এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • দক্ষিণ দামোদর জনপদ

    কৃষ্ণা মালিক
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১০ ডিসেম্বর ২০২২ | ১০৫৪ বার পঠিত
  • চোদ্দ



    দক্ষিণ দামোদরে সব গ্রামেই একটা বারোয়ারী পুজো বা উৎসব থাকেই। কোথাও কালি, কোথাও শীতলা, ওলাইচন্ডী, মনসা, শিব, ধর্ম, পীর – যে কোনো দেবদেবীকে কেন্দ্র করে। আর প্রায় প্রত্যেক পুজোর পিছনে আছে একটা করে কাহিনী। পুজো চালু হওয়ার কাহিনী। মানবরূপী দেবতার নির্দেশ, নয়তো স্বপ্নাদেশ। এইসব কাহিনীতে হয়তো মঙ্গলকাব্যের মতো ব্যপকতা ও আভিজাত্য নেই, তবু সে কাহিনী লোকের মুখে মুখে বেঁচে আছে। যেমন গোটা দেশ জুড়ে, এমনকি বিশ্বব্যাপী দেবতার উত্থান নিয়ে জনপ্রচলিত কাহিনীগুলি টিকে থাকে। গ্রামের লোক যে যত দূরের দেশ-বিদেশেই থাক গ্রামের বারোয়ারি পুজোয় বাড়ি ফেরে সাধারণত। সারা গাঁ হৈচৈ আর ফূর্তিতে মজে যায়।

    এছাড়া বারো মাসে তেরো পার্বণ আছেই। সেই পয়লা বৈশাখ হালখাতা দিয়ে শুরু। আষাঢ় মাসে নবমীর দিন আমাদের গাঁয়ে একটা পুজো হয়। একটা বেদীতে গ্রাম ষোলোআনার পুজো। তবে যোগদান করবে শুধুমাত্র বারোয়ারীর ম্যানেজার, সে-ই জোগারযন্ত্র করবে। থাকবে নাপিত আর ঢাকী। একটা পাঁঠা বলী হবে। তার ধড় পুজোর পর নিলাম হবে। টাকা জমা থাকবে বারোয়ারী ফান্ডে। মুন্ডুটা নেবে নাপিত।

    এছাড়া অম্বুবাচিতে বারোয়ারী বোঁয়াইচন্ডীর পুজো নিয়ে যাবে। গ্রামের সব বাড়ি থেকেই পুজো নিয়ে যাবার নিয়ম।

    শ্রাবণ মাসে ঝুলন যাত্রা। ঘেটো ষষ্ঠী মেয়েলি ব্রত।

    ভাদরমাসে ভাদু-টাদু তো সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচার নয়। তবে এ মাসে এ গ্রামের বিশেষত্ব মাঠফলার। সেদিন ভোরে বারোয়ারীর তরফে এবং গ্রামের সব বাড়ি থেকে অন্তত একজন পুজো নিয়ে যাবে বোঁয়াইচন্ডীর থানে। প্রথমে মায়ের পুকুরে স্নান। এই পুকুরের জল প্রাকৃতিকভাবে উষ্ণ। যেমন প্রস্রবণের জল উষ্ণ হয়ে থাকে। স্নানের পর পুজো প্রদান। বারোয়ারির তরফে পাঁঠা বলী। তারপর খাওয়া। মায়ের থানে বসে বাড়ি থেকে আনা মুড়িমুরকি, শশা, মিষ্টি, তৎসহ চপ ফুলুরি দিয়ে জম্পেশ করে মেখে পেটপুরে বেশ রেলিশ করে খাবে সবাই। আর এখানে এসে কদমা তো কিনতেই হবে, এ হল গিয়ে ঐতিহ্যের ব্যাপার। আর ছোলামটর ছকা হল এ জায়গার মুড়ি খাবার আর এক বিশেষ উপকরণ। গ্রামে ফিরে আর এক প্রস্থ পুজো ও বলিদান। প্রথমে শীতলাতলায়, তারপর বারোয়ারি শিবতলায় ওলাইচন্ডীর থানে মাঙ্গলিক পুজো ও বলী।

    এদিন মাঠে রোয়া সবুজ ধানগাছ আটচালার চারকোণে এনে রেখে দিলো মুকুন্দ গোঁসাই। তার পদবী হল মজুমদার। কেন যে তাকে গোঁসাই বলে সে এক রহস্য। বারোয়ারির নরসুন্দরের দায়িত্ব তার।

    এই মাঠফলার একই সঙ্গে ফসল সুরক্ষা আর আপনজনের সুস্থতা ও মঙ্গল কামনার্থে পূজা-ব্রত। বিকেলে আছে স্ত্রী-আচার। ঠাকুমা আজ সারাদিন উপবাস আছে। প্রত্যেক বাড়ির একজন করে মহিলা আজ উপবাসে। ঠাকুমা কাকুর সঙ্গে বোঁয়াই গিয়েছিল পুজো দিতে। বিকেলে বাড়ির বাচ্চাদের নিয়ে ঠাকুরতলায় ফলার করতে যাওয়া নিয়ম। গাঁয়ের সব মহিলারা একসাথে বসে খাবে। আপাত দৃষ্টিতে ওইদিন জাতিগত ছোঁয়াছুঁয়ি না মানলেও ক্ষীণ একটা বিভাজন অবশ্য থাকেই। আমাকে যাবার জন্য খুব জপাল ঠাকুমা, “বুড়ি, চল না আমার সঙ্গে! ”
    “না ঠাকুমা! তুমি তোমার বুড়োকে নিয়ে যাও।” আমি ভাইকে এগিয়ে দিই। ভাইও যাবে না। ঠাকুমা খানিক ক্ষুণ্ণ হয়ে একাকি চলে গেলো ফলার করতে।

    খাওয়া শেষ হলে ব্রতী মহিলাদের সঙ্গে গিয়ে ঠাকুমা পুকুরঘাট থেকে জল নিলো। সেই জল ঠাকুরদুয়ারে ঢেলে আবার ঘটিতে তুলে নিলেই সেটা হয়ে গেল শান্তিজল।

