পুরোনো দরদালানে বট-অশ্বত্থ ভরাডুবি নিয়ে বসে থাকে। তার থেকে কেউ কোনোদিনই পরিত্রাণ পায়নি। এই অঞ্চলের গৌরব ও বনেদিয়ানাও কালের নিয়মেই ধসে পড়েছিল। দরিদ্র, গ্রামীণ সাদামাটা জীবনের ফাঁকফোকর থেকে মহীরুহের মত কিছু মানুষ অভ্রভেদী মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন, কালের নিয়মে তার লয় হয়েছে।
তবে এও তো ঠিক, সময় নিজেই রূপরেখা তৈরি করে! ভেঙে পড়া মহীরূহের তলা থেকে একটা-দুটো কচি পাতা, ছোট ছোট শাখা বেরিয়ে আসে একদিন। ঘাসে ধুলোমাটিতে, জলে-হাওয়ায় থেকে যায় উত্তরাধিকারের বীজ, উত্তরণের আশা।
শান্তা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে, দর্শকের ভূমিকা নিয়ে। কুটিলতা আর নগ্নতাকে সে এড়িয়ে যেতেই ভালবাসে। জীবনে এটুকু বিশ্বাস করে – সবই যখন অনিত্য, সবই যখন আপেক্ষিক – তখন নষ্ট আর পচনশীলতাকে দেখতে চাওয়ার অর্থ নেই। সে আছে, থাকবেও জীবনের ভেতর। উপরে ভাসমান যতটুকু ততটুকুতেই নাহয় নজর ফেলল! বারান্দায় বসে বসে সে ভাবনার পানসি ভাসিয়ে দেয়।
সাহিত্য সাধনার প্রবাহপথে কয়েক প্রজন্মের পর গুটিকতক কলম নতুন প্রাণ নিয়ে উপস্থিত। মঙ্গলকাব্য আর আধুনিক কাব্যকালের মাঝের ব্যবধানে কিছু রচিত হয়েছিল কিনা, সেটা গবেষণার বিষয়; শান্তা তা জানে না। কিন্তু একটা সংকীর্ণ স্রোত আজও বহমান। একটা ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বছরখানেক আগে। স্কুলছাত্র। মধুকবির নামে তার নাম। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে পত্রিকা করে। এমন আরো দু’-একজন আছে। চকমকি পাথরের মত আগুনের প্রবল সম্ভাবনা নিয়ে। প্রসন্নতা নিয়ে। কার্তিকচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের ছত্রছায়ায় তরুণ, কওসের, অনন্যর মত ছেলেরা কী চমৎকার লিখছে। তবু সাহিত্যচর্চার স্রোতের পাশে যে অবনমনের মহানদী বয়ে চলেছে! যে অবনমন আজ দেশের তরুণ সম্প্রদায়কে গ্রাস করেছে এই অঞ্চলও তার বাইরে পড়ে না। ক’টা কিশোরের মাথা গোল বৃত্ত হয়ে রয়েছে দেখলেই বোঝা যায় হয় নেশা করছে, নয়তো ইন্টারনেটের মারণ জালে আটকেছে। কেন এমনটা হল, ভাবলে সবটাই স্পষ্ট। তবু মুক্তি তা থেকে এত সহজ নয়। চুষিকাঠি ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে ওদের হাতে।
এই এলাকায় গাঁজার ব্যবসা চলে রমরমিয়ে। পাঁচ কিলোমিটার দূরের বাজারে প্রকাশ্য-গোপনে গাঁজা বিক্রি হয়। দরিদ্রের ঘরে টিমটিমে লম্ফ জ্বলে। শুধু জ্বলছে মাত্র, তার কার্যকারিতা চোখে না পড়লেও আশা তো আছে! অথচ কিছু করার নেই। হাওয়ার দোলায় পাতার মত তার নৈর্ব্যক্তিক অস্তিত্ব। ভেতরে ভেতরে বিষপানে নেশাগ্রস্ত। যতটুকু বিষ শরীরকে বিষায়িত করে মেরে ফেলে, তার থেকে কম বিষ হয়তো নেশার ঝিম ধরায়। সেভাবেই গাঁজায় আসক্ত এই অঞ্চলের অনেক যুবক, তরুণ, এমনকি বয়স্ক মানুষও। কী করে, কবে থেকে এর জাল বোনার শুরু – তা শান্তার জানা নেই। তবে পুলিশ মাঝে মাঝেই জালের দড়ির প্রান্ত ধরে টেনে তোলে দু’-একটা চুনো-পুঁটি, বড্ডজোর কই-মাগুর। রাঘববোয়াল ধরা অত সহজ নয়।
