গনগনে রাগী দুপুর তখন অনেকটা শান্ত হয়ে বিকেলের দিকে এগিয়ে চলেছে তার কোলে মুখ লুকোবে বলে। আর বিকেল তখনও খানিকটা দূরে বসে তাকিয়ে আছে দুপুরেরই দিকে, সেই সময় রাস্তার ধারে, খামারে, আমি আর মায়া এক্কাদোক্কা খেলছি। এমন সময় কিন্তুপিসি খোনা গলায় “কানা, গু-খেগোর ব্যাটা –” বলতে বলতে আমাদের ধূলিধূসরিত রাস্তা দিয়ে এগিয়ে এল। চৌকায় আমার পা নামানোর কথা নয়, কিন্তু আপসেই আমার পা নেমে গেল সেখানেই। ভগবান ব্যাটাকে তেড়ে গালাগাল দিতে দিতে যাচ্ছে কিন্তুবালা দাসী। তার বগলে একটা ময়লা চটের ব্যাগ আছে – লক্ষ্য করলাম আমি। সে যে নিশ্চিত ভিক্ষে করতে গিয়েছিল, তা না বোঝার মতো নয়।
দুপুরবেলা আমার বাইরে থাকার কথা নয় ঠিকই, তবে আমার তো ঘরে মন বসে না – সারাদিন টইটই চলে। নয়তো গরমের দিনে তখন আমার ঘুমোনোর কথা। আমি বাড়ির সবার বিশ্রামের সুযোগ নিয়ে লুকিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। কিন্তুবালা দাসী চোখে ভালো দেখে না, বয়স থুত্থুড়ে হবার মতোও নয়। নিজের গ্রামে সে ভিক্ষেয় বেরোয় না কখনও। এই কাজের জন্য সে যায় ভিন গাঁয়ে। ভিক্ষে থেকে ফিরে সে এবার চান সেরে রান্না করে তবে দু’টি খাবে।
কিন্তুবালাকে, যাকে গ্রামে আমাদের বয়সী প্রায় সব ছেলেমেয়েই পিসি বলে ডাকে কেন জানি না, আমার খুব দুঃখী মানুষ বলে মনে হয়। পিসির একটাই ছেলে। ধরণী। আহা! পিসির পৃথিবী! সে পৃথিবী একদিন তাকে বলল, “মা! ভাবছি এবার থেকে পাকাপাকিভাবে আমি শ্বশুরবাড়িতে গিয়েই থাকব।”
মা তাকিয়ে আছে, তার পৃথিবী আর কী বলে তা শোনার জন্য। সে তখন বলছে, “তুই তো জানিস, তোর বৌমা ছাড়া তার বাবা-মা’র আর কোনো ছেলেমেয়ে নেই। শ্বশুর গত হলে আমাকেই সব বজায় রাখতে হবে তো! তাই এখন থেকে সবকিছু বুঝে নেওয়াই ভালো।”
পিসি কিন্তু বললো না যে, সে-ও তার একমাত্র সন্তান। বুড়ো মাকে সে না থাকলে আর কেই বা দেখবে? সেকথা না বলে সে বলল, “আমার পেটখানা কী করে চলবে, বাছা?”