    ফলার করে ফিরে এসে ঘরে ঢুকতে যেতে বাধা। জ্যেঠিমা ভেতর থেকে দরজা বন্ধ রেখেছে। ভেতরে জ্বলছে প্রদীপ। সেও এক রীতি। ঠাকুমা জিগ্য্যেস করছে, “ঘরে কেন আলো? ”
    জ্যেঠিমার উত্তর, “গিন্নি গেছে বনভোজনে, সবাই আছে ভালো। ”
    এই প্রশ্নোত্তর তিনবার চলল। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে ফিকফিক করে হাসছি।
    ঠাকুমা আবার জিগ্যেস করল –, ওমা! দুয়ারে একটা কুলগাছের ডাল! আমি তো এতক্ষণ সেটা লক্ষ্যই করিনি! সেটার দিকে তাকিয়ে ঠাকুমা জিগ্যেস করছে, “দুয়ারে কেন কাঁটা? ”
    “যমের মুখে ঝাঁটা”! ঘরের ভেতর থেকে উত্তর আসে। এবারও প্রশ্নোত্তর চলবে তিনবার।

    তারপর দরজা খোলা হল। ঘটির শান্তি জল ঘরের চাল, ধানের মড়াই ও আমাদের মাথায় ছেটানো হল।

    আশ্বিন মাস তো বড় পুজোর মাস! তারপর কালিপুজো। কালিপুজোয় নাড়াপোড়া আছে। তার জোগাড় করে দেবার জন্য কাকুকে আর শেতলদাকে অস্থির করে দিতাম। নাড়াপোড়ানো বা এঁজোলে-পেঁজোলের পর পোড়া কাঠিগুলো সারকুড়ে পুঁতে রেখে পরেরদিন নিজেদের ধানজমির কোণে গেড়ে দেওয়া নিয়ম।

    কালিপুজোর রাত পুইয়ে সে এক মজার ভোর। ভোরে মজা করে মশা তাড়ানো। ঘুম ভেঙে শুনতে পাই -বেরিয়ে পড়েছে সকলে। ঘুম জড়ানো চোখে কুলোর বাতাস দিয়ে যত আনাচ কানাচ থেকে মশা বের করে তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করে দিয়েছি আমি আর দিদি, আর হি হি করে হাসছি। এ তো মজা ছাড়া কিছু নয়! ছড়া শুনতে পাই - “ধা রে মশা ধা, যতগুলো মশা আছে – ” এরপর কেউ বলল পাঁজাপাড়া যা, কেউ বলল মোড়ল পাড়া যা। কিংবা বামুন গিন্নি, সরকার গিন্নি ইত্যাদি সব জাঁদরেল গিন্নিদের বাড়ি যা। ঠাকুমা আমাকে আর দিদিকে উৎসাহ দিচ্ছে। আমরাও প্রাণপণ চেঁচাচ্ছি। ওদিকে মন্ডল, সরকাররা উল্টে অন্যদের নাম করে মশা তাড়াচ্ছে। এইসব হাসিঠাট্টার সঙ্গে সকাল শুরু হল। শুকতারাও অমনি মুচকি হেসে ঢুকে পড়ল তার ঘরে।

    ভাইফোঁটার আগের দিন জামাই ফোঁটা হয় কারও কারও বাড়িতে। ওইদিনই আবার গরুর পরব বলে জামাইদের নিয়ে মস্করা করে শালিশালারা।

    পাঁচুকাকা গরুগুলোর গা ধুইয়ে আনল পুকুরে নিয়ে গিয়ে। মা আর জ্যেঠিমা, তারপর তাদের গা শুকোলে তেল-হলুদের ফোঁটা পরাল, শিঙে মাখানো হল। জ্যেঠিমা মাকে বলল, নমিতা, “তুমি গায়ের লোমগুলো আঁচড়ে দাও। আমি কপালে চন্দনের ফোঁটাটা পরিয়ে দিই”।

    পাঁচুকাকা গলায় মালার মতো করে পরিয়ে দিল গোয়াললতা। আমরা সবাই গোল করে ঘিরে দাঁড়িয়ে মজা দেখছি।
    দিদি বলল, “ও পাঁচুকাকা! এবার দুব্বোঘাসগুলো খেতে দাও! ”
    “দিচ্ছি রে, মা! এই তো –” বলে ঝুড়ি থেকে ঘাস তুলে তুলে গাই আর হেলেগুলোর সামনে নামিয়ে রাখল।

    গরুর পায়ে জল দেওয়া, পাখার বাতাস করাও নিয়ম। গায়ে গিরিমাটি গুলে শুকনো প্যাঁটারি ফল ডুবিয়ে ছাপ দেওয়া হল। সবশেষে ভগবতীকে দু’হাত তুলে নমস্কার জানানো।

    যত পুজোপার্বণের ফিরিস্তি, তত মেয়েলি ব্রত। তবে সব পালপার্বণ আর ব্রতই কৃষিকেন্দ্রিক। অঘ্রাণ মাসের এক তারিখ মুঠ উৎসব। যাদের নিজস্ব জমিতে চাষ তাদের বাড়ির একজন পুরুষ সকালে স্নান সেরে সাদা ধুতি পরে আর উড়ুনি গায়ে মাঠে যাবে। এক গোছা ধান খড়সহ কেটে খড় দিয়ে গোছাটা জড়িয়ে মাথায় করে আনবে উড়নিতে ঢেকে। একমুঠোয় যতটা ধানের গোছা ধরে ততটা কাটা হয় বলেই হয়তো এই উৎসবের নাম মুঠ। বাড়িতে যে জায়গায় মুঠ রাখা হবে সে জায়গা নিকিয়ে আলপনা দেওয়া থাকবে। পুরুত এসে পুজো করবেন। এই পুজোর পর ধান কাটা শুরু হবে। শাস্ত্রীয় রীতি মেনে এদিন ধানকাটার আনুষ্ঠানিক সূচনা।

