সন্দীপনের ব্যাপারে শান্তা কিছুই ভাববার অবকাশ পেল না বাড়ি এসে। সিদ্ধান্ত নেব বললেই আসলে নেওয়া যায় না, কার্যকারণের ঠিকঠিক সংযোগ হলে তবেই না একটা ঘটনা ঘটে ওঠে! বাড়ি এসে ওর মাথা থেকে সব বেরিয়ে গেছে, কিংবা বের করে দিয়েছে সে। শেকড়ে লেগে থাকা মাটির গন্ধমেশা এই খুশি খুশি পরিবেশটাকে ও উপভোগ করার ভেতর কোনো জটিল ভাবনায় ডুব দিতে চাইল না। বরং তার ভাবুকমন পুরোনো দিনগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগল।
শেষ রাতে দু-চার ফোঁটা বৃষ্টি হয়েছিল, সকালে দেখল কেবল ধুলোটুকুই মরেছে। গ্রামে টানা ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি কতদিন দ্যাখেনি শান্তা।
টানা তিন দিন, চার দিনের বাদুলেবৃষ্টি তো ইদানীং আর চোখেই পড়ে না। মানুষের তৈরি সভ্যতা নামের ছ্যাবলামো প্রকৃতিকে প্রতিদিনই পাল্টে দিচ্ছে বটে, তবে সবটা পারবে না, কারণ প্রকৃতি অমোঘ।
মানুষ জন্মায় একটা বড়ো শূন্য নিয়ে, তারপর কেবল হাঁকড়পাঁকড় করে নিতে গিয়ে নেবার পাগলামোতে বুঁদ হয়ে তাকে। আর এরই ভেতর আবার সে একটা মহাশদন্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে কথা বেমালুম ভুলে যায়। সবকিছু থাকে, কিছুই সে পাল্টাতে পারে না। জল মাটি গাছ লতাপাতা অরণ্যের প্রাণীকুল – মহাকাশের ওই জ্যোতিষ্কমন্ডলী সব মিলিয়ে স্বয়ম্ভু এই বিশ্বজগৎ - তাকে বিষাক্ত করতে পারে, ক্ষত-বিক্ষত করতে পারে বটে, কিন্তু পাল্টাতে পারে না। ঘা খেতে থাকা – সহ্য করতে থাকা এক অটল ও বিরাট অস্তিত্ব একসময় মানুষকে ঝাঁকুনি দিয়ে ঝেড়ে ফেলে দেয় ।
ছেলেবেলার বর্ষা মনে পড়ল শান্তার - ভোর থেকে বৃষ্টি নেমেছে। বান না হয়ে যায় না- বাড়িতে বড়রা বলাবলি করছে। পশ্চিম দুয়ারী ঘরের জানলা থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখি পুকুরের জল একেবারে পাড় ছুঁয়ে ফেলেছে। টলটলে পুকুরের জলে বৃষ্টির বড়ে বড়ো ফোঁটাগুলো পড়ে প্যাঁটারি ফুলের বীজ বা ফলের আকারে ফেটে পড়ছে। প্যাটাঁরির শুকনো ফল দিয়ে কার্তিক মাসে ভাইফোঁটার পরের দিন যে গো-পরবে গরুর পিঠে গিরিমাটি গুলে ছাপ দেওয়া হয়, সেই ফলের মতো বৃষ্টির ফোঁটাগুলো। কখনও মনে হচ্ছে অনেক দূর আকাশের তারার মতো বৃষ্টির ওই ফোঁটা।
দূরের বাঁশবন, গাছপালা, বাড়িঘর তখন কুয়াশায় মোড়ানো।কুয়াশার ভেতর অন্য চলাচল আমাদের অজান্তে জেগে ওঠে। অন্য এক জগত, যা ঝাপসা, জলছবির মতো। সেখানকার অবস্থান, ছায়া সবই শব্দমুখর হলেও সে শব্দ কিন্তু কানে শোনা যায় না। পোকা মাকড় কথা বলে, মাছেরা কথা বলে, তাদের ভাষা কি আমরা বুঝি? সে অন্য পৃথিবী, পৃথিবীর ভেতরের পৃথিবী। একই সঙ্গে দু জগতে দুরকম ভূমিকা পালন করছে সমস্ত কিছু। কোনোটাই আসল বা নকল নয়, দুটোই সমান সত্যি। বহুদিন পর নিজের ঘরে শুয়ে মনে পড়ল সে একসময় এমন করেই ভাবত সবকিছু নিয়ে।