নিরন্তর নিঃশব্দ এই ক্ষয় শান্তাকে কষ্ট দিলেও এই জিনিসটাই বিরাট হয়ে ছায়া ফেলছে চলমানতার উপর। এর ক্ষমতাই বেশি – এও জানে সে।আর নিঃশব্দে দ্যাখে। এরই ভেতর পথ করে চলতে হয়।
প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের দিক থেকে দেখলে আদিগন্ত মাঠ আর মাঠ। আর মাঠ পেরিয়ে গ্রাম – এছাড়া কোনো বিশেষত্ব নেই। এর ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে, শরীরে বিভঙ্গায়িত নারীর মত কোনো নদী বয়ে যায়নি। উত্তরে সেই একমাত্র দামোদর। দক্ষিণে বর্ধমান জেলা ছাড়িয়ে হুগলি জেলায় দ্বারকেশ্বর হল সবচেয়ে কাছাকাছি নদী। না, নদী নয়, নদ। দামোদরের মত দ্বারকেশ্বরও নদ, পুরুষ যেন। কিন্তু তারা বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া অচেনা পথিকের মত। দু’টির তুলনায় দামোদর কিছুটা চেনা – যে পথিক যেতে আসতে খোঁজখবর নেয়, সুখ-দুঃখে সামান্য পরামর্শদাতা।
যেমন নদী বয়ে যায়নি এর ভেতর দিয়ে, তেমনি কোনো অরণ্য-পাহাড়-টিলা কিছুই নেই। জীবনও যেন নিস্তরঙ্গ! প্রবল প্রাণশক্তি নেই, আবার খুব দুর্বলও নয়। শান্ত নির্বিবাদী জীবন এখানকার মানুষের। অভাব অভিযোগ জানায় না তেমন।
তার ভাটিয়ালি, বাউল, কীর্তন নেই, পুরুলিয়ার ধামসামাদল আর উড়ুত্তা আকাশ ফাঁড়া লম্ফঝম্পের ছৌও নেই। কোনো উল্লেখযোগ্য শিল্পীসত্তাই কি আছে এর? - নাহ! এবারও উত্তর নেতিবাচক। তাহলে কী আছে দামোদরের কোলের কাছে বসে থাকা শিশুর মত এই এলাকার? – আছে আপাত শান্তি। মানুষ বোবা হলে তার কাছে যা পাওয়া যায়। বদ্ধপুকুরের কচুরিপানা। সরিয়ে দিলে কালো নির্গুণ জল বেরিয়ে পড়ে। এই জলকে পচা বলতে পারবে না কেউ। বরং তা শান্ত, তরঙ্গহীন। ঘুমন্ত মানুষের শান্তি কেউ কেড়ে নিতে পারে না। তবে যতক্ষণ ঘুমোবে ততক্ষণই।
এই প্রথম আচমকাই তার একটা কথা মনে হয়, এই বেদনাময়তার মধ্যেও – যেন চোখ খুলে যায় তার। এই অঞ্চলের বিশেষ কোনো শিল্পসত্তা নেই তা তো নয়! এই যে মঙ্গলকাব্যের এতজন কবি বাংলা কাব্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন, এটাই তো এর বৈশিষ্ট্য! একে যে মঙ্গলকাব্যের দেশ বলা যায়! এত দামী একটা অলঙ্কার এর, আর কী চাই? খুব আনন্দ হল শান্তার আজ এই উপলব্ধিতে পৌঁছে।
দিগন্তজোড়া ওই ধানের মাঠ, ঋতুভেদে কখনও সবুজ পেলব যৌবনের তরুণী, কখনও পাকা ধানের সোনালি রঙের ছটায় পুরন্ত ডাঁটো যৌবনা নারী। ধান্যলক্ষ্মী বিরাজ করে বলেই বেশিরভাগ মানুষের পেটভরে দুটো ভাতের অভাব তেমন হয় না। তবু একসময় মানুষের ঘরে খিদের আগ্রাসন ছিল। পেট বড় বালাই! যদি হয় ভাতের অভাব – তবে হয় স্বভাব নষ্ট। চুরি ডাকাতি তো একসময়ের স্বাভাবিক ঘটনা।
নিজের মনে সে কথা ভাঙে, গড়ে। অমিশুকে বলে তার আত্মজন কম। তাতে তার অবশ্য কোনোই অসুবিধা নেই। সন্দীপনের সঙ্গে কথা বলে কিছুটা। যদিও সব কথা, সব চিন্তার দরজা তার সামনেও খোলা যায় না। হালকা চালে চলতেই সন্দীপন ভালবাসে। হাসতে হাসতে বলে, তোর চিন্তার আছোলাগুলো কেন আমার মধ্যে সেঁধোচ্ছিস বাবা! এরপর সত্যিই কি সব কথা তার সামনে ধরে দেওয়া যায়? যতই সে বন্ধু হোক না কেন। শান্তা না চাইতে সে তাকে প্রেমিকা ভাবলেও প্রত্যেকের একটা ব্যক্তিগত পরিসর আছে।