    এই দিন ইতুপুজোরও শুরু। ইতু পুজোটা বোধহয় বাংলার সব কৃষি পরিবারেই হয়ে থাকে। পিসি ইতুর ঘট তুলবে। পুকুরঘাটে ডুব দিয়ে পাঁক তুলে মাটির মালসায় রাখবে। জ্যেঠিমা আমাকে আর দিদিকে বলল, এই, তোরা পিসির সঙ্গে যা। পিসি ডুব দিয়ে দিয়ে পাঁক তুলে আনল। বাড়িতে এসে একটা মাটির মালসায় সেই পাঁক রাখল।
    “ও বৌদি! কলাই আর গাছগুলো কোথায়? ” পিসি বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে চেঁচিয়ে জিগ্যেস করছে।

    জ্যেঠিমা বেরিয়ে এল রান্নাঘর থেকে। আঙুল তুলে মড়াইতলার দিকে ইঙ্গিত করে বলল ওখানে পাঁচকলাই রাখা আছে।

    মালসার মাটিতে ছড়ানো হবে অন্তত পাঁচ রকম শস্যবীজ। এছাড়া বিশেষ কয়েকটা চারাগাছ লাগানোর রীতি রয়েছে। নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দেওয়া হবে মালসা বা সরাটি। প্রতি রবিবার উপোস থেকে সরায় জল দেওয়া হবে। মাসান্তে ইতু বিসর্জন, আর একই পাত্রে ইচ্ছুক মেয়ে-বৌ-রা তুসুর ফুল রাখবে। প্রতিদিন সন্ধেবেলা সরায় ফুল দেবে। মেয়েরা – যারা তুসুর ব্রত করছে তারা একসাথে গাইবে তুসুর গান। পৌষসংক্রান্তিতে তুসু বিসর্জন। তার আগের দিন সারা রাত জেগে তুসুর গান চলবে। ভোরে রওনা দেবে পুকুর বা নদীর উদ্দেশ্যে। সেখানে বিসর্জন। সাধারণত নিম্ন সম্প্রদায়ের মধ্যেই টিমটিম করে এই ব্রত চলছে।

    তুসলা ভাসানের আগের দিন সন্ধে থেকে দাস পাড়া, থান্দার পাড়া থেকে তুসু গানের আওয়াজ আসছিল। শুতে গেছি, ঠাকুমা বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, আজ আর ঘুম হবে না। সারারাত তুসুগানের সুরে এপাড়া ওপাড়ায় কথা কাটাকাটি চলবে।

    আমার কিন্তু ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। অত মাইকের আওয়াজেও কোনো অসুবিধা হল না। ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার পাশে শুয়েছে পিসি। পিসি ঠাকুরমাকে সদরঘাটের মেলা নিয়ে কিছু একটা বলছিল, ঠিকঠিক শুনতে পেলাম না, তার আগেই অতল ঘুমের ভেতর আমি।

    মাঠের ধারে কংসায় তুসুর ভাসান হয় রাধাকান্তপুরে। তবে বর্ধমানে সদরঘাটে নদীর জাত বসে মাঘমাসের এক তারিখ। আর একলখীতেও এই জাত, সেটা তুসু ভাসানোর দিনে। দুট‌ো নদীর মেলারই খুব নাম। গাঁয়ের লোক বলে নদীর জাত। সদরঘাটে দামোদরের মেলা। আর একলখীতে দ্বারকেশ্বরের মেলা। সদরঘাটের মেলাকে ঘুড়ির মেলাও বলে। এই মেলাকে ঘিরে বর্ধমান শহরেও নাকি বেশ উন্মাদনা। এসবই কারো না কারো কাছে শোনা।

    সকালে ঘুম থেকে উঠেই পিসি খুব ধরেছে ঠাকুমাকে। বলছে, ছোড়দার সঙ্গে সদরঘাট যাব, মা? যাই না, যাই না -! কখনও তো যাইনি! এই ছোড়দা! চল না রে! নদীর জাত দেখে আসি! কী হবে গেলে? ”

    ঠাকুমার একটুও মত নেই তাতে। বর্ধমান যাবার বাস বন্ধ থাকে সকাল থেকে, যাবি কীকরে এতদূরের রাস্তা?

    পিসি সাহসে ভর করে বলল, কেন, ছোড়দা সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে যাবে। আমি পোঁ ধরলাম শেষে, যাব বলে। বাবা সাধারণত সাতেপাঁচে থাকে না। চা খেতে খেতে হঠাৎ মানুষটা বলে বসল, যাক না ওরা! বাইরে ছাড়তেও হবে তো, নিজে নিজে হাঁটাচলা করতে শিখবে না?

    সবাই কেমন থমকে গেল বাবার কথা শুনে। ঠাকুমাও রাজি হল, জ্যেঠুও। অথচ এই মানুষটাই পরবর্তীকালে পিসিকে স্কুল ফাইনালের পর গ্রামের বাইরে একা একা স্কুল যাবার বেলায় কেন যে ঠাকুমা আার তার অন্য ভাইদের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারল না, কে জানে?

    খানিকটা সাইকেলে, খানিক হেঁটে একটু বেলার দিকে তিনজনে পলেমপুর পৌঁছোলাম। সগড়াইএর পর থেকে রাস্তায় অনেক গরুমোষের গাড়ি। কোনোটা খোলা গাড়ি, মানে ছোদড়ি নেই, কোনোটায় ছোদড়ি দেওয়া। সব গাড়ির গন্তব্য সদরঘাটের মেলা। হেঁটে যাবার লোকেরও অভাব নেই। ইয়ার্কি আর হাসিঠাট্টায় রাস্তা সরগরম। তুসুর গান গেয়ে চলেছে কোনো কোনো দল। গানে গানে সদ্য বানানো কথায় একদল অন্য দলকে ঠেস দেয়। ছেলেদের কোনো দল থাকলে তারাও বেশ রসের কথা বলতে থাকে।