খানিক বেলা হতে বৃষ্টি কিছুটা ধরে এলো। এখনও পুরোপুরি ছাড়েনি, ঝিমঝিম করে হয়েই চলেছে। সকাল থেকে মা-জ্যেঠিমা ভিজে ভিজেই কাজ করছে, ঘাটে যাচ্ছে। মাথায় তালপাতার ‘পেকে’ থাকলেও এমন প্রবল বৃষ্টিতে জামাকাপড় ভিজবেই।
দশটা, সাড়ে দশটা নাগাদ মা ডাকল, “শানু! একবার মাঠে যাবি? শেতল জলখাবার নিতে এসেছে। ও সবটা নিতে পারবে না, তুই কিছুটা মাথায় ধরে নে।”
আমি তো চারপায়ে খাড়া! বেরোতে যাচ্ছি, জ্যেঠিমা ডাকল, “ও শেতল, বিনুর খাবার জল নাও! ওকে খালের জল খেতে হবে না।” কাকু বিনোদবিহারী সবার সাথে একই জলখাবার খাবে। শুধু জলটা তার আলাদা।
রাস্তায় এঁটেল কাদা, কোথাও বা তা গলে পাঁক হয়ে গেছে। পায়ের পাতা তো ডোবেই, হাঁটু বা দাবনা ডুবে যায় কাদায়। গ্রামের বাইরে এসে অবাক হয়ে গেলাম। চারদিক জলে ধূ-ধূ করছে। জমির রোয়া ধানগাছগুলো জলের তলায় চলে গেছে। আল আর জমি একাকার। কোথাও কোথাও ধানগাছের সবুজ মাথাগুলোর উঁকিঝুঁকি।
শেতলদা বলল, “বুড়ি, জামবাটি মাথায় নিয়ে এই জলকাদায় তুমি হাঁটতে পারবে না। কাকিরা তোমাকে খামকা পাঠাল। দাও দি’নি, আমাকে দাও।”
পরপর বসানো কয়েকটা সানকি ভর্তি মুড়ি কাপড় দিয়ে বেঁধে জ্যেঠিমা আমার মাথায় চাপিয়ে দিয়েছিল। শেতলদা সেটার বাঁধনের ভেতর দিয়ে হাত গলিয়ে ঝুলিয়ে নিলো কনুইএর কাছে, কনুই ভেঙে মাথার বোঝা ধরে আছে। অন্য হাতে জলের পাত্র।
আমি তার পিছন পিছন হাঁটি। আছাড় খেলেও অসুবিধা নেই, নরম কাদায় ব্যথা লাগবে না। ভিজেও গেছি। কোনো কোনো আল জেগে আছে। সেখানে আধসেদ্ধ সাবুদানার মতো জমাট বাঁধা শামুকের ডিম। শামুক, কাঁকড়া অজস্র চলে বেড়াচ্ছে। ব্যাঙ লাফাচ্ছে। কখনও জমির জলের ভেতর দিয়ে কিলবিলিয়ে চলে যাচ্ছে ছোট ছোট মাছ।
মাঠে কোথাও রোয়া চলছে, কোথাও বীজ টানা। তারপর আঁটি বেঁধে বীজ মাথায় তুলে কামিনেরা সারি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অন্য জমিতে।রামকিঙ্করের আঁকা ছবি যেন রেখায় আর ধূসর পাটকিলে রঙে। তাদের দ্রুত পায়ে চলার মধ্যে ছোটার আদল। বাঁকুড়া পুরুলিয়া থেকে আসা কর্মরত কামিনদের শরীরে যেন একটু বেশি ছন্দ।ওরা খুব হাসিখুশি হয়। নিজেদের মধ্যে কথা বলে, কখনও সাঁওতালি গানের ঐকতান ওঠে। সুর ছড়িয়ে ভিজে যাওয়া প্রকৃতিকে আনন্দমুখর করে তোলে তারা। কেউ মই চালাচ্ছে জমির কাদাজল চৌরস করার জন্য । আর একজন সেই মইএর উপর বসা। ভার পেলে মই ভালো বসবে, জমির কাদা সমান হবে ভালোভাবে।
কিঙ্কর পাঁজা আসছেন একটা ঢাউস কালো ছাতা মাথায় দিয়ে। পাশ কাটানোর সময় অযথা আমায় পাশ থেকে ঠেলা দিলেন এমন, যেন যেতে গিয়ে লেগে গেছে। আমি হুমড়ি খেয়ে জমির জলে পড়ে গেলাম। ভাগ্যিস কাছে জলখাবারগুলো ছিল না! তাহলে এক কান্ড হতো। বাড়ি ফিরে গিয়ে আর এক প্রস্থ খাবার আনতে হতো। সেই সঙ্গে ঠাকুমার বকুনির ফাউ জুটত। শেতলদা চেঁচিয়ে উঠল, “কিঙ্করদা! এত জায়গা পেয়েও কুলোলো না তোমার? ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে মেয়েটাকে?”
