এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • বাবাকে নিয়ে কোনো গল্প হয় না

    Krishna Malik (Pal) লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ১৬ আগস্ট ২০২২ | ১৪৬৮ বার পঠিত | রেটিং ৪.৩ (৩ জন)
  • এই গল্পের যেহেতু কোনো গন্তব্য নেই, তাই এর চলারও কোনো শেষ নেই। কেবল বয়ে যাওয়া আছে। হাওয়ার মতো, জলের আলগা স্রোতের মতো, যে স্রোতের কোনো গা-গোছ নেই। কিংবা একটা হাল ও দাঁড় ছাড়া ডিঙি নৌকোর মতো যেটা হাওয়ার সঙ্গে আলস্যে হাই তুলতে তুলতে ওই স্রোতের সঙ্গে একটা দুটো কথা বলতে বলতে দুলি দুলি এগিয়ে যাচ্ছে। বৈকালিক ভ্রমণের গতি বললে হয়তো ঠিক বোঝায়। আবার পুরোপুরি তাও নয়, কারণ তার একটা উদ্দেশ্য আছে। তার একটা গন্তব্য আছে – ঘর। কিন্তু এই গল্পে সেসব কিছুই নেই। 

    তাই একে হয়তো ঠিকঠাক গল্পও বলা যায় না। গল্পের একটা অশেষ পথ থাকলেও তার একটা জ্যামিতি থাকে। একটা ধরণ থাকে। আর এর তো সেসবও কিছু নেই! 

    চোখ চলে যতদূর মন চলে তার বহুগুণ। সামনে ওই যে পাথুরে রাস্তা জলের ধারে ধারে, সে রাস্তা কেমন একটা সুর তুলে পঞ্চম থেকে সপ্তমে চলে যাচ্ছে। কোথাও একেবারে গা বর্জিত,  কোমল রেখাবে গলা মদির করে গায়কের রেওয়াজের মতো চলে যাচ্ছে বাঁকের মুখে। 
      
    আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরছি। বাজারটাও সেরে নিলাম বাস থেকে নেমে পাড়ার মোড়ে। দুপুর গড়িয়েছে। বাজারের ব্যাগ হাতে মোড় ছেড়ে পাথুরে রাস্তাটায় এসে পড়েছি। জলের চওড়া নালাটার পাশে পাশে এই রাস্তার গায়ে অমলসুন্দরবাবুর বাড়ি। যাওয়া আসার সময় তাঁর সুন্দর বাগানের দিকে চোখ যাবেই সবার। দেখলাম বাগানের কোণের জবাগাছের একটা সাদা জবাফুল যেন দুহাতের উপর মুখ রেখে দুখীমুখে তাকিয়ে আছে এদিকেই। পড়ন্ত বেলায় সেই ফুলটা যেন শুধুই যাবার কথা বলছে। 

    গোটা গাছে কেবল একটা দুটো সাদা জবা দেখলেই আমার কেমন যেন “বাবা বাবা” মনে হয়। অমলসুন্দর প্রবাসী ছেলে-বৌমাকে নিয়ম করে ভিডিওকল করেন। আর প্রতিদিন বাগানের ফলফুলের ছবি পোস্ট করেন সোস্যাল মিডিয়ায়। তিনি তাঁর দেশ জোড়া কর্মক্ষেত্রখানি গুটিয়ে এখন বসেছেন একটুকরো বারান্দায়, অন্যদিকে ছেলের আকাশ এখন অনেক বড়ো। তাঁর হাবভাব খুব গর্বিত বাবার মতো। সফল সন্তানের বাবারা সাধারণত যেমন হয় আর কি! কিন্তু আমার বাবা সে দলের ছিল না।

    একদিন বাবা একাই আসছে আমার বাড়ি, সঙ্গে মা নেই। জানলা থেকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সাদা ধুতি পাঞ্জাবীতে হেঁটে আসছে বাবা। বিষণ্ণতা তাঁর পাশে পাশে পোষা কুকুরের মতো। বাবা কি স্বভাবতই বিষণ্ণ হয়ে গেলো শেষের দিকে? নাকি -! বাবার কাছে সহজে কবে যাওয়া গেল? তাঁর দরজায় চিরকাল দারোয়ান, কপাট একটু ফাঁক করে দেখে নিয়ে বলেছে, হুকুম নেই। যখন অবসর হয়ে গেল বাবার, তখনও পেনশন চালু হয়নি। তবু প্রয়োজনটি কোনোদিন মুখ ফুটে বলল না। মুখে স্বাভাবিক হাসি, তবু মনে হতো নেকড়ে চেপে বসেছে বাবার পাঁজরের গোড়ায়। হাড় মাস একটু একটু করে কড়মড়িয়ে খাচ্ছে।