দু’দিন টানা বৃষ্টির পর বিকেলের দিকে একটু ধরণ করেছিল। নরম একফালি রোদ দক্ষিণের জানলা দিয়ে বিছানায় এসে পড়েছে। ওর রুমমেট কাঞ্চনা ঘন লম্বা চুল পরিপাটি করে আঁচড়ে বিনুনি করছে। প্রশংসার চোখে ও তাকিয়ে আছে সেদিকে। কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ছে দু’জনে।
মনীষা এসে ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। ও হোস্টেলে পাশের ঘরে থাকে। জামালপুরের দিকে বাড়ি।
ওদের এত হাসিকে পাত্তা না দিয়ে জিগ্যেস করল “দামোদরে জল দেখতে যাবি?… একদম কানায় কানায় –”
“কোথায়, সদরঘাটে? ধূর! দুবার বাস পাল্টে, হেঁটে – অত পারি না বাবা!”
মনীষা জানলার কাছে গিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকল। শান্তা এগিয়ে যেতে আঙুল তুলে বাইরের দিকে ইঙ্গিত করল। শান্তা দেখল বাইরে একটা স্কুটি বকুল গাছের নিচে –“ওটা তোর বুঝি?”
“আজই বাড়ি থেকে নিয়ে এলাম,” মনীষা বলল।
শান্তা ওর সঙ্গে একই কলেজে পড়েছে। বিষয় আলাদা হলেও একটা আলগা বন্ধুত্ব ছিল। হোস্টেলে সেটা গাঢ় হয়েছে কিছুটা। এরপর বর্ষায় স্কুটি চড়ে ওরা দু’জন দামোদরের জল দেখতে গেল সদরঘাটে। যেতে যেতে মনীষা বলল, “এই শান্তা! চল, স্কুটি নিয়ে একদিন বেরিয়ে পড়ি। আমাদের বাড়ির কাছে নদী, দোতলার বারান্দা থেকে দেখা যায়। তোর নির্ঘাত ভাল লাগবে।”
কৃষক সেতুর উপর দাঁড়িয়ে জলের পাক খাওয়া দেখছিল দু’জনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। গরমকালে ধূ ধূ চড়ার পাশে গ্রামীণ কিশোরীর মত একান্ত মনে বয়ে যাওয়া নদীটির এখন কী প্রাবল্য। জলের টানে জল বয়ে যাচ্ছে। কোন অতলে, কোন কারণ সংগোপন কে জানে, একমুখী প্রবল স্রোত বয়ে যেতে যেতে কুটিল ঘূর্ণিতে পড়ে পাক খাচ্ছে। সেতুর তলার পিলারে জল ধাক্কা খেয়ে গর্জন তুলছে। তার শব্দ। জলের বয়ে যাওয়া আর ঘূর্ণির মোচড় এক অজানা আতঙ্ক তৈরি করছে।
জীবনেরই প্রতিচ্ছবি যেন, তাই না রে? এগিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছে, বাধা পেলে কেমন পাক খায় ফেনা তুলে। আবার কখনও শান্ত ক্ষীণ চেহারায় চোখে পড়ে, কি পড়ে না। মনীষার কথায় কোনো উত্তর দেয় না শান্তা। জল আর জীবনকে দেখছে চোখ মেলে।
ওর জোরাজুরিতে পুজোর পরে পরে একদিন চলেই গেল ওদের বাড়ি। পরের দিন ফিরবে ভাবলেও সংকল্প থাকল না। জায়গা ভাল তো লাগলই। আটকে দিল ওর মায়ের ভালবাসা। একদম মাতৃমূর্তি। চৌকাঠ পেরিয়ে তার অপার জলধি টের পাওয়া যায়। যেন ভরাভর্তি দামোদর। কাকচক্ষু। আকাশের ছায়া পড়ে সে জলে। নৌকো ভেসে যায়।
শান্তার বুকের ভেতর জল পাড় ভাঙতে লাগল।
দুপুরে খাওয়ার পর মনীষা আর শান্তা দাদুর ঘরে গেল। মনীষার দাদু গল্প বলছিলেন, পুরোনো দিনের গল্প, “বুঝলে, নদীতে তখন কত যে মাছ হত সে ভাবতে পারবে না। বর্ষায় আমাদের বাড়ির পোস্তায় জল উঠে গেল। উঠোনে মাছ খেলে বেড়াচ্ছে।’’
“দাদু, বান হত না তখন?”
