বেশ কিছুদিন যাবৎ সন্দীপনের বাইকে চড়ে ওর সঙ্গে স্কুল চলে যায় শান্তা। ব্যবস্থাটা সন্দীপনের জোরাজুরিতে হয়েছে। কোনো কারণে দুজনের মনোমালিন্য হলে সন্দীপন সে সময় শান্তার ফোন পর্যন্ত রিসিভ করে না। তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের গাঢ়তায় একটা যে ছায়াতল আছে তারই অধিকারে শান্তা তার রাগ ও রোষের মর্যাদা দেয়। সে কারণেই কোথাও আত্মমর্যাদার হানি হচ্ছে বলে মনে না হওয়ায় সে সময় বাইকের অপেক্ষা না করে শান্তা আগেভাগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাস ধরে স্কুলে রওনা হয়ে যায় । আজও তাই সে সকালে রুটের বাস ধরে স্কুলে চলে এসেছে। ফেরার সময় বাসস্টপে বাসের অপেক্ষায় যখন দাঁড়িয়ে আছে, মূর্তিমান তখন বাইক নিয়ে এসে হাজির। হেলমেট খুলে কিছুক্ষণ কথা বলল শান্তার সহকর্মীদের সঙ্গে। তারপর যেন কিছুই হয়নি এমন মুখ করে ওকে বাইকে ওঠার ইশারা করে হ্যান্ডেলে ঝোলানো বাড়তি হেলমেটটা ওর দিকে এগিয়ে দিল, নিজেরটা মাথায় পরতে পরতে বলল, নে, ওঠ! কিন্তু কিন্তু ভাব নিয়ে শান্তা উঠে বসল সহকর্মীদের কৌতুহল বাড়াতে চায় না বলে। হেলমেটটা পরে নিয়ে ওর সহকর্মী অনিতাকে টা টা করে বাইকে উঠে বসল এবং একই সঙ্গে একটা সিদ্ধান্তে আসার কথাও সে ভেবে ফেলল।
বাইক চালাতে চালাতে সন্দীপন সাধারণত বকবক করতে করতে যায়, অনেক সময় শান্তার মাথাটা খারাপ হতেই বাকি থাকে শুধু। আজ একদম চুপচাপ চলেছে ভদ্রলোকের মতো, তাতেই শান্তা বুঝল তার রাগ এখনও পড়েনি। সেও তার নীরবতা ভঙ্গ করতে চাইল না। বাতাসের ইথারে ডুবে থাকা তার এই অস্তিত্ব দিয়ে সে উপলব্ধি করল শরতের আবহাওয়া এবার স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তার খুব প্রিয় ঋতু এই শরৎকাল। বাতাসের গন্ধে , আকাশের রঙে, ঘাসে ঝরে পড়া শিশিরে এই সময় ঋতু পরিবর্তনের ইশারা ফুটে ওঠে। আর ছুটি ছুটি একটা গন্ধ মনের ভেতরের তার সব গুমোট কাটিয়ে দেয়।
রাস্তার ধারে, মাঠের ভেতর ফুটে থাকা কাশফুল দেখে খেয়াল করল, সত্যিই আর ক’টাদিন পরই পুজোর ছুটি পড়ছে! এই মুহূর্তে সে ঠিক করল এবার মনস্থির করে ফেলতেই হবে তাকে, নিজের মন গুছিয়ে নেবার জন্য কেবল তার কিছুটা সময় দরকার।
পুজোর ছুটি পড়ার আগে স্কুলের প্রতিষ্ঠাদিবস উপলক্ষ্যে একদিনের ছুটি পেয়ে শান্তা বাড়ি গেল। জ্যেঠিমা তখন রান্নাঘরে রান্না করছে বটে, তবে কাকীমাকে দেখতে পেল না। বারান্দায় উঠতে উঠতে ডাকল, “জ্যেঠিমা -!”
“ওমা, শান্তা! আয় মা, আয়-!” বলতে বলতেই রান্নাঘর থেকে আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে জ্যেঠিমা বেরিয়ে এসেছে।
জ্যেঠিমাকে প্রণাম করে শান্তা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় জিগ্যেস করল, “কী রান্না করছো গো? সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে!”
