার একটা কান খুব জ্বালা করে উঠল। কারও আঙুলের স্পর্শ পেলাম কানে হাত বোলাতে গিয়ে। হুঁশ হতে দেখি, মা রাগী-রাগী মুখে তাকিয়ে আছে, তার আঙুল আমার কানে। সবাই আমার অপদস্থ অবস্থা আর আনমনা ভাব দেখে হাসছে। মায়ের হাতে পীড়ন খুব সম্ভব সেটাই প্রথম ও শেষ।
নিজের সম্পর্কে ভাবলে প্রশ্ন আসে মনের মধ্যে। আমি কি কিছুটা নির্বোধ ছিলাম? বোবায় পাওয়া? ছিলাম বলছি কেন? আমি তো চিরকাল তাই-ই। আমার তো কোনো অনুভূতিই হ’ল না ঘটনাটায়। শুধু একটু লজ্জা পেলাম। কিন্তু একটুও রাগ বা অভিমান হল না। মা আমায় খাইয়ে দেয় রাতে। দিনেও এক-একদিন। আমার খেতে খুব দেরি হয়। মা-র যেদিন তাড়া থাকে সেদিন নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়ার পাট সারে। রাতে খেতে বসলেই আমার ঘুম আসে, মুখে খাবার নিয়ে ঢুলতে থাকি। নয়তো ঘুমিয়ে যাই। বাড়ির কাজে ব্যস্ততা থাকত, তাই রোজদিন মা-র খাইয়ে দেবার সময় হয় না। ঠাকুমা বলে, “নিজের হাতে খেতে শিখুক, সবার সঙ্গে বসিয়ে দাও।”
আমি তো তবু কিছুটা বড়। নিজে যতটা পারি খাই, বাকিটা মা বা অন্য কেউ খাইয়ে দেয়।
মাকে নিয়ে আমার বিশেষ কোনো স্মৃতি নেই। ক'দিনই বা মাকে কাছে পেলাম! তবে যতটুকু স্মৃতি আছে, বড় আনন্দের সেগুলো। মা চুপচাপ, শান্ত প্রকৃতির। নিজের মনে কাজ করে চলত। কোনো অভিযোগ নেই কারও প্রতি। তার চাওয়া পাওয়াগুলোরও কোনো হদিশ পেয়েছিল কি কেউ? বড় হয়ে মনে হত মা কি আদৌ জীবিত ছিল? নাকি মায়ের মত চেহারা নিয়ে কোনো রোবট চলেফিরে বেড়াত? গলা শোনা যেত না তাঁর। কখনও প্রাণখোলা হাসিটাও হাসতে দেখিনি। কান্নাটাও অবশ্য নয়। বাবার সঙ্গে কথাই বা বলতে দেখলাম কবে! ঝগড়া নেই, ভাবও কি ছিল? কে জানে!
দেখতে পাই, ভাই রয়েছে, মা তার দেখাশোনা করে, সে ঘুমোলে মা আমাকে কোলে টেনে নেয়। গল্প বলে, ছড়া বলে। তবু আমি ঠাকুমার কাছে কাছেই থাকতে বেশি ভালবাসি। ঠাকুমা যেন ঘরের “মুদুনি”। বিকেলে ঠাকুমাদের বয়স্ক সম্মেলনে পাড়ার বুড়িরা একথা বলত। আমি মানেটা না বুঝলেও, বুঝতাম যে ঠাকুমা না থাকলে আমাদের বাড়িটা কিছুই যেন নয়।
একদিন ক্ষুদিরাম মাস্টারমশাইএর পাঠশালায় পড়তে গেলাম। তিনি গাঁয়ের ভেতর শিব মন্দিরের গায়ে একটা চাতালে পড়ান। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি সেটা।
তার আগে হাতেখড়ি হল ক্ষুদুবাবুর কাছে। পিসি আর কাকু আমায় নিয়ে গিয়েছিল ওঁর বাড়ি। নিশ্চয়ই সেটা সরস্বতী পুজোর দিন। আমার ঠিক মনে নেই। ঠাকুমা পিসির হাতে সিধে পাঠাল। একটা পাথরের থালায় আতপ চাল, আনাজ আর ষোলো আনা পয়সা। কাকুর হাত ধরে গেছি। আমার বগলে শ্লেট, হাতে পেনসিল।