“বান তো ওপারে। দেবখাল যত জল বয়ে আনে, সব পাশ হয় কামারগোড় ধামনারির উপর দিয়ে। এখনও প্রতিবছর ওই ওপারে কামারগড়িয়ায় বান।”
নদীর কাছে গিয়ে দামোদর আর মনীষার মা অলকামাসি যেন একাকার। মা মনে এল বানভাসির মত। মায়ের সঙ্গে অলকা মাসির কোনো তফাৎ করতে পারছে না সে। দু’জনে একইরকম স্নেহশীল, নির্বিবাদী, শান্ত, ধৈর্যশীলা।
বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে আবার মাঠে। আল বরাবর। জমিতে নেমে গেল শান্তা। ওদের মাঠের মাটির থেকে এ মাটির রঙ চেহারা আলাদা। হাতে নিয়ে দেখে। ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে। আদুরে মেয়ের মত গলে যাচ্ছে এমন ভাব। ডাঁটো ফলবতী মেয়ের মত গুণময়ী।
সন্ধ্যেবেলা আবার দাদুকে ঘিরে বসেছে দু’-বন্ধু। শান্তার উৎসাহে মনীষাও ঘনিয়ে আসে। দাদুর কাছে এসব শোনার মন তার আগে হয়নি। শান্তা বলে, “ও দাদু, কামারগড়িয়াতেই প্রতিবছর বন্যা হয় কেন গো? ”
“এসব অঞ্চল এমনিতেই নীচু। চাষের কাজে সুবিধে হবে বলেই হয়তো কোনো একসময় দেবখাল কাটা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর পর তার সংস্কারও হল। কিন্তু সংস্কার হল না নদীর বাঁধগুলোর। এমনকি শাখা-উপশাখাগুলিসহ নিম্ন দামোদরের নূন্যতম ড্রেজিংও হল না আজ পর্যন্ত। নিম্ন দামোদরের বন্যা প্রতিরোধের জন্য এর অববাহিকায় অন্য নদীগুলিরও সংস্কার প্রয়োজন ছিল। সেসব কিছুই হল না।তার ফল ভুগতে হয় প্রতিবছর, এখানকার মানুষদের।
সুবলদা কামারগোড়েতে দামোদরের পাশে পাশে অজগড়ের মত দেবখাল চলে এল লকলকিয়ে। উপর থেকে যত নিকাশী জল পুকুর ডোবার, সব পাশ হয় খাল দিয়ে। বর্ষায় একেবারে টইটম্বুর। বর্ষার অতিরিক্ত জল, দামোদরের উথলে ওঠা জল নিয়ে জমি খাল নদী সব একাকার। সব জল ওই কামারগোড় ধামনারিকে ভাসিয়ে গিয়ে পড়ে বড়বৈনানের কাছে মুণ্ডেশ্বরীতে।” কাজের বৌ চা দিয়ে গেলে তিনি চায়ের কাপটা তুলে নিলেন।
“প্রতিবছরের বন্যায় ওদের বাড়িঘরের কী হাল হয়, দাদু? থাকে কী করে?” মনীষা জানতে চায়।
“ওরা তো অভ্যস্ত। ডোঙা, নৌকো নিয়ে এপাড়া ওপাড়া করে। আসলে দেবখাল তো গ্রামের পাশ দিয়ে গেছে। ওর একটা কাটিং ধামনারি, কামারগোড়, সুবলদাকে পাকে পাকে জড়িয়েছে।” চায়ে চুমুক দিয়ে নিলেন ছোট করে। তারপর আবার বলতে শুরু করেন, “বর্ষায় এক একটা বাড়ি, এক একটা পাড়া – ঠিক দ্বীপের মত। ভূগঠনের কারণেই এইসব গ্রামে বাড়িগুলো মাটির ঢিবির মাথায় মাথায় উঁচুতে তৈরি।”
মনীষা পাশ থেকে বলে, “পাহাড়ী অঞ্চলে টিলার মাথায় কাঠের বাড়িগুলো যেমন?”
