যশপতি সিংহের বুকের মধ্যে অনেকগুলো কাশফুল ডিজে মিক্সের তালে নাচছিল। পুজোর বাকি আর মাত্র কয়েকদিন। আজ আমদানি ভালই হল। দু'লাখ লাগিয়েছিলেন সকাল সাড়ে নটায়। বারোটার মধ্যেই বেড়ে হয়ে গেল দু'লাখ আশি। মানে ফর্টি পার্সেন্ট। শেয়ার বাজার কি জয়! প্রাণ ভরিয়ে ঝিঙ্গালালা ধ্বনি বাজছিল। অ্যাপ থেকে অর্ডার করে বিখ্যাত দোকানের কিং সাইজ বিরিয়ানি আনালেন। সাঁটিয়ে খেলেন। সঙ্গে ছিল মাটন চাঁপ, স্পেশাল রায়তা আর ফিরনি। তার পরে গ্লাসে কোল্ড ড্রিঙ্ক ঢাললেন। দু-প্যাকেট জলজিরা মেশালেন। গ্লাসের অন্তঃস্থল থেকে উঠে এল আনন্দ বুড়বুড়ি। কতটুকু গুঁড়োয় কি পরিমাণ বুদবুদ। ঠিক যেন শেয়ার বাজার। ধরতে জানতে হয়। ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সটা আরও একবার দেখে নিলেন। এক কোটি ছাপ্পান্ন লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার সাতশ সাতাত্তর। যাবতীয় টাকাপয়সা একটা অ্যাকাউন্টেই রাখেন। দেখতে বেশ লাগে। কোল্ড ড্রিঙ্ক পেটে পড়ার পরেই ঘর কাঁপিয়ে আহ্লাদি ঢেকুর তুললেন বার-তিনেক। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। রিমোটটা দিয়ে এসির তাপমাত্রা আরও চার ডিগ্রি কমিয়ে দিলেন। কুড়ি থেকে কমে হল ষোলো। পঁয়ষট্টি ইঞ্চির এলসিডি টিভিটা অন করলেন। এবারে একটা ওটিটি সিরিজ দেখবেন। বিকেল ছটা পর্যন্ত নিশ্চিন্ত। তার পরে আবার অন্য মজা। আইস কিউবগুলো সাজুগুজু করে তৈরি হয়ে যাবে এর মধ্যে, ডিপ ফ্রিজারে। তখন আবার হোম থিয়েটারে হানি সিং বাজবে।
এমন সময় কলিং বেল বাজল। মস্তির সময়ে অস্বস্তি একেবারে ভাল লাগে না যশপতি সিংহের। এখন তো কারও আসার কথা নয়। আর না বলে কয়ে এলে তো কমপ্লেক্সের সিকিউরিটি আটকে দেবে। ফোন করে পারমিশন নেবে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে যশপতি দেখলেন, একটা কিম্ভুতকিমাকার লোক দাঁড়িয়ে আছে। বডি পুরো নীল। চারটে হাত। মাথায় মুকুট। গলায় বিচিত্র সব হার। হাতে একটা ডান্ডা। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, লোকটার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা মহিষ। ভুল দেখছেন না তো? নিজের গায়ে চিমটি কাটলেন একবার। কই না তো! স্বপ্ন দেখছেন না তো? আরেকবার অ্যাপ দিয়ে ব্যালেন্স চেক করে নিলেন যশপতি। এক কোটি ছাপ্পান্ন। ঠিকই তো আছে। আশি হাজার প্রফিট মর্নিংয়ে, ডিম্যাট থেকে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে দিয়েছেন চটজলদি। দেওয়ালে রাখা এক্সটেনশন থেকে সিকিউরিটিকে ফোন লাগালেন। সে আবার বিহারের মানুষ। যশপতি চিল্লিয়ে বললেন, “দুপুরবেলা ইয়ে সব জোকারকো কৌন অ্যালাউ কিয়া? সাথ মে এক মহিষ ভি হ্যায়।” সিকিউরিটি মিনমিন করে বলল, “স্যারজি। আপলোগ অ্যালাউ নেহি করেগা তো এক মচ্ছর ভি নেহি ঘুষেগা। ভাইরাস ভি নেহি। মনে হচ্ছে, আপনার তবিয়ত ঠিক না আছে। রেস্ট লিজিয়ে।”
বাইরে দাঁড়ানো লোকটা যশপতিকে দেখে মিচকি মিচকি হাসছে। মহিষটাও জুলজুল করে চেয়ে রয়েছে যপশতির দিকে। এর পরে যা ঘটেছিল তা এক দীর্ঘ কথোপকথন। তাই লেখাটার ফর্ম পাল্টে নেওয়া জরুরি।
-চলো যশপতি, চলো। তোমার সময় হল।
-মানে? আপনি কে বলুন তো মশাই? ফুটুন। না হলে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করো দেবো।
-তা আর হবে না যশপতি। এই তো আমি তোমার ফ্ল্যাটে ঢুকলাম। তোমার ড্রয়িংরুমে সোফায় বসলাম। আর রে মহিষসোনা, আয়। দাঁড়া এখানে চুপটি করে। পটি পেলে বলিস।
-আপনার মাথার ঠিক আছে তো?
