শান্তা এখন দূর থেকে নিরীক্ষণ করে তার চেনা গন্ডীর মানুষগুলোকে। দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয় অতীতের কন্দরে। সুযোগ পেলেই সে ক্ষুদিরাম মাস্টারমশাইএর কথা সবাইকে শোনায়। তাঁর কথা একদিন পার্থদাদুকেও শোনাল সে। এই এক মানুষ, যার কাছে চুপ করে বসে থাকা যায় অনেকটা সময় আর অশান্ত মন আপসে শান্ত হয়ে আসে। তার কাছে মাষ্টারমশাইএর মতোই বড়ো শ্রদ্ধার আর ভালবাসার মানুষ তিনি। মনীষার কাছে মনে মনে কৃতজ্ঞ হয় এই ভেবে যে, ও জোর না করলে এ বাড়িতে তার আসাই হতো না কখনও, দাদুর সঙ্গও কখনও না পেয়ে জীবনে অজান্তেই বঞ্চিত থাকত অনেকটা। দাদু তাঁর কথা শুনে চুপ করে থাকলেন খানিকক্ষণ। তারপর হাতের বইটা নামিয়ে রেখে সামান্য আড়মোড়া ভাঙলেন, বললেন, “ কোনো মিল না থাকলেও আমার আর একজন মাস্টারমশাইএর কথা মনে পড়ছে রে, শান্তা!”
“কে, দাদু? কার কথা বলছ?”
“তুই তো জানিস, তুর্কী আক্রমণের কালে বাঙালি নিজের ঘর সামলাতেই ব্যস্ত ছিল। অবিশ্বাস, সন্দেহ, রক্তপাত আর ধর্মনাশের ভয় তাড়া করল তাদের। গবেষকরা বলছেন বাঙালি নাকি সৃষ্টি আর নির্মাণের কথা ভুলে থাকল দেড় দু’শ বছর। তবে সত্যি তাই কিনা আমার কিন্তু সন্দেহ হয়। সেই সময়ের কোনো পুঁথিপত্র পাওয়া যায়নি বলেই বাঙালির সাহিত্যচর্চা থেমে গিয়েছিল এমন সরলীকরণ কীকরে করা যায়, বল? তখন বহু পন্ডিত ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসী তিব্বত, নেপাল বা আরও অন্য অন্য নানা জায়গায় পালিয়ে গিয়েছিলেন ভারতীয় অর্জিত জ্ঞানবিজ্ঞান, সাহিত্য ইত্যাদির নানা পুঁথি ও নিজেদের জীবন বাঁচাতে। তাঁদের ভেতর কারও যেমন বিদেশে বসে লেখার সম্ভাবনা আছে, তেমনি দেশের ভেতর গোপনে কেউ লিখেছেন সে সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে প্রমাণ ছাড়া কিছু বলা যায় না! তাই ওই সময়ের কোনো লিখিত নিদর্শন পাওয়া গেল না। এরপর বিদেশীরা বঙ্গের মাটিতে নিজেদের স্থাপন করল, তারপর রচিত হলো শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য। তারও পরে মঙ্গলকাব্যগুলো, ও মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য গ্রন্থগুলো। এও কি বঙ্গে এক নবজাগরণের কাল নয়?
ওই সময়ে সৃষ্টির অর্গল যেন খুলে গেল। উচ্চবর্ণের মানুষেরা একদিন যাদের অস্পৃশ্য বলে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল, এখন তাদের ঘর সামলানোর জন্য পরস্পর মিলনের প্রয়োজন দেখা দিল। সে মিলন অবশ্য সাংস্কৃতিক মিলন। প্রকৃতপক্ষে দেবতার আদানপ্রদান, দেবতার প্রতিষ্ঠা। অথচ মুকুন্দ, রূপরাম, ঘনরামের ছিল মানুষে মানুষে মিলনাকাঙ্ক্ষা। সেই মিলন কি ঘটল? দেবতাকে বহিরঙ্গে রেখে মঙ্গলকাব্যগুলোতে মানুষেরই ঘরদোর উঠে এল বলে তোর মনে হয় না?”