এ কথায় লোকটার হেলদোল হল না, যেন কিছুই হয়নি, শুনতেই পাননি – এমন করে হেঁটে চলে গেলেন। ঘটনাটা আমি কোনোদিন ভুলতে পারলাম না।
কিঙ্কর পাঁজারা গাঁয়ের অন্যতম ধনী এখন। চিরকালই তাদের অঢেল টাকাকড়ি। ইদানীং কীসব ব্যবসা শুরু করেছে তাদের ছেলেপুলেরা। ফুলে ফেঁপে উঠেছে আরও।কয়েক বছর হল বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেছেন। ঠাকুর দেখতে যেতে পারে গাঁয়ের সবাই, তবে ভোজে সবাই নিমন্ত্রণ পায় না। জ্যেঠুর সঙ্গে খুব খাতির ছেলেবেলার বন্ধু হওয়ার সুবাদে। প্রায় দিনই জ্যেঠু বাড়ি ফিরলে, অনাদি ফিরেছিস নাকি? বলতে বলতে এসে দুয়ারে বসে পড়েন।
বাড়িতে আড্ডায় এসে বলেন, “বউদি, মিনতি – তোমরা যেও কিন্তু। পুজোর চারদিনই তোমাদের নেমন্তন্ন”।
পরে তাদের বাড়ির কেউ গ্রামে নেমন্তন্ন করতে বেরোলে আর এক প্রস্থ এ বাড়িতেও বলে যায়। তবে কাকিমা জ্যেঠিমা কখনও যায় না, হয়তো অষ্টমীর খ্যানের সময় একবার গিয়ে প্রতিমা দর্শন করে প্রণাম করে এলো। আমি নিজেও কখনও যাইনি পাত পেড়ে খাবার নেমন্তন্নে। ওনার স্ত্রী আর ভাদরবৌ গঙ্গাধরের পুজো দিতে এলে একবার আসবেই আমাদের বাড়ি, খানিক গল্পটল্প করে যায় চা খেতে খেতে। এই হৃদ্যতার ও সৌহার্দ্যের সম্পর্ক যেখানে দুই পরিবারের মধ্যে বহমান, সেখানে তাঁর এমনতর আচরণের ব্যাখ্যায় তাই ভেতরে বসে থাকা বিদ্বেষ খোঁজা ভুল বলে মনে হয় না আমার।
এখন এমন ভাব করলেন যেন চেনেনই না। স্বভাবগত বিদ্বেষ, নাকি অন্য কিছু? সেই বয়সে বুঝিনি বটে, এখন মনে হয় - পুজোর সময় গাঁয়ে বস্ত্রবিতরণ করতে গিয়ে নীচুজাতের সবাইকে কাঙালের দলে ফেলে দিয়েছিলেন ওনারা। অনেকের আঁতে লেগেছিল খুবই। আর্থিক বিচারে, বা অকুলীন জাতপাত দিয়ে যে সবার আত্মমর্যাদা মাপা যায় না – সেটা ক্ষমতাবান থেকে শাসক কেউই বুঝতে পারে না। অকারণ অর্থক্ষয় করে আনুগত্য পেতে চায় আসলে। যাদের দরকার তাদের দিলে অন্তত জনগনের চোখে অকারণ কোনো কোনো “সিড্যুল”কে অপমানিত হতে হয় না। পাঁজাদের সম্পর্কেও তাই কেউ কেউ বলেছিল, টাকার গরম।
কিঙ্কর পাঁজা চলে যাবার পরও শেতলদা গজগজ করছিল রাগে। আমি তাকে থামানোর জন্য ডাকি, “ও শেতলদাদা! আমাদের কোন্ জমিতে কাজ হচ্ছে গো? কাকুকে দেখতে পাচ্ছি না তো!”
