বাড়িতে ঘর মোছা বাসন মাজার কাজে সাহায্য করেন যে মধ্য চল্লিশের ঝুমাদিদি, তিনি চুপিচুপি আমার ঘরে এলেন। শারদ ঢাক বাজতে বাকি আর মাত্র কয়েকদিন। কথাবার্তা হয়েছিল অনেকটা এ রকম।
-দাদা, এ বছর আমার বোনাসের টাকা চাই না। একটা আবদার আছে।
-এ আবার কেমন কথা! সারাবছর কাজ করেছো। বোনাস হিসেবে এক মাসের মাইনে তো তোমার প্রাপ্য।
-মূল্য ধরে অন্য জিনিস দেন।
-বুঝলাম মা ঝুমাদিদি। একটু সহজ করে বলো।
-দেড়শো দু'শো টাকা করে আমায় একটা নেটফিলিকের প্যাক ভরে দেন না..। ছেলেটার বড় বায়না জানেন।
-নেটফ্লিক্স! তোমার ছেলের তো উচ্চমাধ্যমিক সামনের বছরে। এখন এ সব করবে? আচ্ছা ভরে না হয় দিলাম। দেখবে কিসে?
-সরকার থেকে একটা বিরাট মোবাইল দিয়েছে দাদা। এর নাম নাকি ট্যাব। ওতেই দেখবে। এর নাম তরুণের স্বপ্ন। ভরে দেন না দাদা, প্লিজ।
শারদ আবদার ফেলতে পারিনি। এক বছরের প্যাক ভরে দিয়েছিলাম একসঙ্গে। বার্ষিক সাবস্ক্রিপশন হলে কিছু টাকা বেঁচে যায়। দিন কয়েক পরে শুনলাম, আঠারো বছরের ছেলে একেবারে ডুবে রয়েছে ট্যাবলেটে। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্কটাও, যাকে বলে পাড়ি দিয়েছে দিকশূন্যপুরে। ঝুমাদিদি চোখ মুছতে মুছতে বলছিলেন, ‘তরুণের এ কেমন স্বপ্ন গো দাদাভাই! পড়াশোনায় এমনিই লবডঙ্কা। যতটুকু করত, সব গিয়েছে। ওই ট্যাবলেট এসে বরং আমাদের স্বপ্নটাকে বানের জলে ধুয়ে দিয়েছে। ওটা বড় অভিশপ্ত যন্তর গো দাদা। ট্যাবলেট না, ওইটাকে আমি আয়লা বলে ডাকি।’ একটু থেমে, গলার স্বর অনেকটা নামিয়ে ফের বললেন, ‘ওই যন্তরে কি করে পড়াশোনা করতে হয় জানেন? ছেলেকে তো তা করতে দেখলাম না কোনোদিন। কি সব পাকা পাকা সিনেমা দেখে কানে ছিপি গুঁজে। তার নাম নাকি ওটিটি।’
সমাজ চিত্র বলে, ট্যাবলেট তার কাজ করে গিয়েছে নীরবে নিভৃতে। গায়ের মধ্যে সামান্য যে আঁচড় পড়েছিল, তা এখন ঘা হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষেত্রেই। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের টেস্টের খাতা দেখে শিক্ষকদের চোখ কপালে উঠেছে। বিদ্যায়-বুদ্ধিতে-জ্ঞানে এমন বহু পরীক্ষার্থী হার মানিয়েছে বেসরকারি স্কুলে পড়া পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণীর পড়ুয়াদেরও। টেস্টের ফলাফল দেখে আক্ষরিক অর্থেই ভীত ও সন্ত্রস্ত শিক্ষক শিক্ষিকারা বলছেন, ‘টেস্টেই যদি এমন হাল হয়, ধারাবাহিক পড়াশোনার এই যদি নমুনা হয়, বোর্ডের পরীক্ষায় যে ভরাডুবি হবে।’ জানতে পারলাম, কল্পতরুর মতো নম্বর দিয়েও নাকি পাশ করানো যাচ্ছে না বহু পড়ুয়াকে। ফেল করা ছাত্রছাত্রীর অভিভাবকরা আসছেন। আসছেন না বলে চড়াও হচ্ছেন বললেই হয়তো যথাযথ হবে। অনুরোধ করছেন, নম্বর বাড়িয়ে দিতে হবে। করাতেই হবে পাশ। আর শিক্ষকরা বলছেন, ‘এ যাত্রায় না হয় হল। বোর্ডের পরীক্ষায়, আসল সমরে তাদের নিয়তি কি?’ সরকারি প্রসাদে বোর্ডের পরীক্ষাটাও উতরে গেলে বিরাট বড় ফন্টে পরের প্রশ্নটা ধেয়ে এসে গলা পেঁচিয়ে ধরে। তার পর? এমন আলোচনা কিছুক্ষণ করার পরে পরিচিত এক শিক্ষিকা মুচকি হেসে গেয়ে উঠেছিলেন, ‘তার আর পর নেই নেই কোন ঠিকানা, যা কিছু গিয়েছে থেমে যাক থেমে যাক না।’ বললেন, ‘মন মজেছে ট্যাবলেটে। পড়াশোনা করতে কি আর ইচ্ছে করে!’
