ফেসবুকের ওই পোস্টটার মধ্যে হয়তো আঠা ছিল। আর স্ক্রল ডাউন করতে পারলাম না। একজন লিখেছেন, ‘স্বপ্নদীপের মৃত্যু নিয়ে এই শোরগোলের আয়ু আর মাত্র কয়েকদিন, যে কদিনের মধ্যে নতুন কিছু এসে এই ঘটনাকে চাপা না দিয়ে দেয়।’ দিন তিনচারেক আগের সেই পোস্টের ভবিষ্যৎ-বাণী ফলতে দেখেছি ইতিমধ্যেই। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন, বিগ ডে মহা-ধামাকায় তেলের সঙ্গে আটা ফ্রি আর অনলাইন খুচরো বিপণিতে নতুন কোনও ফোন উদ্বোধনের লিমিটেড টাইম ডিলের গর্জনে ক্রমশ আড়ালে চলে যাচ্ছে স্বপ্নদীপের মৃত্যু। কবীরের সুমনের গানে ছিল, 'শ্লোগান পাল্টে হয়ে যায় ফিসফাস'। এমন শিরোনামও ক্রমশ পর্যবসিত হবে টুকরো খবরে। তারপরে, আমাদের মন থেকে স্রেফ মুছে যাবে এই অকালপ্রয়াণ। পুজো এগিয়ে আসছে ক্রমশ। আশ্বিনের শারদপ্রাতে, বেঁচে থাকার শ্রেষ্ঠ উৎসবে নিজেদের গায়ে জরির ঝালর পরব সবাই। আজকে যে খবরে মন উথালপাথাল, তা জাঙ্ক হতে দেরি নেই আর।
বাসে-ট্রামে-মেট্রোতে, টিভিতে-সামাজিক মাধ্যমে গত কয়েকদিন শুধু স্বপ্নদীপের মৃত্যু নিয়ে কাটাছেঁড়া চলল। এখনও চলছে অবশ্য। যে যাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী, চেয়ারের ওজন অনুযায়ী কাদা ছুঁড়েছেন, ছুঁড়ছেন বিরোধী পক্ষের দিকে। বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ থেকে আঁতলামির মুখোশ টেনে খুলে দিয়ে তাকে বাস্তবের রাস্তায় দাঁড়াতে বলার গর্জন যেমন শুনেছি, ঠিক তেমনই শুনেছি স্বপ্নদীপের বলতে না পারা কথাগুলোর স্বঘোষিত ভার্সান। খবরে জানতে পেরেছি, মৃত্যুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে হোস্টেল থেকে মাকে ফোন করেছিল ছেলেটি। বলেছিল, “আমাকে নিয়ে যাও।” বলেছিল, “তোমাকে আমার অনেক কথা বলার আছে।” সে কথাগুলো যে আসলে কি, তা আমাদের জানা হল না। লোকাল ট্রেনে এই নিয়ে যখন তুমুল আলোচনা হচ্ছিল আমার একদল সহযাত্রীদের মধ্যে, শেষে একজন ইউটিউব থেকে চোখ সরিয়ে, কানে লাগানো ইয়ারপোড খুলে বলেছিলেন, “অনেকেই তো এখন ফেসবুক লাইভ করতে করতে জীবন শেষ করে দেয়। ছেলেটার মাথায় তো এই বুদ্ধিটা এলেও পারতো। এত পোস্ট মর্টেমের কোনও প্রয়োজন হতো তা হলে?” একথা শুনে রে-রে করে উঠেছিলেন কিছু যাত্রী। তার মধ্যে অবশ্য সেই যাত্রীর কানে ফের গুঁজে গিয়েছিল নতুন কোনও গানের নতুন ঝিনচ্যাক সমন্বিত ইয়ারবাড।
যাদবপুর কাণ্ডের পরে বেশ কিছু যুদ্ধজয়ের কাহিনী চোখে পড়ছে এদিক ওদিক। কয়েকদশক আগে র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে, মানসিক ট্রমা কাটিয়ে উঠে কিভাবে জীবনের মূল স্রোতে ফিরে এসেছেন, তা নিয়ে কিছু মানুষ তাঁদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিচ্ছেন আমাদের সঙ্গে। এমনই একজন বলেছিলেন, “যুদ্ধজয় তো অনেক দূরের কথা। আসলে এই যুদ্ধের দরকারই ছিল না কোনও।” বলেছিলেন, “ইচ্ছে করে, জোর করে নিজেদের চোখগুলো বুজে রেখে সমাজই তৈরি করেছিল এই যুদ্ধ। আমরা এর মাসুল দিয়েছিলাম। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।”
যে কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের চত্বরকে র্যাগিংমুক্ত বলে দাবি করে, তার মধ্যে সত্যির পরিমাণ কতটা? দেশের শীর্ষস্থানীয় কারিগরি শিক্ষার কলেজে র্যাগিং-এর ঘটনা খবরে উঠে এসেছে অনেকবার। চেতন ভগতের ‘ফাইভ পয়েন্ট সামওয়ান’ বইতে পড়েছি, ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবিতে দেখেছি। রিওয়াইন্ড আর রিপ্লে করে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছি কলেজের জুনিয়রদের নির্যাতিত হওয়ার দৃশ্য। সেই দৃশ্যের সংলাপ এখনও গড়গড় করে মুখস্থ বলে দেবেন আমাদের মধ্যে অনেকেই। প্রবাদে বলে, যা রটে, তার কিছুটা অন্তত বটে। আইআইটির অভ্যন্তরের র্যাগিংয়ের কাহিনী আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছিল তখন। আমার পরিচিত ক্লাস টুয়েলভের এক পড়ুয়া দিনকয়েক আগে বলছিল, “বাড়ি থেকে বলছে রাজস্থানের কোটায় গিয়ে আইআইটির প্রস্তুতি নিতে। কোটায় পড়াশোনার চাপে, মা-বাবার প্রত্যাশার চাপে বাঁচব কি না জানিনা। এ বছরে তো জনাকুড়ি মরল। আর সে যাত্রায় টিকে গিয়ে আইআইটিতে যদি কোনোক্রমে চান্স পেয়েও যাই, সেখান থেকে বেঁচে বেরোতে পারব কি না তা বিরাট প্রশ্ন।” মুখচোরা ছেলেটি বলছিল, “আমার যা স্বভাব, ওখানকার র্যাগিংয়ের পরীক্ষা পাশ করার ক্ষমতা আমার নেই।”