“ঠিক বলেছিস, খেঁদি”!
“দাদু! ভাল হবে না কিন্ত”! মনীষা নাকি কান্না কাঁদে। দাদু নাতনির খুনসুটি শান্তার ভাল লাগে, তবু দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সে।
দাদু হাহা করে হেসে ওঠেন – “বন্ধু তোর ডাকনামটা জেনে গেল, খেঁদি! কী হবে এবার?”
“চিন্তা করিস না, তোর টিকোলো নাকটা আমি কিন্তু দিব্যি দেখতে পাচ্ছি,” শান্তা বলল। দু’জনে হিহি করে হেসে উঠেছে তারপর।
“ঠিক আছে এবার বল! কী বলছিলে –” শান্তা জেনে নিতে চায় দাদুর কাছে।
“ওদের গ্রামে বাড়িগুলো তো খুব উঁচুতে, তাই ধাপ ভেঙে ভেঙে উঠে যেতে হয় উঠোনে। রাতের অন্ধকারে নতুন আগন্তুক নীচের রাস্তা থেকে উপরে তাকালে বাড়ির আলো দেখে নিশ্চিত মনে করবে গাছের মাথায় কেউ হ্যারিকেন লন্ঠন জ্বেলে দিয়েছে।”
মনীষা শুনে কাঁধ ঝাঁকাল, “ওয়াও!” ওর দাদু পার্থপ্রতিম ওর প্রতিক্রিয়ার কায়দা দেখে মুচকি হাসলেন।
“বন্যার কথা মাথায় রেখেই নিশ্চয় এরকম পরিকল্পনা?” শান্তার প্রশ্নে দাদু সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন।
সব মিলিয়ে মনীষাদের বাড়িটা কী ভালই না লাগল শান্তার! ওর মায়ের ভালবাসা আর দাদুর গল্পের টানে পরের দিকে শান্তা বারবার ওদের বাড়ি গেছে। ওর দাদু একসময় এলাকার ডাকসাইটে প্রধানশিক্ষক ছিলেন। বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল বহুদিন। তারপর একসময় নিজেকে নাকি গুটিয়ে নিয়েছিলেন আদর্শগত কোনো দ্বন্দ্বের কারণে। ওর গল্প শোনার উৎসাহ দেখে তিনিও ভাঁড়ার উপুড় করে দিতেন। কিন্তু তাঁর মুখের ভাবে এক ধরণের নিরাসক্তি লেগে থাকত। কোনো পর্যটন কেন্দ্রের একজন ট্যুর গাইড যে ভাব নিয়ে বর্ণনা করে যায়, দাদুরও ভাবখানা তেমনি থাকত। ঘটনার বর্ণনায় আবেগটাবেগ বিশেষ প্রকাশ পেত না। হয়তো বয়স হলে এমন নিরাসক্তিই স্বাভাবিক!
“জানিস তো, ১৬৬০ সালে ভূপর্যটকেরা মধ্য আর নিম্ন দামোদর অঞ্চলকে পৃথিবীর উৎকৃষ্টতম অঞ্চলের মাটির সঙ্গে তুলনা করেছেন? ১৮১৫ সালে ইংরেজ সাহেব হ্যামিলটন বর্ধমান-হাওড়া-হুগলি অঞ্চলকে অবিভক্ত ভারতবর্ষের উৎকৃষ্ট কৃষি অঞ্চল বললেন। আর ১৯৩০ সালে ইজিপ্টের জলসেচ বিভাগের একজন ইঞ্জিনিয়ার স্যার উইলিয়াম উইলকক্স কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ওই কথাগুলোকেই সমর্থন করলেন।…”
একটু থেমে আবার বললেন, “এমন পলি-ধোয়া মাটি তো সোনা ফলাবেই! এক সময় নাকি গরীব মানুষেরও ভাতের পাশে তিন-চার রকমের পদ জুটত। দুধ-ঘি-মাছ মাংসও সহজেই পেত তারা। চাষের জমিতে, পুকুর -ডোবায়, খালে-বিলে তখন অজস্র মাছ, শামুক, গুগলি, কাঁকড়া। দামোদরের বাঁধ পরিকল্পনার আগের কথা এটা। এতে আর একটা জিনিস হত, জানিস! স্বাভাবিক বন্যায় জমিতে পলি পড়ে ধান হত যত, তত ছিল মাছ। মাছেরা মশার লার্ভা খেয়ে ফেলত, ফলে তখন অত মশার উপদ্রব ছিল না। নদীর বাঁধ হল, আর সব ওলটপালট হয়ে গেল।
