মানুষ বেঁচে আছে পরবাসে। আর তার চারপাশে দাপিয়ে বেড়ায় থর। বালি আর বালি তাঁবুর সমুদ্রে, ভাতের থালায়। খেজুর কাঁটায় রক্তাক্ত হয় মানুষের শ্রান্ত হাত। এসব দেখে দেখে মরামাছের চোখেও শোক জেগে ওঠে। সে দ্যাখে, আর অশ্রুগ্রন্থির আগুনে সেঁকে নেয় মরূদ্যান। ... ...
এতকাল জীবনের হারিয়ে যাওয়া পুরোনো গল্পগুলোকে খুঁজে বেড়িয়েছি। আজ পরিচিত জগৎ ছেড়ে একার বর্তমানে এসে বুঝেছি পিছনের দিকে হাঁটার কোনো মানে হয় না। তাই এখন আমি আমার নিজের গল্প নিজে তৈরি করছি, এক মধ্যবিত্তের সাধারণ গল্প। আর সেই গল্প কেবল আমার আর কুড়চির, মা আর ছেলের গল্প। সেই গল্প বাবা-চরিত্র বর্জিত। তবু নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভাবি, তার বাবাকে শাস্তি দিতে গিয়ে কুড়চিকে বঞ্চিত করছি কিনা। ভাবতে গিয়ে ফুঁসে উঠি, সে শুধু অরণ্যের সন্তান নয়, সে যে বনবীথিরও সন্তান। তাই সে সবটা বঞ্চিত হচ্ছে না; তার ইতিহাস, তার পরম্পরার একটা অংশ তার অজানা থেকে যাবে হয়তো। না, তাও তো নয়! সময় হলে তার সামনে আসবে কুড়চি। তারপরের সিদ্ধান্ত হবে কুড়চির নিজের, আর বাকিটা ভবিষ্যতের হাতে। ... ...
উত্তরে যা আমি শুনেছলাম তাতে করে মনে হয়েছিল, মানুষের ক্ষমার গুণ কত অপার হতে পারে। এই নিঃসংশয় তিতিক্ষা আজকের পৃথিবীতে কতটা জরুরি। কতটা জরুরি সামন্তদাদু আর ভানুঠাকুমার মতো উদারতা আর শিক্ষিত মন। মানুষের অন্তর্গত স্বভাবের উচ্চতা যা সব কুশ্রীতাকে, সব সংকীর্ণতাকে মুছে ফেলতে সক্ষম – সেই সম্ভাবনা আজও যেন কোথাও কোথাও ক্ষীণভাবে প্রজ্জ্বলিত। ... ...
আর দ্যাখো, গলায় গামছা বাঁধা ফ্যান থেকে ঝুলন্ত সমুদ্রগুপ্তের মুখের দিকে প্রথমে আমার চোখ পড়ল না! আমার নজর গেল কিনা তার পায়ের অ্যাসিডে পোড়া বুড়ো আঙুলের দিকে? ও কি আমাকে বলতে চাইল – দ্যাখো, আমি কিন্তু তোমার কাছে পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছি? অথচ মুখে তো ওর স্বভাবসুলভ লাজুক হাসিটা নেই? বরং ঘাড় বেঁকে গেছে, চোখ বিস্ফারিত ও দৃষ্টিশূন্য। সারা মুখে কেমন একটা ছাপছাপ কালচে দাগ। ... ...
আমি তো এসেছি হারিয়ে যাওয়া গল্প খুঁজতে। তার ভেতর কেমন পাশ কাটিয়ে এর ওর ফাঁক গলে এই গল্পটা ঢুকে পড়েছে।তা পড়ুক, ওকে আমার দরকার নেই তেমন, তাই ওকে ফসকান্তি করে সরিয়ে দিলাম। দরকার হলে আবার টেনে আনলেই হবে। পিসির বাড়ির বার দরজায় দাঁড়িয়ে গল্পটার আগের অংশটা ঝালিয়ে নিলাম। সেই যে এক মধুসূদনটাইপ মামা আমার সারাজীবনের ভয় ভাঙালেন, তারপর আমি একেবারে বাঁধা গরু ছাড়া পেলাম যেন। ... ...
জ্যোৎস্না নামের আলেকিত – সুরভিত সুষমায় মনে হয়েছে বরাভয়দানকারী আনন্দময় এক অস্তিত্ব আমাদের এই মরজগত ছাড়িয়ে ছড়িয়ে আছে হয়তো আকাশে আকাশে। আর গহন অন্ধকারের নিকষে নক্ষত্রখচিত আকাশ ও মাঠঘাটের ভেতর অন্ধকারের কায়ারূপী এক দেবি রয়েছেন বুঝি, যিনি কঠিন, তবে মাটি ফুঁড়ে যেভাবে ফল্গু উৎসারিত, সেভাবেই তার বুক ফুঁড়ে আলোর ঝরণা ঝরে পড়ছে নিরন্তর। ... ...
সন্তানের সঙ্গে বাবা-মার সম্পর্কের রহস্য এখন জানি। সন্তানের জন্য সবটুকু উজাড় করে দেওয়া যায়। হাত ধরে তাকে রাস্তা চেনানো, খানাখন্দ পার করে দেওয়া, তারপর বড় রাস্তায় তুলে দিয়ে দুগ্গা দুগ্গা করে তার যাত্রাকে সফলতায় পূর্ণতাপ্রাপ্তির নিরন্তর শুভকামনা জানিয়ে যাওয়া।আর কী বা করতে পারে কোনো বাবা মা? ... ...