পাতাবাহার, বেলফুল, নয়নতারা, গোলাপ গাছের টবগুলোকে পাশের বাড়িতে রেখে এসেছে রূপা। কেবল কৃষ্ণতুলসীর টবটাকেই সরানো বাকি। ঐ টবটাই সবচেয়ে বড়। তাই বেশ ভারিও। রূপা ভাবল ওটাকে টেনে বাড়ির সামনের চাতালেই রেখে দেবে।
বহুবছর পর বাড়িটা প্লাস্টার করে রং করাচ্ছে অবধেশ। মাঝে মধ্যে ওরা বাড়িতে যেমন তেমন করে রঙের পোঁচ লাগালেও ভাল করে সারানো হয়নি অনেক বছর। জায়গায় জায়গায় প্লাস্টার খসে ইট বেরিয়ে পড়েছে।
অবধেশের দাদা লোকেশের বিয়ের সময় শেষবার খুব ভালো করে বাড়ি মেরামত হয়েছিল। গোটা বাড়িটা ঝকঝক করছিল। তারপর তো অনেকগুলো দিন কেটে গেছে।
কাল থেকে মিস্ত্রি লাগবে। আজকে তাই রূপা গাছগুলোকে সরিয়ে রাখছিল।
কৃষ্ণতুলসীর গাছটা বড় টবে ঝোপ হয়ে গেছে। কতদিনের গাছ যে ওটা রূপার আর মনে পড়েনা।
টবটা টেনে সরাতেই দেওয়ালের গায়ে একটা বড় ফাটল।
হাঁ করা একটা ক্ষতমুখের মত দেখাচ্ছে ফাটলটাকে। রূপার এবার মনে পড়েছে, ঐ ফাটলটাকে আড়াল করতেই টবটা ওখানে রাখা হয়েছিল।
ভাঙা ফাটল দিয়ে ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা আলমারি। একটা দুধসাদা আলমারি।
আলমারিটা তোলার সময় সেরকম কোন তোড়ফোঁড় হয়নি।
কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামানোর সময় আলমারির ধাক্কায় একতলার একটা দেওয়ালের গা থেকে কিছুটা সিমেন্টের চটা উঠে গেছিল।
তবে ঠিক সেদিন ফাটলটা অবধেশদের চোখে পড়েনি। চোখে পড়লে দুচারটে খিস্তি অবশ্যই দিত মজুরগুলোকে। আগে খুব মুখ খারাপ করত অবধেশ। এখন ছেলে বড় হতে গালি দেবার অভ্যেসটা খানিক কমিয়েছে।
বিয়ের ঠিক পরে পরেই অবধেশ অন্য কাউকে গালি দিলে, রূপা দু একবার শুধরোতে গিয়ে উল্টে নিজেই গালি খেয়েছে। তবুও বারণ করতে যেত ও।
অবধেশের মুখে কুৎসিত গালিগুলো যেন রূপার কানে গরম সীসা ঢেলে দিত।
অবধেশের মা বলতেন, “গুসসে মে আদমি শের হোতে হ্যয়, তব উসকো কুছ না শিখাও। অউর তুঝে ক্যায়া? তুঝে তো না দে রহে গালি।’’
তা ঠিক। রূপাকে গালি দেয়নি কোনদিন অবধেশ।
ঝগড়াই হয়নি ওদের সেরকম।
ছোটখাটো মন খারাপ, মান অভিমান নিজেদের মধ্যেই মিটে গেছে। মিটিয়ে নিয়েছে ওরা। বেশিরভাগ সময়েই অবধেশ মিটিয়ে নিয়েছে। রূপাই বরং কখনো কখনো গুসসা করে ঘোমটার ভেতর মুখ ফুলিয়ে বসে থাকতো আর অবধেশ খুনসুটি করে, আংটপরা আঙ্গুলে সুড়সুড়ি দিয়ে হাসিয়ে ছাড়ত ওকে।
সেই দিনগুলো যেন রূপার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে।
সেইসব খুনসুটি আর একটা দুধসাদা আলমারি।
অবধেশ সেদিন ছিল বাইরের ঘরের সালিশি সভায়। সেখানে রূপার যাওয়ার হুকুম ছিলনা। রূপা তাই ওপরের জানলা থেকে দেখতে পেয়েছিল দুধসাদা আলমারিটার ধাক্কায় কি ভাবে দেওয়ালের সিমেন্টের চাকলা উঠে গেল।
ইসস, সেদিন আলমারিটাও খুঁতো হয়ে গিয়েছিল নাকি!