“দ্যাখ না, তোর কাকিমাকে বলছিলাম, শান্তা পছন্দ করে – ও বাড়ি থাকলে – আর তুইও এসে পড়লি। ডুমুরের ডালনা করেছি।”
কথা বলতে বলতে শান্তাকে এক গ্লাস জল এনে দেয় জ্যেঠিমা। রান্নাঘরে ফিরে যেতে গিয়ে বলে, “ তুই এতদিন আসিস নি কেন, বলতো? আমাদের মন খারাপ লাগে না? ”
একথার উত্তর না দিয়ে ও জিগ্যেস করে , “কাকিমা কোথায়, দেখছি না?”
কড়াই-এ খুন্তি নাড়তে নাড়তে জ্যেঠিমা উত্তর দিল, ছোট চান করতে ঢুকেছে, এবার হয়ে যাবে।
একটু পর কাকীমা বাথরুমের দরজা খুলে এক মুখ হাসি নিয়ে বেরিয়ে আসে।– "গলা শুনতে পেয়েছি, বুঝেছি এ হ’ল ভালবাসার টান।"
ভিজে জামাকাপড়ের বালতি হাতে উঠোনে নেমে যায় কাকিমা।
শান্তা বারান্দায় ওঠার সিঁড়িতে বসে পা ছড়িয়ে দিয়ে চারপাশ দেখতে দেখতে যেন ভরে ওঠে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে কাকিমা বলে, “ডুমুর এখন নিজেই ডুমুরের ফুল হয়ে গেছে। অনেকদিন পর পাওয়া গেল, শেতলের ছেলেটা দিয়ে গেল। আর শান্তাও টানে টানে চলে এলো।”
“ভালোই গো!কপালে ছিল গো!” বলতে বলতে হেসে ওঠে শান্তা। কাকীমার কথায় ল-এর এত অনুপ্রাস দেখে ইয়ার্কি করে সে ।তারপর বলে , “এসো দেখি, একটা পেন্নাম করি।”
“খুব হয়েছে, চলো তো! তার আর দরকার নেই।এমনি ভক্তিছেদ্দা থাকলেই হল।” কাকিমার সঙ্গে তার খানিকটা বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক। ভালোবাসেও খুব।
“তুই বাস স্ট্যান্ড থেকে এলি কীকরে? ” জ্যেঠিমা রান্নাঘর থেকে জিগ্যেস করে।
“থান্দার পড়ার সুনীল দাদুর নাতি অমৃত না কী নাম – ও বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বাসস্ট্যান্ডে।আমাকে দেখে বলল, বাড়ি যাচ্ছি দিদি, তুমি যাবে? তো - চলে এলাম।”
এসময় কাকু জ্যেঠু কেউ বাড়ি নেই, নিশ্চয় একজন দোকানে আর অন্যজন মাঠে। বাড়িতে থাকার আর লোকই বা কোথায়? পিসি তো শ্বশুরবাড়িতে রীতিমতো ছড়ি ঘোরানো গিন্নিগান্নি মানুষ হয়ে উঠেছে। ঠাকুমা মারা গেছে ক’বছরই হয়ে গেল। দিদির বিয়ে হয়ে গেছে, আর ভাই তো কলকাতাতেই আস্তানা পাকা করে ফেলল একরকম। কাকুর ছেলেমেয়ে এসময় স্কুলে। বাড়িতে এসে না চাইলেও ওর মনের ভেতর তাই ছায়া পড়ে, একটু আগের ভালোলাগাটা কিছুক্ষণের জন্য সেই ছায়ায় ডুবে গেল।গাছপালার আড়ালে নির্জন পুকুরে হেলে পড়া ছায়া, যে ছায়া উল্টো, আর স্থির। জলের ভেতর আলাদা যে প্রাণময় জগৎ তার নড়াচড়ায় ছায়া অবশ্য ভেঙে ভেঙে যায়। জ্যেঠিমা শক্ত মনের মানুষ, প্রবল প্রাণশক্তি। রান্নাঘরে পুড়ে পুড়ে লোহা হয়ে গেছে নিশ্চয়। কিন্তু মানুষটা খাঁটি সোনা বলেই আজও তাঁর মনটাকে যেমন ভাঙতে পারেনি সংসারের এই জনশূন্যতা, তেমনই খাদহীন নরম হৃদয়টিও রয়ে গেছে। নিরাসক্তি অর্জন করেও তিনি স্নেহপ্রবণ।
