রাধাকান্তপুরের ঝিল বোজানো বন্ধ করতে যারা বদ্ধপরিকর ছিলেন, তাঁদেরই একজন হলেন সুপ্রতীম বক্সী। তাঁর একান্ত চেষ্টা ছাড়া ওই বিলের মরণয়াত্রা কেউ ঠেকাতে পারত না। ঝিলটা বেঁচে গিয়েছিল। অনুষ্ঠানের আগে সুপ্রতীমদা শান্তাদের গ্রামে এলেন একদিন বিকেলে। পার্থ, নিখিল আর শান্তা তাঁর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ঝিলের দিকে যাচ্ছে। তিনি নানা কথা বলছিলেন। একসময় সাহিত্যের কথাও উঠে এল।
শান্তাকে জিগ্যেস করলেন, “তোমার কবিতা চর্চা চলছে?”
“লিখছি – এই পর্যন্ত। কেমন হচ্ছে – তা জানি না!”
“সেসব ভাবতে হবে না। তোমার কাজ লেখা, তুমি সেটাই করবে। তবে পাশাপাশি প্রচুর পড়াশুনাও করতে হবে কিন্তু। আর আগের প্রজন্মের কবিদের লেখার সঙ্গে বর্তমান সময়ের লেখাও পড়বে। দ্যাখো, কী ধরনের লেখা হচ্ছে, সেই ধারার দিকে নজর রাখাটা খুবই দরকার। সেখান থেকেই তোমায় নিজস্ব স্বর খুঁজে নিতে হবে, যা খুবই জরুরি একটা বিষয়। তোমরা – তুমি, পার্থ – দু’জনেই সম্ভাবনাময় বলেই কথাগুলো বলছি। কবিতার বই-ই শুধু পড়লে চলবে না, গদ্য, প্রবন্ধ, নাটক, ছোটগল্প উপন্যাস এ সব বেশি বেশি পড়বে। লেখার থেকে পড়াটা বেশি জরুরি।”
একটু থেমে বললেন, “যত দিন যাচ্ছে একটা জিনিস লক্ষ্য করছি”।
“কী জিনিস, দাদা” পার্থ তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করতে গিয়ে একটা ঢেলায় জোর হোঁচট লেগে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। তার মুখের কথা তখনও শেষ হয়নি, ‘দাদা’ শব্দটা বেশ হাঁচোড়পাঁচোড় করে যেন গলা থেকে বেরোল। সামনে চার পা এগিয়ে গিয়ে থামল, বাকিরা খুব জোরে হেসে উঠেছে। তাতে পার্থ তো চটেমটে লাল। কিল বাগিয়ে শান্তাকে মারতে এল। সে হাত আড়াল করে তখন দাদার পিছনে চলে গেছে।
দাদা থামালেন, “ঠিক আছে, ঠিক আছে”।
ওরা সবাই মাঠ পেরিয়ে ঝিলের পাড়ের রাস্তায় উঠে এসেছে। সূর্য তখনও পুরোপুরি অস্ত যায়নি। গাছগুলোতে পাখিদের কিচিরমিচির বেশ জোরালোভাবে ঘোষণা করতে লাগল সারাদিনের বিচরণের পর বাসায় প্রত্যাবর্তনের আনন্দবার্তা। একদল কাক উড়ে চলেছে ঝিল পেরিয়ে আরও ওদিকে কোথাও। ক’টি কাক সন্ধ্যের আগেই ঝিলের পাড়ে কৃষ্ণচূড়া আর বটগাছের ডালে এসে বসল। হয়তো এখানেই ওদের বাসা। তখন পূর্বপাড়ে দাঁড়িয়ে পশ্চিমের গর্ভপাতের দিকে তাকিয়ে আছে সকলে। একটা নিঃশেষিত হয়ে যাবার মুহূর্তও কেমন সম্ভাবনার কথা বলে যায়! জগতের সব ঘটনাই কি তবে এমনই দু’পিঠ নিয়ে মানুষের নজরের সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকে, আমরা সে ইঙ্গিত সবসময় ধরতে পারি না? ভাবনাটা হয়তো বা শান্তার সঙ্গে সঙ্গে আর সবার মাথাতেই ঘুরতে লাগল!