পার্থপ্রতীমের প্রশ্নে ঘাড় নাড়ে শান্তা।
দাদু বলেন, একে নবজাগরণই বলা যায়। ইংরেজ আমলেও ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকা বাঙালি বঙ্গের ভাবধারা – তার চিন্তন মনন ও আদর্শকে রূপদান করতে লাগল। শাসক আর শাসিতের মধ্যে সংঘর্ষ, কখনও বা সম্মিলনে গড়ে উঠতে থাকল বঙ্গের রূপরেখা। সেই নবজাগরণের কালে দক্ষিণ রাঢ়বঙ্গ ও দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলের প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ হলেন তার একজন সহযোগী।
একটু থেমে দাদু আবার বলতে শুরু করলেন, - এই তো জামালপুর থেকে তোদের দামোদর পেরিয়ে শাঁকনাড়ায় তাঁর পৈত্রিক নিবাস। তাঁর নিজের করা রাঘবপান্ডবীয় কাব্যের টীকার শেষে আত্মপরিচয় দিয়েছেন এইভাবে –
যস্যাভবজ্জননভূঃ কিল শাকরাড়া
রাঢ়াসু গাঢ়গরিমা গুণিনাং নিবাসাৎ।
রাষ্ট্রান্তরালমিলিতঃ সরিতঃ প্রতীচ্যাম্ ॥”
মানেটা বলো নাগো, দাদু?
“মানে হলো, সুখবর্ধক বর্ধমান রাজ্যের মধ্যে দামোদর নদের পশ্চিমে শাকরাঢ়া (শাকনাড়া) গ্রাম যাঁর জন্মভূমি, আর অনেক গুণীলোকের বসবাস বলে এই গ্রাম হলো রাঢ়দেশের মধ্যে বিশেষ গৌরবের স্থান।”
তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, কী জানিস তো, সবই বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যাচ্ছে। এই যে কবিত্বে পান্ডিত্যে ছাত্রদের প্রতি সহমর্মিতায়, তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় সেই সময় এক অন্যতম অধ্যাপক, তাঁর কথা তোরা সাহিত্যের ছাত্রী হয়েই বা কতটুকু জানতিস? - দাদু অতীতকে মেলে ধরেন চোখের সামনে।
শান্তা মেনে নেয় যে সত্যিই তারা খোঁজখবর রাখে না কিছুই।
সে মনশ্চক্ষে দেখতে পায় পাঠশালার গুরু জয়গোপাল তর্কভূষণের সঙ্গে দীর্ঘপথ হেঁটে চলেছেন প্রেমচাঁদ। পথের দৃশ্যের বর্ণনা গুরুকে কবিতাকারে দিতে হচ্ছে। গুরু এভাবেই শিষ্যের মধ্যে কবিত্বশক্তির উন্মেষ ঘটাচ্ছেন। গ্রামে কবিগানের দলে প্রেমচাঁদ গান লিখে দেন।
আলপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে গুরু একদিন জিগ্যেস করলেন, “শুনলাম গাঁয়ের চাষাদের কবিদলের সঙ্গে বামুন কায়েতদের অন্যদলের নাকি কী নিয়ে বিবাদ চলছে? তা ব্যাপারটা কী?”
“আজ্ঞে, তারা সদগোপদের বলে কিনা লাঙ্গল-জোয়াল নিয়ে জমি চাষ করা যাদের কাজ তারা তাই করুক। হরিনামের তারা কী বোঝে? একথা সদগোপদের আঁতে লেগেছে।”
জয়গোপাল জানতে চাইলেন, এরপর কী হলো?
শিষ্য উত্তর দিলেন, “ওরা আমাকে কিছু লিখে দেবার জন্য ধরল, আমি একটা গান লিখে দিলাম।”
“বেশ বেশ। তা গানের কথাগুলো একবার বলো দেখি!”