    ভোর চারটে থেকে হাঁটতে যাওয়া, হালকা ব্যায়াম, ঠাকুর প্রণাম থেকে শুরু করে নিয়মমাফিক খাওয়াদাওয়া, ওষুধ। খুব নিয়মনিষ্ঠার ভেতর আত্মকেন্দ্রিকতার উই থাকে।সবার আগে আমার, অন্যের সুবিধা অসুবিধা দেখলে আমার যে নিয়মের ব্যাত্যয় ঘটে! স্বার্থপরতা পরতে পরতে থাকে না? ভাইকে কোনোদিন বাজারহাটেও পাঠাল না, ব্যাঙ্কে না, পোষ্ট অফিসে না – সব নিজের হাতে। বিশ্বাস নেই তো, মনে করত সব ভুল করে ফেলবে। সেও তাই হয়েছিল গায়ে-ফুঁ বাবু।

    অপছন্দের ছেলে জামাই হয়েছিল। দশটা-পাঁচটার অল্প বেতনের চাকুরে। বেতনটা মাসের শেষের দিকে কীরকম যেন শীতকালের কথা মনে পড়ায়। কেমন যেন শুখো, টান ধরা গায়ের চামড়া। কিংবা মনে করো, জল সপসপে একটা উলের মাফলার, জলসহ তারে ঝুলছে। জল ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে  --- ঝরছে - । একসময় জলের ফোঁটা আর ঝরবে না, তবে দু-প্রান্তের ঝিরি ঝিরি উলে হাত দিলে ভেজা আছে বোঝা যায়। যখন সংসারে মাসকাবারি জিনিসগুলো আছে, তখন এরকম লাগে। মাসের শেষে টাকা ফুরোলেও ভেজাভাবটা থাকে – এটুকুই যা। বাড়ির কাজকর্ম, আর সবকিছু দেখাশোনার পর অবসরে বারান্দায় আমার সেলাইমেশিন খুব তড়বড়ে গিন্নির মতো চলে খটখটখটকটখটখট ---।

    তবু বাবা তো মনটা খুলতেই পারত! ধারদেনার হিসাবগুলোও বলে যায়নি। এখন ভাইকে সব দেখতে হচ্ছে, ওই উড়নচন্ডীটাকে। আমাকেও। কিছু করার নেই তো!

    একার মনে বাবা হাঁটছে। ব্যাঙ্কে যাবে। পোস্ট অফিস যাবে। বয়স হয়েছিল আটাত্তরের বেশি।কিছু অসুস্থতাও ছিল, তবে বাইরে থেকে বেশ শক্তসমর্থ। কখনও বা যেন বাবা-মা'র কেউ নেই আপন, দুই বুড়োবুড়ি পরস্পর সম্বল এমন ভাব। হাঁটছে। ধীরে ধীরে আগে পিছে করে দুটো ছায়া। কখনও কখনও একজনের ছায়ায় সেঁধিয়ে যাচ্ছে আর একজন। দুই সহযাত্রী মরুভূমি পেরোচ্ছে। তাকলামাকান। সাহারা। হিমালয় ডিঙোচ্ছে। ডিঙোলেই যেন সব সুসার হবে। কিছু বললে কী হতো? না বললেও বোঝা যায় বটে কিছুটা, কিন্তু সবটা তো নয়?

    হয়তো দুজনেই সময় সম্বন্ধে আর সন্দীহান ছিল না। সময় ফুরিয়ে আসছে বুঝতে পারছিল, তাই হয়তো দুজনে দুজনকে প্রথম বেলার মতো অনুভবে উপলব্ধিতে পেতে চাইছিল! হয়তো কেন, নিশ্চিত তাইই। তাই পাশাপাশি, কাছাকাছি ক্রমাগত হেঁটে হেঁটে সময়টাকে উপভোগে লাগানো। নব প্রেমিক প্রেমিকা যেমন উদ্দেশ্যহীন হেঁটে যায়। বাড়ি ফিরতে হবে, তবে যদি আরও কিছু পরে যাওয়া যায়, যদি আরও কিছুটা সময় একসাথে কাটানো যায়। দুজনের একান্ত যাপনে আর কারও উপস্থিতি পছন্দ নয় যেন।