    কাকু গম্ভীরসে সাইকেল চালাচ্ছে। পিসি চুপচাপ। আমি একখামচা মানুষ, আমি আর কী করব। রাস্তার রগড় দেখতে দেখতে যাচ্ছি। নেহাৎ কেঁদে পড়েছিলাম বলে প্রচুর বিধিনিষেধের গন্ডী মাথায় রাখব আমরা সেই কথা দিয়ে তবে পিসি-কাকুর দলে ঠাঁই পেয়েছি। বড়োরা ওই ভিড়ের মধ্যে তিনজনকে ছেড়ে যে কী দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে কাটাবে সে বুঝতেই পারছি।

    গিয়ে দেখি, যেমন মেলা হয় আমাদের রাধাকান্তপুরে অঘ্রাণমাসের বারোয়ারিতে সেরকমই কিছুটা। তবে তুসুর ভাসান এখানে বিশেষ ব্যাপার। সেটাকে কেন্দ্র করে একই ধরনের সুরে গাওয়া গান ভেসে আসছে নদী যেখানে সরে গেছে সেই দূর থেকে। সেখানে গাঁদাফুলে সাজানো সব তুসলার সরা মালসা ভাসিয়ে অবগাহন করছে নারীপুরুষ, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা। দামোদর বর্ষার জলে পুষ্ট। শীতের দিনে সে ক্ষীণকায়া। সরু সরু দু-তিনটি স্রোত বইছে ধীরে এদিক ওদিক। সেখানেই মানুষ চান সারছে। বাব্বা! কীকরে যে ওই ঠান্ডা জলে শীতের সকালে এ কাজখানা করছে ভেবে পাই না। মনে মনে ওদের তারিফ করি।

    অবাক হয়ে আনমনে দেখছি। কেমন অবহেলায় বাষ্প ওঠা কুয়াশাচ্ছন্ন নদীতে চান করছে সব ছায়াময় মেয়েরা। কেমন যেন সবট মিলিয়ে একটা রহস্যময়তা। চানের পর মেয়েরা কেউ সায়া, কেউবা ফ্রক দাঁতে চেপে অবলীলায় সবার সামনে পোশাক পাল্টে ফেলছে। গামছায় ঘসে ঘসে মাথা মুছে চুল ঝাপটে পিঠে ফেলছে। ভিজে কাপড়জামা ব্যাগে ভরে সেইসব চনমনে মানুষজন বালির উপর দিয়ে হেঁটে এসে মিশে যাচ্ছে মেলার ভিড়ে।

    আমরা সাইকেল নিয়ে বিব্রত। কাকু বলল, “সাইকেল ছেড়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ছাড়লেই হাপিস হয়ে যাবে, আবার ভিড়ের মধ্যে সাইকেল নিয়ে ঢোকাও যাবে না। খুব মুশকিল তো! ”

    শেষে ভিড় বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে কাকু আমাদের নিয়ে এগোল। মূলত মেলাটা বসেছে পাকা রাস্তার পূব দিকে নদীর বাঁধের উপর যে সমতল জায়গা আছে সেখানে আর নদীর চড়ার উপর বালিতে। পাকা রাস্তার পশ্চিমদিকেও কিছু কিছু। সাইকেলের কারণে আমরা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি। খিদে পেয়ে গেছে এদিকে। কিন্তু কিচ্ছু বলছি না। মুখ ভেটকে দাঁড়িয়ে আছি। কাকু যেন ধ্বন্ততরি, বলল, কী রে, খিদে পেয়েছে তো? তোরা সাইকেল পাহারা দে, আমি আসছি। যাক বাবা, পেটে কিছু পড়বে। বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি ঠাকুমা জ্যেঠিমা মায়ের সম্মিলিত প্রয়াসে বানানো গড়গড়ে পিঠে আর দুধে সেদ্ধ পিঠে। সেসব হজম হয়ে গেছে। রসাকাকু বামনার ধারে আমাদের যে খেজুর গাছগুলো আছে তা ভাগে নিয়েছিল। গাছ তৈরি করা, গাছে উঠে কলসী বাঁধা, রসভরা কলসী নামানো এসবেরই দায়িত্ব রসাকাকার। একটা বড়ো খাঁজওয়ালা বাঁশ সব থেকে বড়ো খেজুর গাছটার সঙ্গে বাঁধা। টঙে উঠতে সুবিধা হয় তাতে। রসাকাকা কলসী পেড়ে নিয়ে যখন জিরেন দেয় তখন উপর থেকে ফোঁটা ফোঁটা রস ঝরে পড়ে মাটিতে। আমরা কখনও তাকমতো হাত পেতে সেই ফোঁটা ধরে নিয়ে চেটে খাই। কখনও সরাসরি হাঁ করে একেবারে মুখের ভেতর রসের ফোঁটা। আহা! কী যে ভালো লাগা, আর সেই রসের স্বাদ যেন অমৃত।

    ওরা একদিন কলসীর রস নেবে, একদিন আমাদের – এই চুক্তি। পিঠে পার্বণের আগে ঠাকুমা রস ফুটিয়ে ফুটিয়ে গুড় বানিয়ে রেখেছিল। তার স্বাদই আলাদা। খেজুর গুড় দিয়ে দুধে সেদ্ধ পিঠের স্বাদটাও অপূর্ব। বোধহয় কাকুর পেটেও সেই অমৃত হজম হয়ে গেছে, তাই হয়তো রাশিকৃত গরম জিলিপি আর তেলেভাজা নিয়ে এল। পাকা রাস্তার পশ্চিম গায়ে সাইকেল মাটিতে শুইয়ে রেখে আমরা তিনজন পাশাপাশি বসে উদ্ধার করলাম সেগুলো। মেলায় প্রচুর যে জিনিসটা বিক্রি হচ্ছিল -, খেয়াল করলাম লোকজন গরুর গাড়িতে তুলে নিচ্ছিল থলে বস্তা ভর্তি করে, তা হল শাঁকালু।