-তা আছে বটে। আমার নামটাই তো বলা হয়ে ওঠেনি। ভেবেছিলাম চিনতে পারবে তোমাদের গুগল-এ আমার ছবিটবি দেখে। দুঃখ পেলাম।
-অ্যাই, তুই কি বহুরূপী? পয়সাকড়ির ধান্দায় হাজির হয়েছিস এই ভরদুপুরে? তিন গোণার মধ্যে বাড়ি থেকে বডি না সরালে কিন্তু ভয়ঙ্কর ব্যাপার হবে। একটা ছোট্ট জিপে করে দেবো পাড়ার দাদাকে। দশ মিনিটে পাঁচশ লোক চলে এসে ব্যাপক ক্যালাবে। দেখবি? দেখতে চাস? ইওর টাইম স্টার্টস নাউ।
-উত্তেজিত হয়ো না যশপতি। চলো যশপতি চলো। তোমার যাওয়ার সময় হল। আমার নাম শ্রী যমরাজ। মারব এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে।
-মানে? পুরো নামটা বলুন। একবার ফেসবুকে দেখেছিলাম, কোথাকার কে যেন অ্যাপে গাড়ি বুক করে দেখে, যমরাজ ইজ কামিং। কি খিল্লি মাইরি।
-হেসে নাও যশপতি। আর তো মাত্র কয়েক মিনিট। তোমার ওই মুঠোফোনে একটু আমার নামটা দিয়ে সার্চ মারো তো। দেখো তো আমার চেহারার সঙ্গে মেলে কি না।
লোকটার তো কনফিডেন্স ভয়ঙ্কর! তাও গুগল করে নিলেন যশপতি। দেখলেন চেহারা মিলে যাচ্ছে অবিকল। কিন্তু বাজিয়ে দেখা জরুরি।
-বলছি, আপনার চারটে হাতই অরিজিনাল?
-তোমার মন থেকে এখনও সন্দেহ দূর হল না যশপতি। এই দেখো, পিছনের দুটো হাত দিয়ে গোঁফজোড়ায় একবার তা দিলাম। আর সামনের দুহাত দিয়ে পাঞ্জাবীদের মতো বাল্লে বাল্লে করছি। বাল্লে-বাল্লে। শান্তি হল যশপতি?