    ভাবতে ভাবতে বাড়ি ঢুকলাম। বাজারের ব্যাগ রাখলাম। বাথরুমে ঢুকে জামাকাপড় রেখে এলাম। আগে গা ধোবো,  তারপর বেরিয়ে এসে শাশুড়িমাকে চা করে দেব। শাশুড়িমা বললেন, "সে-ও খেলতে চলে গেল, আর তুমিও এসে পড়লে। একটু আগে এলে দেখা হয়ে যেত। আজ তাড়াতাড়ি ফিরেছ, সে খুব খুশি হতো।" নাতির কথা বলছেন। ছেলে রোজ খেলেটেলে যখন সন্ধ্যের মুখে দরজা ঠেলে বাড়িতে ঢুকবে, - মা! ওমা! তুমি কই? ডাকতে ডাকতে। কিন্তু বারান্দায় উঠে চেয়ারে বসা ঠাকুমার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে আগে। 
    "যাও, দাদুভাই! আগে হাত-পা ধুয়ে এসো।" শাশুড়িমার তদারকি শুরু হয় তখন।
    ছেলে পরিচ্ছন্ন হলে জলখাবার দিই। সে খেয়ে পড়তে বসবে। ছবি আঁকতে খুবই ভালোবাসে সে। পড়ার পর ছবি আঁকবে, গল্প শুনবে - সবই অবশ্য ঠাকুমার কাছে। 

    শাশুড়িমা বিকেলে খানিক টিভি দ্যাখেন। আমি চা করে আনলাম। দুজনে চাটুকু একসঙ্গে বসে খেলাম একসঙ্গে। সেই সময়টুকু টুকটাক কথা হলো। আজ কথা বলার উৎসাহ পাচ্ছি না। তাছাড়া আমাকে এখন সেলাইমেশিনে বসতে হবে। প্রাইমারি স্কুলের দিদিমণি ঝর্ণাদির একটা ব্লাউজ বানিয়ে দিতে হবে। সামনেই ওনার বোনঝির বিয়ে, সেই উদ্দেশ্যে বানানো। হাতে দুদিন মোটে সময়। 

    হাত-পায়ে মেশিন চলল খটখটখটখট। বিএলআরও অফিসের তৃতীয় শ্রেণির কেরানিগিরি করি, অবসরে মেশিনে সেলাইটা শখের সাথে সাথে প্রয়োজন সামলাতে করতে হয়।
     
    মনটা আজ ভালো লাগছে না। ঘুরেফিরে বাবার কথাই ভাবছি। বারান্দার পশ্চিম প্রান্তে আমার সেলাইমেশিন। যখন সেলাই করি সেখান থেকে ঠাকুমা-নাতিকে দেখি, আর মনে হয় বয়স হলে মানুষ বাড়ির সকলকেই বোধহয় কাছে চায়। তাই নাতির সঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে থেকে থেকেই নিজের ছেলের ঘরে ফেরার অপেক্ষা করেন। ফিরতে কোনোদিন দেরি হলে নাতির উদ্দেশ্যে বলেন, "তোর বাবা এখনও আসছে না কেন বল তো?"
       
    বয়স হলে মানুষ কবে আছে, কবে নেই। কিন্তু আমার বাবা-মা'র আমাদের দুই ভাইবোনের প্রতি সেই টান বা বিশ্বাস ছিল না যেন। তাই আমাদের প্রতি তাদের মনোভাব বুঝতে পারলেও আমার রাগ হতো। মনে মনে বলতাম, থাকো। দূরে আছো, তাই থাকো। আমরা ভালোবাসার নই হয়তো! অভিমান হয়, আমার কাঁধটা হয়তো খুব শক্তপোক্ত নয়, তবু কাঁধটা কি এগিয়ে দিতে পারতাম না? 