এরপর ওঁর কাছে একদিন আসন বগলে পড়তে গেলাম গ্রামের ভেতরের শিবতলায়। মাস্টারমশাই যেন স্বয়ং যমদূত! সেই যমদূত যদি ভিক্টিমের জাগ্রত অবস্থায় হাতে ডাঙশের বদলে মার্বেল গুলি আর মণ্ডা-মিঠাই নিয়ে যমপুরীতে নিয়ে যাবার জন্য আসে, তাহলেও ছেলের দল নির্ঘাৎ মাটিতে পায়ের আঙুল পুঁতে দিয়ে শরীরটা শক্ত করে পিছন দিকে ঠেলুনি দিয়ে পরিত্রাহি চিৎকার ছাড়ত “আমি যাব না গো–ওওওও” বলে! ছেলেদের গাধা থেকে ঘোড়া বানাবার জন্য আর শাসনে রাখার জন্য অভিভাবকেরা সেই যমদূতসম “মাস্টামশায়”-এর কাছেই পাঠাতেন।
তাঁর হাতে ছিপছিপে ছড়ি। বাতাসে সজোরে চালালে সাঁ করে শব্দ হবে। সেটা ত্যাঁদোড় পড়ুয়াদের হাতের পাতায়, পায়ের গোছে, আর পিঠে সপসপ করে পড়ে। তাঁর তামার মোটা আংটি পরা আঙুলের গাঁট্টাও খুব “খ্যাতি” অর্জন করেছিল।
আমাদের গাঁয়ে আরও কয়েকজন “পেরাইভেট মাস্টার” আছে বটে। তবু এ হেন ক্ষুদুবাবুর কাছে আমাকে পাঠানোয় আমার খুব রাগ হ’ল। বাড়ির কেউই তো আমার পড়ার দায়িত্ব নিতে পারত? কিন্তু তা আর হল না। বাড়ির কারও তত সময় হবে না। মুখে মুখে কথা বলা বা অভিভাবকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবার কথা আমরা ভাবতে পারতাম না। অগত্যা সেই ক্ষুদুবাবু!
মা আমাকে পৌঁছে দিলে। মায়ের একগলা ঘোমটা। “মাস্টামশাই”কে মা গড় হয়ে পেন্নাম করে আমাকে ইশারা করল, “প্রণাম কর”। আমি তাঁর পায়ে হাত রেখে পেন্নাম করলাম। আসন পেতে বসলাম “মাস্টামশায়ে”র নির্দেশ মত। ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
মা ওঁকে বলল, “জ্যাঠামশাই, আমি তাহলে আসি?”
“এসো মা, এসো”।
দেখলাম মা ফিরে যাচ্ছে।
কেন যে ফিরে যাবার দৃশ্যগুলোই এত মনে থাকে! শুধু দেখতে পাই ওই চলে যাচ্ছে। মা চলে যাচ্ছে, মাথায় ঘোমটা। তার শেষযাত্রা দেখিনি আমি। একপাশে চুপ করে থাকা ওই মানুষটির চলে যাওয়াটা পরিচিতদের কেমন যেন হতচকিত করেছিল। ভাই আর আমি দু’জন দু’জনকে ধরে বসে আছি, ঘর থেকে বেরোলাম না। প্রবল অভিমান, কেন যাবে, মা?
দরজা পার হয়ে অফিস বেরোল বাবা। ফিরে এল লাশ হয়ে। মা-ও একদিন। মাস্টারমশাই চলে যাচ্ছেন শেষযাত্রায়। আলতা মাখা পা দুটো অমোঘ হয়ে ওঠে কখনও কখনও। কতদিন রক্তে ডোবানো পা দেখে স্বপ্ন ভেঙে কাঠ হয়ে শুয়ে থেকেছি ঠাকুমার গা ঘেঁষে। সায়নদীপ একদিনের দেখার পর সারাজীবনের জন্য চলে গেলেন নিজের জগতে, নিজের যাপনে। যাবার সময় একপলক পিছু ফিরে তাকানোটাই মনে থেকে গেল। গতকাল সন্দীপন চলে গেল বাসাবাড়ি থেকে। হয়তো আর কখনও আসবে না তাদের যৌথযাপনের ক্ষণকালীন এই বাড়িতে।
মায়ের চলে যাওয়া দেখে মন আকুলিবিকুলি করে উঠছিল। গলার কাছে টাাটানি। কান্নাটাকে ঢোঁক গিলে গিলে ওখানেই আটকে রেখে ছিলাম যে! ভাবলাম টেনে ছুট লাগাই। কিন্তু আসনের সঙ্গে আঠা দিয়ে কেউ সেঁটে দিয়েছে আমায়।
মাস্টামশায় শ্লেটে অ, আ লিখে হাত ধরে একবার দাগা দিয়ে দিলেন। বললেন, “যা জায়গায় বসে এইভাবে দাগা দিয়ে নিয়ে আয়। যেন বেশ মোটা হয়, বুঝতে পেরেছিস?”