নদীর বাঁধ যতটা দরকারী বলে মনে হয়, বাস্তবে ততটা নয় রে! নদীর প্রাণশক্তি শুষে নেয় বাঁধ আর জলাধারগুলো। একদিকে বন্যা আটকাতে নদী পরিকল্পনা, অন্যদিকে বন্যার সম্ভাবনা বৃদ্ধিতে সাহায্য করা আর নদীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া। সংকটটা ভাব একবার।”
বলতে বলতে, কী আশ্চর্য, দাদুর গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে! আগের কথার রেশ টেনে বলেন – “তবু ভাতেরও অভাব কিছু মানুষের।” কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন দাদু। তারপর আবার বলতে থাকেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে, বিশ্বযুদ্ধের পরে পরে পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের ছায়া বাংলার এই শস্যগোলাকেও গ্রাস করল। তারপর স্বাধীনতা লাভ। এদিকে স্বাধীনতার পঞ্চাশ-ষাট বছরেই অতিরিক্ত রাসায়নিক সার আর কীটনাশক মাটির গুণ অনেকটা নষ্ট করে দিল। বড় বড় দেশী আর বিদেশি কোম্পানিগুলো মানুষকে কম শোষণ করল? কোটি কোটি ডলার লুঠ করে নিয়ে গেল। বেশি ফসলের আশায় চাষীরা তা দিল! কী করবে তারা? লোভের দেখানো পথের বাইরে আর কোনো বিকল্প তারা নিজেরা ভাবতে পারল না, কেউ ভাবাল না।”
শান্তারও মনে হয়েছিল, যেখানে এত ফসল; এত ভাল মাটি, ভূগর্ভে সঞ্চিত এত জল, তবু অভাব! ফসলের পরিমাণ যে অভাবের কারণ নয় সে কে না জানে?
গরীব মানুষের হাতে দান বা ভিক্ষে তুলে দিয়ে সরকার তার দায়িত্ব সারে। অমুক প্রকল্পে এত কোটি, তমুক প্রকল্পে এত শ’কোটি কিংবা হাজার কোটির ঘোষণা। শুনতে গালভরা কোটির গল্প। তবে যারা এসব প্রকল্পের আওতায়, সেইসব প্রকৃত দাবিদারের একএকজনের হাতে কতটা পৌঁছোয়, এবং সবার হাতে আদৌ পৌঁছোয় কিনা – জোর দিয়ে কেউই বলতে পারে না। আর একটি মূলগত প্রশ্ন – সন্দীপন একবার কথায় কথায় বলেছিল, উফ! এইজন্যই সন্দীপন তার বন্ধু। ও বলেছিল, দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও গরীব-গুর্বো আর পিছড়ে সম্প্রদায় নিজেদের খুঁটি কেন শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করাতে পারে না, বলতে পারিস? ভিক্ষে নয়, দান নয়, ঠিকঠিক সহায়তা দিয়ে তাদের স্বাবলম্বী করে তোলা হয় না কেন, যাতে তাদের কখনও হাত পাততে না হয়? নিজের কাজ নিজে করে নেবার সামর্থ্য তৈরি করাই আসল লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল। মধ্যবিত্ত মানুষেরও কিন্তু নাভিশ্বাস উঠে গেছে।
ওকে মনে মনে তারিফ না করে পারেনি। মুখে বলেও ফেলেছিল, “তুই আমার বন্ধু কি আর এমনি এমনি? এত মেলে বলেই না! কিন্তু বন্ধু! প্রকল্পের খেলা বন্ধ করলে দেশের নির্বাচন,রাজনীতি – এসব অনেকটা নিরামিষ হয়ে যায় না?”