হঠাৎ পার্থ বলল, “মানুষগুলো কী বলুন তো? কীকরে এই সুন্দর ঝিলটাকে বোজানোর চিন্তা মাথায় আনতে পারল? মনের ভেতর চাপচাপ অন্ধকার নিয়ে বসে আছে সব?” ওর গলায় ক্ষোভ ঝরে পড়ে। সবাই ওর দিকে ঘুরে তাকায়।
দাদা বললেন, “এখানকার জল হাওয়া আর মাটির স্বভাবের মতই এখানকার লোকজন, পার্থ। তুমি রাগ কোরো না। ম্যাসাকার করে দেবার মত মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা এখানকার মানুষের মধ্যে খুব একটা নেই। কোনো সময়েই তুমি দেখতে পাবে না।”
“কেন স্যার? মঙ্গলকাব্যের মাহুদ্যা – ভাঁড়ুদত্ত – ?” অনেকক্ষণ পর নিখিল কথা বলল। সে বরাবরই একটু কম কথা বলে। তার উপর সে সুপ্রতীমদার কলেজের ছাত্র।
“তোমার কথা মেনে নিয়েও বলছি। রাঢ়ের এই অঞ্চলের অতীতের ইতিহাস আমরা মঙ্গলকাব্যগুলোতে পাই। সেখানে এরা আছে ঠিকই, তবে সে তো সাহিত্য, বাস্তব ইতিহাস নয়। একটা কথা বল তো, তারা কি দুর্যোধনের মত মারাত্মক? ব্যাপক সামাজিক ধ্বংস, হত্যালীলার নায়ক? মাহুদ্যা আর ভাঁড়ুদত্তের মধ্যে প্রথম জন কেমন যেন মাথা গরমের, আর দ্বিতীয় জন লোভী, কুচুটে। যারা ঝিল বোজাতে চায়, তারা ব্যাপকভাবে অন্ধকারের মানুষ এমনটা নয় কিন্তু! চরম ধ্বংসাত্মক মনোভাব এখানকার মানুষের তেমন নেই। উচ্চকিত মন্দ নেই, গড়পরতা ভাল, গড়পরতা মন্দ।” বলতে বলতে আচমকা হেসে ফেললেন তিনি। বললেন, “তোমরা যদি কখনও উপন্যাস লেখ, এই এলাকার পটভূমিতে মহৎ উপন্যাসের সাদা মানুষ কালো মানুষ নিয়ে মুশকিলে পড়বে। আপাদমস্তক “কালো” মানুষ বোধহয় আঁকতে পারবে না, যদি বাস্তব থেকে চরিত্র খোঁজো। আবার সব ভাল মানুষের পো যদি সেই লেখার চরিত্র হয়, তবে পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না নিশ্চিত। কৃত্রিমতার অভিযোগ উঠতে পারে কিন্তু!”
সন্ধ্যে নামার মুখে তারা বাড়ি ফিরেছিল একটা উজ্জ্বল বিকেল কাটিয়ে। মন্দিরের পিছনের দিকে ভূতের আস্তানা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যাওড়া গাছটাতে তখন একটা দুটো জোনাকি ভূতের চোখের মতই জ্বলতে নিভতে থাকল। ঝিলের পাড়ে হাওয়া খেতে আসা লোকজন একে একে বাড়ি ফিরছে। কেউ কেউ আরও কিছুটা সময় পার করে ফিরতে চায়। হঠাৎ খুব জোরে শিবতলা থেকে অট্টহাস্য করে উঠল কেউ। স্যার বাদে ওরা সবাই হেসে উঠল। এ হল রগুড়ে লোক সুশীল জ্যাঠা। কৌতূহলী হয়ে দাদা জিগ্যেস করলেন, কী ব্যাপার?