দশ পনেরো সেকেন্ডের জন্য ভড়কে গেলেন যশপতি সিংহ। লোকটা অরিজিনাল যমরাজ! কেলেঙ্কারি। কিন্তু দ্রুত সামলে নিলেন। সাহস যোগাল এক কোটি ছাপ্পান্ন। অর্থবলের কাছে দুনিয়ার সব বল মিছে, তুচ্ছ।
-এবারে বিশ্বাস হল তো যশপতি? চলো। তোমার যাওয়ার সময় হল। টয়লেটে যাওয়ার থাকলে সেরে নাও। শেষবারের মতো।
যশপতি বুঝলেন, লোকটা ফালতু নয়। অরিজিনাল যমরাজই হাজির হয়েছেন। একটা স্যার যোগ করা জরুরি।
-স্যার যমরাজ। আমার যা চেক করার আমি চেক করে নিয়েছি। আপনি নকল নন। এক্কেবারে অরিজিনাল। তা এসে পড়েছেনই যখন, জল খান। আপনার মহিষ কিছু খাবে কি না বলুন। চেনা সব্জিওয়ালাকে জিপে করে দিলেই লাউ শাক, কুমড়ো শাক দিয়ে যাবে চার বান্ডিল। আনিয়ে দিই স্যার?
-এ সবের কোনও দরকার নেই যশপতি। চলো। তোমার যাওয়ার সময় হল।
-নেভার মাইন্ড স্যার। কিন্তু আপনার একটা মস্ত বড় ভুল হচ্ছে কোথাও। আপনি ভুল ঠিকানায় চলে এসেছেন। আর বারবার ফাটা রেকর্ডের মতো এই চলো, যাওয়ার সময় হল-টা বাজানো বন্ধ করুন প্লিজ। ভীষণ ইরিরিটেটিং লাগছে।
যমরাজের মহিষ জিভ বের করে ঠোঁট চাটল। একবার হাম্বাধ্বনি দিল। ডাকটা কেমন যেন অন্যরকম ঠেকল যশপতির কাছে। ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি হাম্বাসঙ্গীত ভেসে আসে টাইপের। হাম্বারবটা যেন ইকো হল বিশ্বচরাচরে। স্মিত হেসে ফের গোঁফে তা দিলেন যমরাজ।
-আমার কোনও ভুল হয়নি যশপতি। জীবনে যতই ব্যাটিং করো, চার মারো, ছক্কা মারো, আমিই তো আম্পায়ার। তোমায় আজকে আমি আউট দিয়েছি। আমার ইচ্ছে। চলো। তোমার যাওয়ার সময় হল।
-আপনি বললেই যে আমার যেতে হবে এমন কোনও মাথার দিব্যি কি আছে স্যার? এক কোটি ছাপ্পান্ন জমিয়েছি। এত সহজে যাওয়ার জন্য এসব করিনি স্যার। ইউ গট মাই পয়েন্ট?
-কি বোকার মতো কথা বলো তুমি। তুমি এখনও পয়সা দিয়ে জীবন মাপো? খবরের কাগজ টাগজ কি পড়ো তুমি যশপতি? আমি তো ই-এডিশনগুলো পড়ি সবই।
-খবরের কাগজ পড়ার থেকে আরও অনেক সেক্সি উপায় আছে টাইম পাস করার। ফালতু সময় আমার কাছে নেই। কিন্তু আপনি বলতে কি চাইছেন বলুন তো?
-দিনকয়েক আগে লিবিয়ায় কত লোক মারলাম জানো? ছ-হাজার। বন্যা দিলাম। মরক্কোয় ভূমিকম্প দিলাম। ওখানে তো প্রায় তিন হাজার ছুঁয়ে ফেলেছি। কোনও কোনোদিন আসলে একটু বেশি খিদে পায় তো। খেয়ে নিলাম। এই সাড়ে ন’হাজারে গরীব যেমন ছিল, বড়লোকও ছিল বহু।
-অতশত জানি না স্যার। অত খিদে পেলে আপনি অন্য কোথাও গিয়ে আরও হাজার লোককে তুলে নিন না। ঝামেলা মিটে যায়। একটা ওটিটি সিরিজ দেখব বলে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি স্যার। এবারে প্লিজ আসুন।
-একাকী যাব না অসময়ে। তোমাকেও সঙ্গে নিয়ে যাব, যশপতি। রেডি হয়ে নাও।
-আবার বলছি স্যার। ভুল হয়ে যাচ্ছে বিলকুল।
-যশপতি! তোমার তো এখন আটত্রিশ। তা, কত বছর বাঁচবে বলে ঠিক করেছো?