প্রান্তিক ক্লাসের বেশ কয়েকজন স্কুল পড়ুয়ার কাছে ট্যাবলেটের উপকারিতা সম্পর্কে জানতে চেয়ে বিভিন্ন উত্তর পেয়ে ঋদ্ধ হয়েছি। ‘ইহাতে দারুণ গেম খেলা যায়’, ‘ঝিনচ্যাক ফটো ওঠে’, ‘গার্লফ্রেন্ডকে এগারো ইঞ্চি স্ক্রিনে পুরো তাপসী পান্নুর মতো লাগে’, ‘সরকার জিন্দাবাদ, ভিডিও কল লা জবাব’, ‘রাত্তিরবেলা ঘরের আলো অফ করে দেওয়ার পরে দারুণ মস্তি’—এমন হাজারো গুণগান শুনেছি ট্যাবলেট প্রসঙ্গে। কবিতাপ্রেমী এক ছাত্রীর থেকে শুনেছিলেম, ‘ইউটিউবেই জন্ম আমার, যেন ইউটিউবেই মরি।’ শুনেছি, ‘এত লেট করলে কেন, ট্যাবলেট?’ জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘পড়াশোনা করো না এই গ্যাজেটে?’ একটা উত্তর মনে আছে এখনও। ট্যাবে চুমু খেয়ে বলেছিল, ‘গুরু, পড়াশোনা কারে কয়? সে যে কেবলই যাতনাময়।’
সাবেকি পড়াশোনার পাশে ট্যাবলেটকে বন্ধু হিসেবে রাখার বিষয়ে অনেক শিক্ষাবিদই প্রবল কপাল কুঁচকচ্ছেন। তাঁরা ক্রমাগত প্রশ্ন তুলছেন, ‘স্বপ্ন দেখিয়ে ট্যাবলেট না হয় দিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু তাতে কাজের কাজ বলতে যা হওয়ার কথা, তা আদৌ হয়েছে কি?’ প্রশ্নটা খুব স্বাভাবিক। কারণ, বাস্তব পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে হেরে যাওয়ার কথাই জানান দেয়। ট্যাবলেট পেয়ে উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা কিভাবে এর ব্যবহার করছে, তা দেখার জন্য আদৌ কোনও পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারিনি আমরা। পড়াশোনার পরিপূরক হিসেবে যা ভাবা হয়েছিল, তা পরিপূরক হওয়ার বদলে আখেরে ক্ষতি করেছে বেশি। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।
করোনাকালে ট্যাব বিলি করার মূলে ছিল অনলাইন ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি বাড়ানো। বহুদিন স্কুল বন্ধ থাকলে স্কুল ছুটের সংখ্যাও বাড়ে। অতিমারিমাখা দিনগুলোতে বেশ কিছু শিক্ষককে দেখেছি, প্রতিদিন সকালে ছাত্রছাত্রীদের মুখ থেকে ভার্চুয়ালি ‘প্রেজেন্ট প্লিজ’ শোনার জন্য তাঁরা মুখিয়ে থাকতেন। নোট তৈরি করতেন। আপলোড করতেন। পড়ুয়াদের হোমটাস্ক দিতেন নিয়ম করে। বাইনারি খাতা দেখতেন। পড়াশোনা না করলে স্ক্রিনের মধ্যেই উড়ে আসত ধমক। ছাত্র-পাগল বেশ কিছু শিক্ষক খবরের কাগজের শিরোনামে এসেছিলেন তখন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পড়ুয়াদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিনা পয়সায় পড়িয়ে এসেছেন অনেক শিক্ষক। অনেকে আবার অকাতরে ছাত্রছাত্রীদের ডেটাপ্যাক ভরিয়ে দিয়েছেন। তবে শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সব মহলের মানুষরাই এক সুরে বলেছেন, ‘স্কুলের চার দেওয়াল অর্থাৎ অফলাইন ক্লাসের মধ্যে যেভাবে সার্বিক শিক্ষাদান করা যায়, ভার্চুয়াল দুনিয়ায় পড়াশোনার ধরণ তার থেকে বহু যোজন দূরে থাকে।’ এই দূরত্বটাই স্বাভাবিক। শিক্ষাবিদদের একটা বড় অংশেরই মত হল, অতিমারি কাটিয়ে আমরা যখন আগের জীবনে ফিরে আসতে পেরেছি, তখন এই ট্যাব বিলির প্রকল্প আর একটুও দেরি না করে বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
হোয়্যাটসঅ্যাপে আসা একটি মিমের কথা মনে পড়ে। কোনও এক দেওয়াললিখনের ছবি। লেখা ছিল, ‘মদ, গাঁজা, ট্যাবলেটের (তরুণের স্বপ্ন গ্যাজেট) নেশা ছাড়ান।’ ফটোশপে কারিকুরি করে বানানো ছবি, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। পরিচিত এক মনোবিদকে এটা পাঠানোর পরে ভেবেছিলাম স্মাইলি উড়ে আসবে ফুলঝুরির আলোর মতো। তা তো হলই না। বরং উনি ফোন করলেন আমায়, পত্রপাঠ। বেশ রাগী গলায় বললেন, ‘এই ছবির থেকে বড় সত্যি এখন আর দুটো নেই। পেশেন্টের সংখ্যা কত বেড়ে গিয়েছে জানো? অদ্ভুত রোগ এসেছে এখন—ট্যাব প্রীতি, গ্যাজেটপ্রীতি। বাপমায়েরা মুখ চুন করে বসে থাকছেন। আর কাউন্সেলিংয়ের সময় ছেলেটা আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতেও আঙুল দিয়ে খুটখুট করে যাচ্ছে মোবাইলে, থুড়ি, ট্যাবলেটে। প্রবল রেগে এমন এক অ্যাডিক্টকে বলেছিলাম, তোমার এই ট্যাবটা না আমি গুঁড়িয়ে দেব মাটিতে। ছেলেটা হিমচোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, সাহস থাকলে করে দেখুন না স্যার। আপনাকেও গুঁড়িয়ে দেবো। বুঝলেন?’