শান্তা বলল, উনি হলেন সুশীল বাগ। অভাব দারিদ্রের মধ্যেও নিজে খুব হাসতে পারেন, আবার মানুষকে হাসাতেও পারেন। ভীষণ খুব মজার মাানুষ।
“এমন লোক সমাজে কিছু কিছু থাকা খুব দরকার, শান্তা। মানুষ নাহলে হাসতে ভুলে যাবে। তবে এই ধরনের মানুষেরাও দ্রুত বিরল হয়ে উঠছে”।
অমরেন্দ্র সাঁইএর বাড়ির বৈঠকখানার ঘর ছাইতে এসেছে সুশীল বাগ। বসতবাড়ি পাকা হলেও মাটির বৈঠকখানাটা পুরোনো স্মৃতি হিসাবে পার পেয়ে গেছে। ইদানীং গ্রামের দিকে মাটির বাড়ি ভেঙে পাকা বাড়ি বানানোর হিড়িক। মাটির বাড়ি, খড়ের ছাউনি, আমকাঁঠালের পিঁড়ি – এসব পুরোনো সাহিত্যেই আছে। সাহিত্যের পাতায়ও তা কতদিন টিকে থাকবে বলা মুশকিল। গ্রাম জীবন নিয়ে ক’টা লেখাই বা বাংলায় লেখা হচ্ছে?
যাই হোক, অমরেন্দ্র সাঁইও স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। শুধু মাটির বৈঠকখানাটা রেখে দিয়েছেন হয়তো পুরোনো স্মৃতি হিসাবে, কিংবা নেহাৎই তা আরামদায়ক বলে। লোকজন জড়ো হলে, কিংবা গরমের দিনে মাটির এই ঘরটাতে সবাই এসে জোটে। ঠান্ডা ঠান্ডা আরামদায়ক ঘরখানার বাইরে তখন বাড়ির লোকজন বেরোতে চায় না। বাড়ির কত্তা বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে দৈবাৎ জোর আড্ডাও বসান।
সাত ঝামেলায় আর ব্যবসার চাপে তিনি বাড়ির দিকে কিছুদিন মন দিতে পারেননি। বৈঠকখানার চাল সারানো হয়নি অনেক দিন। এবার চালে নতুন খড় না দিলে চাল ফুঁড়ে ঘরে জল পড়বে। এদিকে কালবৈশাখীর দিনও এসে পড়ল বলে। আগের দিন বিকেলে অমরেন্দ্রবাবু ওদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ডাক দিলেন, সুশীল আছিস?
সুশীল বাগ তখন ঘরে বৌকে লুকিয়ে কিছু একটা দুষ্কর্ম করছিল। চট করে সাড়া দিতে পারল না। দ্বিতীয়বারের ডাকে তার নাতি একহাতে প্যান্টের কষি ধরে অন্য হাতে নাকের পোঁটা মুছতে মুছতে ছুটে কাছে এসে দাঁড়াল। তাকে কিছু জিগ্যেস করবার আগেই সুশীল বেরিয়ে এসেছে। সামনে এগিয়ে এল অমর সাঁইকে দেখে।
“বল গো, দাদা! কী খবর এই সন্ধেবেলা?”
“কাল একবার আমার বৈঠকখানাটা ছেয়ে দে দিকিনি, সুশীল! কালবোশেখী শুরু হলে বাকি চাল ক’টা উড়ে গিয়ে একেবারে টাক পড়ে যাবে নাহলে —”
তার কথা শেষ হবার আগেই সুশীল বলে উঠল, “কাল কী করে হবে গো, দাদা? কাল আমার অন্য কাজ আছে যে!”
“সে তোর যত কাজই থাক। দে দে! এরপর আমি আর বাড়িতে থেকে কাজ করানোর সময় পাব না। কাল সময় করেছি, কালই তুই একটা লোক নিয়ে চলে আয়। না হলে ঘরটা বৃষ্টিবাদলে গলে পড়বে যে রে!”
অমরেন্দ্র সাঁই সুশীলের পাকা কথা নিয়ে তবে ফিরলেন।
তার মত ভাল করে ঘর ছাওয়ার কাজ গাঁয়ে আর কেউ পারে না। তাকে দাসপাড়ার গুণো খড় তুলে তুলে দিচ্ছে। দু’জনে সমানে গালগপ্প করতে করতে কাজ এগিয়ে নিতে থাকে। সুশীল থেকে থেকেই গান ধরছে তারস্বরে।
সাঁই-এর স্ত্রী জলখাবার রেডি করতে করতে তাঁদের একমাত্র মেয়ে পলিকে বলেন, “লোকটার মাথায় নির্ঘাৎ গণ্ডগোল আছে। এত বকতেও পারে কোনো মানুষ?”