একদিকে আঙুল তুলে দেখাল সে। “ওই দ্যাখো, একটু দূরে – বাঁদিকে। মাথায় কেমন লাল গামছাটা কায়দা করে বেঁধেছে দেখতে পেয়েছ?”
এবার খেয়াল করি। ওই তো কাকু! মুনিশদের কিছু নির্দেশ দিচ্ছে।
বৃষ্টি সারাদিন প্রায়। সন্ধ্যেবেলা মা খুক-খুক করে কাশতে লাগল। ঠান্ডা লেগেছে নির্ঘাৎ। ঠাকুমা বললেন, “মেজ বৌমা, তুমি আাদা দিয়ে একটু গরম গরম চা খাও।”
কিন্তু মায়ের বুকে সর্দি বসে গেল। সারাক্ষণই কাশে। সঙ্গে ঘুষঘুষে জ্বর।মা কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে দিনদিন, শুকনো হলদে পাতার মতো হয়ে থাকল মা। গাছ থেকে যেন যে কোনো সময় ঝরে পড়বে সেই হলদে পাতা।মা খায় না ঠিক করে। মুখে রুচি নেই।শরীর দুর্বল, জ্বর বাড়ে কমে, শুয়ে থাকে অনেক সময়।বাড়ির সব কাজ জ্যেঠিমাকে করতে হচ্ছে দেখে মা জোর করে করতে যায়। পেরে ওঠে না, আর বকুনি খেয়ে মরে সবার কাছে। আমার অমন মমতাময়ী জ্যেঠিমা সংসারের চাপে কখনও বিরক্ত হয়ে উঠলেও মায়ের প্রতি অগাধ মমতা। এত কাজের ভেতরেও মায়ের খেয়াল রাখেন সে মহিলা।
এদিকে যার বেশি খেয়াল রাখার কথা তিনি চিরউদাসী। বাবার কপালে অদৃশ্য ভাঁজ পড়লেও বাইরে অবিচল। মায়ের ব্রঙ্কো-নিউমোনিয়া হলো। প্রথম থেকেই ডাক্তার দেখানো হয়েছে বটে, তবে রোগ যে গুরুতর প্রথমটায় ঠাওর হয়নি। সবাই ভাবল ঠান্ডা লেগে সাধারণ সর্দিকাশী, ও আরমান স্যারের দু-দাগ কুইনাইন খেলেই সেরে যাবে। ওষুধ চলছিলই। কাজ হচ্ছে না দেখে ডাক্তার পাল্টানো হলো। বর্ধমানের নাম করা ডাক্তার মাকে দেখলেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না।
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বিছানার পাশে বসে থাকতাম।খেয়েছি কিনা, পড়াশোনা করেছি কিনা মা জানতে চাইত।বেশি কথা বলত না।খুব বলিয়ে কইয়ে তো মা কোনদিনই নয়! মায়ের কথা বলার শক্তি ছিল না। একদিন বলল, “ভাইয়ের খেয়াল রাখিস।”
মা কিন্তু থাকল না। দু-এক মাসের মধ্যেই চলে গেল। মায়ের সঙ্গে মনে মনে কত ঝগড়া করলাম। রোজই ঝগড়া করতাম। কেন চলে গেলে, মা? কেন? আমাদের কথা ভাবলে না! কোথায় গেলে তোমাকে আবার দেখতে পাব?