আলমারিটা এসেছিল পুনমের সঙ্গে।
পুনমের দুধসাদা মাখনের মত ত্বকের মতই আলমারিটাও ছিল জেল্লাদার। রূপার মনে মনে খুব পছন্দ ছিল আলমারিটা, একটু লোভও হয়েছিল বটে।
বাড়িটা তো তখনও এত পুরনো ছিল না। আর লোকেশের জয়পুরিয়া মার্বেল বসানো ঘরে আলমারিটা খুব ভালো মানিয়েছিল। লোকেশ অবধেশের দাদা, বড়ভাই।
সেদিন সকাল থেকেই ঝকঝকে রোদ উঠেছিল। চোখ ধাঁধানো রোদে পুনমের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনজনকে দরজায় একসঙ্গে দেখে সাসুমা শশব্যস্তে উঠে এসেছিল। পুনমের দাদাজী, পরদাদা সব নাকি প্যাহেলওয়ান ছিলেন, ওর ভাইদেরও নাকি শরীর চর্চার আখড়া। জিম এর ব্যবসা।
ওদের সবারই বেশ মজবুত চেহারা। ওদের সেদিন একটু রাগী রাগীই মনে হচ্ছিল।
তারপরে তো ওপরের ঘরে সেদিন পঞ্চায়েত বসেছিল পুনমকে নিয়ে। পুনম ছিল রূপার দেড়মাসের জেঠানি, বড়জা।
ওদের বাড়ি যদিও বেশিদূর নয়। কে জানে কিভাবে খবর পাঠিয়েছিল পুনম? ফোন করেছিল নাকি? তখন তো বাড়িতে একটাই টেলিফোন। এখনকার মত বউদের হাতে হাতে মোবাইল দেওয়া হত না।
রূপা যখন বাড়িতে ফোন করত, সেই সময় তো সাস আশেপাশেই থাকতেন, বলতেন “তেরা বাত হ যায়ে তো, হম সে ভি বাত করা দেনা সমন্ধিজি সে।’’
সেই নজরদারির ঘেরাটোপে মনের কথা বলা যেত না।
তবুও পুনম কি ভাবে যেন ডেকেছিল ওর দাদাদের।
সেদিন সালিশি সভার শেষে ওর দাদারা সুন্দরী পুনম, তার দুধসাদা আলমারি, দহেজের টাকাপয়সা সব গুছিয়ে নিয়ে চলে গেছিল।
অবধেশের মা পরের দিন মুখ লাল করে পাশের চৌদা নম্বরের তাইজিকে বলেছিলেন, “ঠাণ্ড হ্যায়, বিল্কুল ঠাণ্ড অউরত।”
তা পুনমকে ঠাণ্ডা, নরম নরম, শান্ত বলেই মনে হয়েছিল রূপার।
রূপার তামাটে রং, একহারা লম্বাটে খাটাপিটা গড়নের বিপরীতে পুনম এসেছিল একেবারেই মাখনের মত নরম শরীর, পুতুলের মত গড়ন নিয়ে।
তবে মুখটা আজ এই কুড়ি বছর পর আর খুব ভালো মনে পড়ে না রূপার।
তবে এটা মনে আছে ওর, লোকেশের সঙ্গে পুনমকে ভারি সুন্দর লাগছিল। লোকেশকেও তো তখন দেখতে ভালো, ফর্সা, লম্বা, হাট্টাকাট্টা সাজোয়ান।
অবধেশের মা তখন দু দুটো জোয়ান ছেলের মা। জোয়ান ছেলের মা’দের খেটে খেতে নেই।
ঐ চোদ্দ নম্বরের তাইজিই নাকি সাসুমাকে রোজ বলতেন, “দো, দো জওয়ান বেটে রহতে অউর কিতনে দিন তু রোটি বানায়েগি?”