আমি ঘাড় নাড়লাম। একমনে দাগা দিয়ে চলেছি। ওদিকে উচুঁ ক্লাসের ছেলেমেয়েদের অবস্থা কাহিল। একজনকে ডাকলেন গম্ভীর গলায়, “বিমল! বই নিয়ে আয়।”
স্পষ্ট দেখলাম সে কাঁপতে কাঁপতে চলল। পড়া ধরছেন, ছেলে তোতলাচ্ছে। অনেকক্ষণ সময় দিলেন, পড়া ধরিয়ে দিচ্ছেন। শেষে বেত চলল সপাসপ। বেশ কয়েকজনের একই অবস্থা। পরিত্রাহি চেঁচানি, “ছেড়ে দাও মাস্টামশাই… আর ভুল হবে না গো-! মাগো–বাবাগো-!” আপনি-আজ্ঞের সম্ভ্রম আর বজায় রাখতে পারছে না তারা।
কেমন কান্না পাচ্ছিল ওদের হেনস্থায়। তবু দেখছি আর লেখায় দাগা দিয়ে চলেছি একমনে। লেখাগুলো বেশ মোটা হয়ে গেছে। পেনসিল অনেকটা ক্ষয়ে গেছে। মাস্টামশায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি, ও মাগো! তিনি তো আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন! কিছু কি ভুল হল? তাহলেই তো গেছি! আমারও কি ওদের মত হাল হবে?
তিনি ডাকলেন, “এই! শোন এখানে। শ্লেটপেনসিল নি’আয়।”
কন্ঠস্বর যদিও অত ক্রুদ্ধ শোনাল না, তবু কেঁপেকুঁপে অস্থির হয়ে এগিয়ে গেলুম। চোখে যেন ঝাপসা দেখছি। দাগা দেখে কিছু বললেন না। মুছে দিয়ে অ আ লেখা দেখিয়ে দিলেন।তারপর বললেন, “এগুলো একইভাবে অভ্যাস করবি। কাল নিজে লিখে আনবি।”
মাস্টারমশাই খুশি ছিলেন আমার লেখাপড়ার অগ্রগতিতে। আমার প্রতি কখনও তাঁর ছড়ি বা গাঁট্টা বর্ষিত হয়নি। একদিন ছুটির আগে বললেন, “সবাই শোন, কাল থেকে আমার বাড়িতে পড়তে যাবি। এই রোদগরমে আটচালায় পড়তে হবে না তোদের।”
সকালবেলা পড়তে গেলাম। তাঁদের লম্বা বারান্দা দেওয়া মাটির ছোট বাড়ি। কিন্তু উঠোনটা বেশ বড়। মাটির প্রাচীরঘেরা সেই উঠোনে গাছপালা ছায়া করে আছে। অনেক গাছ। বেশিরভাগ ফলের। আম, জাম, পেয়ারা, বাতাবি, নারকোল – এইসব। বাগানও যেন তকতক করছে। কোথাও শুকনো পাতার স্তুপ বা আবর্জনা জমে নেই।
পরিষ্কার ধবধবে উঠোনে গাছের ছায়ার নীচে আসন পেতে পড়তে বসতাম। রোদের রক্তচক্ষুর সব জারিজুরি তাঁর বাড়িতে খতম। পড়া শেষ হয়েও যেন হত না। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে সব ক্লাসের পোড়োকেই নামতা আর ধারাপাত আওড়াতে হত একসঙ্গে। এরপর ছুটি। সেদিন নামতা পড়া শেষ হল। তিনি অপেক্ষা করতে বললেন। তাঁর স্ত্রী একটা বড় গামলা নিয়ে এলেন। তাতে কিছু পাকা আমের ফালি। বাড়ির গাছের। নির্দেশমত সবাই হাত পাতল, আর হাতে পাকা মিষ্টি আমের ফালি এসে পড়ল।
এমন প্রায়ই হত। গাছে যা ফল হত, সব পোড়োকেও তার ভাগ দিতেন। খুব বড় বড় মিষ্টি বাতাবি লেবু হত। গোঁড়া লেবুও। গোঁড়া লেবু এমনিতে বেশ টক, কিন্তু পাকলে খুব মিষ্টি। পেয়ারা হত অজস্র। গাছপালায় ঘেরা ওই খোড়োচালের মাটির বাড়িটাতে গেলেই আমার মন ভাল হয়ে যেতো। বড় হয়ে মনে হত পৃথিবীর সমস্ত শান্তি ওইখানে।
আগ্রহী ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ি গিয়ে তাদের শেখাতেন। বাড়তি পাঠ দিতেন। সেজন্য অবশ্য বাড়তি কোনো পাওনার ধার ধারতেন না। কেউ দিতে চাইলেও তিনি কখনও গ্রহণ করেননি।
বামুন গিন্নিকে আমি ঠাকুমা বলতাম। তিনি আর মাস্টারমশাই আমাকে বলতেন, “শানু-মা, তুই একটু পরে যাবি”।
সব পোড়ো চলে যেত। আমাকে ডবল ভাগ দিয়ে বলতেন, “ভাই-এর সঙ্গে ভাগ করে খাবে।”
তাঁর প্রতি সব ভয় আমার ততদিনে কেটে গেছে।
(ক্রমশঃ)