-টার্গেট নাইনটি নাইন। আর নব্বইয়ের আগে যাওয়ার তো কোনও চান্সই নেই।
-কি করে বুঝলে?
-মেডিকাল ইনসিওরেন্সের প্রিমিয়াম বছরে কত দিই জানেন? বিয়াল্লিশ হাজার টাকা। প্রতি বছর পয়লা জুলাই জিপে করে দিই। কত টাকার কভার বলুন তো?
-কত, যশপতি?
-এক কোটি টাকা। একের পরে সাতটা জিরো। মনে হয় একটা বিরাট বড়, পয়সা বোঝাই করা মালগাড়ি।
-বাঃ। অতি উত্তম। আর কি কি কর তুমি?
-বাইশ বছর বয়স থেকে ভিটামিন-ই ট্যাবলেট খাই। এতে কি আছে জানেন? অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। বয়স বাড়তে দেয়না একদম। আমাকে দেখে কি কেউ বলবে আমি আটতিরিশ?
-ঘুণাক্ষরেও না। দেখে তো আঠাশ-ঊনতিরিশ মনে হয় মোটে।
-মাসে আট হাজার টাকার ওষুধ খাই স্যার। কোনটাই ওষুধ নয়। সব সাপ্লিমেন্ট। এক তারিখে দিয়ে যায়। আমি জিপে করে দিই। ওই যে তাকের উপর সাদা পেটমোটা ডাব্বাটা আছে, ওটায় কি আছে জানেন? প্রোটিন গুঁড়ো। কত দাম জানেন? আড়াই হাজার টাকা।
-অতি উত্তম যশপতি, অতি উত্তম। আর কি কর তুমি?
-বছরে চার বার করে হেলথ চেক আপ করাই, শহরের এক নম্বর হাসপাতালে। দশ হাজার টাকা করে লাগে প্রতিবার। জিপে করে দিই। আমার সব রিপোর্ট নর্মাল স্যার। নো প্রেশার, নো সুগার। পালস নর্মাল। টিসি ডিসি ইএসআর সব নর্মাল। লিভার ফাংশন নর্মাল। ট্রেডমিল করার সময় ডাক্তারবাবু বললেন, আপনি তো মশাই টাট্টু ঘোড়া।
-শুনে বড় আনন্দ পেলাম যশপতি। আর কি করো?
-বছরে দুবার জ্যোতিষ দেখাই। কলকাতার বেস্ট জ্যোতিষ। গোল্ড মেডেলিস্ট। তারাপীঠ, কামাখ্যাসিদ্ধ। সবাই বলেছেন আমার আয়ুরেখা ফ্যান্টাস্টিক। সেঞ্চুরি করা কেউ ঠেকাতে পারবে না। আরও বলেছে, ষাটের আগেই আমার ষাট কোটি হবে। বৃহস্পতি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। সবসময় তুঙ্গে।
-তা ষাট কোটি দিয়ে কি করবে যশপতি? ঠিক করেছো?
-টাকা খরচ করার রাস্তার কি অভাব আছে স্যার? শেয়ারে ঢালব। ষাট কোটিটা যেন সত্তর হয় তার জন্য চেষ্টা করব প্রাণপণ।
-বাঃ। তোমার খিদে আমায় মুগ্ধ করেছে যশপতি। এই তো জীবন।
-আনন্দের কি অভাব আছে স্যার? চারদিকে কত আনন্দ। কিউআর কোডের ডটগুলোর মধ্যে পাউডারের মতো আনন্দ ঘুরে বেড়ায়। বন্দুকের মতো ক্যামেরা তাক করলেই লেন্সটা গিলে খায় সেই কোড। আনন্দের শাওয়ারে স্নান করি।
-অরূপ তোমার বাণী যশপতি। টাকা দিয়ে তো জগত কেনা যায়, কি বলো?