সরকারেরর পালাবদল ঘটে, সাধারণ মানুষের অবস্থার পরিবর্তন হয় না। যেটা হয়, সময়ান্তরে জীবনযাত্রার ধরণ বদলে যাওয়া। যেমন আর্যরা আসার আগে, বাকি ভারতবর্ষের কথা বাদ দিলে অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের অবস্থা কেমন ছিল, ততটা তো জানা গেল না। বৈদিক প্রাচীন সাহিত্যে রাজাদের পাওয়া গেল। হিন্দু রাজাদের পরে মুসলমান শাসক। তাদের দিন শেষ হল বিদেশী বেনেদের কবজির জোরে। তারপর জমিদার এল। এখন আবার মন্ত্রীদের আমল। তবে সবার নাকের দড়ির প্রান্ত ধরা আছে বণিকদের হাতে। চিরকাল।
সুতরাং এক স্তরের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। সেটা তো দরকার বটেই। ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লে বাজার-অর্থনীতি ফুলেফেঁপে উঠতে পারবে না। নাগরিকদের হাতে টাকা যেটুকু আসে, তা যেন বাজারে ফেরত যায়। তার জন্য যেটুকু নীতি নির্ধারণ দরকার তা তো করতেই হবে! মোদ্দা কথা হচ্ছে, মধ্যবিত্ত আর গরীব মানুষেরা যে যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সে সেখানেই দাঁড়িয়ে।
একসময় কম্যুনিস্ট পার্টির হাত ধরে পশ্চিমবাংলায় সিপিএম সরকার এল। বর্গা আন্দোলন, তেভাগা আন্দেলন হল। শ্রমিক-কৃষকদের মজুরি বাড়ল। গরীবরা কিছু কিছু জমি পেল। সবাই নয়। এই অঞ্চলেরও না খেতে পাওয়া মানুষের খাদ্যাভাব অনেকটা দূর হল ধীরে ধীরে। চর্বিতচর্বণ এই তথ্যগুলো কার আর অজানা! বহুবছরের বামশাসনে কতটা সদিচ্ছা থাকলে কতটা সোনা ফলত তার চুলচেরা বিশ্লেষণ দরকার নেই। চশমা খুলে রেখেও তা পরিষ্কার দেখা যায়। সর্বহারার মতবাদ বেনোজলে ডুবল, নাকি মতবাদের ভেতরেই নোনাজল ছিল – তা প্রাজ্ঞজনেরাই বলতে পারবেন।
হাজারটা শৃঙ্খলে মানুষ যে বন্দি, তা থেকে মুক্তি তো বাম রাজনীতির হাত ধরে এল না! সামাজিক আর রাষ্ট্রিক নিগড়ে মানুষ বাঁধা পড়েই থাকল। তার দুর্ভোগ, জীবন যন্ত্রণার প্রতিটি মূল রাজনীতির খুঁটোয় বাঁধা। হয়তো বা নৈতিক বোধও চলিত রাজনৈতিক মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত। কে জানে, এটাই সত্যি কিনা। অবশ্য কমিউনিজমের এত বছরের মজ্জাগত ধারণার বলি হয়েও সন্দীপনকে এভাবে চলে যেতে হল। হাতের মুঠাোয় যা আছে তা নিয়েই বাঁচতে চাইলে তাকে ফিরে যেতে হত না। তার নিজেরই বা এই আত্মগ্লানির জন্ম হল কেন? নৈতিকতা যখন একটা বাজে সংস্কার ছাড়া কিছু নয়, তখন উত্তম-সুচিত্রা মার্কা সিনেমার প্রতিফলন কেন ঘটাল নিজের জীবনে? একটা সামান্য স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে থেকে কী লাভ? বাস্তবকে নিয়ে বাঁচো, আর ভোগে মত্ত হয়ে চেটেপুটে জীবনকে উপভোগ করো – এই তো আজকের দিনের বেঁচে থাকার মন্ত্র।
মনপবনের নাও কোথা থেকে কোথায় না ভেসে গেল! দৃষ্টি ছড়িয়ে গিয়ে লাটাই ছাড়া ঘুড়ি আবার গুটিয়ে এল লাটাই-এর কাছে। চিন্তাসূত্র ফিরে এল তার ব্যক্তিকেন্দ্রে।
লাইব্রেরি থেকে ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে সন্দীপনের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ফিরছিল। ফেরা বলতে হোস্টেলেই। হোস্টেল থেকে খুব একটা ও বাড়ি ফিরত না। যখন হোস্টেল প্রায় ফাঁকা, তখনও অন্য গোটাকতক মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে ও-ও থেকে যেত। ওই নির্জনতা তাকে জাড়িত করত। ব্যথা ব্যথা একটা ভারে যেন মোহগ্রস্ততা।
শান্তা বলছিল, “রাজনীতির চক্কর থেকে মানুষের মুক্তি প্রয়োজন। তোর কি মনে হয় না, এই জিনিসটা মানুষকে আর মনুষ্যত্বকে কোণঠাসা করে?”