    যত সময় যাচ্ছে ভিড় ততই বাড়ছে। বালির চড়ে অজস্র মানুষ ছড়িয়ে আছে। অথচ মেলা সাঙ্গ হলে এই বালুচর রিক্ত ও শূন্য হয়ে পড়ে থাকবে। বুকে কেবল অজস্র পদচিহ্ন সময়ের সাক্ষ্য দেবে বটে, তবে মহাকাল নামক নিরবচ্ছিন্ন সময়ধারায় তার কোনো মূল্যই থাকবে না। এত মানুষ যেমন এসেছে একে একে, দলে দলে ; তেমন করেই একসময় ফিরে যাবে। বড়ো হয়ে এই দিনে যতবার নদীর জাতের, ঘুড়ির এই মেলার পাশ কাটিয়ে চলে গেছি ততবারই আমার এসব কথা মনে হয়েছে। সেদিনের পর আর কখনও এই মেলায় অংশ নিই নি, অচেনা পথিকের মতো পার হয়ে গেছি মেলাছোঁয়া রাস্তাটুকু।

    সদরঘাটের মেলা মানে – যত গাড়ি তত দাড়ি। যত ঘুড়ি তত ছুঁড়ি। অর্থাৎ গরুমোষের গাড়ি ভরে অধিকাংশ মুসলমান এই মেলায় আসেন যেমন, তেমনি আজ মেলার পাশাপাশি বর্ধমান শহরেও ঘুড়ি ওড়ানোর হিড়িক। আর রইল পড়ে ছুঁড়ি। তুসু ভাসাতে ছুঁড়ির দল তো আসবেই।

    যেদিকে চোখ যাচ্ছে শুধু রঙ বেরঙের ঘুড়ি আকাশে। আর মাঝে মাঝে কাটা ঘুড়ির পিছনে বালির উপর দিয়ে হো হো করে ছেলের দলের দৌড়। মনে আছে, একমনে একটা ঘুড়ির উড়ে চলা দেখছি। ঘুড়ি আপনমনে নিরাসক্তভাবে নিরুদ্দেশের পথে, তার কেবল এগিয়ে যাওয়া, কোনো বাসনা থাকে না তার। এক শ্রমণ চলেছে যেন শূন্যমার্গে, দূর থেকে জীবন ও জগতকে দেখা, জ্ঞান আহরণ করা – এতেই সব আনন্দ, আর কোনো উদ্দেশ্য নেই।

    সেদিনও দেখে চলেছি আকাশের কোন দূর প্রান্তে পৌঁছে সে এতটুকু হয়ে ভেসে চলেছে। মুছে গেছে সব শব্দ, মুছে গেছে এত মানুষের অস্তিত্ব। কেউ নেই, কিছু নেই। শুধু সেই গোলাপি ঘুড়ি পুচ্ছ নাচিয়ে নদী অতিক্রম করবার মতলবে পলেমপুরের দিকে ভেসে চলেছে। আচমকা কানের কাছে জোর ধমক। আর মাথায় চাঁটি। কাকু ডাকছে, শানু! আমার ছোটবেলায় মায়ের কানমলা দেবার ঘটনাটা মনে পড়ে গেল।

    মেলায় এসেও যেন ঠিক পোষাল না। ভেতরে না ঢুকতে পারলে কী মেলার সবটা বোঝা যায়? ভাবছি আমরা কোনো দোকানদারকে সাইকেলটার উপর নজর রাখতে বলে ভেতরে ঢুকব কিনা। কিন্তু বিশ্বাসও করতে পারছে না কাকু। এমন সময় হঠাৎ কে যেন কাকুর নাম ধরে ডাকছে। এত ধরনের শব্দ, ভিড়ের কথাবার্তা, ভেঁপুর আাওয়াজ, ঝুমঝুমি, বাঁশি – ইত্যাদি ভেদ করে সত্যিই মনে হল কেউ ডাকছে, “ও বিনু -! বিনু – এদিকে এদিকে -” চারদিক তাকিয়ে দেখি রাস্তার গায়ে অল্প দূরে যেখানে বাদাম ভাজা, কাঠিভাজা কুচো নিমকির দোকানগুলো – সেখান থেকে একজন হাত নেড়ে ডাকছে। আমরা এগিয়ে গেলাম। পিসি বলল, মনে হচ্ছে গোরা সরকারের বোনের বর? ও তো মেলায় মেলায় ঘোরে বলে শুনেছি।

    বাড়ি ফেরার পথে যেতে যেতে কাকু পিসি বলাবলি করছিল, ভাবা যায় না, সরকারদের বাড়ির জামাই এরকম একজন মানুষ। সবাই লেখাপড়া করা, ভালো চকরি বাকরি করা সব ভাই বোনেরা। শুধু এই জামাই শ্বশুরবাড়িতে অচ্ছুত।

    পিসি বলল, রুমিদিকে দেখলে বড়ো খারাপ লাগে। বাড়ির লোক দুচ্ছি করে বড্ড। সেজন্য রাধাকান্তপুর খুব একটা আসে না।

    শান্তা একবার দেখেছিল। ভারি সুন্দর দেখতে, মুখখানা দুগ্গা প্রতিমার মতো। এখন সে বেশ রোগা হয়ে গেছে, আগে নাকি চেহারা ভালো ছিল। পিসির থেকে বয়সে অল্প বড়ো হলেও খুব ভাব ছিল দুজনে। বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছিল এক মেলার লোককে। অনেক দিন বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না।

    এসব কথা পরে পরে শোনা। গোরা সরকারের বোন রুমির বর এই লোকটা! লোকটাকে ঠিক কেমন দেখতে তা বলতে পারব না, তবে চোখমুখের মধ্যে যে ভাব থাকলে ভক্তি হয়, সেটা ছিল নিশ্চিত। এই লম্বা আর বেশ শক্ত শক্ত চেহারার মায়াবী চোখের লোকটাকে কিছুতেই মেলার ফেরিকর বলে মানতে মন চাইছে না। ওই জামাই একজন বাদামওলাকে বলে দিল সাইকেলটা খেয়াল রাখতে, বোধহয় তার পরিচিত।