    কত কত ফোন আসত বাবার। মাসির মেয়ে, মাসির জামাই, ভাগ্নে – আরও সব কে কে।নিজেকে অবাঞ্ছিত বলে মনে হতো। ওরা এত আপন? বেড়াতে গেলো পুরী। যাবার আগের দিন ফোন করলাম ঘটনাচক্রে, জানা গেল সেকথা, নিজের থেকে জানাল না।

    মনের ভেতর মেঘটা জমাট হচ্ছে। কষ্টে রাগে মেশিন চালাচ্ছি খটখটখটখটখটখট ---। থেমে যাই। ছুঁচের তলায় জামা লাগানো, বসেই থাকি। চোখের জল পথ পেয়ে গড়িয়ে যায় বেলা গড়িয়ে যাবার সাথে। দিগন্ত সরে যায় অনতিক্রম্য পথের মতো। দোয়েল ডাকে বিকেলের সুরে, মানে যেভাবে ডাকলে বিকেলের সঙ্গে সুরটা বেশ খাপ খেয়ে যায় আরকি। একটা দুটো ফুল বিষণ্ণ বিকেলে বাবার মতো ফুটে থাকে প্রাচীরের গায়ে।

    শীতের দুপুরে পাতলা চাদর গায়ে জড়িয়ে পিঠে রোদ নিচ্ছে বাবা, দেখতে পাচ্ছি।  তাঁর নাতি হবার পর আমাকে বিষাদ ঘিরে ধরল। সব কিছু বিরক্তিকর লাগে। এমনকি মা ও বাবার হাবভাবও।  ডাক্তার বললেন “পোষ্ট পার্টাম ডিপ্রেসন”।  তবু বাবা-মা কয়েকদিন পরই আমাকে একপ্রকার জোর করে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিলো।  মায়ের আলাদা কন্ঠ নেই, চিরকাল বাবার ছায়ায় লেপ্টে।  আমার সিজারিয়ান বেবি, শ্বশুরবাড়িতে আমার দেখাশোনার কেউ নেই।  আমার মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সবার আন্তরিকতা ও সুব্যবহার দরকার – নস্যাৎ করল তারা।  উপরন্তু যখন শাক্য বলল, কিছুদিন ওবাড়িতে কাটিয়ে আসুক, এখানেই বেশ কিছুদিন থাকতে হবে।নয়তো সেরে উঠতে পারবে না।  এখানে সোহিনি রয়েছে, ও-ও দেখতে পারবে। সোহিনি আমার ভাইএর বৌ।

    সোহিনি ঘাড় নাড়লেও, মা-বাবার মুখে কুলুপ। একটু পরে, বোধহয় দোনামনার ভেতর ছিল বলবে কি বলবে না, শেষে বাবা বলল, “না, না! আর আসতে হবে না! আমরা দেখাশোনা করতে পারব না। ওখানে তোমরা একটা লোক রাখো। ”

    দু-বছর বাপের বাড়ি এলাম না, কারও সঙ্গে দেখা হলো না। মা এক-দুবার ফোন করেছে শুধু। বাবার সঙ্গে কতদিন কথা হয়নি। রাগ মুছে যাচ্ছিল বাবার প্রতি। ছেলে যত বড়ো হতে লাগল, তত বুঝলাম বাবা-মায়ের সব দোষ ক্ষমা করে দেওয়া যায়। সন্তান বাবা-মাকে যে আনন্দ দেয় তার কাছে আর সব জাগতিক দোষ-ত্রুটি তুচ্ছ। সে আনন্দ পাবার সৌভাগ্য লাভ করেছি আমারই বাবা-মা আমাকে পৃথিবী দেখিয়েছিল বলে। আমি কৃতজ্ঞ তাদের কাছে। আমার রাগ আর ছিল না স্বভাবতই। তবু বাবাকে ফোনে পেলাম না দু-বছর। ওই দু-বছর বাবার জামাইকে বোঝাতেই সময় গেল আমার। বাবা কেন খবর নেন না? জামাইএর বক্তব্যকে আমি ফেলতে পারি না। তার রাগ যাবার নয়, সে তো তাদের সন্তান নয়!

    সন্তানের সঙ্গে বাবা-মার সম্পর্কের রহস্য এখন জানি। সন্তানের জন্য সবটুকু উজাড় করে দেওয়া যায়। হাত ধরে তাকে রাস্তা চেনানো, খানাখন্দ পার করে দেওয়া, তারপর বড় রাস্তায় তুলে দিয়ে দুগ্গা দুগ্গা করে তার যাত্রাকে সফলতায় পূর্ণতাপ্রাপ্তির নিরন্তর শুভকামনা জানিয়ে যাওয়া।আর কী বা করতে পারে কোনো বাবা মা? একসময় উড়তে শিখে পক্ষীশাবক থেকে প্রাপ্তবয়স্ক বিহঙ্গ হয়। ওড়ার আকাশ পেলে ওড়ার আনন্দে সে ফেরার। তার বাসা পড়ে থাকে অনেক দূরে। সে দেখে আকাশের নীলের বিস্তার, সমুদ্রের ঢেউএর ভিজে উচ্ছ্বাস, তাতে সাতরঙে কুহকের জাল। আর ঝিকিমিকি তারাদের পাড়ার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তাকে শেষ পর্যন্ত ফিরতে হয় দীনের দুনিয়ায়। সেজন্য কাকেই বা দোষ দেওয়া যায়?