তা জওয়ান বেটারা তো আর রোটি বানায় না, যারা রোটি বানাবে তাদের খোঁজ শুরু হয়েছিল।
খাটিয়ে পিটিয়ে রূপাকে মোটামুটি এদের চোখে ধরতেই বিয়েটা হয়ে গেছিল।
অবধেশ ছোট হলেও ওর বিয়ে হয়ে গেছিল আগে।
সে তখন একটা ছোট অফিসে একাউন্টস ক্লার্ক। সাধারণ দোহারা চেহারা।
যেরকম ছেলেদের বউরা সংসারে আসে, খাটবে আর তার বিনিময়ে খাবে বলে। তার জন্য খুব একটা খোঁজাখুজি করতে হয় না।
বিয়ের বাজারে খুব একটা ভালো দামও ওঠেনি অবধেশের। সামান্য দহেজ, আর একটা স্কুটারের দরে রূপার বাবা বিয়ে পাকা করে ফেলেছিলেন।
দহেজের টাকা অবধেশের মার হাতবাক্সে, আর রূপা নিজে রসুইঘরে ঢুকে গেলেও, ঐ স্কুটারটাই ওকে মাঝে মাঝে একটু খোলা হাওয়ার স্বাদ দিত।
বিয়ের পরে পরেই অবধেশ কখনো কখনো ওকে নিয়ে ঘুরতে যেত পুরনো দুর্গে, চিড়িয়াঘরে, ঝিলের পাড়ে। স্কুটারে গতি উঠতেই অবধেশ চিৎকার করে গান ধরত, “
“ওহ হাসিনা জুলফেওালি”
চুলও ছিল বটে রূপার।
কোমর ছাপানো কালো মেঘের মত চুল। তখন অবধেশ খুব ভালবাসত রূপার চুল।
একদিন রাতে রূপার চুল নিয়ে খেলতে খেলতে অবধেশ বলেছিল, লোকেশের জন্য মেয়ে খোঁজা হচ্ছে অনেকদিন আগে থেকেই। কিন্তু ঠিক মনোমত পাওয়া যাছে না। সে হবে সুন্দরী, 'খাতে পিতে' ঘর থেকে আসবে। সেই মেয়ে হবে পাঁচ, সাত ভাইয়ের এক বোন। তবেই তো শ্বশুরঘরে গিয়ে লোকেশ খাতির পাবে, দায়ে বিপদে সাহারা পাবে।
কিন্তু এমন সাত রাজার ধন তো আর সহজে মেলেনা, তাই অবধেশের বিয়ে দিয়ে দেয়া হল।
অবধেশের বেলায় এতসব ভাবেনি এরা।
অবধেশের বৌ এসেছিল রোটি বানাবার জন্য।
রূপা ভাবে, ভাগ্যিস ভাবে নি। তাহলে রূপার মত চার,পাঁচজন ভাইবোনের মধ্যে থেকে, তামাটে রঙের রূপার কি আর অবধেশের সঙ্গে বিয়ে হত?
অবধেশও হয়তো সত্যিই এতো কিছু ভাবত না। রূপা বিয়ে হয়ে এসে থেকে দেখছে অবধেশ যেন জানেই যে লোকেশের জন্য সংসারের সেরা জিনিসটা রাখা থাকবে। এটাই নিয়ম, এটাই দস্তুর।
অবধেশ রূপাকে যেন বুঝিয়ে বলছিল হাট্টাকাট্টা, গোরা লোকেশের জন্য সেরকম মেয়েই তো মানাবে ভালো। আর লোকেশের বিজনেসও তো তখন রমরমিয়ে চলছে। রূপার মনে হচ্ছিল অবধেশ যেন রূপাকে নয়, নিজেকেই বুঝিয়ে বলছিল এসব।
সেই রাতে অবধেশের মুখের দিকে তাকিয়ে রূপা জিজ্ঞেস করেছিল, “আচ্ছা, আমাকে তোমার ভালো লাগে? না কি তুমিও ওরকম সুন্দরীই ……
রূপার কথা শেষ করতে দেয়নি অবধেশ। রূপার শরীরে সুড়সুড়ি দিতে দিতে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলেছিল “আরে বেহেনচো…, তুহি তো মেরি হেমামালিনি,তুহি মেরি শ্রীদেবি।”
শুধু অবধেশই বা কেন?
রূপার বিয়ের পর থেকে ওর শাশুড়ি যে কোন ছুতোয় ভবিষ্যতের বড়বৌ এর আগাম গুণগান করতে ছাড়তেন না। লোকেশের বৌ হবে অপূর্ব রূপসী, আর গুণবতী। এতে অন্তত তাঁর কোন সন্দেহ ছিল না।
শুধু কি বাড়িতেই? বিয়ের পর যেখানেই গেছে রূপা, সেখানেই বড়িবহুরানির আসার অপেক্ষার গানের মুখরার আলাপ শুনে এসেছে।
সে পিতমপুরায় জেঠাশ্বশুরের বাড়ি হোক বা বিরোনাতে মৌসিসাসের বাড়ি।
বিরোনা ব্রজধামের খুব কাছেই। ওদের বাড়ি ফুলদোলে খুব তামঝাম হয়। বাড়ির সব মেয়েরা কপালে চন্দনের অলকাতিলকা করে, রাধাকিষেনজির মূর্তি বসিয়ে নেচে নেচে কীর্তন গায়। বিয়ের পর প্রথম বছর শাশুড়ির সঙ্গে রূপাও গিয়েছিল ওদের বাড়ি।
মৌসিসাসের মেয়ে সঙ্গীতাদিদি রূপার কপালে ফুল দিয়ে চন্দনের আলপনা আঁকতে আঁকতে মিষ্টি হেসে বলেছিল, “রূপাভাবী হমে ভি তো বতাঁও, ক্যায় সে হামারি অবধেশ ভাইয়া কো প্যার মে ফাঁসায়ে হো? এয়সে হো তো আপ বহত সুন্দর।’’
খুব একটা কিছু ভেবে হয়তো বলেনি। এমনিই তো ছোট বাচ্ছা বা নতুন বৌ দেখতে গেলে লোকে যেমন একটু আদুরে ভাবে কথা বলে তেমনই।
রূপা লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে হেসেছিল। ইসস্, সঙ্গীতাদিদি যেন কি একটা!