“বাব্বা! তুই এ কথা বলছিস? তুই? থুই! আমি বললে বোধহয় বেশি মানাত।” তারপর ঢঙ করে মাথা চুলকে বলে, “যাই হোক, তাহলে এখন কী করা উচিত, ম্যাডাম?”
ওর ঠাট্টাকে পাত্তা না দিয়ে বলে চলে সে – “উপায় যে কী – তাও অজানা। তবু মনে হয়, ব্যবস্থার ভেতর যত দ্বিচারিতা, ভণ্ডামি এসব দূর করা দরকার।”
“রাজনীতি, না সামাজিক ব্যবস্থা তুই কোনটার কথা বলছিস?”
শান্তার চিরাচরিত গম্ভীর মুখ। তার ভাবনা যতটা গভীরে গোছানো থাকে, প্রকাশে ততটা নয়।অগোছালো হয়ে যায় কখনও বা। বলে, “সমাজ গড়তে পারে রাজনীতির বাইরের মানুষ।”
“রবীন্দ্রনাথের মত?”
“ঠিক যেমন সুরুলকে গড়ে তুলতে চাইলেন। শ্রীনিকেতন গড়ে তুললেন …” বলতে বলতে থেমে যায় স্বভাব মত।
সন্দীপন যতই ঠাট্টা করুক, ও জানে ওরও একই ভাবনা। সুশিক্ষিত, রুচিবান, সৎ, সংস্কৃতি চেতনাসম্পন্ন অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা রোম্যান্টিকতার নেশায় নিষিদ্ধ রাজনীতির সংস্পর্শে যদি বা আসতে চায়, সংসদীয় খোঁয়াড়ে কখনও নয়। হয়তো তারাই পারে সব ক্লীবত্ব দূর করতে। তারাই হয়তো পারে একটা মানুষের গোটা জীবনকে রাজনীতির অক্টোপাশ থেকে মুক্ত করতে। গোটা জীবনটাই পরিচালিত হচ্ছে এক বিরাট অক্টোপাশের শুঁড়গুলোর দ্বারা।
ওকে মুচকি হাসতে দেখে জিগ্যেস করল সন্দীপন, “কী হল, হাসছিস যে?”
“বিদেশী সিনেমায় দেখা যায় না, কোনো যান্ত্রিক অক্টোপাশের মতই কিছু, কিংবা ধর ভীনগ্রহীরা, – মানুষের কাছে জীবন্ত ঝামেলা আর বিপদ হয়ে দাঁড়াল? তার একটা মাথাকে গুঁড়িয়ে দিলে আবার সেখান থেকে তৈরি হচ্ছে আরও আরও মাথা। সিনেমা শেষে সেই জ্যান্ত শয়তান ফিনিশড্।”
“বাস্তবে হবে কি?” এই প্রশ্নে শান্তা ওর দিকে তাকায়। তারপর দু’জনেই হেসে ফেলে।
শান্তার মাথায় যেসব ভাবনা ভর করে, তা অনেকসময় পরবর্তী কোনো লেখার উপাদানে কাজে লাগতে পারে ভেবে লিখে রাখে। হোস্টেলের ঘরে ফিরে এসে লিখে রেখেছিল –“এসব হল কূটকচাল আর প্যাঁচ-পয়জারের কথা। এসব বাদ দিয়ে বাংলার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখলাম, তুর্কি আক্রমণের দেড়শো বছরের কিছু বেশি সময় পর মঙ্গলকাব্যের উৎপত্তি। অন্য ধর্মের আগ্রাসনের ভয়ে নিজেদের ঘর সামলানোর তাগিদ। একদিন যাদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল অস্পৃশ্যতার দোহাই দিয়ে, এখন তাদের পরস্পর মিলনের প্রয়োজন দেখা দিল। সে মিলন সাংস্কৃতিক। প্রকৃতপক্ষে দেবতার আদান-প্রদান, দেবতার প্রতিষ্ঠা। মুকুন্দ, রূপরাম, ঘনরামের ছিল মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনাকাঙ্ক্ষা। সেই মিলন কি ঘটল? দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলের মঙ্গলকবিরা যে বৃহত্তর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনকে দেখলেন, সেই জীবনচর্যা থেকে একবিংশ শতকীয় সময়ে জীবনধারা কতটা বদলেছে? রঙ ও সজ্জার বদল নয়, একটা ভবনের কাঠামোয় কতটা বদল? তাঁদের রচিত কাব্যের ভেতর বঙ্গের যে ইতিহাস তলে তলে বইছিল তা আজও নিশ্চিত বহমান। নির্মোক দৃষ্টিতে তা ধরা পড়বে।”