মহা উৎসাহে বালক প্রেমচাঁদ বলতে শুরু করলেন –
চাষা অতি খাসা জাতি, নিন্দা কি তাহার কত দিব্য গুণাধার।
প্রেমভরে হরিরে ডাকতে চাষার পূর্ণ অধিকার॥
থাকে সত্য মাঠে ঘাটে , বেড়ায় সে স্বভাবের হাটে চতুরালি নাহি তাহার।
কুটিল সমাজ যত্নে করে পরিহার॥
স্বার্থে পরার্থে কাজ, নিজ কাজে নাহি লাজ ভাবে ধর্ম এই তাহার।
প্রাণপণে যোগায় চাষা জগতের আহার॥
কিবা গৃহী উদাসীন, চাষার অধীন চিরদিন
বিনা চাষে দুনিয়া আঁধার।
পেটে ভাত বিহনে ঘুরিয়ে ঘানি, ফল কি পাবে একটিবার॥
কাব্য শুনে জয়গোপাল হাততালি দিয়ে উঠলেন।–“বা! বা! চমৎকার লিখেছ হে! থামবে না প্রেমচাঁদ, একদিন অনেক বড়ো হবে তুমি, বাবা! আমার আশীর্বাদ রইল তোমার উপর।”
প্রেমচাঁদ গুরুর আশীর্বাদের উত্তরে মাথা ঝুঁকিয়ে দু-হাত কপালে জোড় করে প্রণাম করলেন। উপরে আকাশখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠল আরও। রোদের কিরণ ছড়িয়ে পড়ল গুরুশিষ্যের মাথার উপর।
টোলের পাঠ শেষ করে কলকাতায় সংস্কৃত কলেজে পড়তে এলেন তিনি। তাঁর সংস্কৃত জ্ঞান পরীক্ষা করার জন্য অধ্যক্ষ হোরেস উইলসন তাঁকে তাৎক্ষণিক একটি শ্লোক রচনা করে শোনাতে বললেন। তিনিও সঙ্গে সঙ্গে রচনা করে শুনিয়ে দিলেন, “ভবান ধন্যঃ শ্রী হোরেস উইলসন সরস্বতী।/ লক্ষ্মীবানী চিরদ্বন্দ্বং ভবতৈব নিরাকৃতং॥” চমৎকৃত হোরেস সাহেব তাঁকে সাহিত্য শ্রেণিতে ভর্তি করে নিলেন সঙ্গে সঙ্গে।
সেখানে ছিলেন আর এক জয়গোপাল অধ্যাপক, জয়গোপাল তর্কালংকার। প্রথম দিনের ক্লাসে তিনি জিগ্যেস করলেন, “এর আগে কোন্ অধ্যাপকের কাছে পড়েছ, হে?”
চতুষ্পাঠীর গুরু জয়গোপালকে স্মরণ করে প্রেমচাঁদ শ্লোকে তক্ষুণি উত্তর দিলেন –“গোপালৌ দ্বৌ জয়ৌ দ্বো দ্বাবেব তর্কমন্ডনৌ / মথুরাধিপ একোহি বৃন্দাবনাধিপোহপরঃ”
দুই গোপাল “জয়য়ুক্ত”, দুজনই “তর্কমন্ডন”।একজন তাঁর মথুরায়, আর একজন বৃন্দাবনে।তর্কালঙ্কার খুব খুশি হলেন তাঁর প্রতিভার পরিচয় পেয়ে। প্রতিভাবান প্রেমচাঁদ ছাত্রাবস্থায়ই এই কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হলেন। তায় আবার গুরু জয়গোপালের ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁরও ছাত্র হলেন। জয়গোপাল ঈশ্বরকে উৎসাহ দিয়ে শ্লোক রচনায় অংশগ্রহণ করিয়েছিলেন। আর তিনি তাঁকে গল্প লেখা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করালেন। তাতে প্রথম স্থান প্রাপ্ত হলেন ঈশ্বর।
কবিত্বে , পান্ডিত্যে, সহমর্মিতায় প্রেমচাঁদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এক অধ্যাপক। কচি চারা যখন পুষ্ট হয়ে গাছ হয়ে ওঠে তখন তার বেড়ার বাঁধন সরিয়ে তার কান্ডে হেলান দেওয়া যায়; প্রেমচাঁদ ছাত্রদের সঙ্গে এরকমই ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