রূপার শাশুড়ি পাশ থেকে বলেছিলেন, “আরে ইসে তো ছোড়, আগলে সাল যব বড়িবহু কো লেকে আউঙ্গি তব দেখ না। খোঁজ চল রহি হ্যায় উঁচি খানদানো মে। উসকা রহনসহন, ক্যায়দা হি হোগা কুছ অউর।”
রূপা সেইসব জায়গাতে শাশুড়ির ব্যাগ বয়ে নিয়ে গেছে, ঠিক ঠিক সময়ে বের করে দিয়েছে সুগারের বড়ি, ঝাপসা চোখের চশমা হাতে হাতে এগিয়ে দিয়েছে।
রূপার শাশুড়ি বাড়ি ফেরার সময় বলে এসেছেন“ আগলে সাল যব বড়িবহু কো যব লেকে আউঙ্গি তব দেখ না। খোঁজ চল রহি হ্যায় উঁচি খানদানো…।”
এইরকম শুনতে শুনতে রূপার মনেও লোকেশের সেই উঁচু বংশের, সুন্দরী বহুর একটা আবছা ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছিল।
সে যেন আসবেই রাণী হতে। বহুরাণী। শ্বাশুড়ির ভাষায় সংসারে 'রাজ' করতে। রূপারা কেবল সেই সংসারে প্রজার মতো থাকবে, খানিকটা ভৃত্যের মত তার হুকুম তামিল করবে।
সেই তখনও বিয়ে না হয়ে আসা বহুরাণী রূপার সমগোত্রীয় ছিল না। রূপা প্রজা হয়ে, ভৃত্য হয়ে, ছায়া হয়ে বড়বৌরানির জন্য অপেক্ষায় ছিল। পুনম আসার আগেই রূপার মনের মধ্যে একটি ছায়া ওর ‘বড়জা’ হয়ে সংসারে বহাল ছিল।
মাঝে মাঝে সেই ছায়া জেঠানির সঙ্গে মনে মনে কথাও বলত রূপা।
সামনের উঠোনটা ঠিকঠাক ঝাড়ু দেওয়া হল কিনা জানতে চাইত।
চায়ে চিনি কম হল কি? বা সেবার গরমে যখন ঘৃতকুমারীর গাছগুলো ঝাড় হয়ে উঠোনে অনেকটা ছড়িয়ে পড়েছে, রূপাকে ওর সাস বলেছিল সেইসব ঝোপঝাড় কেটে সাফ করে রাখতে। লোকেশের হবু শ্বশুরবাড়ির লোকজন কথা বলতে আসে, দেখতে খারাপ লাগে।
রূপা গাছ সাফ করতে করতে ঘাড় টেরিয়ে সেই ছায়ারাণীর সঙ্গে কথা বলছিল, কিছু গাছ রেখে দেবে কি?, কারণ ও শুনেছে ঘৃতকুমারীর রস খুব উপকারী, যদি বড়ি বহুরাণীর কোন কাজে লাগে।
পাশ থেকে সেই বিড়বিড় শুনে শাশুড়ি বলেছিল, “এইসে তো থা হি কালা ভইস, অব দিমাগ ভি চল বসি। পতা নেহি কব আয়েগি বড়ি বহু, কব সামালহেগি আপনি গেরস্থি।”
রূপা চুপ করে গাছতলা নিড়েন দিয়ে উঠে গিয়েছিল।
ঠিক পাগল না হলেও, ক্রমশ, অনাগত বড়বৌয়ের একটা অলীক সংসারের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছিল রূপা। নবীন এসে খানিক হাত পা ছুঁড়ে, চেঁচিয়ে টেচিয়ে ওকে যেন সেই ঘোর থেকে জাগিয়ে দিল।
নবীনকে কোলে নিয়ে যেন ধড়মড়িয়ে জেগে উঠে রূপা দেখল যে, ও আর কেবলমাত্র অবধেশদের বাড়ির ছোটবৌ নেই।
মা হয়ে গেছে ও।
ওর কোলে ছোট্ট নবীন, বুকে আঠা আঠা দুধ আর সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে একটা ঘন মায়া।