মায়ের ছোট্ট, শ্যামলা কপালে সিঁদুর টিপ কুসুম-কুসুম ঊষাকালীন সূর্যের মতো। কত তাড়াতাড়ি তা গোধূলিতে অস্ত গেলো! বিকেলে মা আর জ্যেঠিমা গা ধুয়ে, ধোয়া কাপড় পরে দাওয়ায় চুল বাঁধতে বসত। পরস্পরের চুল বেঁধে দিচ্ছে এই সুখকর দৃশ্যটা দেখতে পাই। ওই সময়টুকুই ছিল তাদের বিশেষ, নিজস্ব। এটুকুই বিনোদন। কারও ইচ্ছা-অনিচ্ছার অধীনতার বাইরে ওই কিছুটা সময় যেন নিজের মনে ফুটে ওঠা শিউলি গুচ্ছ, আর নিজের মনে ঝরে পড়া।
আমি বনে-বাদাড়ে ফুলফল তুলে বেড়াতাম - কোথায় বেজির গর্ত, কোথায় সাপের খোলস, কোন ঝোপে কোন গাছ, তাদের আলোছায়ার সঙ্গে কেমন অচেনা নতুন দেশে এসে পড়ার বিস্ময়। যা দেখি, সবই অনির্বচনীয়। বেজির গর্ত দেখে মনে হতো পাতালের বামনের দেশ পর্যন্ত চলে গেছে ওই গহীন সুড়ঙ্গ। সেখানে যক্ষের পুরী, নাকি পৃথিবীর অতল তল কে জানে? কিছু প্রশ্নের উত্তর না পাওয়াই ভালো। কল্পনায় অজস্র সম্ভাবনা মনকেও দূরগামী করে। ঝড়ে পড়া জাহাজের মাস্তুলে উড়ে এসে বসা অ্যালবাট্রস, যে এনে দেয় আশার আনন্দ, এনে দেয় গভীর পর্যটনের স্বাদ আর বয়ে আনে সুগভীর বেদনার মতো বহু দূর অভাবনীয় সমুদ্রের পেটের ভেতরের নতুন গন্ধভরা বাতাস, বিপদগ্রস্ত নাবিকের যে পথপ্রদর্শক। সেসবই ভাষার অতীত। আমার ঘোরাঘুরিতে বিরক্ত মা বকাবকি করত। ভয় পেতো কবে অপঘাতে মরেই যাব।
আমার কিচ্ছু হয়নি, মা! আমি তো বড় পুকুরের জলে শুনশান দুপুরে গা ডুবিয়ে বসেও থাকতাম। পুকুরের মাঝখানে একদম নীচে নাকি জাঁট আছে। সে নাকি একলা কাউকে পেলে জলের তলায় টেনে নেয়, অথচ সে যে কী বস্তু সে কেউ ঠিকঠাক করে বলতে পারে না আর আমিও জানতাম না। অথচ আমার গা ছমছম করত। তবে ভয় পেতাম না, বরং ভয়-ভয় তরাসটা বেশ উপভোগ করতাম।
কেউ কোত্থাও যখন নেই ভর দুপুরে, তখন পুকুরের ঈষদুষ্ণ জলে গা ডুবিয়ে উঁচু পাড়ের দিকে তাকালে খালি আকাশ আর দু-একটা গাছের মাথা। গাছের মাথাগুলোকে মনে হতো কারো বিরাট হাতের পাঞ্জা। সেই বিরাটকে চোখে দেখা যায় না, শুধু একটা অনুভূতি জাগে সেই বিরাটত্বের। তার হাত আমাকে ক্রমাগত বলতে থাকে, কেউ কখনো একা হতে পারে না --- কেউ কখনও ---। কেউ না কেউ তোমায় দেখছে। তোমার পাপ, তোমার পূণ্য – সব, সব কিছু। পিছু ফিরলে যেমন তেমার পিঠে তোমার মায়ের স্নেহময় অদৃশ্য চোখদুটো আঁকা থাকে, ঠিক তেমনই। তুমি কিছুই গোপন রাখতে পারবে না। একান্ত গোপন যা মনে করছ, তা দেখছে এই নির্জন পুকুর, নিথর জল, জলে ভাসমান আকাশ, ওই গাছের পাঞ্জা। আমি সেই গাছের ডালপালার দিকে তাকিয়ে ভাবতে চেষ্টা করতাম কী আমার গোপন। সত্যি কি কোনো গোপন আছে? আছে তো! গোপনে একজনের চিঠি আর একজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া আছে, গোপনে তেঁতুল চুরি করে খাওয়া আছে, আর নব বিবাহিত আত্মীয় দম্পতির গোপন প্রেমালাপ ঘটনাচক্রে শুনে ফেলা আছে। এসব কেউ জানে না, তবু পুকুরের জলে গা ডুবিয়ে বসে থাকতে থাকতে মনে হলো বিরাটের সামনে সব যেন প্রকাশিত।
জলে আমি অনেকক্ষণ ডুবে থাকতে পারি। ডুবে থেকে দেখেছি সেখানে কেমন অন্যরকম আলো। বস্তুর ছায়া সেখানে বাড়তি রহস্য তৈরি করে, সময় থেমে থাকে সেখানে।
বড় পুকুরের উত্তর-পশ্চিম কোণে একটা তাল গাছ জলের উপর নৌকোর খোলের আদলে চলে এসেছে। সেখানে জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকি। বিকেলের খেলুড়েরা এলে জায়গাটা সরগরম হয়ে ওঠে।
পুকুর পাড়ে বনঝোপ। ঝাঁটিফুল ফুটে থাকে, সেঁয়াকুলের গাছ। এসব অ-জায়গায় আমার ঘোরাঘুরি। মা তো ভয় পাবেই! অথচ সব ভয় সঙ্গে নিয়ে মা চলে গেলো।
ঝিমলিদের বাড়ির পিছনের বাগানে একটা আঁজিরের গাছ। তাতে চড়ে বসে ঝিমলি আর আমি একটার পর একটা আঁজির পেড়ে পেড়ে খাচ্ছি। বাইরেটা সবুজ, এক কামড় খেয়ে ভেতরে তাকালে – মিষ্টি একটা গোলাপি রঙ, কখনও বা সেটা লালচে ঘেঁষা। পোকা থাকলে ফেলে দিই ছুঁড়ে, কম পাকলে ঈষৎ কষা। সেও ফেলে দিই। পাকা, পুষ্ট আঁজিরগুলো ভীষণ মিষ্টি। গাছে সেই আঁজির ফলেও অজস্র। মনে হলো আমার মায়ের মন যেন ওই আঁজিরের মতো; বাইরে এক, ভেতরটা পুষ্ট আর টুকটুকে।
গাছে বসে আঁজিরে কামড় দিয়ে ঝিমলি বলল, “শানু! পূণ্যিপুকুর করবি?”
“ব্রত? কীকরে করে জানি না তো!” আমি বললাম।
“শিখিয়ে দেব রে, বোকা!” হাতের পোকা ধরা পেয়ারাটা ছুঁড়ে ফেলল সে।
“কী হয় এই ব্রত করে?” আমার জিজ্ঞাসায় ঝিমলি বলে বসল, “পিতৃকুল মাতৃকুলের মঙ্গল হয়। পরের জন্মে দেখবি তোর বাবা-মা আর মারা যাবে না।”
আমি কেঁদে ফেললাম, আর আধখাওয়া আঁজিরধরা হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে আমার চোখের জল মুছিয়ে দিতে চাইল ঝিমলি। পরজন্ম কী সেই প্রশ্নটা চাপা পড়ে থাকল অবশ্য।
ব্রত নয়, ওর আয়োজনটা আমায় টানল, আর ঝিমলির কাছে শোনা কথাটা। এই ব্রত করলে সত্যিই যদি পরজন্মে মা-বাবাকে অকালে হারানো থেকে রেহাই পাই! তুলসীতলার কাছে সামান্য গর্ত কেটে, মাটির বাঁধ দিয়ে হলো পুকুর। একটা কুল কাঁটা পুঁতে দেওয়া তাতে। আরও কীসব আচার ছিলো, ভুলে গেছি। শুধু ব্রত করার কথাটাই মনে আছে।
কুল-কুলতি ব্রত করলাম সেবার, বোধহয় ওই কার্তিক মাসেই। মাঠ আর বন ঝোপ থেকে ঝাঁটিফুল তুলে আনলাম। মধুফুল, আসলে কুলেখাড়া গাছের ফুল -সেই ফুল তুলে বোঁটার সঙ্গে লেগে থাকা অংশটা মুখে লাগিয়ে টানলে সত্যিই মিষ্টি স্বাদ পেতাম। মধুফুলও তুলতাম কুলকুলতি ব্রতের জন্য। ব্রতের জন্য কুলপাতার দরকার হতো। কার্তিক অঘ্রাণে কুলগাছে ফুল আসে। কী সুন্দর গন্ধ তার! কুলপাতা তুলতে গিয়ে সেই গন্ধে কেন জানি না মায়ের কথা মনে পড়ল।
এখনও কুলফুল আর তার পাতার গন্ধে নস্ট্যালজিয়া ছেয়ে আছে। সবই অতীত হয়ে যায়। শুধু স্মৃতির ভেতর মানুষ টিকে থাকে।
(ক্রমশঃ)