পলি বর্ধমান রাজ কলেজের ছাত্রী। খুব প্রাণোচ্ছল মেয়ে। সুশীল জ্যেঠার তারস্বরে গাওয়া গান শুনে হেসেই চলেছে। বৈঠকখানার বারদুয়ারে তাদের জন্য জলখাবার নিয়ে যায় সে। চাল থেকে নামতে নামতে জ্যেঠা বলে, “এনেছ মা জননী? খুব খিদে পেয়ে গিয়েছিল গো!”
ওরা কল টিপে হাত-পা ধুয়ে নিচ্ছে। সবে চৈত মাসের শুরু। এখনই টিউবয়েলে জলের লেয়ার নামতে শুরু করেছে। তাই জল বের করতে বেশ চাপ দিতে হয়। সামনে পড়ে রইল পুরো গরমকাল। তখন জল থাকবে কিনা সন্দেহ। তেমন বুঝলে অমরেন্দ্র হয়তো এবার গরমে সাব-মার্শেবেল মোটরও বসিয়ে নিতে পারেন।
মোটরে জল উঠবে – এখানকার মানুষের কাছে ব্যাপারটা আজও কেন যেন অবাস্তব লাগার। এখানে আছে পঞ্চায়েতের বারোয়ারি টিউবয়েল। গরম কালে তা থেকে জল তুলতে ঘেমে নেয়ে যেতে হয়। অনেক সময় জল আসেও না। তখন কার বাড়িতে সাব মার্শেবল আছে সেখানে ছোটো।
পলি বলে, “জ্যেঠু, একবার লক্ষণের শক্তিশেলের ডায়লগগুলো বল না!”
বলতে না বলতেই সে নাটকীয়ভাবে দু’হাত ছড়িয়ে বলে উঠল, “ওরে ওরে রাবণ, পাপিষ্ট! তুই আমার সীতা-মাকে করেচিস চুরি, তোরে কি আমি ক্ষমা করতে পারি?” – এরপরই কিম্ভূতভাবে গলা কাঁপিয়ে শান্তিগোপালের মত (চেষ্টা করল) হা হা হা হা করে হেসে উঠল।
পলির মা উঁকি না দিয়ে পারলেন না। অমরেন্দ্র সাঁই কাজ ফেলে ছুটে এলেন বাজ পড়েছে, নাকি দক্ষযজ্ঞ শুরু হল বুঝতে না পেরে। দু’জনে তাজ্জব হলেন বটে! পলি হাসতে হাসতে বসে পড়েছে পেট চেপে। এই সময় মুড়ির জামবাটি টেনে নিয়ে গুণো বলে উঠল, “তোমার ফুটুনি রেকে খাবে এসো দিনি কলা!”
এ’কথায় হয়তো তার আবেগের রাশে টান পড়ে। খেতে বসে সে। তবে কাঁচুমাচু হবার বান্দা সে নয়। কথার তুবড়ি ছুটতেই থাকে তার। মুড়িতে জল ঢালে দু’জনে। চটকাতে থাকে। তারপর আলুসেদ্ধ মাখা চাখনা দিয়ে পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কায় কামড় মেরে বড় বড় খাবলে মুড়ি দু’-মিনিটে শেষ। তারা আর মুড়ি নেবে কিনা পলি জিগ্যেস করল। গুণো মাথা নেড়ে খাওয়া শেষ করে উঠে কলতলায় গেল। জ্যাঠা আধখানা কাঁচা লঙ্কাটা দু-আঙুলে চোখের সামনে তুলে ধরে নিরীক্ষণ করতে করতে বলে, “মা জননী! কাঁচা নঙ্কাটা রয়ে গেচে। আর চাট্টি মুড়ি দাও দিকিনি!”