    সময় পেরিয়ে যায়। নদীর জল গড়িয়ে যায় মোহনার দিকে, তার ঘরবাড়িতে। শনশন হাওয়া বয়ে যায় সমুদ্র, দেশ, নদীর উপর দিয়ে, কত আঁক বাঁক পেরিয়ে আসে, কত বদল বাঁক বদলে।হাওয়ারও চরিত্র বদলায়। সব পাখি ঘরে ফেরে – সব নদী। ঋতু বদলে যায় সময়ের সঙ্গে। ডাল ছিল খালি, ফুলে ভরে গেল সকালে। কেউ হয়তো তুলে নিয়ে গেল পুজোর জন্য, কিংবা ঘর সাজাতে। ফুলকে মূল্যবান করে দিলো। ধন্য হলো সে। আর টুপটাপ করে পুরোনো হতে হতে বাকি ফুল কেবল ঝরে যাবার অপেক্ষায়। খাঁ খাঁ বিকেলে গাছে রয়ে গেল যে একলা ফুলটি সে কি অভাগা? না তো! এরও কোনো উদ্দেশ্য আছে বই কি।

    গাঁয়ে পাড়ার মাঝের দিকে দুটো বিরাট খেজুর গাছ ছিল। অতি বড়ো গেছোও তার টঙে কস্মিনকালে পৌঁছোতে পারে নি। গ্রীষ্মে বিরাট একটা বাঁশের লগা কে যে জোগাড় করেছিল কে জানে! সেই লগা লাগিয়ে পাকা খেজুরের কাঁদিতে নাড়া দিলে টুপটাপ ঝরে পড়ে পাকা খেজুর। খুব স্বাদের। পক্ষীবাবা কুড়িয়ে এনেছে, নাকি মা, জানি না। পক্ষীবাবা বড় বাটির একবাটি ভরে সেই খেজুর টুকটুক করে --- । পক্ষীশাবক দুটি পড়াশোনায়, আর জুলজুল তাকানোয়। সব খেজুর শেষ হলো।

    অসহ্য প্রেম তাঁদের, কথাটা মনে হলেই জিভ কেটে কান মলে দিতাম নিজেরই। নিজেদের অত প্রেম হলো কই ? শাক্য, আমি দুজনেই কেবল ছাকে দেখি, তাই করতে করতে প্রেমভাব জাগলই না!

    দিগন্তের কোলে সূর্যোদয়ের দিকে ঊর্দ্ধমুখে তাকিয়ে থাকে অমলসুন্দরের বাগানের সাদা জবা, স্থলপদ্ম। কেবল পার্থিব শৃঙ্খলের কার্যকারণ ওই ফুটে থাকা। তার আর কোনোদিকে তাকানোর কিছু নেই। যখন সময় আসে তখন তাদের ঝরে পড়া, শুকিয়ে যাওয়া।ওটুকুতেই সার্থকতা হয়তো।

    বাবা যেন প্রথম সূর্যের দিকে তাকিয়ে  হাঁটছে।  মায়ায় ভরা, হয়তো অভিমানও লেগে আছে দু-চোখের পাতায়। তবু মাথা সোজা করে কর্তব্যজ্ঞানে এগিয়ে চলেছে। একটা দুটো করে জবা শুকিয়ে উঠছে। স্থলপদ্মের রঙ ঘন গোলাপি হয়ে উঠল বিকেলে। পূর্ণতার সেই রঙের ভেতরেও বড়ো বেদনার ছায়া।

    এগিয়ে গেলো বাবা। একা। নিঃসঙ্গ। মা ঘরে ঢুকে বিছানা নিলো।

    অমলসুন্দর একা আড়াআড়ি হাতের উপর মুখ রেখে বসে আছেন ছোট্ট বারান্দায়। হু হু করে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে বাগানের গাছপালা সরিয়ে নড়িয়ে হলদে হয়ে যাওয়া পাতা ঝরিয়ে। তাঁর বাগানের কোণে একটা সাদা জবা বিষণ্ণ মুখে  বাবার মতো ফুটে আছে।  

