মাশরুম ছাঁট চুলের ছেলেটা তার সোনালী চুলের বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বাঁদিকে জাস্ট লুক। এদের কাছে তো শামুকও লজ্জা পায়। যত সব আনাড়ীর দল।’ সোনালী চুল উত্তর দিল, ‘আমরা মারি এন্ট্রি আর দিলমে বাজে ঘন্টি। হানি, চল্, চল্, চল্।’ দ্রুত তারা হারিয়ে গেল একটা গেটের দিকে। মেকি টেরাকোটা-আলপনা দিয়ে সাজানো সেই গেটের উপরে সোনালী থার্মোকলে জ্বলজ্বল করছিল, ‘ভিআইপি এন্ট্রি’। সেই স্পেশাল রাস্তা যেন ভিড়ে ঠাসা এঁদো গলির পাশে নবমির্মিত হাইওয়ে। ওই গলির বমি করা মানুষের ভিড় অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল ফাঁকা ভিআইপি গেটের দিকে। ওদের মধ্যে আমিও ছিলাম, একা। মিনিট কুড়ি পরে এক সত্তরোর্ধ্বা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাঁশের ব্যারিকেডটা ধরে মাটিতে বসে পড়লেন। হয়তো হঠাৎই মাথা টলমল। কাতর কন্ঠে পুজো কমিটির এক স্বেচ্ছাসেবকের কাছে আর্জি জানালেন, ‘আর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না বাবা।’ বৃদ্ধার স্বামীর অনুরোধ ছিল, ‘অনেক কষ্ট করে নিয়ে এসেছি ভাই। নার্ভের রোগী। বছরে একদিন ঠাকুর দেখার হয়তো এবারই শেষ। একটু ব্যবস্থা করে দাও না।’ স্বেচ্ছাসেবকের থেকে যান্ত্রিক কন্ঠস্বরে উড়ে এল, ‘ভিআইপি পাস আছে?’ অশীতিপর বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন দুদিকে। সেবকের উত্তর ছিল, ‘কিচ্ছু করার নেই দাদু। এটা অর্ডিনারি লাইন। তাই অর্ডিনারির মতোই থাকতে হবে।’ বৃদ্ধ হয়তো আরও কিছু বলতে চেয়েছিলেন। সাউন্ডবক্সে উচ্চগ্রামে শারদ সম্মান প্রাপ্তির ঘোষণা তাঁর আওয়াজকে ফিকে করে দিয়েছিল।
সদ্য পার করে আসা দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল খোলা হয়ে গিয়েছে অনেক জায়গাতেই। কাঠামোর কঙ্কাল থেকে হাড় বিচ্ছিন্ন করার মতো বাঁশগুলো খুলে ফেলা হচ্ছে রোজ। ওই কাঠামোরই মাইক্রোসার্জারি করে অনেক ক্লাব মেতে উঠেছিল কালীপুজোর আয়োজনে। শহরের বড় বড় পুজো কমিটিগুলো হয়তো ইতিমধ্যেই আগামী বছরের থিম নিয়ে মাথা ঘামানো শুরু করে দিয়েছে। এ বারে যারা মাত করেছে, সামনের বছর কিভাবে তাদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে পকেটে পুরে নেওয়া যায় বাহারি সম্মানের ডালি, তা নিয়ে নানা মগজের লড়াই চলছে খুব। তবে এত কিছুর মধ্যেও গোড়ার কিছু বিষয় প্রচ্ছন্নই থেকে যায়। ইংরিজিতে যাকে বলে, বেসিক ফ্যাক্টস। রাজ্যের শীর্ষনেত্রী বছরতিনেক আগেই ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন তুলেছিলেন পুজোর প্যান্ডেলে এমন ভিআইপি গেট নিয়ে। প্রাক-শারদীয়া এক মিটিংয়ে দৃপ্তকন্ঠে বলেছিলেন, ‘পুজো মন্ডপে লাইন একটাই হবে। সামান্য একটা কাগজের টুকরো দেখিয়ে (অনেকে) আগে আগে প্যান্ডেলে ঢুকে যাবে। আর কিছু মানুষ বহুক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকবে, এমনটা এ বছর থেকে হতে দেওয়া যাবে না।’