নবীন হবার আটের মাথায় লোকেশের পছন্দ, দর ও দস্তুর মেয়ের বাড়ির সঙ্গে মিলে গেল। পুনমের সঙ্গে শাদী হয়ে গেল লোকেশের।
খুব ভালো করে এতদিন পরে পুনমের মুখটা আর মনে পড়ছে না রূপার। লম্বা ঘোমটার আড়ালে মুখটা কতটাই বা দেখতে পেয়েছিল।
তবে ঐ কদিনে রূপার সঙ্গ ছাড়তে চাইতো না পুনম। রূপা আটা মাখতে বসলে ওর থেকে কেড়ে নিয়ে মাখতে বসত, ধোয়ামোছা বাসন র্যাকে তুলে রাখতো। কখনো আবার সব্জির ঝুড়ি টেনে বসত।
এসব কাজ রূপার তখন চোখের নিমিষে হয়ে যায়।
লোকেশের বিয়েতেই তো গোছা গোছা রোটি, চাপাটি বানিয়েছে রূপা। পাতিলা ভর্তি ডাল, সব্জি একলাই করে ফেলেছে। বরং অপটু পুনমকে সংসারের কাজ করতে দিতে গিয়ে দেরি হয়ে যাচ্ছিল রূপার।
তবু পুনমকে না বলতেওও পারছিল না সে। কারণ সংসার তো পুনমেরই। কে জানে পুনমকে কাজ করতে না দিলে সেটাও রূপার দোষ হত কি না?
তবে রূপার ধারণা অনুযায়ী পুনমের ব্যবহার মিলছিল না।
পুনমের তো হুকুম করার কথা। সেই হুকুম তামিল করার জন্যই তো রূপা তৈরি হয়েছে এত বছর ধরে।
রূপা ভাবত সেকথা কি কেউ পুনমকে বলে দিচ্ছে না? লোকেশ? শাশুমা?
না কি পুনম জেনেশুনেই আসছে রূপার কাজে হাত লাগাতে? দেখে, শুনে, বুঝে, ছকে নিচ্ছে সবটা? তারপর ধীরে ধীরে জাঁকিয়ে বসবে নিজের তখ্তে?
আড়চোখে পুনমকে জরিপ করত কখনো কখনো।
তবে তখন রূপার মনে হয়েছিল পুনমের এই আনকোরা কাজ করা একটা বেখেয়ালি শখ, দুদিনে এই শখ মিটে গেলেই আর এদিকে আসবেনা সে। চালাক নয়, কেমন যেন বিভ্রান্ত, উদাস মনে হত ওকে।
নিজের বাড়ি ছেড়ে আসলে পুনমের মত আদরের দুলারিদের একটু কষ্ট হয় বটে।
আদরের তো বটেই নাহলে এতো দহেজ, এতো সামান মেয়ের সঙ্গে পাঠায় তারা? শুধু টাকা গয়নাই নয় খাট, সোফা, বাহারি শোকেস আর তার সঙ্গে সেই দুধসাদা আলমারি।
রূপাও পেয়েছে বৈকি। পুনমের মাইকে থেকে রূপার জন্য এসেছে লালজড়ি পাড়ে টিয়াপাখি সবুজের সিল্ক আর অবধেশের সোনার অঙ্গুঠি।
রূপা ভাবত, এই দুঃখ পুনমের কেটে যাবে।
লোকেশ মাঝেমাঝেই রসুইঘরের আশপাশে ঘুরঘুর করছে। সাসুমাও পুনমকে ডেকে পাশে বসিয়ে সব পুরনো দিনের গল্প করছে, এমন কি অবধেশও ভাবীর সঙ্গে বেশ সহজ, মাঝেমাঝে সেও গল্পে যোগ দিচ্ছে।
রুটি সেঁকতে সেঁকতে, ডাল বানাতে বানাতে রূপা ভেবেছিল, এমনটাই তো হবার কথা।
বিয়ের পর নবীনটা কটাদিন খুব ভুগল। এই বিয়ের ডামাডোলে ছেলেটার অযত্ন হয়েছিল খুব।
রিস্তেদাররা তখনও কেউ কেউ নয়ি দুলহন দেখতে আসছিল। রূপা ঘরের কাজ করে, ছেলে সামলে লক্ষ্য করেনি শান্ত পুনম কখন আরও চুপচাপ হয়ে গেছে।
এখন মনে হয় সংসারের রানী হয়ে এসেও কি বড় কম কথা বলতো মেয়েটা?