ওয়াকিবহাল শিবিরের অনেকেই একটি বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত। তাঁরা স্বীকার করে নিয়েছেন, ছোট-মাঝারি-বড় কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের যত ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিদিন, সামনে আসছে তার সামান্য কিছু অংশ। এ এক নিকষ কালো হিমশৈলের চূড়ার মতো। কলেজ যদি তথাকথিতভাবে বিখ্যাত হয়, গায়ে লেগে থাকে রেটিংয়ের নানা তকমা, তাহলে সেখানে ঘটে যাওয়া র্যাগিংয়ের ঘটনার ছিছিক্কার অনুরণিত হয় সমাজে। নাম না জানা কলেজের ক্ষেত্রে এমনটা ভাবাও ভুল। এক শিক্ষাবিদ বলছিলেন, “সাম্প্রতিক ঘটনাটি যদি ঘটত দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অ-বিখ্যাত কোনও কলেজে, তাহলে হইচইয়ের মাত্রা এর ধারেকাছেও যেতো কি?” এর সঙ্গে তিনি জুড়ে দিয়েছিলেন, “মৃত্যু কিন্তু দিনের শেষে মৃত্যুই থেকে যায়। যে মায়ের কোল খালি হল, রাষ্ট্রের ক্ষমতা নেই তা পূরণ করার। আমরা আর ঘুমিয়ে থাকব কতদিন?” এ প্রসঙ্গে এক ওসিসাহেবের মুখ থেকে শুনেছিলাম, “কলেজ যদি অখ্যাত হয়, আর সেই র্যাগিং কাণ্ডের পরিণতি যদি কোনও ছাত্রের মৃত্যু পর্যন্ত গড়িয়ে না গিয়ে থাকে, হলফ করে বলতে বলতে পারি স্থানীয় থানা সেই অভিযোগই নেবেনা। বরং ছাত্রের পরিজনদেরই মৃদু কড়কে ছেড়ে দেবে।” একটু থেমে তিনি বলেছিলেন, “কেউ কিছু বললেই যে ডায়রিতে টুকতে নেই—এ শিক্ষা আমাদের প্রশাসনের অলিখিত রুলবুকই দিয়েছে। হতাশাজনক। কিন্তু কিছু করার নেই।”
সিনিয়র হয়ে যাওয়ার পরে জুনিয়রদের র্যাগিং করেছেন—এমন কিছু মানুষ মুখ খুলছেন ইদানীং। জানা যাচ্ছে, কলেজের প্রথম বর্ষে ঢোকার পরে দাদাদের থেকে যে অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন, সিনিয়র হয়ে যাওয়ার পরে তা সুদে আসলে নতুন ছাত্রদের থেকে উসুল করে নেওয়ার মানসিকতা কাজ করত তাঁদের মধ্যে। আসলের সঙ্গে সুদ যোগ করা হলে অত্যাচারের পরিমাণও পাটিগণিতের নিয়মেই বাড়ে। নতুন জুনিয়রদের অনেকেই হয়তো সেকেন্ড কিংবা থার্ড ইয়ারে উঠে যাওয়ার পরে একই পথ ধরেছিলেন। মনের অলিগলি নিয়ে কাজ করেন যে বিশেষজ্ঞরা, এমন প্রসঙ্গ নিয়ে মতামত জানতে চাওয়া হলে তাঁরা রীতিমতো শিউরে উঠছেন। তাঁরা বলছেন, “এমন মানসিকতায় এই মুহূর্তে যদি শিকল না পরানো যায়, তাহলে আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের আর বিন্দুমাত্রও বাকি থাকবে না। মারণ রোগের থেকেও ভয়ংকর এর পরিণতি।” যাদবপুরের এই কাণ্ডের পরে আমার এক বন্ধু স্থানীয় মনোবিদ বিড়বিড় করে বলছিল, “যে পচন ইতিমধ্যেই ধরে গিয়েছে আমাদের এই সমাজে, তা দূর করতে হলে নিজেদের গালেই সপাটে থাপ্পড় মারা দরকার।”
কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় আর প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা দায় ঝেড়ে ফেলবার এই টেবিল টেনিস খেলা বন্ধ রেখে আর কবে সচেতন হবেন জানি না। সচেতন হওয়ার আগে যেটা প্রয়োজন তা হল সচেতনতাবোধ। এই ঘটনার পর সেটা তাঁদের মধ্যে এসেছে তো? কলেজের জুনিয়র এবং সিনিয়রদের মধ্যে খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক জেনেও তাদের এক গুহায় ছেড়ে দেওয়ার কাজ নির্বুদ্ধিতা ছাড়া অন্য কিছু তো নয়। তলানিতে ঠেকে যাওয়া যে মানসিকতা রাতারাতি বদলানোর নয়, তা আটকানোর জন্য বাহ্যিক দূরত্ব জরুরি। এই অপ্রিয় সত্য তাঁরা বুঝবেন কবে?