    লোকটার পিছন পিছন ভিড় ঠেলতে ঠেলতে আমরা মেলার ভেতরে ঢুকলাম। কাকু পিসির একপাশে, পিসি আমার হাত ধরে আছে। রুমিপিসির বর চুড়ি বিক্রি করে। সামনে কয়েকটা কাচের বাক্স পাশাপাশি রাখা। তার ভেতর ইমিটেশনের নানা গয়না। নানা পাথর বসানো হাতের চুড়ি, বালা। পাশে সাজানো রয়েছে রঙবেরঙের নানা কাচের চুড়ি। বাক্সগুলো ডিঙিয়ে দোকানের ভেতরে ঢুকে গেল লোকটা। পলিথিন দিয়ে ঘেরা ছোট ছোট কাউন্টার। মেলায় যেমন হয় আরকি। তার অনুপস্তিতিতে একজন সহকারী দোকান সামলাচ্ছিল। বেশ ভিড় এখানে মেয়েদের। পসরার সামনে নিজের জায়গায় বসতেই মেয়েরা হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে চুড়ি পরার জন্য। এক সঙ্গে অনেক মেয়ে কলকল করে কোন চুড়ির কত দাম জিগ্যেস করে চলেছে। তারস্বরে অজস্র মাইক বেজে চলেছে। কত দল যে মাইক নিয়ে এসেছে তার ইয়ত্তা নেই। তাই সবাইকেই চিৎকার করে কথা বলতে হচ্ছে। চুড়ির ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়েই চিৎকার করে দরদাম করে চলেছে।

    পিসি এক ফাঁকে জিগ্যেস করল, রুমিদি কেমন আছে? সেও চিৎকার করেই।

    উত্তর এল চিৎকারে, “খুব ভালো আছে। সে এখন মেয়েকে নিয়ে খুব ব্যাস্ত। পাকা গিন্নি হয়ে উঠেছে তো তোমার রুমিদি। ”

    খদ্দের সামলানোর এক ফাঁকে বলল, এবার একটা দোকান দিচ্ছি আমাদের ইন্দাসের বাজারে। মেলায় মেলায় আর ঘোরা পোষাচ্ছে না, ভাই বিনয়। দোকানটা দিলে রুমিও দোকান দেখতে পারবে। তবে মেলায় যাওয়া আমি একেবারে বন্ধ করতে পারব না, বুঝলে?
    “কেন? ” কাকু জিগ্যেস করল।
    “এর টানই আলাদা। তবু এতে আমার শ্বশুরবাড়ির মান যায় তো, তাই রুমিরও খুব আপত্তি মোলায় ঘোরা নিয়ে। অথচ রাধাকান্তপুরের মেলায় আমার হাতে চুরি পরতে গিয়েই প্রেম, সেকথা ভুলে গেছে। কিংবা সেজন্যেই হয়তো আমাকে আর বিশ্বাস করতে পারে না, যদি এই হাতে ধরা হাত শক্ত বাঁধনে আটকে যায়? ” বলে হাহা করে হাসল খানিকত। তারপর বলল, মেলায় বেরোনোতে ওর আপত্তির জন্যেই আমি দোকান ঘর নিচ্ছিল”।

    সদরঘাটের মেলার স্মৃতি কোনোদিন ভুলব না। মেলায় না গেলে রুমিপিসি, যার নাকি একদিন দুগ্গা প্রতিমার মতো গড়ন ছিল, তার বরকে দেখা হত ন। লোকটার ভেতর একটা চাপা বেদনার ভাব, না কী যেন ছিল যা আমাকে বেশ স্পর্শ করেছিল সেই ছেলেবেলাতেও।

    ফেরার পথে শুনি খোলা গাড়িতে বসে একদল মেয়ে সাইকেল আরোহী একদল ছেলের উদ্দেশ্যে গাইছে, “যত জোরে চালাও সাইকেল, গরুর গাড়ি আগে যাবে। তোমাদের মনে খারাপ চিন্তা তাই তো সাইকেল হার মানবে। মুখ দেখবে না সাইকেল চালাবে, সেটা আগে ঠিক করো। গঙ্গাজলে মুখটা ধুয়ে তারপর আমাদের পেছন ধরো। ” এই গাওয়াও তুসুগানের সুরে।

    ছেলেরা আসলে গাড়ির পিছন ছাড়ছে না, আর নানা ধরনের ঠাট্টা-তামাশা করছিল, মেয়েরা তারই জবাব দিয়েছে।

    মেলায় পিসি কাচের চুড়ি পরবে ভাবলেও পরতে পারল না। জিনিসটা কাকুর দু-চক্ষের বিষ। তাই পরতে দিল না। পিসির মুখ ছোট হয়ে গেল। পিসি বলল, তাহলে আমাকে সিঙ্গার টিপ আর খোঁপার জাল কিনে দে! ” কাকুর তাতে আপত্তি নেই। আমাকে কিনে দিয়েছে একটা ফতিঙ্গা আর তালপাতার সেপাই। দুটোই আমার খুব পছন্দের।