বাড়ি খুব একটা না এলেও শান্তা ফোনে টুকটাক গ্রামের খবর পায়। যদিও ফোন খুব একটা করে না ও, কাকীমা ও জ্যেঠিমা কাকু বা জ্যেঠুর মোবাইল থেকে কল করলে খবরটবর পায়। এখন জমে থাকা কত কথাই যে শান্তা জানতে পারছে! কাকীমা, জ্যেঠিমা সব বলে হালকা হল যেন। কত সামান্য সামান্য কথা, তবু বাড়ির এই মেয়েটিকে না বললেই নয়। কে গাছে উঠেছিল ফল পাড়তে, তারপর বোলতার চাক নড়ে গিয়ে কী কান্ড! সোনাকাকিমাদের বাগাল তিলু। সে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলে শিরি তিলোচন শম্মা।৷ কেউ কখনও হয়তো তাকে এভাবে ডেকে থাকবে, সেটা হয়তো তার পছন্দ হয়েছে। সে গরুর লেজ ধরে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিল, তো যাচ্ছে। হঠাৎ গরু চার পা তুলে দিয়েছে দৌড়, হেঁচড়ে পড়েছে মাটিতে। ভাগ্যিস হাত ছেড়ে গিয়েছিল, তাই রক্ষে, নাহলে যে কী ঘটত ভগবানই শুধু জানেন! ভয়াবহ কিছু ঘটতে পারত ভেবে কাকীমার মুখ একবার কাঁচুমাচু হচ্ছে আবার পরক্ষণেই দৃশ্যটা ভেবে হাসছে।
দুপুরে কাকু জমির কাজ দেখে বাড়ি ফিরে স্নান সারলে পর খেতে বসা হলো। খেতে বসে কাকু কথা বলছিলেন। কাকুর গলায় অভিমান, বাড়ি আসে না, খোঁজ পাওযা যায় না তার ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর অবধারিতভাবে বিয়ের প্রসঙ্গ এসে পড়ল।– “বিয়ে তাহলে আর করবি না?
শান্তার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো কথাটা শুনে। যেন কত সম্বন্ধ দেখেছেন ওনারা, কত যেন চেষ্টা করেছেন! তবু কাকুর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ও মাথা নীচু করে বসে আছে, বলার মতো কিছু নেই এই মুহূর্তে৷ কাকীমা, জ্যেঠিমা যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে, মুখ নীচু থাকলেও তা বুঝতে তার অসুবিধা হয় না। কাকিমা কাকুকে থামাতে চেষ্টা করে বলে, “এখন থাক না এসব কথা।”
কাকিমার কথায় কান না দিয়ে শান্তার নীরবতা লক্ষ্য করে কাকু আবার বলেন, “আবার কবে করবি! এতখানা বয়স হয়ে গেল।”
জ্যেঠিমা কাকুকে থামাতে চেষ্টা করে এবার।-বিনু, খাবার সময় এ’কথা থাক। তেমন করে আমরা তো চেষ্টাও করিনি! তাই বিয়ের প্রসঙ্গটা থাক, ও যখন চাইবে তখন করবে।
“হ্যাঁ! থাক। বলি না তো আর। বলেই কী হবে! ও তো সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে। আসলে নানা কথা কানে আসে –। খারাপ লাগে, তাই – ”। এরপর কাকু চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে গেলেন নিজের ঘরে।
শান্তার আর খেতে ইচ্ছে করে না। ডুমুরের ডালনা বিস্বাদ লাগছে তার। রাগ হচ্ছে নিজের উপর, রাগ হচ্ছে সন্দীপনেরও উপর। কিন্তু দুই মহিলার মুখ চেয়ে মনের তিতকুটে ভাব হজম করেও নেয়, অহেতুক ওই দুই স্নেহময়ী নারীকে কষ্ট দেবে কেন সে? অতটা আহাম্মক বা হৃদয়হীন তো সে নয়। টুকটাক কথাবার্তা বলতে বলতে তিনজনের খাওয়া চলে। খানিকটা ফিসফিসিয়ে জ্যেঠিমা বলে, “গ্রামের খবর জানিস?”