-এক্কেবারে মনের কথা বলেছেন। টাকা দিয়ে নয়, জিপে দিয়ে। স্ক্যান করলেই আনন্দ। জিপে করার সময় চার ডিজিটের যে পিনটা দিই, তার মধ্যে যে কি উত্তেজনা মিশে থাকে আপনাকে কি করে বোঝাই।
-বুঝলাম যশপতি। তোমার নামটা কিন্তু বেশ।
-নাম উজ্জ্বল করেছি স্যার। যশের পতি হয়েছি। এক কোটি ছাপ্পান্ন। তারপরে আবার একটা সিংহ রয়েছে দেখুন। এক বন্ধু বলেছিল, আমার নামটা উচ্চারণ করলেই নাকি টাকার বান্ডিল শাফল করার মতো আওয়াজ হয়। আমি বললাম, কতর বান্ডিল? পঞ্চাশের নয়তো? ও বলল, খেপেছিস! একেবারে পাঁচশ। কড়কড়ে নোটকা বান্ডিল। আমি খুশ।
-শোননা যশপতি! তোমাকে দিন-চারেক আগে এক মহিলা ফোন করেছিল না বোম্বে থেকে?
-তা করেছিল বটে। কিন্তু আপনি কি করে জানলেন?
-ওইটুকু খবর তো রাখতেই হয় ভাই। সবার নামে চার্জশিট, থুড়ি, রিপোর্ট তো থাকেই।
-স্যার শুনুন না, একটু জিপে করে খাবার আনাই? মনটা আর ফোনটা খুব স্ক্যান-স্ক্যান করছে। কি খাবেন বলুন।
-কথা ঘুরিও না যশপতি। বলছি, ওই মহিলা তোমার কাছে কিছু টাকা চেয়েছিল? বলেছিল, অনাথ বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করে ওদের সংস্থা। শ-দুয়েক চেয়েছিল না?
-তা চেয়েছিল বটে। তা আপনি কি করে জানলেন?
-সে প্রশ্ন থাক। দিয়েছিলে? কিউআর কোড পাঠিয়েছিল তোমায়। তাই না?
-তা পাঠিয়েছিল বটে।
-দিয়েছিলে?
-না স্যার। এগুলো ফালতু ইনভেস্টমেন্ট। রিটার্ন নেই।
-দমদম স্টেশনে সেদিন এক ভিখিরি তোমার সামনে হাত পেতেছিল। বলেছিল, দুটো টাকা দিননা দাদা। সারাদিন কিছু খাইনি। দিয়েছিলে?
-না স্যার।
-জানি তো। কি বলেছিলে মনে আছে?
-বলেছিলাম, কিউআর কোড দাও। জিপে করে দেবো।
-লোকটা যখন অসহায়ের মতো তোমার দিকে তাকিয়েছিল, মনে খুব আনন্দ পেয়েছিলে তো? তার পরের দিনই কিন্তু লাখদেড়েক টাকা শেয়ারে লাগিয়েছিলে ফের।
-না, মানে...।
-আর কিছু বলার দরকার নেই যশপতি। বলছি, এক হাঁড়ি রসগোল্লার মতো যদি মিনিট পাঁচেক পরে তোমায় একটা সেরিব্রাল দিই, ভাল লাগবে তো?
-তা পারবেন না স্যার। আমার হেলথ রিপোর্ট সব নর্মাল। ব্যাঙ্কে এক কোটি ছাপ্পান্ন।
-যদি দিই?
-অসম্ভব। ভাগ্যফল আমার কাছে ডেইলি আসে। পাঁচ বছরের সাবস্ক্রিপশন জিপে করে দিয়েছি। নিরানব্বইয়ের আগে নো চান্স। মনে কোনও প্রশ্ন থাকলেই শহরের বেস্ট জ্যোতিষকে জিপে করে দিই। পাঁচ মিনিটে কনফিডেন্স ভর্তি উপদেশ চলে আসে।
-প্যারালাইসিস করে যদি দু'মিনিটে তোমার একদিক বসিয়ে দিই?
-পারবেন না স্যার। জিপে করলে একমিনিটে চারটে ডাক্তার ছুটে আসবে।
-যদি আজ মাঝরাত্তিরে সাপে ছোবল মারে?