শান্তা ভাবে, তাদের পাড়াগাঁয়ে ক্ষুদিরাম মাস্টার যেমন কিঞ্চিত ছাত্রপীড়ন করা সত্ত্বেও ব্যতিক্রমী – তাঁর ক্ষুদ্র পরিমন্ডলে, তেমনি বিখ্যাত এক কলেজের অধ্যাপক হিসাবে প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশও হলেন ব্যতিক্রমী। পল্লীবাংলার জলহাওয়ায় ক্ষুদিরাম মাস্টারমশাইএর অন্তঃস্থল আর্দ্র -মেদুর, কখনও কঠোর। জমির আল যেমন কঠোরতার সঙ্গে জমির নরম মাটিকে ঘিরে রাখে, তিনিও তেমনি ছাত্ররূপী চারাগাছগুলোকে কঠিন বেড়ায় আটকে ভেতরে সার জল দিতেন।
দাদুর চোখ অতীতে ভেসে যায় মুহুর্মুহু। শুনতে শুনতে শান্তা কল্পনায় দ্যাখে, শ্রেণিকক্ষে কুমারসম্ভব পড়াচ্ছেন তর্কবাগীশ। অত্যন্ত তদগত ভাব। –“ত্রিভাগশেষাসু নিশাসু চ ক্ষণং / নিমীল্য নেত্রে সহসা ব্যবুধ্যত নীলকন্ঠ ব্রজসীত্য লক্ষবাক অসত্য কন্ঠার্পিত বাহুবন্দনা॥”
পড়ানো থামিয়ে চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়লেন।-আহা আহা ! করে উঠলেন আপনমনে।পঠনক্রীয়া স্তব্ধ হলো। ছাত্ররা বুঝল ওই দিনের পাঠগ্রহণের ওখানেই ইতি। তাঁর সারগর্ভ পাঠদান ক্রিয়া কোনো কোনোদিন এভাবে স্থগিত হলে ছাত্ররা কিছুটা নিরাশ হয় বৈকি!
রসিকপন্ডিত প্রেমচাঁদ শকুন্তলা, কুমারসম্ভব এর অষ্টম সর্গ, পূর্বনৈষধ, উত্তর রামচরিত, রাগবপান্ডবীয় ইত্যাদি প্রায় এগারখানি সংস্কৃত কাব্যের টীকারচনা করলেন। ঈশ্বরগুপ্তের সংবাদপ্রভাকরের কথা কে না জানে বঙ্গদেশে? তাতে নিয়মিত লেখক ছিলেন প্রেমচাঁদ। সংবাদ ভাস্করেও তিনি লিখতেন।
“তারপর শোন,” গল্প বলতে বলতে দাদু প্রাঞ্জল হলেন –“তাঁর জ্ঞানের ব্যাপ্তি বহুদূর ছড়াল। হেম্যান উইলশন সাহায্যপ্রার্থী হলেন একবার। সম্রাট অশোকের কোনো এক শিলালিপির পাঠোদ্ধার করতে হবে। ভারতের পুরাতত্ত্ব সংকলনের কাজে জেমস প্রিন্সেপকেও সাহায্য করলেন তিনি। পুরাতাত্ত্বিক রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সঙ্গে এ বিষয়ে বহুবার চিন্তার আদানপ্রদান হল।আর এই কারণেই ভুল করে কেউ কেউ তাঁকে "পুরাতাত্ত্বিক" আখ্যাও দিয়ে ফ্যালেন।”
সেবার জামালপুরে মণীষাদের বাড়ি থেকে ওর সঙ্গেই একেবারে হোস্টেলে ফিরল শান্তা। বাড়ি গেল না ওই সপ্তাহে। ওর এই খামখেয়ালিপনায় বাড়ির মানুষগুলো কষ্ট পায় তা যে ও বোঝে না এমন নয়। তবু কোনো কিছুতেই তার টান নেই, এমনি বাউন্ডুলে স্বভাব হয়ে উঠছে দিনদিন। ক্লাস, নোটস - এসবের বাইরে থাকল দু-দিন। এমনিতেই চুপচাপ, কখনও কখনও মুখে কুলুপ এঁটে দেয় একেবারে। লোকজন ভুল ভাবলেও ওর ভাবান্তর হয় না।
রুমমেট কাঞ্চনা সামান্য সাধ্যিসাধনা করল ঘরের বাইরে বের করতে। স্বপ্নারা কাঞ্চনার কাছে শুনে আর আসেনি। শান্তি হলো যে, ওরা তাকে জোরাজুরি করেনি।
এই অঞ্চলের বিগত দিনের কয়েকজন গুণী মানুষ সম্পর্কে কিছু তথ্য জোগাড় করেছে ও। নারায়াণ সান্যালের “আমি রাসবিহারীকে দেখেছি” বইটা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ছিল। পড়তে পড়তে চিন্তার অনেকগুলো দরজা খুলে গেল তার সামনে। বইটা বন্ধ করে উঠে জল খেল, তারপর সেটা আবার হাতে তুলে নিতে গিয়ে ওর একটা কথা মনে হল। পার্থদাদুর সঙ্গে কথাবার্তার সূত্রেই অবশ্য ওই মনে হওয়াটুকু যে, পুঁথি ও কাব্যের লালশালুর আভিজাত্য অতিক্রম করে জীবন এসে পড়েছে এখন মাটির দুযারে।