“কী হয়েছে কী হয়েছে” বলে শান্তা অমনি হেদিয়ে উঠল এমন কথাটা যেন না শুনলে খাবারটা তার গলা দিয়ে নামবে না। ওর যখন খুব মন খারাপ থাকে তখন কথা বলে অন্যমনস্ক থাকতে চেষ্টা করে সে। তার উৎসাহে কাকিমার উৎসাহ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তাদের গ্রামে – তাদের এলাকায় এমন একটি ঘটনা বেশ আলোড়ন সৃষ্টিকারীই বলতে হবে।
– ভিটে নিয়ে বিবাদ। অসীম থান্দার একটা ঘর তুলেছে নতুন। সেই ঘরটা নাকি শুকদেবদের জায়গায় উঠেছে। যখন থেকে ঘর উঠছে, তখন থেকেই শুকদেব বলতে শুরু করে, জায়গাটা যে অসীমের তার প্রমাণ কী? তাকে কাগজপত্র দেখাতে হবে। অসীমও সে কাগজ দেখাতে পারে না, কিন্তু ঘর উঠে যায়।”
“পার্টির লোক তো অসীমের দলে ” – কাকিমা ফুট কাটে মাঝখানে।
“যাইহোক, শুকদেবদের উঠোনের পাশ থেকে যে জায়গাটা বালিপুকুরের পাড় পর্যন্ত সেটা ধনঞ্জয়দের। ও তো এখন পার্টিতে খুব তালেবর।– ”
“ওই উঠোনে ধনঞ্জয়ের দখল মারার ইচ্ছা ছিল আর কি!” কাকিমার এ কথায় তার দিকে কটমট করে তাকায় জ্যেঠিমা। বলে, “ভাষাটা কী হচ্ছে, ছোট?” তারপর হেসে ফেলে। হাসিটা তিনজনের মধ্যে সংক্রামিত হতেই কাকু ঘর থেকে ভারিক্কি গলায় বলে ওঠেন, “আজ কি খাওয়াদাওয়া শেষ হবে না? রাতে আবার খাবার সময় হয়ে গেল তো!”
গল্প স্থগিত রেখে উঠে পড়ল সবাই। শুধু কাকিমা ফিক করে হেসে ফেলল।
ভাইবোনদুটো স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এসে দিদিকে দেখে খুব খুশি। তাদের অনেক জমানো গল্প ছিল, স্কুলের নানা ঘটনা , বন্ধুদের গল্প সব পারলে একবারেই বলে নেয়। বিকেলটা তার অনাবিল আনন্দে কেটে গেলো। সন্দীপনের ব্যাপারটা মনের ভেতর মাঝেমধ্যে খোঁচা দিতে থাকল না তা নয়। ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেললে সে খানিক রিলিফ পাবে বলে মনে করল। কতদিন যেন পারিবারিক এই আনন্দময় জীবনটাকে নির্বাসন দিয়ে রেখেছিল বলে ভাবল সে।
সন্ধ্যেবেলা শান্তা ভাই-এর সঙ্গে কথা বলছিল ফোনে। ভাই বলল, “দিদি, একটু টাকা পাঠা না রে! আটকে গেছি।”
“কবে চাই তোর?”
“কালকেই পাঠাতে হবে, এমন নয়! দু-একদিন পরে পাঠালেও চলবে। তবে বেশি দেরি করলে কিন্তু সমস্যায় পড়ে যাব”।
ভাই-এর সঙ্গে কথা শেষ হয় না এমন সময় বেশ একটা শোরগোল, চিৎকার শোনা গেল। কারও দুদ্দাড় ছুটে যাওয়া পায়ের শব্দ।
“শোন না! এখন রাখছি, পরে কথা বলব।” ফোন রেখে তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দ্যাখে নাছ দুয়ারে কাকীমা জ্যেঠিমা, ভবাকাকীমা আর পাড়ার কয়েকটা বৌ দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবাই বেশ উত্তেজিত। অনেকেই থান্দার পাড়ার দিকে যে যাচ্ছে তা বোঝা গেল। খেল তাহলে ভালই জমেছে!