“চিন্তা করিস ক্যানে? একটা পেট তো, ঠিক চলে যাবে।”
পিসির দিন চলতো, তবে পেট চলতো না। তাই শেষে ভিক্ষার ঝুলি হাতে বেরিয়ে পড়তে বাধ্য হল একদিন। নিজের মনে কথা বলে পিসি আর ভগবানকে তেড়ে গাল দেয়। সন্ধ্যের পর হাতড়ে হাতড়ে রাস্তা হাঁটলেও দিনের বেলা তারচে’ একটু বেশি দ্যাখে। সেইজন্যই ভিন গাঁয়ে ভিক্ষে করতে যেতে পারে।
কিন্তুবালার শ্বশুরবাড়ি ছিল সেই মুন্ডেশ্বরীর ধারে এক গাঁয়ে, ফতেপুর না আতাপুর – কোথায় যেন। তার বর আশপাশের গাঁ থেকে গরুর গাড়ি করে পাট বয়ে নিয়ে যেত কামারগড়িয়া-ধামনারির পাটের আড়তে। তারপর দেবখালে বোঝাই করা পাট নিয়ে নৌকো ভাসানো।
দামোদর-মুন্ডেশ্বরীর কাছাকাছি গ্রামগুলোতে যে পাটের চাষ হয়, সে খানিকটা সোনালি বর্ণের পাট। মেমসাহেবদের চুলের মতো ঝকঝকে। এ হল মাটির গুণ। নিম্ন দামোদর অববাহিকার সোনার মতো মাটিতে সোনার পাট। বাজারে তার চাহিদাও প্রবল।
কিন্তুবালার বর অনন্ত শীট যেমন ভালো গাড়োয়ান, তেমনি দক্ষ মাঝি। আড়তের কাছে খালের ঘাটে নৌকো বাঁধা থাকে। দেবখাল পুরোপুরি কখনও শুকোয়নি না, সারাবছরই কিছু না কিছু জল থাকে তাতে। স্বচ্ছ পরিষ্কার সেই জল প্রাণভরে পান করে তেষ্টা মেটায় চাষীবাসী কিরষেণ মুনিশ। বর্ষায় তাতে একেবারে উবচুবু জল। আর তার সঙ্গে নদীর জল বানের জল মিলেমিশে ভয় জাগানি প্লাবন। বিশেষ করে কামারগোড়িয়া, ধামনারি – এই দুই গ্রামে। বন্যার সব জল গ্রামদুটো ভাসিয়ে গিয়ে পড়ে মুন্ডেশ্বরীতে। উবুচুবু বর্ষায় উপায়ান্তর না থাকায় যাতায়াতে নৌকোই ভরসা। নানা ধরনের পণ্য বোঝাই নৌকো দামোদরের ওপারে কালনা জামালপুর আরও কোনো জায়গার ঘাটে গিয়ে ভেড়ে। জামালপুরের এপারে কারালাঘাটেও নৌকোযোগে মালপত্র পৌঁছে যায়।
এখানে এক এক মরশুমে বাতাসে এক এক রকমের বাস। ধানের মরশুমে পাকা ধানের গন্ধ। ধান উঠলে রবিফসলের চাষ, তখনও বাতাস ধানের গন্ধে নেশাগ্রস্ত নারীর মতো গা-গতরে ভরে থাকে। তারপর যখন রবিশস্য পুষ্ট হয়ে ওঠে, তার গন্ধ অমনি পালটে যায়। তখন নীল আকাশটা আরও খোলতাই মারে মাঠের হলুদ সবুজের সঙ্গে খাপ খেয়ে গিয়ে। গরমকালে খালে, কাঁকিতে পুকুর ডোবায় পাট ভেজানো হয়। বাতাস ভারি হয়ে থাকে পাট পচার বদ গন্ধে। পাট পচবে, পাট কাচা হবে, তা শুকোনো হবে – ধাপে ধাপে এই কাজগুলোর সবেতেই বড়ো যত্ন লেগে থাকে। পাট তৈরি হয়ে রপ্তানির উপযুক্ত হতে হতে ঘোর বর্ষা চলে আসে। ভাদ্র মাসে যে একধরনের ভ্যাপসা গন্ধ জমির জল থেকে উঠে আসে, তা যেন মা লক্ষীর আসার পথকে সুবাসিত করতে ধানকে পুষ্টিগুণে ভরিয়ে তুলতে ধানগাছের শরীরের সব অধিবিষ বের করে দেবার প্রক্রিয়া। মানুষের শরীর যেমন অধিবিষ থেকে মুক্ত না হলে শরীর রোগমুক্ত ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল হয় না ঠিক তেমনই। পুকুরডোবার জলে যে আগাছাগুলো চটকা গরমে পচতে থাকে, বাতাসে তারই গন্ধ পাক খায়। তবে সে আর ক’দিনের জন্য? তারপরই কাশ ফুল, শিউলি ফুল, হিম হিম বাতাস নিয়ে উৎসবের আমেজ।
বর্ষায় পাটের মরশুমের ওই কয়েকটা দিন দেবখালে চোখে পড়বে অজস্র পাটের নৌকো। মরশুম শেষ তো ব্যস, নৌকো খালের জলে গা ডুবিয়ে বিশ্রামে যাবে বচ্ছরকার জন্যে। পাকে পাকে গ্রাম বেড় দেওয়া খালের মতো যে কাটিং, যেটা দেবখালের সঙ্গে জুড়ে আছে তাকে গাঁয়ের লোক বলে “কাঁকি”। সেখানেও যার যার ডোঙা, নৌকো জলজ প্রাণীর মতোই যখন ডুবে থাকবে, সেই অবগাহনকালেও সেগুলি বেশ ফলদায়ক। কারণ সেগুলির খোঁদলে প্রচুর মাছ শামুক গুগলি সব বাসা বাঁধে যে!