কাঁচালঙ্কার বদান্যতায় আরও আধ জামবাটি মুড়ি খেয়ে ঢকঢক করে গলায় জল ঢেলে তবে তার শান্তি।
গাঁয়ে রগড় করার লোক বটে এই সুশীল! যে কোনো হুজুগে সে একেবারে সামনে হাজির। চৈত মাসে গাজনে সঙ করবে ছেলেপুলেদের নিয়ে। সেই একঘেয়ে মোটা দাগের যত ব্যাপার স্যাপার। গল্প কিছুই থাকে না তাতে, আধা খামচা গোঁজামিল দেওয়া একটা কাহিনী খাড়া করে। খাড়াই বা হয় কোথায়, ঘাড় বাঁকিয়ে তো ঝুলেই থাকে! কিন্তু আসল ব্যাপার হল সুশীল জ্যাঠার চোখা চোখা মজার সংলাপ। কাহিনীর সঙ্গে খাপও খায় না। তবে চারপাশের সমাজ সংসারের অসংগতিকে চিমটি কাটতে ছাড়ে না। তবু সঙ তো সঙ-ই। মোটা দাগের মজা। আজকালকার ছেলেমেয়েদের ও’সব ভাল লাগে না। অথচ গাজনে ও জিনিসটি না হলেও কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগবে।
অমরেন্দ্র সাঁই-এর মা উঠোনের একদিকে পাথরের থালায় গত বছরের আমের আচার রোদে দিয়ে গেছেন। পাতলা কাপড় আলগা করে ঢেকে দিতে দিতে বলে গেলেন, “ও সুশীল! আচারটা আর সদর দরজাটা একটু দেখিস বাপ! গরু-ছাগল যেন ঢুকে পড়ে মুখ না দেয়!”
“তুমি চিন্তা করুনি, কাকী। আমি আর গুনো আচি তো।” বেশ দায়িত্ব নিয়েই বলল সে।
সূর্য মাথার উপর উঠে এসেছে। মনে হচ্ছে যেন মাথার চাঁদি ফেটে যাবে। চাল ছাইতে ছাইতেই একসময় ভেতরবাড়ি চুপচাপ। সুশীল চাল থেকে নেমে এসে গুণোর সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কী যেন শলা করে।
হঠাৎ সে চিলচিৎকার জুড়ে দেয়, “ও কাকী, কাকী গো! দেকে যাও, দেকে যাও – তোমার আচার কুকুরে খেয়ে গেল গো! হেই! যাঃ যাঃ!”
বয়সের কারণে সাঁই-এর মা দুপুর বারোটা সাড়ে বারোটার মধ্যে খাওয়া সারেন। তাঁর খাওয়া হলে তবে বাড়ির অন্যেরা। খাওয়া শেষ হতে এবার আচার তুলতে আসবেন বলে ভাবছিলেন। তখনই সুশীল অমন চিৎকার ছেড়েছে। বাড়ির সবার সঙ্গে তিনিও দুর্বল পায়ে কুঁজো পিঠে ল্যাকপ্যাক করে ছুটে এলেন প্রায় কী হল কী হল করে। এসে দেখেন ঢাকা দেওয়া কাপড়ে খানিক আচার লেগে, সেটা সরে গেছে কিছুটা। মাটিতেও কিছু আচার পড়ে। বাড়ির নেড়ি কুকুরটাই যেন খানিক হতভম্ব। সে শুয়ে ছিল আধো নিদ্রায়। এমন হুলুস্থুলুতে বেচারা উঠে দাঁড়িয়েছে। তার সামনের এক পায়ের থাবায় আচার লেগে, মাটিতেও তার দাগ।
এরপর কুকুরটার দোষী প্রমাণ হতে দেরি হয় না। সুশীল সাক্ষ্য দেয় তার বিরুদ্ধে, সুশীলের কথার সপক্ষে সাক্ষ্য দেয় গুণো। বেচারা অবোলা প্রাণীটির পক্ষে একজনকেও পাওয়া গেল না। তাড়া খেয়ে সে কেঁউ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
কাকী বললে, এই আচার জলে ফেলে দিয়ে আয়, সুশলে!
