বারকোড আর ক্রেডিট কার্ডের গন্ধমাখা হাতে গোনা কয়েকটা অলংকার বার ছাড়াও এ শহরের বুকে বহু বার আছে। বার বলা ঠিক নয়, বলতে হবে ঠেক। মদ কেনার পরে লাগোয়া কুঠুরিতে তা ভোগ করার বন্দোবস্ত রয়েছে এমন ব্যবস্থায়। ‘নাগরিক ক্লান্তিতে তোমাকে চাই’-এর মতো সেখানে সূর্য ডোবার পরেই ভিড় করেন অজস্র মানুষ। বহুজাতিক রিটেল চেইনের লিকার কাউন্টারের মতো এখানে খরিদ্দারদের জন্য কোনোও লয়্যালটি কার্ডের বন্দোবস্ত নেই। মদ কেনার প্রশংসায় সেখানে জমা হয়না কোনও রিওয়ার্ড পয়েন্ট। রেস্তোরাঁ বুক করার অ্যাপ থেকে কুপন কোড এসে হাতছানি দিয়ে বলে না, ‘সারাদিন তো অনেক কাজ হল, এবার এখানে নিওন আলোয় একটু চিল-আউট হোক।’ এখানে যে লোকগুলো আসেন, তাঁদের অধিকাংশের গায়েই ঘেমো গন্ধ। মদ খাওয়ার সময় তাঁদের চোখ থাকে শুধু গ্লাসের দিকে, হাতে ধরা মোবাইলের স্ক্রিনে নয়। কর্ণকুহরে ব্লু-টুথ ইয়ারফোনের জোনাকি আলো জ্বলে না। গ্লাস ঘিরে আড্ডা হয়, কোনও ডেসিবেলের তোয়াক্কা না করেই। পাশের লোকের অসুবিধা হচ্ছে কি না, তা জানতে প্রথম পক্ষের বয়েই গেল। দোকানে যে গুটিকয়েক স্টাফ রয়েছেন, তাঁরা পরিচিত মুখ দেখলে হাল্কা সেলাম ঠোকেন। পান করতে করতে মজে গিয়ে দোকানের মেঝেতেই থুতু ফেলেন যাঁরা, তাঁদের বকেন। বমি করে দিলে খিস্তি মারেন। হঠাৎ কোনও কুকুরের উদয় হলে হঠ্, হঠ্ বলে তাড়ান।
ইন্ডিয়া নামক পর্দার আড়ালে যে একেবারে হদ্দ গরীব ভারতটা লুকিয়ে রয়েছে, তার অধিকাংশ সন্ধ্যেবেলা এমনভাবেই কাটে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। বছর ঘোরে। দোকানের বাঁধা খরিদ্দারের তালিকা দীর্ঘায়িত হয়। আবগারি দফতরের আদায় করা রাজস্বের খতিয়ান তার আগের বছরের হিসাবকে দশ গোল দেয়। দেশি মদ তৈরি করে যে সংস্থাগুলো, তারা গলদঘর্ম হয়ে গিয়ে প্রায় হাত জোড় করে বলে, ‘আর পারছি না।’ ট্যাঙ্কের পর ট্যাঙ্ক খালি হয়ে যায় নিমেষে। আর নিন্দুকরা বলেন, অন্য সব কিছুতে ক্রমাগত পিছিয়ে যেতে থাকলেও মদ গেলার টক্করে আমাদের সঙ্গে সত্যিই পেরে ওঠা মুশকিল।
ঘরের মধ্যে ঘরের মতো, এমন কুঠুরির মধ্যেও লুকিয়ে থাকে আরও অনেক কুঠুরি। এক বিখ্যাত ব্রিউয়ারিতে কাজ করা আমার এক বন্ধুর মুখে শুনেছিলাম, ‘দেশি মদের যদি শ্রেণীবিভাগ করতে যাওয়া হয় কখনও, তাহলে সেই তালিকা মাকড়সার জালের মতো হিজিবিজবিজ রুপ নেয়। সেই অর্থে এর তেমন কোন শ্রেণীবিভাগ হয়ই না, মান্যতা পাওয়ার মতো।’ স্থানীয় যে মদ তৈরি হয় রাজ্যের আনাচে কানাচে, রেল লাইন লাগোয়া ঝুপড়ির কোনও বেড়ার ঘরের গোপন গহ্বরে, নেশার ঘোর আরও জমাটি করার জন্য সেখানে মদের সঙ্গে অন্য উপাদান মেশে। নেশা জমতে জমতে হঠাৎ তা স্পর্শ করে ফেলে অতলকে। মধুর তোমার শেষ যে না পাই। বিষমদে বেঘোরে প্রাণ হারিয়ে ফেলেন কিছু লোক। খবরের কাগজ বলে, ঠিক কত জন লোক মরে গিয়েছেন, তা নিয়ে ঠিকঠাক ধারণা মিলছে না কোনও। মৃত্যুতালিকায় যাঁরা নাম লেখাচ্ছেন রোজ, বলা হচ্ছে, তাঁদের কোমর্বিডিটি ছিল আগে থেকেই। বিষমদ খেয়ে আসলে তাঁরা মরেননি। মরেছেন, আরও আগে থেকে শরীরে লুকিয়ে থাকা কোনও চোরাগোপ্তা রোগের কারণে। এমন হিসেবে আসল পরিসংখ্যানে অস্বত্ত্বিকর খাদ মেশার সম্ভাবনা কমে। আমাদের প্রশাসকদের স্বস্তি আসে।