    পিসি কাচের চুড়ি পরতে না পারলেও অঘ্রাণমাসের মেলায় কিনে ফেলল। তবে লুকিয়ে রাখল বেলোয়ারি চুড়ি। সুযোগ মতো পরা, যখন কাকু বাড়ি থাকবে না। সেবার শীত শেষের মুখেই হবে হয়তো, অত মনে নেই, বৃষ্টি হল বেশ। হতে পারে আমার কল্পনা প্রবণ মন ছবি বানাচ্ছে, তাই সেই ছবিতে সুন্দর করে মিলে যাবে যে দৃশ্য মন সেটাই দেখছে। দেখলাম, অকাল বৃষ্টির দিন পশ্চিম দুয়ারি ঘরের ধারিগোড়ায় বসে পিসি চুড়ি ঘুরিয়ে হাতখানা দেখছে। আচমকা কাকু হাজির বাইরে থেকে। এক লাথিতে পিসি ছিটকে পড়ল উঠোনে। বৃষ্টির জলের ভেতর পড়ল আছাড় খেয়ে, হাতের চুড়ি ভেঙে খানখান। যেন অপমানিত, অতৃপ্ত চুড়িগুলি চরম অভিমানে শীতের বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চোখ ভরা জল নিয়ে তাকিয়ে আছে চরম বিস্ময়ে। ভাঙা চুড়িগুলি ভিজতে লাগল। ভিজছে পিসি। তার চোখ মুখ থেকে জলের ধারা নামছে। সে ধারা বৃষ্টির, না চোখের তা অবশ্য আমি বলতে পারব না। বৃষ্টির দিনে ভাঙা রঙিন চুড়ি খেলি কুঁড়িপিসির সঙ্গে, চুড়ির গায়ে কত কত সুখ দুঃখ লেগে থাকে সঙ্গোপনে।

    অঘ্রাণ মাসের সংক্রান্তির দিন আমাদের বারোয়ারী ওলাইচন্ডী পুজো। চারদিন ধরে উৎসব, নানা অনুষ্ঠান, যাত্রাপালা – সব মিলিয়ে গ্রাম জমজমাট। রাধাকান্তপুর গাঁয়ের যাত্রাপালার খুব নামডাক।

    ঠাকুমার সঙ্গে যাত্রা দেখতে বসা জীবনে একটা বিরাট অভিজ্ঞতা। যাত্রা দেখার জন্য সবাই সকাল থেকে চাটাই কম্বল চট বস্তা যে যা পায় তাই বিছিয়ে জায়গা দখল করে রাখে। সারাদিন বাড়ির খুদেরা সেই জায়গা পাহারা দেয়। নাহলে বসার সে সব জিনিস উপে যেতেও পারে, কিংবা সেটা সরতে সরতে চলে যেতে পারে একেবারে প্যান্ডেলের বাইরে। কারণ সবার চেষ্টা থাকে দুটো। এক যতটা সম্ভব স্টেজের কাছাকাছি জায়গা রাখা। আর দু নম্বর হল ছাউনির নীচে বসতে পারা। কারণ পৌষ মাস পড়ে গেছে। মাথায় হিম বসে ঠান্ডা লেগে না যায় সেটাও তো দেখতে হবে!

    যাত্রা দেখার জন্য ঘরে ঘরে মা-কাকীমারা সন্ধে রাতেই রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়ার পাট সেরে নিতে চায়। খাওয়া শেষ হলেই ঠাকুমাকে লাগাতার তাগাদা দিতে থাকি, ও ঠাকুমা, চল গো! যাত্রার সিন পড়ল বলে।
    “দাঁড়া না, দেরি আছে এখন। প্রথম সিন পড়লে তারপর যাব। নয়তো গিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হবে। ” কিন্তু ছোটদের আর তর সয় না। যেই ‘ঝ্যাং’ করে বাজনায় ঘা পড়া অমনি ফ্লুট, আর ব্যাগপাইপার আরও কী কী যেন সঙ্গত শুরু করল। বুকের ভেতর অপেক্ষার উৎকন্ঠাও হয়ে উঠল অসহ্য।

    আসলে সিন পড়াপড়ি হল দর্শককে সময় সম্বন্ধে সচেতন করা, আর কলাকুশলী ও শিল্পীদের তৈরি হতে তাগাদা দেওয়া, বা ওয়ার্ণিং দেওয়া। দ্বিতীয় সিন পড়লে দর্শকদের এসে পৌঁছতেই হবে। কারণ এরপর বেশি সময় অপেক্ষা থাকে না। তৃতীয় সিন পড়বে, আর বেশ দরাজ গলার বিখ্যাত শিল্পী কালীচরণ বসু বা নামকরা ভিলেন সাজা বাসুদেব ধাড়া “নমস্কার” বলে ভূমিকাটুকু করে নেবে। তখন চারপাশের গুঞ্জণ থেমে আসতে থাকবে। তখন কেউ কথা বললেই টেনে ধমকে উঠবেন বয়স্করা। ভলান্টিয়াররাও কম যায় না।

    ঠাকুমা আমার হাঁপাহাঁপি থোড়াই কেয়ার করে শেষ অব্দি পৌঁছবে প্রায় লাস্ট সিন পড়ার সময়। এর ওর পাশ কাটিয়ে, এদিক ওদিক পা গলিয়ে, এর মাথা সরিয়ে, তাকে ডজ করে গোলে গিয়ে ঠিক পৌঁছে যাবে। নিজেদের বসার জায়গা খুঁজে না পেলেও কোই পরোয়া নেহি। সব ডোন্ট কেয়ার করে গিয়ে বসবে একেবারে স্টেজের কাছে। কারও না কারও জায়গা পাতা আছে। তারা হয়তো চেঁচিয়ে উঠল হাঁ হাঁ করে। -করো কি করো কি, আমাদের বাড়ির লোক বাকি আছে বসতে। ওঠো ওঠো, বসো না, বসো না -! কেউ বিরক্ত হবে। বাইরের আত্মীয় কুটুম হলে তারা হয়তো ঠাকুমাকে চেনে না, তারা দুকথা শুনিয়ে দেবে। ঠাকুমা সব উষ্মাকে তুড়ি মেরে, স্রেফ কালা সেজে বসে পড়বে। আমার লজ্জা লাগলেও কিচ্ছু করার নেই তখন। চারধারে কেবল কালো কালো মাথা। ফেরার উপায় নেই। পিছন থেকে আওয়াজ আসছে বসো গো – বসো গো -! ঠাকুমাও ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিয়ে বসে পড়বে ঠ্যাঙ ছড়িয়ে। পাশে লন্ঠনটি নিভু নিভু মাপে কমিয়ে রাখবে। আমি ঠাকুমার গায়ে গা লাগিয়ে।