মুশকিলটা হল, বারোয়ারি পুজো কমিটির কর্তাব্যক্তিরা রামধনুরঙা থিম বুনতে যতটা তৎপর, সেই চিন্তার সিকিভাগও এই গেট বদলের জন্য খরচ করলেন না। পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা সরকারি অনুদানের চেকের ছবি ব্লো-আপ অবতারে প্যান্ডেলের বাইরে শোভা পায়। ওই ফ্লেক্সেই চেকের পাশে স্থানীয় কাউন্সিলার হাত জোড় করে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকেন। অথচ যে শীর্ষনেত্রীর অনুদানে ঝলমলে গয়না যোগ হয় প্রতিটি বারোয়ারি পুজোর আয়োজনে, তাঁর ইচ্ছার সম্মানরক্ষার্থে পুজো কমিটির আধিকারিকরা আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। নীরব নেত্রীও।
পুজো প্যান্ডেলে প্রবেশের এই ব্লু-প্রিন্ট নিয়ে সমাজের একটা অংশ প্রতি বছরই মাথা ঘামান। সবার রঙে রং মেলানোর জন্যে ফি বছর পুজোর যে আয়োজন করা হয়, সেখানে একটা বিশেষ দ্বারের প্রয়োজনীয়তা কতটা তা নিয়ে তাঁরা ক্রমাগত প্রশ্ন তোলেন। তাঁদের দাবি, ‘সুবিধাভোগীরা যে গেট দিয়ে ঢুকবেন সদলবলে, সেই গেটের নাম ভিআইপি এন্ট্রি কেন? আমজনতাকে হেলায় টেক্কা দিয়ে যে মানুষরা ওই গেট দিয়ে ঢুকছেন, তাঁরা কি আদৌ ভিআইপি?’ আন্তর্জালে জিজ্ঞেস করলাম, ভেরি ইম্পরট্যান্ট পার্সনের সংজ্ঞা দাও হে। সবজান্তা সার্চ ইঞ্জিন নিমেষে বলল, ভিআইপি কথার অর্থ হল সামাজিকভাবে সম্মানীয় ব্যাক্তি যাঁরা যে কোনও কারণে বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকেন। স্পেশাল ট্রিটমেন্ট। আর এই বিশেষ ব্যবস্থার জন্য তাঁরা সমাজের বাকি অংশের থেকে আলাদা হয়ে যান। শব্দের নিহিত অর্থ আরও বলে, এই আলাদা হওয়ার ব্যাপারটা তাঁরা প্রকৃতপক্ষে ‘অর্জন’ করেন, অন্তত ব্যাকরণগতভাবে।
খুঁতখুঁতে লোকেরা প্রশ্ন তুলছেন, কলার তুলে ভিআইপি গেট দিয়ে প্রবেশ করছেন যাঁরা, তাঁদের গলায় কি সত্যিই ঝুলে থাকে সামাজিক সম্মানের লকেট? এমন মানুষ থাকলেও তাঁরা সংখ্যায় ক’জন? শহরের বিখ্যাত পুজো কমিটির দু তিন জন কর্তার কাছে এই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। আমার এমন প্রশ্নে একজন হাসলেন মৃদু। অন্যজনের থেকে উপহার পেলাম অট্টহাসি। শুনলাম ভিআইপি কথার নয়া অর্থ। ‘এই ভিআইপি সেই ভিআইপি নয় রে ভাই। শেষ শব্দে পার্সনটাকে কেটে দিয়ে পেট করে দাও। ভেরি ইম্পরট্যান্ট পেট। পোষ্য ভাই, পোষ্য।’ কমিটিকর্তা বললেন, ‘এটাই আমার ভিউ। উত্তরে তোমার পেট ভরল তো ভাই?’
জানতে পারলাম, ভিআইপি পাস বিলি না করলে বিজ্ঞাপনে ভাটা পড়ে। প্যান্ডেলে ঢোকার মুখে গেঞ্জির বিজ্ঞাপনময় এক থামের দিকে আঙুল তুলে কমিটিকর্তা বলছিলেন, ‘এটার জন্য কত দিয়েছে জানো? কড়কড়ে দু লাখ। এমন ব্র্যান্ডকে পুষতে হয়। মাথায় হাত বুলিয়ে, বাবা বাছা করে ভুলিয়ে রাখতে হয় সারা বছর। না হলে যে পরের বছর এই থামে শুধুই শুন্য খেলা করবে।’ আমি অবাক চোখে তাকিয়েছিলাম ওঁর দিকে। বললেন, ‘লেনদেনের এই পুজোয় পাস ছাড়া আর কিই বা দিতে পারি? প্রভুভক্তি তো ওখান থেকেই আসে।’ আমি বোকার মতো জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘প্রভু কে?’ ভদ্রলোক আমার দিকে চেয়ে হেসেছিলেন শুধু। কয়েক সেকেন্ডের বিরতির পরে বলেছিলেন, ‘বুঝে নাও। বয়সটাতো কম হল না।' আমি বলেছিলাম, ‘বেশ। তা না হয় দিলেন। কিন্তু ওগুলো নিয়ে যাঁরা আসছেন, তাঁদের কতজন আপনাদের পুজোর বিজ্ঞাপনদাতা?’ উনি মুখ ঘুরিয়ে বলেছিলেন, ‘তা দেখা কি আমার কাজ বলে তোমার মনে হয়?’