বিষমদকান্ড নিয়ে যা হইচই শুরু হয়েছিল, তা নিজগুনে ঢেকে দিয়েছেন ক্ষমতার শীর্ষে থাকা মন্ত্রী, অধুনা প্রাক্তন। এই অপমৃত্যুর খবরগুলো নিয়ে রোজ সকালে বিচলিত বোধ করছিলেন যাঁরা, সাঁড়াশি দিয়ে তাঁদের চোখ খুলে দিয়েছে মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠের তালাবন্দি ফ্ল্যাট। পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন জপতে জপতে অধিকাংশ গোয়েন্দা-আধিকারিক বন্ধ ফ্ল্যাটের চাবি নিয়ে মজেছেন। রণে বনে জলে জঙ্গলে এখন শুধু এমন সংবাদ নিয়ে কথোপকথন। আর কত রাখা আছে লুকায়ে? প্রভাবশালীদের দুর্নীতির এই পর্দাফাঁসে লাভের লাভ হয়েছে একটাই। বিষমদে উল্টোপাল্টা মৃত্যু নিয়ে সামান্য হলেও যে সচেতনতা বাড়ছিল, এদিক ওদিক থেকে কথা শুরু হয়েছিল একটু আধটু, তা ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। জুলাইয়ের শুরুর দিকে এ রাজ্যের বর্ধমানে বিষমদ পান করে ৬ জনের মৃত্যু হয়। ওই মাসেরই তৃতীয় সপ্তাহে হাওড়ার ঘুসুড়িতে বিষ মদ প্রাণ নেয় আরও ১০ জনের। একই সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটেছে গুজরাতে। সেখানে ইতিমধ্যেই বিষমদের বলি হয়েছেন ৩০ জন। অনেকেই চিকিৎসাধীন আছেন। ফলে সংখ্যাটা হয়তো বাড়তে পারে আরও। অবশ্য চারপাশে খবরের নয়া সমারোহে এ নিয়ে আমরা আশ্চর্যজনকভাবে নীরব।
শহর মফস্বলের ঠেকগুলো সন্ধে হওয়ার পরেই বলে, ‘আয়, আয়, আয়।’ এমন দোকানের বাইরে দেখেছি, শবাসনে রয়েছেন একাধিক মানুষ। বসন এলোমেলো। হয়ত প্রবল বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছেন তিনি প্রতি মুহূর্তে। ফুটখানেক দূরে দাঁড়িয়ে প্রস্রাবে মগ্ন আমাদেরই কোনও সহনাগরিক। সেই নোংরা জল হয়তো ছুঁয়ে যাচ্ছে ঘুমন্ত লোকটির শরীরও। কারওরই বিকার নেই কোনও। শবাসনে থাকা লোকটি যদি জেগেও থাকতেন, তা হলেও প্রতিবাদ করার কোনও শক্তি থাকত কি না জানিনা। প্রোগ্রেসিভ ফাইবারের লেন্স লাগানো দামি ফ্রেমের চশমা পরে দূর থেকে দেখেছি এমন দোকান ঘিরে চলতে থাকা অদ্ভুত মাদকতা। দোকান লাগোয়া কুঠুরিতে প্রবল বিক্রমে মেতে ওঠেন কয়েক ঘন্টার রাজারা। দশ টাকায় মুরগীর নাড়িভুড়ি দিয়ে তৈরি করা ঘুগনি জাতীয় কিছু বিক্রি করেন কেউ। মাংসের আরও নানা উপাদান থাকে এমন যে কোনও দোকান ঘিরেই। তবে তাতে কতটুকু ‘মাংস’ থাকে তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। মূল কারখানার পাশে অনুসারী শিল্পের মতো গজিয়ে ওঠা এমন দোকানের ব্যবসাও রমরম করে বেড়ে চলে। কিছু অদ্ভুত গুঁড়ো পাওয়া যায়। বেশ কিছু লোককে বোতলের মধ্যে এই গুঁড়ো মিশিয়ে ঝাঁকিয়ে এক চুমুকে খেয়ে নিতে দেখেছি। জিজ্ঞেস করায় উত্তর এসেছিল, ‘দেখে তো মনে হয় আপনারা তো সব ইংলিশ। গরীবের এতে নেশা হয়। ফুটুন তো মশাই।’ গলাধাক্কা দিয়েছিলেন। এমন একজন লোকের সন্ধান পেয়েছিলাম, যিনি ফেলে দেওয়া প্রতিটা বোতলের অবশিষ্টাংশ মিশিয়ে তৈরি করেন এক অদ্ভুত ককটেল। রামের সঙ্গে ভদকা মেশে, ভদকার সঙ্গে হুইস্কি। তার সঙ্গে দেশি মদ। এর সঙ্গে আবার বিয়ার। ‘পাঞ্চটা করে দিয়ে তার উপরে অল্প করে একটু থু থু থু করে দিই, বুঝলেন দাদা। ষোলকলা পূর্ণ হয়।’ বলেছিলেন তিনি। আমি ভ্রু কুঁচকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আরে এত কিছু মেশানোর ফলে তো বিষ হয়ে যাবে পুরো জিনিসটা। লোকে মরবে তো।’ উনি উদাসীন হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘জীবনটাই তো বিষ। কি রাজকার্য করবেন বেঁচে থেকে? তাও যদি মন্ত্রী হতে পারতেন!’ লাইসেন্সওয়ালা সংস্থার পানীয় যেমন বিক্রি হয় এমন ঠেকে, একই সঙ্গে নজর এড়িয়ে বিক্রি হয় এমন কিছু পানীয় যার গায়ে একটি সাদা কালো স্টিকার ছাড়া অন্য কিছু লাগানো থাকে না। অবশ্য কে কার নজর এড়ায়! এগুলোরকোনও রেগুলেটরি টেস্ট নেই। গুণমান বলে আদৌ কিছু আছে কি না তা জানার কোনও চেষ্টা নেই। প্রস্তুতকারকের ঠিকানা ও ব্যাচ নম্বর বলে যে অতি প্রয়োজনীয় দুটি জিনিসের উল্লেখ করতে হয় যে কোনও পানীয়র লেবেলে, তার ত্রিসীমানাতেও থাকে না এমন প্রডাক্ট। নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা লোকেরা ছিপি খুলে আসলে যে কি পান করছেন, তা জানার উপায় থাকে না কোনও। কোনও রকমে যদি বিষক্রিয়া হয়, তাহলে এর তদন্ত করার সময় সবার প্রথমে যা ভেসে আসে তা হল নিকষ কালো এক পর্দা। শহর মফস্বলের ঠেকের ক্যাশ কাউন্টার সামলান যাঁরা, তাঁদের থেকে হিসেব নিলে বোঝা যায়, পিতৃমাতৃপরিচয়হীন এমন মদের বিক্রিও বাড়ছে হু হু করে। এক জন বলেছিলেন, ‘দুটো কারণ। সিম্পিল। এক, দাম কম। দুই, নেশার ঘোর হয় আরও বেশি। বুঝলেন কি কথাটা?’
গুজরাতের কংগ্রেস বিধায়ক অমিত চাবড়া অভিযোগ করে জানিয়েছিলেন, ‘বিষ মদ নিয়ে কারবার করেন যাঁরা, তাঁদের থেকে প্রতি মাসে পুলিশ ঘুষ খায়।’ আমাদের রাজ্যে ঘুষের নেটওয়ার্কও কম বলীয়ান নয়! এমন ঠেকের অদূরে পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। ঠেক লাগোয়া কুঠুরি থেকে রাস্তায় বেরিয়ে যাঁরা পান করতে শুরু করেন, মুখ কিংবা পকেট বিচার করে তাঁদের কয়েকজনকে কলার ধরে পুরে ফেলা হয় গাড়িতে। আড়াইশ-তিনশ-চারশর আশায়। অন্যদিকে অবৈধ মদ বিক্রি করছেন যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে মাসান্তে হওয়া জটিল সমীকরণ আমাদের নাগালের বাইরেই থেকে যায়। শুধু হাত জোড় করা ছবিগুলো বলে যায়, কাছে আছি, পাশে আছি। এই যে হাত। এই যে ফুল। সদা থাকো আনন্দে।