মাঝে মাঝেই দুপুরের দিকে রূপার ঘরে চলে আসত পুনম। লোকেশ আজকাল দোপহরে ঘরে চলে আসে। বাড়ি ফিরে লোকেশ পুনমকে ডেকে নিয়ে যেত। পুনম কখনো যেত, কখনো আবার নবীনকে কোলে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত।
রূপার নিজের বিয়ের পরের সময়গুলো মনে পড়ে যেত। অবধেশও তো অফিস ছুটি করে চলে আসত মাঝেমাঝে তখন। এই সময়টাই তো একটা চমৎকার, ম্যাজিক।
একদিন বিকেলে ছাতে জামাকাপড় তুলতে গিয়ে রূপা দেখেছিল পুনমকে একলা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় ঘুঙ্ঘট ছিল না। ভাঙা বেলায় ঘরমুখী পাখিদের দিকে তাকিয়ে ছিল ও।
বিকেলের কমলা আলোয় পুনম যেন একটা লালচে মোমের পুতুল।
রেখার মনে হল, লোকেশ দোপহরে তো চলে আসবেই। এমন গুড়িয়া পেলে কেউ না খেলে থাকতে পারে?
রূপা ওর কাছে গিয়ে বলেছিল, “দিদি ঘুঙ্ঘট কর লো, পতা নেহি কৌন কাহাঁ সে দেখ লে…।
পুনমের কাছে গিয়ে কথা বলতে গিয়ে রূপা দেখেছিল, পুনমের গলায় একটা প্রজাপতির মত বেগুনি দাগ। কালশিটে নাকি?
কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তাড়াতাড়ি ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে নীচে চলে গিয়েছিল পুনম।
রূপাও কি খুব একটা আপন করে নিতে গিয়েছিল নতুন আসা মেয়েটাকে? মিশেছিল নিজে থেকে?
না কি শাশুড়িই আগলে রেখেছিলেন পুনমকে আগাগোড়া।
তার কদিন পর তো ওর ভাইয়ারা এসে পুনমকে নিয়েই গেল। ভিতরের ঘর থেকে বাইরের কথা কাটাকাটি কিছুটা কানে আসছিল ওর।
লোকেশের মা ও কিছুটা জানত তাহলে!
রূপাই কেবল বুঝতে পারেনি, ঠিকদুপুরে নবীনের কাছে পালিয়েই আসত তবে পুনম। কিন্তু বেচারা রাতে বাঁচতে পারেনি। এতদিনে দুজনে মিলে কোন ম্যাজিক ছোঁয়নি ওরা। কোন আশ্চর্য সুরই বেজে ওঠেনি ওদের বাঁশীতে। একলা লোকেশই কেবল পুনমের শরীর থেকে মাখনের দলা ছিঁড়ে নিয়েছে।
উফফ! কষ্টে, যন্ত্রণায়, লজ্জায় রূপার গলার কাছে কান্নার পুঁটলি আটকে গেছিল সেদিন।
পুনম না ডাকতেও সেদিন ওর ঘরে গিয়েছিল রূপা।
রূপা পুনমের ঘরে গিয়ে দেখে, ও পাথরের মূর্তির মত বসে রয়েছে।
রূপাকে কিছু বলতে হয়নি, তার আগেই পুনম রূপার দিকে ঘুরে বসে ওর গায়ে জড়ানো লাল ওড়নাটা আলগা করে দিয়েছিল।
পুনমের কমলার কোয়ার মত ঠোঁটটা অর্ধেকটা ছিঁড়ে কামড়ে খেয়েছে কেউ। সেই রক্তমাখা চামড়া ঢাকতে কোন সাদাটে পাউডার তার ওপর ধেবড়ে দিয়েছে। ছেঁড়া ঠোঁটের মধ্যে দিয়ে সেই রক্তে ভেজা সাদা পাউডার মুখের ভেতরেও খানিকটা ছড়িয়ে পড়েছে। গলার কাছে প্রজাপতির মত পাখামেলা গাঢ় কালশিটেটা আজ আরও গভীর, আরও বেগুনি। ওড়নাটা সরে গিয়ে কামিজের ফাঁক দিয়ে বুকের খানিকটা অংশ বেরিয়ে আছে।যেন কোন হিংস্র পশুর কামড়ে মাংস তুলে নিয়েছে সেখান থেকে। পুনমের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে কাটা ঠোঁট বেয়ে, কালশিটের ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে সেই খোবলানো মাংসের গর্তে।
রূপা চমকে উঠে এতক্ষণে সাসুমার কথাটা বুঝতে পারে, “ ওহ ঠানড অউরত, পতি সোহাগ না সহ পাই।”
পুনমের পা টেনে চলা, গলায় কালশিটের প্রজাপতি আর আজকের এই খোবলানো মাংসের ক্ষত আসলে সেই ‘পতি সোহাগ’। প্রতি রাতের শেয়াল কুকুরের মত পুনমের নরম শরীরটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে রক্তাক্ত করেছে তারই সবচেয়ে কাছের মানুষ।
পুনম চোখে একটা শুন্য় দৃষ্টি। শুধু চোখ নয়, রূপার মনে হচ্ছিল ওর সামনে রক্তমাংসের পুনম বসে নেই। বরং বেখেয়ালি কুমোরের হাতে তৈরি একটা বেঁকাটেরা কলসি পড়ে রয়েছে। সংসারটিকে ভরে রাখার, নিজে ভরে থাকার আশ্বাস নিয়ে এসে কেবল যেন শুন্যতাই ভরতে পেরেছে পুনম।
সেদিন রূপা এগিয়ে এসে পুনমের হাতটুকু ধরতে পেরেছিল একবার।
রূপার হাতটা ধরে পুনম ডুকরে উঠে বলেছিল, “শায়দ ভগবান ইস ঘর মে মেরা চাউল নেহি মাপে।”
পুনমের হাতটুকু ধরে থাকা ছাড়া সেদিন আর রূপার কিছুই কি করার ছিল?