মেলা বা কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া বেশি লোক জড়ো হতে দেখলে শান্তাকে ভয় গ্রাস করে চিরকাল। চিৎকার, হৈচৈ সহ্য করতে পারে না, তবু আড়ালে লুকিয়েও কি থাকা যায়? কৌতুহল নিরসন তো করাও চাই। তাছাড়া ভয়ের চেহারা বা কারণটা যতক্ষণ না চোখে দেখছে ততক্ষণ তার শান্তি নেই, তাতে ভয় বেড়ে যায় আরও। ভয় পেলে সে কখনও চোখ বোজে না, মুখ লুকোয় না, পিছন ফিরে থাকে না, বরং ভয়ের চোখে চোখ রেখে মুখোমুখি দাঁড়ায়। ভয়ের কারণটা জানা হয়ে গেলে অন্তত ভয়ালের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার একটা উপায় তো করা যায়?
তবে আজ চিৎকারের কারণ অনুসন্ধানে গেল না সে। গ্রামের ভেতরে জিপের শব্দ মানে হয় পুলিশ, নয়তো হাসপাতাল থেকে মড়ি আসা। যেহেতু ঘটনা একটা ঘটেছে তাতে বোঝা গেল এই জিপে পুলিশ এসেছে। ছোটখাটো গ্রাম্য বিবাদ সব জায়গার মতো এইসব জায়গাতেও ঘটছে আজকাল। সেগুলোর কিছু হয়তো পারিবারিক, নয়তো ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব। বড়ো আকারের ঘটনা শেষবার ঘটেছে সেই ’৭৫-৭৬ সাল নাগাদ পাষন্ডার মাঠে। জমি দখলকে কেন্দ্র করে বামফ্রন্টের উত্থানের সময়। প্রাণনাশ হয়েছিল কিনা তা সঠিকভাবে জানা নেই, তবে আহত হয়েছিল প্রচুর মানুষ। তার আগের দাঙ্গা ’৫৫-৫৬ সালে জমিদারী উচ্ছেদের সময়কালে। কৃষাণ -ভাগচাষী বনাম জমিদার। এসব তথ্য সে পেয়েছে পার্থপ্রতিম বসুর কাছে। মনীষার দাদু। যিনি এক স্থির ও শান্ত সরোবর, সব দাহ জুড়িয়ে যায় যার শীতল স্পর্শে, সুখে দুঃখে কতদিন তাঁর কাছেই আশ্রয় পেতে চেয়েছে সে। অনেকদিন আর অশীতিপর সেই পরম শ্রদ্ধেয় মানুষটার সান্নিধ্যে আসা হয় না তার। তবু আজও চাইলেই সেই ছায়াতলে গিয়ে কিছুটা সময় জুড়িয়ে নেওয়া যায়। তাঁর কাছ থেকে সে অনেক অযাচিত স্নেহ পেয়েছে, শিখেছেও জীবনের অনেক পাঠ।
এই দুই বড়ো ঘটনা এই অঞ্চলের মানুষকে খুব নাড়িয়ে দিয়েছিল। নয়তো দক্ষিণ দামোদর শান্ত, নির্বিকার। অথচ এখানেই তিনচার দিন আগে ভয়ঙ্কর একটি ঘটনা ঘটে গেছে। মহৎ কোনো উদ্বোধনের জন্য যেমন ঝাঁকিমারা ঘটনা ঘটে যায় – এ তা নয়। সামান্য আখেরের জন্য মানুষের অন্তর্গত জিঘাংসার প্রকাশে বিচলিত হওয়ার মতোই ব্যাপার। ইদানীং মানুষের লোভ আর অসহিষ্ণুতা যেন বড্ড বেড়ে গেছে। ক্ষমতা প্রদর্শন আর ক্ষমতার দম্ভ অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে, বিশেষত যখন এক দল ক্ষমতা হারানোর ভয়ে বেপরোয়া, আর একদল মাটি কাড়তে চাইছে।
অসীম থান্দারের ছেলেটা শুকদেবদের বাড়ির চারজনকেই প্রায় খুন করতে বসেছিল। মাথায় মুগুরের আঘাত করতেই ঘটনাস্থলেই মারা গেছে শুকদেবের ঠাকুমা। তার মাথা থেকে মাংস ঘিলু বেরিয়ে এসেছে মুগুরের ঘায়ে। তার মায়ের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। এসব শুনে শান্তার শরীর খারাপ লাগে, সামান্য স্বর্থেও মানুষ এতটা নৃশংস হতে পারে ও ভাবতে পারে না। শুকদেব আর তার বৌ যে সামলে গেছে এটা পরিণামের ভয়াবহতাকে কিছুটা আটকেছে। তবে এই ঘটনায় সবাই বাহবা দিয়েছে শুকদেবকে।
কাকিমা বলছিল, আরে! শুকদেবের হাতেও মোটা কাঠ ছিল, কুড়ুলও ছিল। ঝামেলা শুরু হবার আগে সে কাঠ কাটছিল, চাইলেই সে সেগুলো ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু সে তা না করে মাথা ঠান্ডা রেখে শুধু ঢালের মতো করে মোটা কাঠ দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করে গেছে। নাহলে রক্তগঙ্গা দ্বিগুন হতো, শানু!
শুকদেবের কথাটা তার বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়, এখনও তাহলে মানুষের সুবুদ্ধি কিছু বেঁচে আছে!
অসীম আর তার ছেলের নামে কেস দেওয়া হয়েছে। শান্তার মনে পড়ে বছর কুড়ি আগের অন্য পার্টির উঠতি নেতটির কথা, সাধনজ্যেঠুর দোকানঘর গ্রাস করতে চাওয়ার ঘটনা। এবারে উঠতি নেতা ধনঞ্জয় আর তার শাকরেদরাও অন্যের ভিটেমাটি দখল করতে পিছপা নয়। তাই আদর্শ হয়তো সর্বদা বড়ো কথা নয়, কারণ নেতার আদর্শে ক্যাডার সর্বদা নিজেকে জারিত করে নেবে এটা ভাবা যেমন ভুল, আবার নেতা যেমন হবে ক্যাডারও হবে তেমনই এও ঠিক। ভারতীয় রাজনীতিতে শুধু পতাকার রঙটাই বদলে যায়। ক্ষমতা উপভোগের মোহ ক’জন এড়িয়ে চলতে পারে? সে নেতাই হোক বা ক্যাডার। সমাজকে আর মানুষকে আগাগোড়া শুদ্ধিকরণ তো সম্ভব নয়, আর ঘুরেফিরে প্রশ্নটা একই জায়গায় এসে দাঁড়ায়, তা হলো করবেটা কে?
যাইহোক ধনঞ্জয় নেতা আপাতত পুলিশের নজরে আছে, যে কোনোদিন তাকে নাকি তুলবে। অসীম আর তার বৌ ফেরার হয়ে গিয়েছিল।দাম্ভিক ছেলেটা আজ ঘরে এসেছে সন্ধ্যের মুখে কোনো কিছুর পরোয়া করে না - এমন হাবভাব করে। গ্রামের লোক খেপেই ছিল, ঘরের ভেতর আটকে দিয়ে পুলিশে খবর দেয়, তারা এসে তাকে জামাই আদরে নিয়ে গেছে। একটু আগে পুলিশেরই গাড়ির শব্দ পেয়েছিল শান্তা। শান্তার বাড়ি আসার আনন্দ যেন খানিকটা নিভে গেল ঘটনাটায়।
অতীতের ভেতর ঢুকে পড়ে সে।
পাশের বাড়িতে থাকা ছোড়দাদু আর ছোটঠাকুমা খুব ঝগড়া করছেন। একজনের হাতে ঝাঁটা অন্যজনের হাতে খড় কাটার বঁটি। যে কোনো চিৎকার চেঁচামেচি তাকে কুঁকড়ে দেয় আর একটা ভয়ঙ্কর ভয় গ্রাস করে চিরকাল। ছেলেবেলায় ব্যাপারটা অনেক বেশি ছিল, তাই তাঁদের ঝগড়াঝাঁটিতে ভয় পেয়ে সে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। তখন ও টু-থ্রিতে পড়ে হয়তো। এদিকে কেঁদে ফেলতেই ঝগড়া থামিয়ে ছুটে এসে তাকে দুজন মিলে ভোলাতে লাগলেন, থেমে গেলো তাঁদের অজা যুদ্ধ। বাড়িতে তিনজনকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি শুরু করেছেন তখন।
একটু পরে আবার একটা বিজাতীয় চিৎকার চেঁচামেচিতে শরীর কেঁপে উঠল তার। কিন্তু তাকে তো দেখতে হবে কীসের চিৎকার! বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে , পিছন থেকে মা ধমক দিল, শানু-! যাস না! কিন্তু সে বারণ না শুনে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছে।
দুটো লাইন ধরে কিছু লোক কী যেন সব বলতে বলতে এগিয়ে আসছে। একেবারে সামনের লোকদুটো একটা বড়ো লাল রঙা কাপড় ধরে আছে। তাতে যা লেখা ছিলো, তা পড়ে মানে বুঝতে পারল না সে। মানুষের লাইনের ভেতর কারো কারো হাতে ছোট ছোট পতাকা, সে লাইন যেন এক দৃপ্তভঙ্গিতে এগিয়ে চলেছে।
একটা লোক মুঠো উঁচিয়ে বলছে -, কী বলছে কান পেতে শুনে মনে হলো বলছে, “ইনকেলাব জিন্দাবাদ”! লোকটা থামলে লাইনের বাকি সব লোক সেই কথাগুলোই একসঙ্গে চিৎকার করে পুনরুক্তি করল। তীব্র গর্জনের মতো সেই কথার ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল চারপাশে। রাস্তার ধারে ধারে অতি কৌতুহলী কেউ দাঁড়িয়ে, তবে অনেক মানুষই আড়াল আবডাল থেকে সেই লাইন লক্ষ্য করতে লাগল, কারণ সেই রাজনীতি তখনও সর্বস্তরে অত গ্রহণীয় হয়ে ওঠেনি। আর শান্তার হাত-পা কাঁপতে লাগল, যখন গলা আরও এক ধাপ তুলে লোকটা বলতে লাগল – লড়াই লড়াই লড়াই চাই, উত্তরে মেঘের গর্জন ভেঙে পড়ল এই বলে - লড়াই করে বাঁচতে চাই।
কিন্তু এসবের মানে কী? কাকে জিগ্যেস করবে সে? পিসিকে? কাকুকে? নাকি মা বা জ্যেঠিমা, ঠাকুমাকে? পিসি তার থেকে এগারো বারো বছরের বড়ো। স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর বাবা -কাকু -জ্যেঠুদের কেউ আর পড়াতে রাজি হয় নি পিসিকে, কী না, অত দূরে স্কুল - একা একটা মেয়েকে রোজদিন পাঠানো যাবে না এইসব গ্রাম দেশে। ব্যস, সাঙ্গ হলো পিসির লেখাপড়ার পালা!
হাতের কাছে পেয়ে পিসিকেই জিগ্যেস করল শান্তা। পিসি তার মতো করে যা বলল তাতে বুঝল সমবেতভাবে লাইন করে যাওয়াটাকে নাকি মিছিল বলে। এক-একটা দল আছে - তারা তাদের লোকজন নিয়ে মিছিল করে, আর দাবি জানায়। এই দলটার নাম নাকি সিপিএম।
সামনেই ভোট – না, কী যেন হবে তাই মিছিল বেরিয়েছে। পিসি আরও অনেক কিছু বলল, যার মানেটা সে ঠিক বুঝতে না পারলেও একটা কথা আন্দাজ করল, এরা গরীব মানুষের জন্য নাকি ‘লড়াই’ করে। কিন্তু লড়াই করে – মানেটা কী? মারামারি করে?
“না রে,বাবা! এইভাবে মিছিল করে, মিটিং করে হাজার হাজার লোক নিয়ে। সেখানে মানুষের জন্য সরকারকে কী কী কাজ করতে হবে তা-ই জানায়।”
তাকে এসব প্রাথমিক জ্ঞান পিসিই দিয়েছিল। হ্যাঁ! মনে পড়ল, কিন্তুপিসিকেও ওই মিছিলে দেখেছিলা সে। যত নীচু জাতের আর গরীব মানুষই কি বেশি ছিলো ওই মিছিলটায়?