-হাসালে তুমি মোরে। প্রতি তিন মাসে পেস্ট কন্ট্রোল করা হয়। জিপে করে দিই।
-আমার আদেশ মেনে যদি এক্ষুণি পাঁচটা ডেঙ্গির মশা মিছিল করে এসে তোমায় কামড়ায়?
-তাও হবে না স্যার। তিনটে অলআউট আর গুডনাইট জ্বলছে ঘরে। কালকেই বারোটা রিফিল প্যাক জিপে করে কিনে এনেছি।
-যদি ভূমিকম্প দিই?
-হি হি। আমাদের কম্লেক্সের টাওয়ারগুলো ভূমিকম্প রেজিস্ট্যান্ট। ওইসব তুকতাক গরীবগুর্বোদের বস্তিতে গিয়ে করুন স্যার। আমার এক কোটি ছাপ্পান্ন।
-যদি মাল্টি অর্গান ফেইলিওর দিই? আমার খুব খিদে পেয়েছে যশপতি। তোমাকে খাওয়ার খিদে। চলো যশপতি চলো, তোমার যাওয়ার সময় হল।
-হো হো। আমার প্রতিটা অর্গান আনন্দ কিউআর কোডে মুড়িয়ে রাখা আছে স্যার। জিপে দিয়ে আনন্দ কিনে নিয়েছি।
-তা হলে উপায়?
-অন্য রাস্তা দেখুন স্যার। ভুল বাড়িতে এসে পড়েছেন মহিষ নিয়ে।
-তোমার মনে এখন কি গান বাজছে যশপতি?
-আমার মনে সারাদিন নানা গান বাজে স্যার। সব বিন্দাস থাকার গান। তবে ঝিঙ্কাচিকা বাদ দিলে একটা গান আমার বড় ভাল লাগে। প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ। একবার গাইলেই একবছর আয়ু অ্যাড হয়ে যায়। শুধু জিপে করতে ইচ্ছে করে। এক স্ক্যানে কত আনন্দ।
-যখন পড়বে না পায়ের চিহ্ন গাইতে ইচ্ছে করে না?
-ধুস। ওসব লস মেকিং গান স্যার। একটা লোক এমন অপোজিট দুটো গান লিখতে পেরেছিল কি করে কে জানে।
-চলো যশপতি, চলো। তোমার যাওয়ার সময় হল।
-আবার! বকওয়াস বন্ধ কিজিয়ে। আমি অবিনশ্বর। জিপে তোমার জন্য আমি মৃত্যু তাচ্ছিল্য করেছি।
-তুমি তাহলে যাবে না?
-প্রশ্নই নেই।
-লক কিয়া যায়ে?
-বিলকুল।
-যশপতি, ফাইভ।
-মানে?
-যশপতি, ফাইভ নাইন।
-কি সব বলছেন উল্টোপাল্টা?
-যশপতি, ফাইভ নাইন টু।
-হঠাৎ মাথাটা ঘুরিয়ে উঠল কেন স্যার? কি সব নম্বর বলছেন?
-যশপতি, ফাইভ নাইন টু সেভেন।
যশপতি সিংহের বাড়িতে আগত আগন্তুকের মহিষ এর অব্যবহিত পরে এক তুমুল হাম্বাধ্বনি দিয়েছিল। দক্ষিণ কলকাতার গর্জাস ভিলা কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় টাওয়ারের সাত তলার বিরাট অ্যাপার্টমেন্টে যশপতি সিংহ নাকি লুটিয়ে পড়েছিলেন। নট নড়নচড়ন। বুকের মধ্যে যে লাব-ডাব ধ্বনি হয়, দুম করে ব্যাটারি শেষ হয়ে যাওয়া ওয়াকম্যানের মতো তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শরীর ঠান্ডা। আগন্তুকের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল, “সমাপ্তম।” এর পরে উনি একটা হাল্কা ঢেকুর দিয়েছিলেন।
আরও শোনা যায়, আগন্তুকের মুখে জিপে-র পিন নম্বরটা শোনার পরেই যশপতি সিংহের এই অদ্ভুত সমাপতন।