রূপার চাল, ডাল, ইজ্জত যে এই বাড়িতেই মাপা ছিল। রূপার যে পুনমের মত পাঁচজন পেহেলয়ান ভাই ছিল না।
শাশুড়ি এসে রূপাকে বলেছিল, “তু ইস ঠাণ্ড ঔরত পাশ কেয়া কর রহি?”
তারপর পুনমের দিকে তাকিয়ে কেটে কেটে বলেছিলেন, “ আপনা পতি সুহাগ যো না সহ পায়ে, ও বাত বাহর নিকালে ও তো হ্যাই হি বাজারি।” তারপর রূপা কে ঠেলে ঐ ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
পুনমকে নিয়ে ওরা চলে গেছিল।
একদিন পোস্টে কাগজ এসেছিল। একেবারে কোর্টে লেখাপড়া করে বিয়ে ছাড়কাট করার কাগজ। ডিভোর্স হয়ে গেছিল লোকেশ আর পুনমের।
পুনম চলে যাবার পর থেকে রূপার শাশুড়িও কেমন যেন মুষড়ে পড়েছিলেন।
যে রাণীর রাজত্বের একনিষ্ঠ প্রত্যাশায় তিনি এতগুলো বছর ভরতের অপেক্ষায় ছিলেন, তা যে এক নিমিষে এভাবে তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়বে তা হয়তো তিনি দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। এর থেকে পুনম দজ্জাল হলে, স্বার্থপর হলে, মুহফোঁড় হলেও তিনি তাকে সেই বদনাম দিতেন। আর সেই বদনাম দিতে দিতেও হয়তো পুনমের বশ্যতা স্বীকার করে নিতেন। কিন্তু পুনমের চলে যাওয়া এবং শেষে একেবারে ডিভোর্স এই পরিবারেও একটা স্থায়ী কালো দাগ রেখে গিয়েছিল।
রূপা বহুবার শুনেছে এরপর থেকে বিড়বিড় করে কাকে যেন গালমন্দ করতেন অবধেশের মা।
কাকে?
পুনম কে? না কি নিজের ভাগ্যকে? না কি লোকেশকেই? দিমাগ কি খারাপ হয়ে যাচ্ছিল ওনার?