এই যন্ত্রটা কিন্তু ছেলেমেয়েদের নিওন আলোর হাতছানি না দেখিয়ে কাঁধে হাত রাখতে পারত সহজেই। তৈরি করা যেত পারত এক বিরাট তথ্যভাণ্ডার, নিজেদের মতো করে। অন্তর্জলের রাক্ষসসম সার্ভারে তুলে রাখা যেতো অজস্র লেকচার। প্রতিটি স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা নিজেদের মতো করে পড়িয়ে সেই ভিডিও আপলোড করে রাখতে পারতেন এই সার্ভারে। তা থেকে যেত অমলিন। একটা কাল্পনিক সংলাপ ভাবা যেতেই পারে। সালটা ২০২২ ভেবে নিলেও ক্ষতি নেই কোনও।
-কাল ক্লাসে আসতে পারিনি স্যার। বাবার শরীর খারাপ ছিল খুব।
-ঠিক আছে। পড়াটা মিস্ করনি তো?
-না না স্যার। ওই চ্যাপ্টারের ভিডিও তো আপনি করেই রেখেছিলেন করোনা টাইমে। দেখে নিয়েছি।
-বেশ। ওই চ্যাপ্টারটা নিয়ে আরও অ্যাড করেছি কিছু। তাহলে আর অন্যের ক্লাসনোট জেরক্স করো না। কোনও প্রশ্ন থাকলে জানিও।
পরিকাঠামো তৈরি থাকলে এমনটা আজ হতেই পারতো। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনও স্কুলের ছাত্র দেখে নিতে পারত নামজাদা স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা কিভাবে পড়ান। হতে পারতো উল্টোটাও। প্রান্তিক স্কুলগুলিতেও নিয়মিত কাজ করে চলেছেন বহু উজ্জ্বল, দীপ্তিময় শিক্ষক। তাঁদের ক্লাস লেকচার ঋদ্ধ করতে পারত অনেক শহুরে পড়ুয়াকেও। প্রতিটি স্কুলের প্রথম সারির ছাত্রদের উত্তরপত্র স্ক্যান করে, জমিয়ে রাখা যেত কোনও সেন্ট্রাল সার্ভারে, সবার জন্য। বাংলার কোনও শিক্ষক ভাল রচনা পড়লে তা শেয়ার করে নিতে পারতেন লক্ষাধিক পড়ুয়ার সঙ্গে। এই ইচ্ছে তালিকা অন্তহীন। আক্ষরিক অর্থে পৃথিবীকে ছোট করে দিতে পারতাম আমরা। হতেই পারত। এই ম্যাজিক বিক্রিয়ায় প্রয়োজন ছিল শুধু সদিচ্ছার ক্যাটালিস্ট। তা আমরা করতে পারিনি।
গুরুজনদের থেকে শুনেছি, শুভকাজের দেরি বলে কিছু হয় না। ট্যাব বিলি নিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ হয়তো চলতে থাকবে ফি বছর। এই ট্যাব সত্যিই যেন উপকারে লাগে, তা নিয়ে ভাবনাটা শুরু করা জরুরি।
ওষুধ-ট্যাবলেটের গায়ে ছাপা থাকে, খেতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো। এই লাইনটা এগারো ইঞ্চির পর্দাওয়ালা ট্যাবলেটের গায়ে ছাপিয়ে দিলেও বেশ হয়! গ্যাজেট-ট্যাবলেট ব্যবহারের চিকিৎসক হতে গেলে স্টেথোস্কোপ ব্যবহারের মেধা লাগে না। সবাই হতে পারি, বৃহত্তর স্বার্থে, আগামী দিনের কথা ভেবে।