“গাঢ়গরিমা”পূর্ণ গ্রাম শাকনাড়া থেকে পুব মুখে সোজা হাঁটা দিলেই পাঠক পৌঁছোবেন সুবলদা গ্রামে, যার পোশাকী নাম সুবলদহ। নহরবন্দিত, দামোদরের কোলের কাছে এই গ্রাম বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর জন্মগ্রাম। তাঁর জন্মদাত্রী ভুবনেশ্বরী দেবি জীবন পরিক্রমা শেষ করেছিলেন মাত্র কুড়ি বছর বয়সেই। তবে অতটুকু বয়সেই এক মহাকাজ সম্পন্ন করেছিলেন রাসবিহারীর মতো এক অগ্নিশিশুর জন্ম দিয়ে। বইটিতে নারায়ণ সান্যাল নিজেই একথা বলছেন ভারতবিখ্যাত এই বিপ্লবী সম্পর্কে। তিনি দেশের স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষায় দেশত্যাগ করতেও কুন্ঠিত হননি।
সুবলদা থেকে পায়ে পায়ে উত্তরমুখে খানিক এগোলে কামারগড়িয়া-ধামনারি, পার্থদাদুর কাছ থেকে যেখানে প্রতিবছরের বন্যার কথা শুনেছে সে। এখানেই ১৯১৫য় জন্মলাভ ভারতে কম্যুনিস্ট ভাবধারার অন্যতম প্রচারক হরেকৃষ্ণ কোঙারের।
কামারগোড় থেকে মোটের উপর পশ্চিমে কয়েক মাইল তফাতে বাঁকুড়া জেলা ঘেঁষে বর্ধিষ্ণু গ্রাম তোড়কোনা। এখানে জন্মগ্রহণ করে বঙ্গকে গর্বিত করেছিলেন আর এক রাসবিহারী, রাসবিহারী ঘোষ। অজস্র গুণের অধিকারী ও অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষটি ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাগ্মী, দানবীর ও সুদক্ষ আইনবিদ।
তোড়কোনা থেকে উত্তর দিকে খন্ডঘোষ।এখানকার ওঁয়াড়ি গ্রামে জন্ম বিপ্লবী ভগৎ সিং-এর সহচর বটুকেশ্বর দত্তের। এই গ্রাম আর এক বিপ্লবী কর্মী ও পরবর্তী কালের শিক্ষা উপদেষ্টা বিজয়কুমার ভট্টাচার্যের জন্মগ্রাম। এই অঞ্চলের আর এক কৃতি সন্তান স্বাধীনতা সংগ্রামী দাশরথি তা। পরবর্তীকালে তিনি ধর্মগোলা স্থাপন করলেন জেলায়। ক্যানেল আন্দোলনকে তিনি অনেকটা সফল করেছিলেন।
ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল শান্তা। ঘুম ভাঙল কাঞ্চনার ডাকে।–“কীরে, ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোনোর জন্যে তুই ক্লাস কামাই করলি? ”
“ক’টা বাজছে রে?”
“এই তো, সবে তিনটে।”
“তুই এত তাড়তাড়ি চলে এলি? সব ক্লাস হয়নি?”
“সুমিত বাবু আজ ডুব দিয়াছেন, ওনারই ক্লাসটা বাকি ছিল।”
বিকেলে আজ ও স্বপ্নাদের সঙ্গে ক্যাম্পাস পেরিয়ে ফুচকা খেতে গেল। কাঞ্চনা খোঁচা দিল ওকে, “কেন মুখ খারাপ করিস বাবা, খাবি তো মোটে দুটো, এত্ত ন্যাকা-!"
“তুই আমার ভাগটাও খা, সোনা! আমি দুটোর বেশি পারি না, জানিস!” বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে ওর ভালো লাগছে।
সন্ধ্যাতারার গা ঘেঁষে কয়েকটা নক্ষত্র অমোঘ হয়ে জেগে রইল।
(ক্রমশঃ)