রপ্তানির সময় ঘাটে প্রথমে নৌকোয় পাট বোঝাই হবে, তারপর ইষ্টনাম নিয়ে নৌকো ভাসানো। দেবখাল বেয়ে নৌকো গিয়ে পড়বে বড়বৈনানের কাছে সেই মুন্ডেশ্বরীতেই। বাঁ দিকে মোড় নিয়ে উজানে নৌকো যাবে মুইদিপুরের কাছে, যেখানে দামোদর থেকে মুন্ডেশ্বরী আলাদা হয়ে বেরিয়ে এসেছে। সেখান থেকে আবার সোজা দামোদরের স্রোতের বিপরীতে নৌকো বেয়ে যাওয়া।
খাল ধরে নৌকো বোঝাই পাটের সঙ্গে সঙ্গে মাটির তৈরি হাঁড়িকুঁড়ি, মালসা-টালসা, ধান, আলু এ’সবও যায়। মাল যাবে সেই গুটিকতক জায়গাতে। সেই শুঁড়ে-কালনা, কারালাঘাট বা জামালপুর। সেখান থেকে দূরে কোথাও কোথাও। মুন্ডেশ্বরী পেরিয়ে দামোদরে পড়া পর্যন্ত মাঝিরা দিব্যি খোশমেজাজে চলে যায়। তারপরই তার কপালে খানিকটা ভাঁজ পড়ে, পেশি আর স্নায়ু টানটান হয়ে ওঠে।
নদী আর খাল গেছে সমান্তরালে। ধামনারি কামারগোড়িয়ার গা ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া খাল আর নদীর মাঝে দূরত্ব এক কিলোমিটারেরও কম। খালে খালে কিলোমিটার তিনেক গিয়েই মুন্ডেশ্বরীতে পড়া যায়। সেখান থেকে সমান্তরালে আবার পিছনে ফেরা।
ডাক হাঁকে কথা বলতে বলতে পাট বোঝাই হচ্ছিল। অনন্ত বিড়ি খাচ্ছিল কোঙারবাবুর আড়তে অফিস ঘরের ধারিগোড়ায় বসে।
“অনন্ত, একটু চুপচাপ যেন? হলটা কী?” কোঙার মশাই তাকে জিগ্যেস করেন।
“ছেলেটার শরীর খারাপ দেখে এসেছি তো! তাই ভাবছিনু, বাবু! ওষুধ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি।” চিন্তান্বিত অনন্ত কথাটা বলেই হাঁক পাড়ে, “কই রে, তোদের হল? তাড়াতাড়ি বোঝাই শেষ কর–”
পাট বোঝাই নৌকো ছেড়ে দিল অনন্ত। তখন সূর্য মাঝগগন থেকে পশ্চিমের দিকে যেন ঢলেছে খানিকটা। মুখ তুলে ঈশ্বরকে স্মরণ করতে গিয়ে অমনি বেলাটাও ঠাওর হয় করে নিল একবার। পাড়ে কোঙারমশাই দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর দিকে ডানহাতখানা একবার তুলল সে।
নানা ভাবনা ভাবতে ভাবতে হাল ধরে থাকে অনন্ত। বর্ষার প্রথম দিকে খুব জল ঢুকেছিল গাঁয়ে। উপর থেকে সব নালা-খাল-বিল ধুয়ে নিয়ে ঘোলা জল নেমে এসেছিল এদিকে। রোয়া হয়ে যাবার পর ক’দিন টানা বৃষ্টিতে সব ডাঙা ভেসে গেল আবার। পুরো মাঠের রোয়া তখন জলের তলায়। কতক পচল, কতক বাঁচল। অনেকেই জমিতে বীজ মজুত রাখে এসব তাদের জানা আছে বলে, জানে বানে কিছু চারা নষ্ট হবেই। তখন নতুন করে রোয়া করতে লাগবে।
এখন এ-ই শেষা “ছেরাবনে” খালের জল পাড় বরাবর বয়ে যাচ্ছে। তাই নৌকো খাল ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে, এদিক ওদিক যাবার আর ভয়ও নেই, উপায়ও নেই। তবে যখন বান আসে তখন নদী খাল আর বানের জল মিলেমিশে এমন এককার হয় যে, খালের সীমা বোঝা যায় না। সে সময় বরং নৌকো খালের বাইরে দিয়ে নিয়ে গেলে ভালো। নয়তো এ – ই লম্বা লগি ঠেলে জল মাপতে মাপতে এগোতে হবে।
দামোদরে পড়েই হুঁশিয়ার হয়ে গেল অনন্ত। ও’দিকে হাল ধরে বসে আছে পাঁচু। সেও তীক্ষ্ণ চোখে নদীর জল দ্যাখে। এতক্ষণ গুনগুন করে গান গাইছিল, আল্লা ম্যাঘ দে –। কথাও বলছিল টুকটাক; উল্টোদিকে চলে যাওয়া নৌকোর মাঝির সঙ্গে দু’-একটা কথা চালাচালিও হল। এখন সব চুপ। হাতের বিড়িটা ফেলে দিয়ে হালটা সতর্ক হাতে ধরে থাকল।
সামনেই বেগোহানা আর মুচিহানার দ’। মুচিহানা পেরিয়ে গেলেই নৌকোবালারা হাঁফ ছেড়ে কপালের ঘাম মোছে। ঐ ভয়্ঙ্কর দ’-দুটো পেরোনো মানেই এবার নিশ্চিন্ত। তখন মাঝি দাঁড়ি বিড়ি ধরায়, গলা ছেড়ে কথা বলে, নয়তো গান গায়। রসিক মাঝি ধরে আব্বাসউদ্দিন বা লালন।
নদী একেবারে টইটম্বুর। যেন সমুদ্দুর হয়ে আছে আর জলে তেমনি ছোট-বড় পাক। স্রোতের প্রবল টানে উজান ভেঙে যেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে তাদের। পেশি যেন পাথরে কোঁদা, ফুলে উঠছে। চারদিকে জল বয়ে যাবার কেমন একটা শোঁ-শোঁ শব্দ শুধু। আর নৌকার গায়ে জলের ধাক্কায় ছলাৎ বাজছে। এই নৈঃশব্দ্যের মাঝে থামা গেলে অন্তর এসে সামনে দাঁড়াবে, কে জানে হয়তো ঈশ্বরও এসে দাঁড়াতে পারেন।
বহুদূরে গাঁয়ের মাথা চোখে পড়ছে মাঝনদী থেকে। একটা ফটিক জল উড়ে যাচ্ছে পুব থেকে পশ্চিমে। রাস্তা আর অল্পই বাকি। সামনেই বেগোহানা, এ-ই মুহূর্তে জলের ঘূর্ণি খুব একটা প্রকট নয়। চোরা ঘূর্ণি বোঝার চেষ্টা করতে করতে অতিরিক্ত সচেতনতার কারণে বা অন্যমনস্কতার কারণে, হতে পারে নিয়তির মার – পটু মাঝি অনন্তর হাত আলগা হয়ে লগি পিছলে গেল হঠাৎ। সাপটে ধরতে গিয়ে তা প্রথমে নৌকোর কানায় লাগল, তারপর পড়ল জলে। আতঙ্কের একটা “আঁক” শব্দ তার গলা থেকে বেরিয়ে এল। তার আগেই নৌকোর উত্তর মাথা বেঁকে গেছে পশ্চিম দিকে। আচমকা নৌকো টলমলে দেখে ফ্যাকাশে মেরে গিয়ে পাঁচু প্রাণপণে হাল ধরে নৌকো সোজা করার চেষ্টা করল, তার কপাল থেকে গড়িয়ে পড়ল ঘাম। চিৎকার করে জিগ্যেস করল, কী হল, অনন্তদা – ?
অনন্তর কানে কিছুই গেল না, যেন সে বধির, যেন বা অন্ধ। আর এক দিকের দাঁড়ে আজ লোক নেই, তাই আজ এই মহাবিপদের সামনে পড়ে গেল তারা।
“পাঁচু, সামাল” বলতে বলতে সে ততক্ষণে হালে বসে পড়েছে। দু’জনে প্রাণপণ চেষ্টা করে নৌকো সোজা করার। কিন্তু ঘূর্ণিতে পড়ে গেছে নৌকো। মোচার খোলার মতো তারপর জলের কুটিল প্যাঁচাল টানে সেটা একমুখে ছুটে গেল প্রথমে, তারপর ঘুরতে লাগল ঘূর্নির ভেতর।নৌকো ভয়ঙ্করভাবে দুলতে দুলতে হেলে গিয়ে জল ঢুকতে লাগল। দুজনেই তখন অন্ধ।ইষ্টদেবতাকে ডাকতেও ভুলে গেল তারা। স্বর্ণকেশিনী ময়াবিনী নারীর মতো নৌকো সমেত সোনালি পাট তাদের জ্ঞানহারা করে দিলেও সমানে তারা চেষ্টা চালাতে লাগল, তবু নৌকো ছেড়ে লাফ দেবার কথা প্রথমে মাথায় এল না। যদিও এই ভয়ঙ্কর স্রোতে, ভরা নদীতে সাঁতরে পার পাওয়া মুশকিল ছিল তাদের পক্ষে। সেই মুহূর্তে তাদের কাছাকাছি অন্য কোনো নৌকোও যাওয়া-আসার পথে ছিল না। তাই কেউ জানলেই না সেই ভরাডুবির কথা। কিছু পরেই নৌকো তলিয়ে গিয়েছিল হয়তো।
অনন্তর দেহ পাওয়া যায় শিয়ালি পেরিয়ে নদীর পাড় ঘেঁসে বেনাবনে। পাঁচু নিখোঁজ হয়েই রয়ে গেছে আজও।
সেদিন কিন্তুবালা স্বামীকে নিষেধ করেছিল কাজে বেরোতে – “ছেলেটার শরীর ভালো নেই, এমন ধূম জ্বর। একটু ওষুদপত্তর এনে দাও। যেওনি আজ কাজে।”
অনন্ত বলেছিল, “কাছে ট্যাকা নেই মোটে। কাজে গেলে আজ ট্যাকা পাব। আসার সময় একবারে ওষুধ নিয়ে ফিরব। ত্যাতক্ষণ ছেলেটাকে সামলে রাখিস।”
কিন্তু আর ফিরল না মানুষটা। নিউমোনিয়া আক্রান্ত ছেলের মরণবাঁচন পেরিয়ে কিন্তুবালা বাপের বাড়ি চলে আসে শেষমেশ।
ডোবার ধারে বকুল তলায় পা ছড়িয়ে গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে, কিন্তু পিসি যখন বসেছিল মায়া আমাকে টেনে নিয়ে যায়। পিসির সামনে থেবড়ে বসে আমারও হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল। তার সাদা থান ময়লাটে, চুল কাঁচাপাকা। খোলা চুলে তাকে অশরীরী মনে হত আমার।
মায়ার বায়নাক্কা – “ও পিসি! তোমার ছোটবেলার গল্প বল না!”
পিসির ছেলে চলে যাবার পর তার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকে। যা যা – করে যত সরিয়ে দিতে চায়, মায়া ততই জেদ করে – “বল না, পিসি!”
“ছোটবেলার আর কত গপ্প থাকবে, বল তো? মানুষ কি ছোটুই থাকে, বড় হবে নাকো? আগে যে গপ্প বলেছি সেই গপ্পুই, বাছা!” পিসি চুপ করে যায়। মায়াও কেমন ভেবলে গেল তার কথা শুনে।
একটু পরেই পিসি মহা উৎসাহে বলতে শুরু করল, যেন কথা বলতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তার মতো অকিঞ্চিতকর মানুষের কথা কেই বা জানতে চায়? তার সঙ্গে কথাই বা কে বলতে চায়? তাই প্রথমে হয়তো অভিমান হলেও, পরে মন খুলতে পেরে খুশিই হয় মানুষটা।
পিসি বলছিল, “আমাদের ঘরের কাছেই ছিল ইস্কুল। আমি কিন্তুন যেতুন না। পাড়ার ছেলেপিলেদের সঙ্গে ডাং-গুলি, ভ্যাঁটা, নুনচিক – এইসব খেলতুন।’’… পাড়ার এক বৌ কেন্দাই দেগলে খুব ভয় পেত। আমি চুবুচুবু ধরে তার আঁচলে বেঁদে দিয়ে মজা দেকতুম। কেমন গুটিয়ে গিয়ে চার আনা পয়সার মতো গোল হয়ে যায়! – ”
এই পর্যন্ত শুনে মায়া হিহি করে হাসতে লাগল – “তারপর – তারপর কী হল?”
পিসি দু’হাতে তালি দিয়ে সামনে ঝুঁকে হেসে ফেলে বলতে শুরু করে, “বৌদি যেই দেকেচে আঁচলে কেন্দাই বাঁদা, সে তো কাপড়-ফাপড় খুলে ঘরে ঢুকে পড়েচে। এদিকে আমরা কুটিপাটি করে হাসচি, আর সে ঘর থেকে গালাগাল দিচ্চে, কাঁদচে – হা হা হা –”
“আর তোমার ইস্কুল যাবার গল্পটা বল?”
“আমার বদমাশি দেকে বাবা আমাকে ইস্কুল নে গে বললে, ও মাস্টার, আমার মেয়েটাকে ভত্তি করে নাও দিকিনি তোমার ইস্কুলে! তো মাঝে মাঝে যাই। পড়া তে কিছুই বুঝতে পারি না। একদিন মাস্টার ছড়ি দে মারলে, আমিও ওমনি পাঁইপাঁই দৌড় দিনু। আর ইস্কুলমুখো হইনি।”
মায়ার এসব গল্পের সব জানা, তবু আবার শুনবে – যে মাস্টার তোমাকে পেটাল, তার কী হল, পিসি?
“একদিন ইস্কুল বাড়ির পেছুনের জানলা দে ঢিল ছুঁড়ে মারনু মাস্টারের মাথায়। মাথায় লাগলুনি, কান ঘেঁষে ঢিলটা যাবার সময় কানের লতিখানা কেটে গেল শুদু।”
তিনজনে হেসে অস্থির।
“আজ কী খেলে”, জিগ্যেস করলাম আমি।
“আজ রান্না করিনি রে! দুটো চাল দিনু ভাসুরপো-বৌ-কে। সে কলমি শাক আর গুগলির ঝাল দে ভাত দিয়েছিল। … এই তোরা যা তো এবার! বাড়ির লোক খুঁজবেনি? যা – যা – ”।
সত্যিই সন্ধ্যা নেমে গেছে, এবার বাড়ি ফেরা দরকার। আমরা বকুলতলা থেকে বাড়ির পথ ধরি। বকুলগাছের ভেতর হাওয়া তখন পাক খেয়ে ছুটে গেল অন্য কোথাও।
(ক্রমশঃ)