“কাকী, এতটা আচার ফেলে দোব ক্যানে? বরং আমাকে দিয়ে দাও।”
“ওরে, ও যে কুকুরের এঁটো! খেতে নেই।”
“ঠিক আচে। ও আমি ফেলে দোব এখন।”
পুকুর পাড়ে বসে তার করে আচার সাবাড় করতে লাগল সে। গুণো হাত বাড়াতে গেলে সে পাথরের থালা টেনে নিল, একখানা বাখরাও দিল না, “শুনলি না, কুকুরের এঁটো খেতে নেই?”
গুণো আকাশ থেকে পড়ে, “কোতায় কুকুরের এঁটো? কুকুর মুখ দিলে কখন?”
“দিয়েচে দিয়েচে, তুই দেকিসনি।” খেঁকিয়ে ওঠে সে।
গুণো আমতা আমতা করে বলে, “তবে তুমি খাচ্চ ক্যানে?”
“ওতে আমার কিছু হয় না কো। আমি বুড়ো মানুষ। তাছাড়া তোর জ্যাটাইমার বেদবা হবার খুব শখ কিনা —!”
গুণো বুঝতে পারে না সুশীলদার বৌ কবে তার জ্যাঠাইমা হল। তবে সুশীল বাগ খেতে খেতে এক দু’খানা বাখরা গুণোর হাতে না দিয়েই কি পারে?
কয়েকদিন পর বিকেল নাগাদ চারদিক কালো করে আচমকা মেঘ করে এল। দেখতে দেখতে মরশুমের প্রথম কালবৈশাখী একেবারে তুমুল। চারপাশ ঝড়ে তছনছ হতে থাকল। রাধাকান্তপুরের ঝিলের দিকের মাঠ ঘিরে গ্রাম ক’টা ধুলোয় ঢেকে গেল একেবারে। পাশের গাঁয়ে কোনো কাজ সেরে ফিরছিল সুশীল বাগ। ভেবেছিল কালবোশেখী ধুন্ধুমার বাধানোর আগেভাগে নিশ্চয় শিবমন্দিরে পৌঁছতে পারবে। কিন্তু ঝড়ের দাপটে সে এগোতে চাইলেও ঝড় তাকে পিছনে ঠেলছে। যেন ফাবড়ে ফেলে দেবে! ঝিলের কাছে আসতেই চড়বড়িয়ে বৃষ্টি নেমে গেল। তেমনি থেকে থেকে আকাশ ফালা ফালা করে বিদ্যুৎ চমকানি আর বাজ পড়তে লাগল কড়কড় ঝনঝন করে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা গায়ের চামড়া যেন ছ্যাঁদা করে দিচ্ছে। ঝড়ের মাতুনি আরও বেড়ে গেল নাকি? জয় মা ওলাই চণ্ডী! রক্ষে কর মা।
সুশীল কোনোক্রমে ঠাকুরকে ডাকতে ডাকতে শ্যাওড়াতলায় আসে। সেখান থেকে হয়তো আশি হাত তফাতে শিবমন্দির। সে পথটুকু এগিয়ে যাবার শক্তিও তখন আর অবশিষ্ট নেই তার। মন্দিরের ঢাকা দুয়ারে বা চাতালে আর একটু নিরাপত্তা পাওয়া যেত। তবু পাতাভরা বিরাট শ্যাওড়া গাছের নীচেই বসে পড়ল দুর্যোগ থেকে বাঁচতে। গামছাটা চারভাঁজ করে মাথা ঢাকল।
এই শ্যাওড়াতলার এতটুকু সুনাম নেই সে ভাল করেই জানে। যত রাজ্যের ভূতপ্রেতের আস্তানা নাকি এই গাছ। কিন্তু ভয়ডর তার এতটুকুও কোনোকালেই নেই। একবেলা, আধপেটা খাওয়া এই মানুষটা দারিদ্রের রক্তচক্ষুকেই বা কবে ভয় পেয়েছে? বরং সবাইকে চমকে দিয়ে নিজেই যত ভূতের গল্পের কারখানা। তাই সে ঝড়েজলে কাহিল হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এসে ধপাস করে বসে পড়েছে সেখানে। তার স্বভাবে ভয়ডর না থাকলেও শুধু একটা জিনিসকে তার ভয়। বজ্রপাতের ভয়। যখনই আকাশ চিরে বিদ্যুৎ চমকায়, সে দু’হাতে চোখ বন্ধ করে ফেলে। কিন্তু বাজ পড়ার যেন শেষ নেই বলে মনে হতে থাকল তার। বিদ্যুৎ কি তবে তাকেই চমকাতে লাগল?