শারদোৎসবের ভিআইপি পাস বিভিন্ন অবতারে আমাদের দোরগোড়ায় এসে হাজির হয় প্রতি বছর। আমার এক কবিবন্ধুকে বলতে শুনেছিলাম, ‘পুজোসংখ্যার এখন নতুন নাম হল পাসবই। মাঝখানে দশ পাতা জুড়ে শুধু শয়ে শয়ে পাস।’ এক প্রিয় সাহিত্যিককে বড় আগ্রহ নিয়ে জানিয়েছিলাম, ‘শুধু আপনার গল্পের জন্যই অমুক পুজোসংখ্যাটি কিনেছি স্যার।’ উনি বড় অবজ্ঞাভরে আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘মিথ্যে কথা বলো না একদম। শারদসংখ্যা এখন আর কেউ লেখকসূচী দেখে কেনে নাকি? পাসের জন্য গল্প না গল্পের জন্য পাস? এ নিয়ে বেশি ভেবো না। ব্রেনে ঝিলমিল লেগে যাবে।’
সামাজিক ব্যাকরণ নিয়ে যাঁরা চিন্তান্বিত, তাঁদের অনেকেই বিজ্ঞাপন ও পুজো পাসের লেনদেনের এই সমীকরণ মেনে নেন। বলা ভাল, মেনে নিতে বাধ্য হন। কপাল কুঁচকোতে পারে, কিন্তু বিপণনের দুনিয়ায় এ ছাড়া হয়তো কিছু করারও নেই। তাঁরা ক্রমাগত প্রশ্ন রাখেন বিশেষ গেটের সামনে জুড়ে থাকা ‘ভিআইপি’ শব্দটির দিকে। তাঁদের দাবি, এই গেট দিয়ে যাঁরা মন্ডপে প্রবেশ করছেন, তাঁরা আর যাই হোন, ভেরি ইম্পরট্যান্ট পার্সন অন্তত নয়। এই গেটের নাম বদলে রাখাই যেতে পারে, বিশেষ প্রবেশ। ওয়াকিবহাল শিবিরের মানুষরা জোর গলায় বলেন, ভিআইপি কথাটার মধ্যে এখনও যতটুকু ওজন ও সম্ভ্রম বেঁচে রয়েছে, এমন শব্দ-গেটের বহু ব্যবহারে এই শব্দের ভার ক্রমশ লঘু হয়ে যায়।
ভিআইপি শব্দটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যদি একটা গেটকে আমরা বিশেষ গেট হিসেবে ব্যবহার করতে পারি, তাহলে উপকার হতে পারে পারে এমন কিছু মানুষের, যাঁরা সত্যিই অন্যের হাত ধরার জন্য সামান্য হলেও প্রত্যাশা করে থাকেন। অশীতিপর যে মানুষরা কোনওক্রমে লাইনে দাঁড়ান প্রতিমাদর্শনের প্রবল ইচ্ছে নিয়ে, তাঁদের জন্য আমরা কোনও বিশেষ ব্যবস্থা করতে পারিনি এখনও। বাসে-ট্রামে-মেট্রোয়-ব্যাঙ্কের কাউন্টারে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য সুবিধা রয়েছে। পুজোর লাইনে নেই! আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া বাঙালির প্রাণের উৎসব এখনও হুইলচেয়ারবন্দি মানুষের কথা ভাবে না। যাঁরা বিশেষভাবে সক্ষম, তাঁরাও যেন পুজো দেখতে পারেন, এ নিয়ে আমাদের চিন্তা করার সময় কই? মহামান্য বিচারকরা সেরা প্রতিমার তকমা দেন, সেরা আলোর মুকুট পরান, সেরা পরিবেশের বিচার করেন। কিন্তু সমাজের প্রতিটা অংশকে ভালবেসে কোনও পুজো সত্যিই সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারল কি না তার মাপকাঠি এখনও রচনা করা গেল না সেভাবে। সাধারণ মানুষরা নিশ্চয়ই সাধারণ গেট দিয়ে প্রবেশ করবেন। ভাবতে ভাল লাগে, ভাবতে ইচ্ছে হয়, পাশে থাকা বিশেষ গেট দিয়ে সমাজের বিশেষ মানুষরাও আসছেন সসম্মানে। বিজ্ঞাপনদাতারা স্পেশাল পাস নিয়ে অবশ্যই আসবেন। তবে ওই দরজাটা যেন আরও চওড়াভাবে খোলে।
পরিচিত এক অধ্যাপক বললেন, ‘গেটের সামনে থেকে ভিআইপি কথাটা খানখান করে দেওয়ার একটা মস্ত বড় উপকারিতা আছে জানো তো?’ আমি কান পেতে রই। অধ্যাপক বললেন, ‘ভিআইপিদের দেখে সাধারণ লাইনের যাত্রীরা যে তির্যক মন্তব্য ছুঁড়ে দেন, এমন গেটের ব্যবহার কমাতে পারলে রাশ টানা যাবে তাতেও। এই চারদিনে তো আনন্দধারা বহিছে ভুবনে। অশোভন আর আলটপকা শব্দের ব্যবহার কমলে তাতে সমাজেরই লাভ কি না?’
পুজোর প্রবেশে ‘ভিআইপি’ শব্দটা অবিলম্বে মুছুক। তবে বিশেষ গেটের ব্যবহার আক্ষরিক অর্থেই আরও প্রসারিত করার ব্যপারে আমরা ভাবব কবে? বছর আসে, বছর যায়। বড্ড দেরি করে ফেলছি না তো?