    ছেলে ফিরবে এখনই। চোখের জলটা মুছে নিয়ে মেশিন চালাই - খটখটখটখট...! 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ১৬ আগস্ট ২০২২ | ১৪৬৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • যুগান্তর মিত্র | 2409:4060:e96:b345:4558:e451:3468:***:*** | ১৬ আগস্ট ২০২২ ০৯:১৪511064
  • অসম্ভব ভালো একটা গল্প পড়লাম। ছবির মতো। বাবাকে দেখতে পেলাম যিনি অন্দরমহলের দরজা জানালা বন্ধ করে রাখেন। অনেকের বাবার মতোই। আমার বাবার মতোও। 
  • সর্বাণী রিঙ্কু গোস্বামী | 223.187.***.*** | ১৬ আগস্ট ২০২২ ১২:২৭511070
  • শুরু করার আগে ভাবতে পারিনি এতো সুন্দর নিটোল নিখুঁত একটা গল্পের সঙ্গে দেখা হবে । মুগ্ধ হয়ে গেলাম বোনু । সব কিছু যেন চোখের সামনে ফুটে উঠলো , এমন কি যা লেখা নেই তাও !
  • স্বাতী রায় | 117.194.***.*** | ১৬ আগস্ট ২০২২ ১৫:৩৬511078
  • ভাষা ও গল্পের চলন বেশ ভাল লাগল. বেশ একটা গা -এলানো ঢিমে গতি, অথচ বাঁধন টুকু সযত্নে লোকানো। কিন্তু বাবা চরিত্র টি ঠিক ধরতে পারলাম না।  অনেক কনট্রাডিকশন   আবছা ধূসর  লাগল।
  • | ১৬ আগস্ট ২০২২ ১৬:০০511079
  • গল্পটা পড়তে ভাল লাগল। বেশ চমৎকার ​​​​​​​লেখা। ​​​​​​​
     
    কিন্তু ... কিন্তু এরকম বাবা মা বিশেষত বাবা আসলে টক্সিক বাবা। যে বাবা মা মেয়েকে বা সন্তানকে তাদের দূর্বল সময়ে সাপোর্ট দিতে পারে না তাদের কোনওভাবে আমি নরমভাবে দেখতে পারি না। আসলে আমাদের দেশে সন্তান হওয়া অনেকটাই সমাজের চাপে। যাঁরা সন্তানের মা বাবা হবেন তাঁরা আদৌ সেই দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত কিনা বা ইচ্ছুক কিনা এগুলো দেখার কোনও ব্যবস্থা নেই। 
     
    ফল ঐ 'মানিয়ে নাও স্বশুরবাড়িই এখন তোমার বাড়ি' , 'লোক রেখে নিও ওখানেই থেকো।'এইসব আসে। এই চিত্র খুবই বাস্তব এরকম টক্সিক বাবা মা ঘরে ঘরে। 
     
  • Shuchismita | 24.53.***.*** | ১৬ আগস্ট ২০২২ ১৮:২৯511082
  • ভালো লেগেছে পড়তে। এক কথায় ভালো খারাপ নয়। বৈপরীত্যে ভরা মানুষ। মানুষ তো এমনই হয়। গল্পে তাদের দেখা পেতে মন্দ লাগে না। 
  • অরিন্দম মুখোপাধ্যায় | 42.***.*** | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২১:৫৯511665
  • অসম্ভব ভালো একটা গল্প পড়লাম। - অনেক না বলা কথাও ফুটে উঠলো চোখের সামনে। বাস্তবের আর আবেগের এক অনবদ্য মিশ্রণ। "বাবা" এই শব্দের অনুভূতির বা অভিব্যাক্তির - এর অনেক গুলো স্তর (লেয়ার অফ শেডস) দেখলাম। এক স্পর্শকাতর মন তো এমন ভাবেই দেখে হয়তো বা। দারুণ দারুণ।   
  • Emanul Haque | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২০:৪৮512184
  • সুন্দর লেখা
  • Subhas Dutta | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২১:৪১512215
  • ভারী চমৎকার শব্দ বিন্যাস । মন ছুঁয়ে গেলো ।
  • Krishna Malik (Pal ) | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২০:০৪512301
  • সকলকে ধন্যবাদ জানাই।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন