সময়ের থাবা দেশকাল সমাজ সংস্কৃতির গা থেকে অনেক কিছু চেঁছে তুলে নিচ্ছে। কবে কখন কী যে অদৃশ্য হয়ে যাবে কেউ বলতে পারে না। দেশীয়, আঞ্চলিক কিছু রীতি বর্তমান থেকে যে কোনোদিন অতীত হয়ে যেতে পারে। এই রাধাকান্তপুরেও কত পালপার্বণ আর আচার ছিল এক সময়। শান্তা মনে করে সেসব, সময় সময়। তার দিনযাপনের সঙ্গে, লেখালেখির সঙ্গে, ডায়েরিতে কখনও কখনও তুলে রাখে এতকালের চেনা জনজীবনটিকে।
—
তখন ভাদর মাসে ভাদু পূজা। আটচালায় কিছুদিন ধরেই মহড়া চলছিল। তুসু-ভাদু-সংকীর্তন-অষ্টপ্রহরের বারোয়ারি একটা দল আছে গাঁয়ে। আর একটা আছে মন্ডলদের কয়েক বাড়ির। তবে ওরা এমন হুঁ করতেই বেরিয়ে পড়ে না। নিজেদের মধ্যে শখে চর্চা করে, আর পাড়ার অনুষ্ঠানাদিতে প্রয়োজনে।
আটচালায় এখন হারমোনিয়ামে পোঁপোঁ রিড বাজানো সুর উঠছে। বাঁশবনের ভেতর বাঁশপাতায় হাওয়ার বিশেষভাবে আনাগোনায় তীক্ষ্ণ একটা শব্দ হয়। সেরকম সুরে, কিন্তু অমার্জিত গলায় প্রধান গায়েন কচিধাড়া গান করে। তার সঙ্গে আছে ধাড়া পাড়া, দাসপাড়ার ক’জন, সরকারদের ঝোড়ো, মানে ঝড়েশ্বর; মন্ডলদের তোরো, মানে তরণী—এরা সব। কেউ খোল বাজায়, কেউ খঞ্জনি। সব ধরনের গানে এই তিনটিই বাদ্যযন্ত্র। বাড়তি বলতে, ভাদু গানের সঙ্গে একজন নাচনী থাকে।
“ভাদু আমার শিশু ছেলে, কাপড় পরতে জানে না” – গানের প্রথম এই লাইনটা গাওয়া হল বাদ্যযন্ত্র ছাড়া খালি গলায়। ততক্ষণে তারা মাঝে খানিকটা জায়গা নাচনীর জন্য ছেড়ে রেখে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। হারমোনিয়ামে রিড বাজাতে বাজাতে কচি ধাড়া দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলছে, এই সরো সরো! মাঝে জায়গা রাখো—আরও সরো—আরও সরো—। মাঝের গোলটা আরও খানিক বড়ো হয়। তাদের পিছনে পিছনে দর্শকদের ভিড়।
দর্শকেরা একে অপরের কাঁধে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে নাচনীকে দেখার চেষ্টা করবে। এবার সব বাদ্যযন্ত্র বেজে উঠল – আর নাচনী লাল-হলুদ ঘাঘরায় ঘূর্ণি তুলে পায়ের ঘুঙুর ঝমঝমাল। কোমরে বামহাত, ডানহাত কপালে রেখে কোমরের একদিক উঁচু করে ঘুরে ঘুরে সে নাচতে লাগল। পায়ে আলতা, ঠোঁটে আলতা, চোখে সুর্মা, মুখে স্নো-পাউডার মেখে সেজেছে সে। মাথায় সেফটিপিন আঁটা ওড়নার নীচে নকল বেণী। বেণীর ডগায় লাল ফিতে। গানের বিশেষ বিশেষ জায়গায় সে ঘাঘরা দু’হাতে ধরে যেই ঘুরিয়ে দেয়, বাদ্যযন্ত্রগুলো অমনি ঝম্পক ঝম্পক করে দ্রুত লয়ে বেজে উঠবে।
গোঁফ চেঁছে, স্নো-পাউডার বোলালেও গোঁফদাড়ির জায়গা বিন্দু বিন্দু ঘেমে সবুজ হয়ে আছে। তবু তার গম্ভীর মুখে ভাদুসুলভ নাচ দেখে কে বলবে ও শঙ্কর রুইদাস? সবথেকে আশ্চর্য ওর বুক। অবাক কাণ্ড, কী করে হল! সেখানে সেফটিপিন আঁটা কয়েকটা নোট। তার চোখ আর ঘাঘরা ঘোরানোয় মুগ্ধ কোনো কোনো দর্শকের বকশিস – তার উপরি পাওনা। ভাদুগান প্রথমে হবে নিজেদের গাঁ রাধাকান্তপুরে, পাড়ায় পাড়ায়। তারপর যাবে বাজিতপুর, বৈঠারি, রামকেষ্টপুর—এইসব আশেপাশের গ্রামে। গোটা মাস জুড়ে তারা নেচে-গেয়ে চাল, আলু, টাকা উপার্জন করে আনবে। তারপর একদিন ওদের ‘ফিস্টি’।
পৌষ সংক্রান্তিতে তুষু পরবের দিন শুধুমাত্র ভোরবেলায় তাদের বেরোনো—ওই কংসাপুকুর পর্যন্ত। অষ্টপ্রহরের সময় অন্য একটা কীর্তন দলও আসে। গাঁয়ের দলের সঙ্গে মিলে তারা সারাদিন জনপ্রিয় সব গানের সুরে হরিনাম করে।
দুর্গাপুজো নিয়ে আমাদের উন্মাদনা নেই। কামারদাদুর বাড়িতে তাঁর নিজের তৈরি মূর্তির ব্যক্তিগত পুজো। কিঙ্কর পাঁজার বাড়িতেও নিজেদের পুজো। ওরা উঠতি বড়লোক। তাদের পুজোয় গাঁয়ের অন্যরা তত আহূত নয়। কেউ কেউ নিমন্ত্রিত হয়।
বারোয়ারীর সর্বজনীন দুর্গাপুজো তখনও চালু হয়নি, হত কালিপুজো। জাঁকিয়ে। তার আগে লক্ষীপুজো হবে কয়েকটা বাড়িতে।
মস্ত একটা ঠান্ডা সোনার থালার মতো কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ উঠল। তার আলো এসে পড়ল আমাদের পুব দুয়ারী ঘরের নিকোনো দাওয়ায়। গা শিরশিরে ঠান্ডা ভাব বাতাসে। দূর থেকে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে। মা জ্যেঠিমা পুজোর জোগাড় করে বামুন ঠাকুরের অপেক্ষায়। ঢাকি একবার বাজিয়ে দিয়েই চলে যাবে। পুরুত এসে দু-চারটে মন্ত্র বলে একটু ঘণ্টা নেড়েই পুজো শেষ করবেন। আজ বেশি সময় দেবার মতো সময় নেই। সবার বাড়িতেই পুজো। ঠাকুরকে চিঁড়ে নারকেল মন্ডা ইত্যাদি নিবেদন করে গেলেই আমরা প্রসাদ পাব।
আমি বেরিয়ে পড়েছি কীসের যেন টানে। বাঁশতলার পাশ দিয়ে যাবার সময় ফটফটে সাদা ধুলোর উপর বাঁশগাছের ফাঁক দিয়ে দিয়ে জ্যোৎস্না এসে পড়ে জাফরি কেটেছে। আমি মোহিত। ভয় চলে গেছে। মনে হল মন্ডলদের পোড়ো উঁচু ভিটের উপর ঢাক বাজছে। ওখানে কেন বাজছে? অবাক হই। এগিয়ে গিয়ে দেখি—না তো! আসলে ঢাক বাজছে দূরে দূরে। ধাক্কা খেয়ে খেয়ে আসছে সেই শব্দ। বহু দূরে থেকেও যেন জানান দিচ্ছে তার নিকট অস্তিত্ব। সামনেই সবুজ ধানখেত, যেন সবুজ জ্যোৎস্না! পুকুরের জল হাওয়া উঠে তিরতির কাঁপছে, সেখানকার চাঁদটা কেমন নিষ্পৃহভাবে ভেঙে ভেঙে পড়ছে, যেন ধ্যানী কেউ। আঘাতে, মারে তার কিছুই যায় আসে না।
আহ! কী যে আনন্দ! এখন জানি, ও থাকে না। এই আনন্দ জীবনে ধরে থাকা সহজ নয়। থাকে ক্ষণ-মুহূর্ত, তারপর চলে যায়। কেন যে যায়, বুঝি না। সবই ক্ষণ, সবই মুহূর্তের ভাঙা-গড়া।
ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। এবার গা ছমছম করছে। তবু ছুটলাম না। মাথা নীচু করে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে আসছি, ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করছে। এমন সময় পিছনে পায়ের শব্দ শুনে চমকে উঠলাম। শুধু চমক নয়, ভয়ও পেয়েছি। দাঁড়িয়ে গিয়ে ভয়ে ভয়ে তাকালাম ঘাড় ঘুরিয়ে। ফটফটে জ্যোৎস্নায় দেখি—শিবিদি। ওকে দেখে ধড়ে প্রাণ এল।
বললাম, “ও! শিবিদি তুই!”
ও আমার ভয়টা লক্ষ্য না করে বলল, “তুই একা একা এখেনে কী করচিস? ”
আমি ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জিগ্যেস করলাম, “তুই নাকি মা মনসাকে দেখেছিস? ”
ও বলে ওঠে, “চুপ চুপ! রাত্তিরে নাম কত্তে নাই—দেকেচি তো! কেউ বিশ্বেসই কত্তে চায় নেকো! “
কথাটা ভালই রটেছে। ফরকেল ছেলেরা ওকে দেখলেই “ফোঁস” বলে রাগানোর চেষ্টা করে। ও কেয়ার করে না। একটা প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট দেখাল। ভেতর থেকে বেরোল একটা জামা। গোলাপি-সাদায় মেশানো, বুকের কাছে কুঁচি দেওয়া। মন্ডলরা দিয়েছে। বর্ষাতে ও ওদের জমি রুয়েছে। প্রায় পুরো বর্ষাটাই কাজ করেছিল ওদের জমিতে। পুজোর আগে আগে ওদের বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে হাতে-হাতে ঘরদোর পরিষ্কার করেছে। এ তারই পুরস্কার।
“খুব সুন্দর তো!” জিগ্যেস করলাম – কবে পরবি?
“মাসির বাড়ি যাব কাত্তিক মাসে। ওদের বারালি কালিপুজোয়। তখন পরব।”
“তোর মাসির বাড়ি কোথায়?”
অগ্নিকোণের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “হুই তো! পাঁইটেতে মাসি থাকে।”
মহা উৎসাহে বলতে থাকল, “খুব ধূম হয়! পাঁটা পড়ে পেরায় এক দেড়শ’। ফল-পেন্নামী যা পড়ে না, পাহাড় হয়ে যায়! বড়লোকের গাঁ তো! ওখানে সব দালান বাড়ি। উঁচুজাত–নীচু জাত আলাদা করতে পারবে নেকো।”
“তোর একটাই মাসি?”
“না, দুটো মাসি। ছোট মাসি থাকে নারানপুরে। ওখেনেও কালিপুজো হয়, জানিস তো? ঠাকুর তৈরি, পুজো সব রাতের মধ্যেই।”
নারানপুরের গল্প আমার জানা ছিল। ঠাকুমার কাছে শুনেছিলাম।
বৈশাখ মাসের আঠারো তারিখ নারানপুরে বাৎসরিক পুজো, শ্মশানকালীর। কাছাকাছির মধ্যে থাকা বেশ ক’টা গ্রামের মানুষ এই উৎসবে হাজির হয়। সন্ধেবেলা থেকে পুজোর আয়োজন। সদ্য কাদা তৈরি করে মূর্তি নির্মাণ হয়। রাতভোর পুজো। পরেরদিন বেলা দুপুরের মধ্যে পূজার্চনার কাজ সারা।
পুজো চালুর একটা ইতিহাস আছে। কলেরা ম্যালেরিয়ায় বাংলার কত গ্রাম উচ্ছেদ হয়ে গেছে সেকথা বড় হয়ে তো জেনেইছি। অল্প বয়সেই তা জেনে ফেলেছিলাম বড়দের চোখে একটা অপরাধমূলক কাজ করে। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস না পড়ার বিধি অমান্য করে। এমন অবশ্য অনেক লেখকের বই-ই। পড়তে হত বাবাকাকাপিসিজ্যাঠা যা ঠিক করে দিত—সেসব বই। তবু না বুঝলেও গোপনে শরৎচন্দ্রের বই পড়তাম। তাতে নারীপুরুষের রহস্যজনক সম্পর্ক-টম্পর্কের সঙ্গে পাদটীকার মতো কলেরা-ম্যালেরিয়ার কথাও খানিকটা জেনে ফেলেছি। আর দন্তোৎপাটনসুলভ বঙ্কিমীয় আনন্দমঠ পড়ে দুর্ভিক্ষ বিষয়ে জানতে অসুবিধা হয়নি। সুতরাং নারানপুরও যে একসময় কলেরায় উজাড় হতে বসবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? তখন এখানে পূজাপার্বণের ভার ছিল রায়নার শোভাকরদের। গ্রামের মাতব্বররা একজনকে তাঁদের কাছে পাঠাল কোনো শান্তি-স্ব্যস্তয়ন করে যদি ওই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়—সেই পরামর্শ নিতে। যাকে পাঠানো হল, তিনি আবার গ্রামের চৌকিদার। শোভাকর বা ভটচাজমশাই নাকি ছিলেন দূরদর্শী ও সাধক মানুষ। তিনি একটা চিঠি লিখে চৌকিদারের হাতে দিলেন মাতব্বরদের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য। তাতে লেখা, “এই পত্রবাহকের আজ মৃত্যু হবে। ওর শ্মশানে কালীমূর্তি তৈরি করে পুজো করতে হবে…”
ঠাকুমা বলেছিল, “আশ্চয্যি রে বুড়ি, লোকটা বাড়ি ফিরে আসার পরই তার কলেরা আরম্ভ হল! সে যে মরবে সেকথা সে আগেই জেনে গিয়েছিল।”
“ধুর! তাই আবার হয় নাকি?”
“অবিশ্বাস করিস নিকো! এসব কথা সবাই জানে। বহুদিন থেকে সবাই শুনে আসছে।”
আমি তবু সন্দোহ প্রকাশ করি, “চৌকিদার কি তাহলে চিঠিটা পড়েছিল?”
“হ্যাঁ। সে লেখাপড়া জানত তো!”
যাইহোক, সত্যিই সে পোড়াকপালে মারা যায়, একথা বলে ঠাকুমা খুব আফশোষ করেছিল। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে শোভাকর আসেন। চৌকিদারের শ্মশানে সদ্য কালিমূর্তি তৈরি করে পুজো হয়। এরপরই নাকি গ্রামে কলেরার প্রকোপ বন্ধ হয়ে যায়।
এই দেবির প্রতি মানুষের অচলা ভক্তি। মনস্কামনা পূরণ করতে মানত-টানত করে। বিরাট ধূম হয় একরাতের জন্য। পুজোর সামগ্রী নাকি জড়ো হয় গাড়ি দরুনে। ট্রাক্টর বোঝাই করে ফলমূলসহ অন্য উপকরণ রায়নার ভটচাজরা নিয়ে চলে যান। এটাই নিয়ম। পুজোর প্রসাদ এককণাও এই অঞ্চলের মানুষের খাবার নিয়ম নেই। দূরে গিয়ে সেসব পূজার সামগ্রী অন্য জায়গার মানুষকে বিলিয়ে দেন ভটচাজমশাইরা। দেওয়াই নিয়ম। মূর্তিও তৈরি করেন বংশপরম্পরায় একলক্ষ্মীর সূত্রধররা।
শিবিদির সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাড়ির কাছে চলে এসেছি।
আমি বাড়িতে ঢুকব। ওকে জিগ্যেস করলাম, “একা একা গ্রাম টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিস, তোর ভয় লাগে না?”
হাসল একটু। “ভয় আবার কীসের? আমার ভয়-টয় করে না।”
“তবে যে মা-মনসাকে দেখে ভয় পেয়েছিলি?”
কেমন ভ্যাবলা মেরে গিয়ে বলে, “সে তো আলাদা ব্যাপার!”
(ক্রমশঃ)