নবীনের আধবুলি, দুরন্তপনা, দুষ্টুমি আর আদরে সেই আশাভঙ্গের বেদনা কিছুটা ভুলেছিলেন বটে নবীনের দাদি, কিন্তু তাঁর সেই বিষণ্ণতা কাটেনি।
এরপরেও লোকেশের দেখাশোনা হয়েছে কিন্তু রূপা দেখেছে মা’র সেই আগের উৎসাহ ছিলনা।
যারা আসছিল তাদের কাছে পুনমের বিষয়েও কিছু জবাবদিহি করতে হচ্ছিল। দেনাপাওনার দরাদরিতেও আগের মত আর সুবিধা ছিল না। অবধেশের পক্ষেও অফিস, সংসার, নবীনের ডাক্তার স্কুল এসবের যোগান দিতে দিতে আগের মত বারবার মেয়ে দেখতে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছিল না।
ধীরে ধীরে সবাই বড়বৌবিহীন সংসারটিকেই স্বাভাবিক ধরে নিয়েছিল।
চোদ্দ নম্বরের তাইজি বা বিরোনার মৌসিসাস এলেও লোকেশের বিয়ের কথা আর উঠত না।
তবে বিয়ে লোকেশের হয়েছে বৈকি।
মাঝে যখন একবার ওর কারবার খুব একটা ভালো চলছিল না তখন টাকা দিয়ে ব্যবসার অর্ধেক কিনে নিয়েছিল এক বন্ধু। তারই এক বোনকে বিয়ে করেছে লোকেশ। ওরা ওদের কারবারের সুবিধার জন্য চলে গিয়েছে শহরের অন্য প্রান্তে। সেই বন্ধুরই বাড়ির কাছাকাছি।
বোনের সঙ্গে বিয়ে দেবে লোকেশের, সেই কড়ারেই ব্যবসায়ে টাকা ঢেলেছিল বন্ধুটি সম্ভবত। এও একধরণের দহেজ বটে।
সমিতাদিদি, লোকেশের এখনকার বহুও বেশ ঘরোয়া। লম্বা চওড়া, খাটিয়ে পিটিয়ে মেয়ে। শহরের ধারের দিকে অনেকটা জায়গা নিয়ে বাড়ি করেছে লোকেশ। উঠোন, চওড়া দালান, বড়বড় খোলামেলা ঘর। সমিতা সব ঝকঝকে তকতকে করে রেখেছে।
ও জানে লোকেশের আগের জরুর মাথায় গোলমাল ছিল। রূপাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, “ ছোটিবহু, ক্যাসি থি ওহ পাগল অউরত? বহুত তং করতে থে কেয়া?”
রূপা শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “ ইতনা ইয়াদ নেহি অব।”
এমনিতে লোকেশের এবারের বিয়েতে খুব একটা কিছু করতে হয়নি ওদের। নিমন্ত্রণ খেতেই গিয়েছিল নতুন বাড়িতে। সব ব্যবস্থা লোকেশ আর ওর বন্ধুই করেছিল।
লোকেশ মাকেও নিয়ে গিয়েছিল।
সমিতাদিদি যত্নও করেছিল সাসুমার। কিন্তু লোকেশের মা তিন চার দিন পরেই এই পুরোনো বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। জীবনের শেষে এসে এই বাড়ি থেকে ঠাঁইনাড়া হতে হয়তো মন চায়নি। বাড়িও তো মানুষের শরীরের মতই। রক্ত, মাংস, মজ্জার মতই ইট, সিমেন্ট, কাঠ, ফাটল নিয়েই একান্ত নিজস্ব।
ওদের দুটো ছেলেমেয়ে হয়েছে। ভালোই আছে ওরা। আর পাঁচটা সংসারের মত। আগে প্রায়ই আসত।
কখনো মার জন্য ফল, দুধ, কখনো নবীনের জন্য জামা, খিলোনা আনত।
মা মারা যাওয়ার পর এখন আসা যাওয়া কমে গেছে।
রোদ এতক্ষণে বাইরের চাতাল ছাড়িয়ে ঘরের সামনে এসে পড়েছে।
ঠিকে কাজের মেয়েটা এসে ঝনঝন শব্দ করে বাসন নামাচ্ছে।
রূপা চটকা ভেঙে উঠে দাঁড়ায়। ও এতক্ষণ কৃষ্ণতুলসীর টবটাকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল। ফাটলটায় হাত দিয়ে আর একবার বড়িবহুর সেই নরম সরম মুখটা মনে করার চেষ্টা করল ও।
গোটা মুখটা সত্যি আর মনে পড়ছে না।
কেবল জলভরা চোখ দুটো, কাটা ঠোঁট আর বুকের ক্ষতটা আজও স্মৃতিতে জেগে আছে।
কে জানে, সে কেমন আছে এখন?
সব ক্ষত সেরে গেছে কি তার?
তুলসি গাছে জল দেবার লোটা থেকে, রূপা শেষবারের মত ঐ সিমেন্টের ভাঙা অংশটা ধুয়ে দিতে থাকে। ফাটলটায় হাত বুলোতে থাকে গভীর মমতায়। যেন পুনমের বহুবছর আগের দগদগে ঘায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ও।
রূপার বুকের ভেতর থেকে দলা পাকানো কান্না গুমরে উঠে চোখ দিয়ে গরম অশ্রু হয়ে ঝরে পড়তে থাকে। লোটার জলের ধারা বেয়ে, ওর আঙুল দিয়ে একটা সমব্যথী কান্নার সুর ঐ সিমেন্টের ফাটলের কানে কানে বলতে থাকে,
ঠিক হো যায়গা বেহেন, আরাম হো যায়গা বেহেন, ঠিক হো যায়গা বেহেন……