জানা গিয়েছে, নিজেদের মাথায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশনের মুকুট পরা সত্ত্বেও সিসিটিভি ক্যামেরা নেই বহু কলেজ চত্বরে। ফলে ক্লাস হয়ে যাওয়ার পরে, সূর্য অস্তাচলে গেলে জুনিয়র ছাত্রগুলোর উপরে সিনিয়রদের কি অমরবাণী বর্ষিত হয়, তা জানার ব্যবস্থা নেই কোনও। এগুলো জানা জরুরি, আগামীর স্বার্থে। শুনেছি, শহরের বিভিন্ন অ্যাপ ক্যাবে, সরকারি বেসরকারি বাসে লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্যানিক বটন। কোনও যাত্রী বেকায়দায় পড়লে সেই বোতাম চিপলেই খবর চলে যাবে পুলিশের কাছে। জিপিএস প্রযুক্তির উপরে ভরসা করে সেই অভিযোগ চটজলদি পৌঁছে যাবে স্থানীয় থানার ডেস্কে। জুনিয়র ছাত্রদের হোস্টেলের ঘরে এমন কোনও প্যানিক বোতাম ইনস্টল করার কোনও ভাবনা কি ভাবতে পারি না আমরা? প্রতিদিনের বেঁচে থাকায় আমরা অ্যাপস্নাত হই। তৈরি করা যেতে এমন কোনও অ্যাপ, যা পুরে দেওয়া যেতে প্রতিটি নূতন ছাত্রের মোবাইলে। অসুবিধার সম্মুখীন হলে সেই অ্যাপমারফৎ খবর চলে যেতে পারে কলেজ কর্তৃপক্ষ কিংবা হোস্টেলের ডিনের কাছে। অ্যালগোরিদমের ছোঁয়ায় সেখানে বেঁধে ফেলা যেতে পারে স্থানীয় থানার কর্তাব্যক্তিদেরও। বুলাদির জন্য ১০৯৭ নম্বর ছিল, আগুন লাগলে ১০১ টিপলেই নড়েচড়ে ওঠে দমকল, ১০২তে অ্যাম্বুল্যান্স। ১০০ ডায়াল করলেও শোনা যায় শোনা যার কোনও পুলিশ আধিকারিকের “হ্যালো”। ওয়ান টাচ পরিষেবার ক্ষেত্রে আমরা রকেট গতিতে এগিয়ে গিয়েছি অনেক। র্যাগিং প্রতিরোধে এমন কোনও হেল্পলাইন আছে কিনা জানা নেই। এমন ঘটনার মেগা এপিসোডে এই হেল্পলাইনের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানার আগ্রহও নেই। যদি তা না থেকে থাকে এখনও, কিংবা শীতঘুমে থাকে, তার ঘুম ভাঙানো জরুরি।
সমাজের সুস্থ ব্যাকরণ বলে, কলেজের সিনিয়ররা জুনিয়রদের পথপ্রদর্শক। আজকের দুনিয়ায় সাফল্যের শীর্ষে উঠেছেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেই কলেজ জীবনে সিনিয়র দাদা-দিদিদের ভূমিকার কথা মনে করিয়ে দেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে। সিনিয়রদের প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতা বোধ জিইয়ে থাকে জীবনভর। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো এমন ভালবাসার এবং শ্রদ্ধার সম্পর্কের বস্ত্রহরণ করে।
এই বেরঙিন আজকালে প্রফেসর শঙ্কুর কথা মনে পড়ছে খুব। নতজানু হয়ে বলতাম, “স্যার, আপনার অ্যানাইহিলিন যন্তরটা একবার বের করে ফেলুন তো কষ্ট করে। এই সামাজিক কাদা ভ্যানিশ করে দিন।”
শ্রাবণের ধারার মতো এখন যা প্রয়োজন, তা হল শান্তির জল। এই পচে যাওয়া, পূতিগন্ধময় সমাজের ফর্মাটিং জরুরি।