এরপর কয়েকদিন তার মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। নিজেই উত্তর খুঁজতে চেষ্টাও করে। কাকু একটা ইংরেজি শব্দ বললেন, কমিউনিস্ট পার্টি। তারপর খুব গম্ভীর গলায় বললেন, “তোকে অত পাকামি করতে হবে না। অত বুঝবিও না। নিজের চরকায় তেল দে”!
এ’কথা বলেই কাকু খামোখা তার চুলের ঝুঁটি ধরে পিঠে থাপ্পড় মেরে একগাদা অঙ্কে দাগ দিয়ে কষে দেখাতে বললেন। সে বুঝল, এটা তার শাস্তি।
…..
দু-এক বছর পরেই হয়তো হবে, কিন্তুবালার নামে বার্ধক্যভাতা চালু হয়েছে। দু-তিন মাস ছাড়া ছাড়া আমাদের গ্রামে এসে তাকে যশোদা পিওন ভাতার টাকা দিয়ে যায়। পিসি তো সই করতে পারে না, তাই পিওন এলেই সে লোক খোঁজে - কে সই করে দেবে তার টিপছাপের উপর, তবে টাকা পাওয়া যাবে পিওনের কাছ থেকে। গ্রামে আরও কয়েক জনের নামেও বার্ধক্য ভাতা, বিধবাভাতা চালু হলো। বাধ্যতামূলক আত্মনিগ্রহ ছিল নীচু আর গরীব সম্প্রদায়ের মানুষের ভবিতব্য। তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে থাকল এখন।
যদিও সহস্রাধিক বছর ধরে পদপিষ্ট হতে থাকলে দু-চার বছরে, দু-এক দশকেই শিরদাঁড়ার সেই পায়ের ছাপ মুছে ফেলা যায় না। ওরা অযোগ্য – এই তকমা পিছু ছাড়বে না বহুদিন। তাদের ভেতরেই যে একটা বোবা পশু ঢুকে আছে – সে উইপোকার মতো আত্মবিশ্বাস কুড়ে কুড়ে খায়।
আত্মবিশ্বাস যেমন বাড়তে লাগল, অন্যদিকে তাদের ভেতরকার স্বাভাবিক সৌজন্যবোধও কিছুটা হলেও হারিয়ে গেল নিশ্চিতভাবেই। কিংবা হতে পারে, এতদিন শোষণ আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে ভেতরে ভেতরে অক্ষমভাবে ফুঁসেছে, এখন একটা কথা বলার জায়গা পেয়েছে বলে সেই ক্ষোভই বেরিয়ে আসছে ঔদ্ধত্য হয়ে!
কিন্তুপিসি একদিন পাকড়াও করেছে মুরারিকে। সাইকেল নিয়ে সে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল।বোধহয় স্কুল থেকে ফিরছে। সবাই বলে হরেনের ব্যাটা বাপের ভয়ে জড়ো। কোথাও সে বাপের অনুমতি ছাড়া এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করে না। এখন “ও বাবা, একবার দাঁড়িয়ে সইটা করে দিয়ে যাও না, সোনা ” বলতে বলতে পিসি একেবারে সাইকেলের সামনে। কিছু বুঝতে পারেনি, টাল সামলাতে না পেরে হতভম্ব মুরারি পপাত ধরণীতল। পাশে গরুর লাদ পড়েছিল একদলা, পড়বি পড় কাঁচা গোবরে। দু পক্ষের কাঁচুমাচু মুখের ভাব দেখে যশোদা পিওন প্রথমে হোহো করে হেসে উঠেছে। কিন্তু হেসে উঠেই চুপ। কারণ, মুরারি এক্ষুণি কেঁদে ফেলল বলে - ! এই অবস্থায় হাসিটা তার নিজের পক্ষে বাঁশ হয়ে যেতে পারে সেটা বুঝতে যশোদা পিওনের অসুবিধা হবার কথা নয়। হরেন সরকার যা খিটকেলে লোক!
দুপুর রোদে একটা কাক গামার গাছের ডালটাতে বসে কেমন হতাশ গলায় কা কা করে ডেকে উঠল একবার।
(ক্রমশঃ)