এরপর সত্যিই কান ফাটানো শব্দে চারদিক আলোয় ঝলসে যেতেই হয়তো জ্যাঠা বাহ্যজ্ঞান হারায়। তার বন্ধ চোখ খুলল না আর কখনও। গাছ আর জ্যাঠা দু’জনেই বজ্রপাতে ইহলীলা সাঙ্গ করে একটা জমাট শূন্যের দেহ ফেলে রেখে গেল রাধাকান্তপুরের বেঁচে থাকাদের পৃথিবীতে। জমাট পাতায় ছাওয়া গাছের আস্তানা হারানো যত ভূতপ্রেতকে সঙ্গে নিয়ে হয়তো সে লোক অন্য কোথাও পগার পার হয়েছে!
শ্যাওড়া গাছটাকে সবাই যখন ভয় করেছে, সে যেন তার বন্ধু ছিল। তাকে বাঁচাতেই ভূতের গল্প বানাত কিনা কে জানে! রগুড়ে লোকটাকে বিশ্বাস নেই। বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে তার একমাত্র ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল সে।
প্রলয় থামলে গাঁ থেকে যত হ্যারিকেন লন্ঠন আর টর্চের আলো ভূতের চোখের মতই জ্বলতে জ্বলতে শ্যাওড়া তলায় পৌঁছে গিয়েছিল। কেউ কেউ লক্ষ্য করেছিল গাছটাতে বাজ পড়া ও তার পুড়তে থাকা আঙরার মত লাল রঙ। এসে তাদের আরও এক চমকানো বাকি ছিল। লোকটাকে চিনতে পারে কেউ। হাওয়ায় হাওয়ায় ঠা ঠা করে অদৃশ্য জ্যাঠা তখনও হয়তো হেসে উঠেছিল, আর মুদ্রা দোষে বলেছিল, উঁ! মরণ!
আগের দিন বিকেলে আমি আমার ঠাকুমার সঙ্গে নাছ দুয়ারে বসে। ঠাকুমার মাসি, যার কিনা পাকুরপাড়ায় বাড়ি। টুকটুকে বুড়ি আমাদের বাড়ি এলেই সঙ্গে আনত পাকা কয়েত নয়তো বাতাবি লেবু, চালতার আচার। বুড়ি বাড়িতে ঢুকলেই সেগুলোর লোভনীয় গন্ধ ভেসে উঠত বাড়িময়। আমি ঠাকুমাকে উত্যক্ত করে চলেছি, “বল না, তোমার মাসির গল্প বল না!”
তখনই কে যেন বলল, “কাকী, লাদনির সঙ্গে কী গপ্প করচ গো?”
তাকিয়ে দেখি সুশীল জ্যেঠু। ঠাকুমা বলল, “তা তুই কোথায় চললি হাতে গেলাস নিয়ে?”
“এতে জলপড়া আচে। গা ঝাড়তে ডেকেচে সাধন সাদার বৌ। সাধনদার নাকি খুব শরীর খারাপ। গা ঝাড়তে যাচ্চি, ভাবনু অমনি জলপড়াটাও সঙ্গে নিয়ে যাই।”
“জলপড়া, গা ঝাড়ায় সত্যিই কাজ হয়, জ্যেঠু?” আমি জিগ্যেস করে ফেলেছি সুশীলজ্যেঠুকে। নিশ্চয় সরাসরি আমার এমন প্রশ্ন করা উচিত হয়নি। ঠাকুমা কপাল কুঁচকে তাকায় আমার দিকে।
“ঠিক করে বলতে জানলে শব্দের খ্যামতা আচে গো, মা! আমরা মুখ্যু নোক, জ্ঞানের অধোগতি করে ছেড়েচি। তবু বিশ্বেসে সব হয়, জানলে কিনা।” কথার উত্তর তার রেডি থাকে সবসময়।
লোকটা মরে গিয়েও আপাদমস্তক বেঁচে রইল।
(ক্রমশঃ)