    মজা হচ্ছে, একটু পরেই বৃদ্ধাটি আবশ্যিকভাবেই ঢুলতে শুরু করবেন। যখন খুব ঝ্যাম্প্যারাপ্যার বাজনা বেজে উঠবে, খুব উচ্চকিত ডায়লগ, হাসি বা তরোয়ালের ঝনঝন – ঠাকুরমাও চটকা ভেঙে ঝুঁকে পড়া মাথা সোজা করে ধড়মড়িয়ে ঘুমমাখা চোখ খুলে তাকাবে। এরপর কিছুক্ষণ জোর করে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা, যদিও তাতে কোনো ফল হবে না। যুগপৎ চলতে থাকবে ঢুলুনি ও চোখ খুলে রাখার চেষ্টা। যাত্রা শেষ, আমরা ঠাকুমা নাতনি পিছনের ধুলো ঝেড়ে লন্ঠনের দম বাড়িয়ে বাড়ি ফিরে নিশ্চিন্তে লেপের তলায় ঢুকে পড়ব। গল্পটা এভাবেই শেষ হয়ে যায়। যাত্রা দেখা বিষয়ে যে প্রচলিত গল্পটা ব্যাপারটা সেরকম হয় না।

    এক বৃদ্ধা যাত্রা শুরুর অনেক আগে গিয়ে দেখলেন একটা আলো জ্বলছে, কোনো তোড়জোড় নেই। নাতিকে নিয়ে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলেন। এদিকে যাত্রা শুরু হল, শেষও হল। তিনি তখনও ঘুমিয়ে। আচমকা ঘুম ভাঙতে দেখতে পেলেন কেউ কোত্থাও নেই, সেই একটাই আলো। খুব বিরক্তির সঙ্গে উঠে পড়ে নাতিকে বললেন, চল চল, বাড়ি যাই। যাত্রা আর হবে না, ঢ্যামনাদের একটাই আলো।

    আমার ঠাকুমার ব্যাপারটা অতটাও খারাপ নয়। তবে পরেরদিন মা জ্যেঠিমা – যাত্রা কেমন দেখলেন, মা? জিগ্যেস করলে মৃদু ধমকে অন্য কথা পেড়ে ধামাচাপা দিতে চাইবেন ভদ্রমহিলা।

    বাইরে থাকা গাঁয়ের সব লোক বাড়ি ফেরে এই বরোয়ারি পুজোয়। যে যেখানেই থাক। আত্মীয়স্বজনের আগমনে গোট গ্রাম গমগম করে। চারদিন একেবারে আল্লাদের টঙএ।

    পৌষমাসে পৌষ পার্বণের পর মাঘমাসে ধান ঝাড়া খামার সারা হলে একটি শুভ দিন দেখে মাঠে রান্না উৎসব। বীজ ধান ফেলা, ধান র‌োয়া থেকে ফসল তোলা পর্যন্ত যে দীর্ঘমেয়াদি পরিশ্রম থাকে কৃষকের, এই উৎসব যেন তারই ক্লান্তি অপনোদনের, এক আরামের অবসর। সর্বজনীন বনভোজন।

    সকালে মাঠে গিয়ে জমির আলে উনুন কেটে, যে যার মতো রান্নার জায়গা পরিষ্কার করে আসবে। রান্নায় মাছ রাখতেই হবে। গ্রামের সকলের রান্না খাওয়া সারা হলে বাড়ীর মহিলারা স্নানান্তে পরিস্কার কাপড় পরে ঘটিতে জল নিয়ে সংকীর্তন দলের সঙ্গে গ্রাম পরিক্রমা। শেষে সবাই হাজির হবে আটচালায়। সেখানে মন্দির পরিক্রমা শেষে সংকীর্তন দল একেবারে পাগলের মতো লম্ফঝম্প করে নেচেগেয়ে ক্ষান্ত দেবে। মহিলারা ঠাকুরদুয়ারে ঘটির জল ঢেলে আাবার তা তুলে নেবে শান্তিজল হিসাবে। বাড়িতে ফিরে সবার মাথায় ছেটাবে সে জল।

    উৎসব কখনও ফুরোয় না। party never ends. মাঘী সংক্রান্তিতে হবে শীতলা পুজো। ফাল্গুন মাসে দোল যাত্রায় অষ্টপ্রহর। আর শেষ মাস চৈত্রে গাজন। এ মাসে আর একটি রীতি আমাদের গাঁয়ে। আলুনি খাওয়া। প্রত্যেক বাড়ির একজন মেয়ে বা মহিলা উপবাস থাকবে। বোঁয়াইচন্ডী যাবে। গ্রাম ষোলোআনাই সেদিন উপস্থিত থাকবে বৌঁয়াইচন্ডী মায়ের পুজোয়। স্নান, পুজো ও বলী শেষে উপবাসী মেয়েরা সবাই আলুনি খাবার খাবে। তবে সেই আলুনি খাবারে আটা ময়দা বা ভাত চলবে না। গ্রামে ফিরে আবার সারাদিন পুজো। বিকেলে ঠাকুরতলায় উপবাসী মেয়েরা আলুনি মুড়ি, অন্যান্য আলুনি উপকরণ দিয়ে খেয়ে সেদিনের মতো খাওয়া শেষ করবে।

    এসব রীতি উৎসবে আর কেই বা তেমন করে যোগ দেয়! নিয়ম রক্ষার্থে যতটুকু। আমি কতদিন এসব চোখে দেখি না। তবু স্মৃতির ভেতর বিবর বানিয়ে এসব নিয়ে বেঁচে থাকা আমার। এর ভেতর দিয়েই একটু একটু করে আজ এই জায়গায় এসে পৌঁছেছি, সে কথা ভুলি না। অতীতচারণায় সবই ভেসে ওঠে শান্ত জলের উপর।


    (ক্রমশঃ)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১০ ডিসেম্বর ২০২২ | ১০৫৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • নন্দিতা পাল। | 2409:4061:2d18:7022::4389:***:*** | ১৮ ডিসেম্বর ২০২২ ১২:৫০514705
  • দারুণ লাগছে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন