হিল্লোলের আচার আচরণ দিনে দিনে কেমন সন্দেহজনক হয়ে উঠছে। নীপা একমনে কাঠ খোদাই করছিলো ছাঁচে ছাঁচে। তবে মন যতটুকু কাঠের দিকে তারচেয়ে অনেক বেশী হিল্লোলের দিকে।
সেই কখন ওই ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়েছে এখনও বের হবার নাম নেই। এমনিতেই সারাদিন এ কাজ সে কাজ বলে বাড়ির বাইরে থাকে হিল্লোল, এখন এরসাথে যোগ হয়েছে লম্বাসময় দরজা লাগিয়ে ওই ঘরে বসে থাকা। কাহাতক আর সহ্য করা যায়? নীপা কাঠ বাটালি ফেলে দরজার গিয়ে দু’ঘা লাগায়,
আর কতক্ষণ ঘর বন্ধ করে বসে থাকবে?
নীপা লক্ষ্য করলো দরজাতে আঘাত করার সময় যতটুকু রাগ হচ্ছিলো কথাগুলো বলার সময় তা ঠিক হলো না। নীপার এই এক সমস্যা। কোনোকালেই হিল্লোলকে জোর গলায় কিচ্ছু বলতে পারেনি। আর বলতে পারেনি বলেই সব ছেড়েছুড়ে এই গ্রামে এসে জীবন কাটাতে হচ্ছে ওদের।
কত সুন্দর হতে পারতো ওদের জীবন। কী দারুণ ভাস্কর্য বানাতো হিল্লোল। শুধু হাতের কাজ নয়, থিওরিটিক্যালেও খুব ভালো নম্বর পেতো হিল্লোল। রেজাল্ট এত ভালো ছিল যে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওকে লুফে নিতো। আর তা না হলে নিজেই একটি আর্ট ফার্ম দিয়ে এতদিনে দেশের প্রায় সব বড় বড় প্রজেক্টের সাথে যুক্ত থাকতে পারতো। কিন্তু সে সবে জল ঢেলে হিল্লোল এখন গোবিন্দগন্জ পৌরসভার মেয়র।
এখনও সেই দিনটার কথা মনে হলে নীপার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়। ততদিনে ওদের আকদ্ হয়ে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি ছোটোখাটো অনুষ্ঠান করে হিল্লোলের বাড়ি থেকে নীপাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। অনুষ্ঠান যতই ছোট হোক না কেন, শখের তো আর বড়ছোট নেই। আর হিল্লোল তখন তো পারলে নীপাকে চোখে হারায়। তাই দু’জনে মিলেই সেদিন বেরিয়েছিলো বিয়ের কেনাকাটা করতে। না না হিরের আংটি বা চোখ ধাঁধানো শপিং মল থেকে এক্সক্লুসিভ কোনো শাড়ি কিনতে নয়। নেহাতই একটা জারুল রঙের বেনারসি, তার সাথে মিলিয়ে হিল্লোলের খাদি পান্জাবী, ক’খানা বেতের ডালি——টুকটাক এসব আর কি।
আর হ্যাঁ, সবশেষে বায়তুল মোকাররম মার্কেট থেকে একটা সোনার আংটি। হিল্লোল নিজের টাকায় কিনেছিলো সেটা নীপার জন্য। সেটা কিনে ওরা যখন রিক্সাতে করে আজিমপুর কলোনীতে ফিরছিলো তখনই কথাটি বলেছিলো হিল্লোল,
নীপা, তোমাকে তুলে নেবার পর আমরা গ্রামের বাড়িতে চলে যাবো। দাদুর বয়স হয়েছে। আমাকে বারবার ডাকছেন ওনার কাছে।
শহরের অভ্যস্ত জীবন, নতুন চাকরী সব ছেড়ে গ্রামে কীভাবে চলে যাবে?——-প্রশ্নটি নীপার মনে আসার আগেই মিলিয়ে গেলো হিল্লোলের সহজাত আত্মবিশ্বাসী বাক্যে,
গ্রাম সে তো নামেই শুধু গ্রাম, দাদুর বাড়িতে একবার গেলে তুমি শহর ভুলে যাবে দেখে নিও।
আসলে গ্রাম শহর এসব নিয়ে ভাবার সময় তখন নীপার কই? হিল্লোলের সাথে সারাজীবন থাকার ছাড়পত্র পাবার পর এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভাবার মতো মন অন্তত ছিল না নীপার তখন,
ভালোই হবে, ব্যস্তহীন তুমি আমাকে অনেক অনেক সময় দিতে পারবে।
বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া শব্দগুলো হিল্লোলের কাছে ঠিকঠাক মতোই পৌঁছেছিলো। উত্তরে নীপার হাতদু’টো নিজের হাতের ভেতর পুরে নিয়েছিলো হিল্লোল।
হ্যাঁ হিল্লোল ঠিকই বলেছিলো, গ্রাম তো আসলে নামেই গ্রাম। হিল্লোলের দাদুবাড়িটা বেশ পুরোনো। বেশ জমিদারবাড়ি জমিদারবাড়ি ভাব। তবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাড়িটা এখনো ঝকঝকে। বাড়ির আসবাবগুলোও খুব রুচিশীল আর দামী। এমনকি বেশ পুরোনো একটা এয়ার কুলারও আছে এ বাড়িতে। মোটকথা বাড়িটা এককথায় বনেদী।
আর বনেদী বাড়ির মালিকটাও খুব ভাবগম্ভীর আর অভিজাত। হিল্লোলের দাদু মানুষটিকে দেখলেই মনে সমীহ জাগে। আর এরসাথে পুরো গ্রামে তাঁর আধিপত্য তো আছেই। তবে হিল্লোল ঠিক ওর দাদুর মতো নয়। হবেই বা কেমন করে? বাবা মারা যাবার পর হিল্লোলের মা হিল্লোলকে নিয়ে এ বাড়ি থেকে শহরে গিয়ে উঠেছিলো দাদুর নিষেধ অমান্য করেই। তাই হিল্লোলের বড় হওয়াতে দাদু সেভাবে প্রভাব রাখতে পারেনি।
তবে সারাগ্রামে যার আধিপত্য তিনি কি নিজের একমাত্র বংশধরের উপর থেকে সব দাবী তুলে নিতে পারেন? এজন্যই সুযোগ পেলেই তিনি হিল্লোলের সাথে যোগাযোগ করতেন। আর হিল্লোল বিয়ে করছে জেনে তো আবদারই করে বসলেন অন্তত যে কয়েকটা বছর উনি বেঁচে আছেন হিল্লোল আর ওর বউকে তিনি নিজের কাছে রাখতে চান।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে হিল্লোলও দাদুর এই আবদার মেনে নিলো।
নীপা তখনও জানতো না এই আবদার, এই মেনে নেওয়া——এসবের মধ্যে সংসারের এক কদর্য রাজনীতি লুকিয়ে আছে। হিল্লোলে মাতোয়ারা নীপার সব ভাবনা তখন হিল্লোলে শুরু আর হিল্লোলেই শেষ। অন্যকিছু নিয়ে ভাবার সময় নেই নীপার তখন।
কিন্তু এখন ভাবতে হয়। অনেককিছুই ভাবতে হয়।
তবে ঠিক এই মুহূর্তে নীপার আগপাছ কিছু ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। আবারও দু’ঘা বসিয়ে দিলো ঘরের বন্ধ জরজায়।
না, এবার আর হিল্লোল এই দরাম দরাম শব্দ উপেক্ষা করতে পারলো না। খুব আস্তে করে ঘরের দরাজ খুলে বেরিয়ে এলো।
নীপা চমকে উঠলো। আজ কেন যেনো হিল্লোলকে হুবহু ওর দাদুর মতো লাগছে। চোখের চাহনীতে যতটুকু সরলতা তারচেয়ে অনেকবেশী নির্লিপ্ততা আর জোর করে সিনা টান করে দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে হিল্লোলকে কেমন যেন বেখাপ্পা লাগছে। কিন্তু ওই যে, হিল্লোল সামনে এলেই নীপা কেমন খেই হারিয়ে ফেলে। আচ্ছা, হিল্লোল কি সম্মোহন করতে জানে?
সম্মোহন শব্দটা মাথায় আসতেই নীপা কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। আক্রোশে ফেটে পড়তে পড়তে বললো,
তুমি আবার সেসব শুরু করলে?
অদ্ভুতভাবে শব্দগুলোতে যতটা না ক্ষোভ তারচেয়ে অনেকবেশী আক্ষেপ। খুব অসহায় লাগে নীপার। ও কেন যে পারে না চিৎকার করে হিল্লোলকে ওর অন্যায়গুলো দেখিয়ে দিতে? কেন পারে না নিজের শরীরের সব শক্তি দিয়ে হিল্লোলকে বাঁধা দিতে? নিজের অসহায়ত্বের কাছে আরেকবার হেরে যেতে যেতে নীপা বলে,
এই মাসেই আমাদের বিয়ে হয়েছিলো, তোমার মনে আছে হিল্লোল?
হিল্লোল কেমন যেনো উসখুশ করে ওঠে। কিছু একটা মনে পড়ে যাবার উছিলায় উত্তর দেয়,
জরুরী কাজটা ভুলে গিয়েছিলাম। এখনই বেরোতে হবে আমাকে।
নীপা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হিল্লোলের চলে যাবার দিকে। প্রকান্ড এই বাড়ির নিস্তব্ধতা গিলে খেতে চায় ওকে। মনোযোগী ছাত্রের মতো বাটুলীটা আবার হাতে তুলে নেয় নীপা। বাটুলীর প্রতিটা আঘাত কাঠের টুকরোতে ক্ষত হয় বসছে আর নীপার ঠোটে ফুটে উঠছে একটু একটু করে হাসি।
হ্যাঁ, সবকিছু হারিয়ে এই একটি কাজেই নীপা এখন আনন্দ খুঁজে পায়।
গ্রামে আসার পর পর কিন্তু এমন ছিল না। নতুন সংসার বলতে যা বোঝায় যদিও তা ছিল না সেটা, তবুও ঘরকন্না শুরুর দিন বলে কথা। ঘরে-বাইরে মিলে তিন চারটি কাজের মানুষ থাকা সত্বেও সবার জন্য রান্না করা, বাড়িঘর গুছিয়ে রাখা সব করত নীপা।
আর ওই যে দিনশেষে ছাদে বসে হিল্লোলের সাথে চা খাওয়া, ঠিক গল্পের মতো ছিল দিনগুলো।
কিন্তু সেই গল্প যত এগুলো ততই এই বাড়ির আভিজাত্য ভেঙে বেরিয়ে আসতে শুরু হলো বিশ্রী কথাগুলো। প্রথম প্রথম নীপা খুব একটা কানে নিতো না সেসব কথা। হতেই পারে নিজের একটা ভালো ক্যারিয়ার গড়ার কথা ভেবেই হিল্লোলের মা এ বাড়ি ছেড়েছিলো।
না, নীপার এমন সরল ব্যাখ্যা খুব একটা টেকসই হলো না। ক’দিন পরেই বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো কাজের মানুষটি খুব গোপনে নীপাকে জানালো,
এ বাড়ির বউ পুত লইয়া জীবন বাঁচাইতে পালাইয়া গেছিলো।
যাহ্, এ আবার হয় নাকী। গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষের ছেলের বউ আর নাতির জীবনের আশংকা কীভাবে হয়? আর হলেও এই বাড়ির চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর হতে পারে?
পুরোনো কাজের মানুষটি ঘোলা চোখ নিয়ে বলেছিলো,
নতুনকালে বুঝবা না, পুরান হও বুঝতি সময় লাগবো না।
মনে মনে হেসেছিলো নীপা। পাড়াগাঁয়ের এসব কুটকাচালি কালচার সম্পর্কে অল্পকিছু ধারণা তো নীপারও আছে। এসব কথা পাত্তা দেবার মানুষ নীপা না।
কিন্তু বাগড়া বাঁধলো তখন, যখন পাত্তা দিতে না চাইলেও কিছু ব্যাপার একদম নীপার চোখের সামনেই ঘটতে লাগলো।
এই যেমন, হিল্লোল কথা নেই বার্তা নেই হুট করেই দু’তিন দিনের জন্য কোথায় যেনো চলে যেতো। আবার ফিরে এলেও কেমন যেন আনমনা হয়ে থাকতো।
কোথায় গিয়েছিলে তুমি? আমাকে না জানিয়ে গেলে চিন্তা হয় না আমার?
এসব কথার উত্তরে হিল্লোল নীপার হাতদুটো ধরে বলতো,
কাজ ছাড়া আমি বাড়ির বাইরে কেন থাকবো?
প্রশ্নের উত্তরে হিল্লোল যতই প্রশ্ন রাখুক না কেন, উত্তর নীপা ঠিকই পেয়ে গিয়েছিলো ক’দিনের মধ্যেই।
কল্লোলের পকেটেই পেয়েছিলো রিসোর্টের স্লিপটা। এ বাড়ির কোনো কাজে যে হিল্লোল রিসোর্টে যায়নি তা খুব বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি নীপার। কারণ স্লিপে খুব স্পষ্ট অক্ষরে লেখা আলহ্বাজ ওবায়দুল্লাহ্।
দাদুর নাম নিয়ে হিল্লোল যে শুধু একমাত্র দাদুর কাজেই বাইরে যেতে পারে ততদিনে নীপা তা বুঝে গিয়েছে। কারণ এই নামটি শুধু এই এলাকা নয়, আশেপাশের অনেক এলাকাতেই বেশ প্রভাব রাখতে পারে।
হ্যাঁ এটা সত্যি যে শুধু নামটাই যে এলাকাসহ আশেপাশের সবার উপর প্রভাব রাখছে তা নয়, সেই মানুষগুলোও কীভাবে যেন এই বাড়িটার উপরও প্রভাব ফেলছে প্রতিনিয়ত। নয়ত আর্ট কলেজে যে হিল্লোলের হাতের তৈরী ভাস্কর্যে মুগ্ধ হয়নি এমন কাউকে খুঁজে পওয়া দুস্কর, সেই হিল্লোলই নীপার আনা সব ঘর সাজানো ছোটোখাটো মূর্তিও সরিয়ে ফেললো,
আরেহ্, বাড়িতে এসব থাকলে এলাকার মানুষকে কীভাবে শেখাবো?
হ্যাঁ, হিল্লোল গ্রামে আসার পর এলাকার মানুষদের ভালোমন্দ শেখানোর কাজ তো দাদু ছেড়েই দিলেন। হিল্লোল তাঁর একমাত্র বংশধর, দূরে থাকলেও বংশের রক্ত ঠিকই কথা বলে। তাই হিল্লোলকে নিজের মতো বানিয়ে তুলতে দাদুকে খুব একটা বেগ পেতে হলো না।
কীভাবে বেগ পেতে হবে? বুদ্ধিদীপ্ত হিল্লোল খুব সহজেই বুঝে গিয়েছিলো এখানে প্রতিপত্য’র মূল মন্ত্রই হলো হুবহু দাদুর মতোই হয়ে ওঠা। সে আর এমন কী কঠিন কাজ?
হিল্লোলের জন্য সবকিছু যত সহজ হয়ে উঠছিলো, ততই কঠিন হচ্ছিলো নীপার জীবন।
ছোট্ট এই জীবনের জন্য নীপার চাওয়া তো এত বেশী ছিল না। ন’টা-পাঁচটা চাকরী আর ছুটির দিনে দু’জন মিলে ঘুরে বেড়ানো——-এটুকুতেই নীপার হয়ে যেতো বেশ। এই যে কথায় কথায় এত এত দামী জিনিষ, না চাইতেই অজস্র উপহার এসব কিছুই তো আসলে নীপার চাই না।
একটাই চাওয়া নীপার, সেটা হলো সেই আগের হিল্লোলকে ফিরে পাওয়া।
তবে চাইলেই কী আর সব পাওয়া যায়? বিশেষ করে একজন মানুষ যখন অদ্ভুতভাবে নিজেকে ভুলে যায়, তাকে ফিরিয়ে আনা কী এত সহজ?
আর নীপা সেই কঠিন কাজটাতেই হাত দিয়েছে ক’দিন হলো। নীপার হাতের বাটুলীটা যতই কাঠের বুকে নকশা ফুটাক না কেন ওর মাথায় ভেতর কিন্তু সেই একই চিন্তা কুটকুট করে আঘাত করছে, তা হলো আগের সেই হিল্লোলকে ফিরে পাবার চিন্তা।
না, নীপার এই চিন্তা আজ নয় শুরু হয়েছে বেশ আগেই। আর শুধু বসে বসে চিন্তা করলেই তো হয়না, চেষ্টাও তো করতে হয় বিস্তর। নীপা এরইমধ্যে কতভাবেই না চেষ্টা করেছে।
এই তো ক’দিন আগের ঘটনা, যা মনে হলে নীপা এখনো ভেতর থেকে কুঁকরে আসে লজ্জায়। এমনিতে নীপা খুব সহজ-সরল মেয়ে। কোনোকিছু নিয়ে তালবাহানা বা আদিখ্যেতা, কোনোটাই ঠিক নীপার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়। আর ভণিতা শব্দটি তো একেবারে নেই ওর ডিকশনারীতে।
তবে সেদিন হিল্লোলকে ঘরে রাখতে নীপা এক অদ্ভুত ভান করে বসলো। অসুস্হতার ভান। না, এমন নয় যে নীপার কখনো অসুখ-বিসুখ হয়নি। তবে তা নিয়ে খুব বেশী উঁহু-আহা করার মেয়ে নীপা নয়। কিন্তু সেদিন মাথাব্যাথায় এমন কোঁকাতে শুরু করলো যে হিল্লোলও বেশ ঘাবড়ে গেলো। কিন্তু ওই ঘাবড়ে যাওয়া পর্যন্তই সার। হিল্লোলকে আর ঘরে রাখতে পারলো কই? সেই তো দাদুর এক কথাতেই হিল্লোল ছুটে চলে গেলো বাড়ির বাইরে,
অসুখ হয়েছে ওষুধ খেলেই ঠিক হবে, তবে তুমি বাড়ি থাকবে না কাজের জায়গাতে যাবে এটা তোমার বিবেচনা।
নীপার মিথ্যে মাথাব্যাথার ভান নিমিষেই পন্ড হয়ে গেলো।
আসলে হিল্লোল যা করে বেড়াচ্ছে তাতে প্রতি মুহূর্তে নীপার শুধ অস্বস্তিই হয় না, প্রতি মুহূর্তে রীতিমতো অপমানিত হয় নীপা।
নীপা অনেক বুঝিয়েছে নিজেকে, নিজেকেই নিজে যুক্তি দিয়েছে অনেক কিন্তু দিনশেষে সেই একটি প্রশ্নে এসেই আটকে যায় ও,
কেন হিল্লোল এতটা বদলে গেল?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে সবার আগে জানতে হবে আলহ্বাজ ওবায়দুল্লাহকে। যিনি এই গ্রামে বাস করছেন প্রায় সাতপুরুষ ধরে। শোনা যায়, সুদূর ইরান থেকে ঘোড়ায় চড়ে এই গ্রামে এসেছিলেন তাঁর পরিবারের প্রথম পুরুষ। এই এলাকার ঘরে ঘরে গিয়ে তিনি মানুষগুলোকে জীবনের দিশা দিয়েছেন। তাই বলতে গেলে এলাকার প্রতিটি ঘরেই তাঁর মুরীদ।
তবে সময় সবসময় তো একইরকম থাকেনা। তাই আলহ্বাজ ওবায়দুল্লাহ্-র সময় আসতে আসতে পীর-মুরীদের সম্পর্কের সাথে খুব আলগোছে সেখানে রাজনীতি মিশে গেলো। কারণ আধিপত্য প্রিয় আলহ্বাজ ওবায়দুল্লাহ ঠিকই জানতেন শুধু ধর্মের আলো বিলিয়ে একচ্ছত্র হওয়া যাবে না, ধর্ম আর ক্ষমতাকে এক করতে পারলে তবেই অধিপতি হওয়া যাবে।
তাই নিজের ছেলে মানে হিল্লোলের বাবাকে দিয়ে রাজনীতির শুরুটা করিয়েছিলেন। মানে বড় কোনো মুরীদের রাজনৈতিক সভায় ভাষণ দেওয়া বা আড়ালে থেকে নিজের প্রভাব খাটিয়ে কাউকে কাউকে ভোট পাইয়ে দেওয়া এসব আর কি। কিন্তু হিল্লোলের বাবার সেই শুরুটা হুট করেই থেমে গেল। আলহ্বাজ ওবায়দুল্লাহ্-র দুই বড় মুরীদের মধ্যে পক্ষ নির্বাচন করতে গিয়ে ভুল করা তার মৃত্যু হলো।
আসলে সেটি ছিল হত্যা। তবে সেই হত্যা কে করেছিলো তা আজ অবধি খোলাসা হয়নি।
এটা খোলাসা করত ওবায়দুল্লাহও খুব একটা চেষ্টা করেননি। এ নিয়ে তাঁর কথা একটাই,
মৃত্যূ আল্লাহর ইচ্ছেতেই হয়, শুধু উছিলা লাগে মাত্র।
কী অদ্ভুত! মাঝে মাঝে তো নির্দয়ও মনে হয় মানুষটাকে। তবে বুদ্ধিমান আলহ্বাজ ওবায়দুল্লাহ একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে যে পরিমাণ মুরীদের পিতার জায়গা পেয়েছেন তাতে তাঁর আধিপত্য বাড়ে বৈ কমেনি।
তাছাড়া নিজের সন্তান হলে কী হবে, হিল্লোলের গোবেচারা বাবা যে রাজনীতির জন্য খুব একটা উপযুক্ত ছিল না তা আলহ্বাজ ওবায়দুল্লাহ ছাড়া আর কে বুঝতে পারে। তাই নিজের নাতিন মোহাম্মদ তৈমুরকে নিয়ে ছোটবেলা থেকেই তাঁর পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। হ্যাঁ, হিল্লোলের নাম আলহ্বাজ ওবায়দুল্লাহ দিয়েছিলেন মুহাম্মদ তৈমুর।
সেই মুহাম্মদ তৈমুর হঠাৎ করেই একদিন দাদুর মুরীদদের বিপদহন্তা হয়ে উঠলো।
আরেহ্, বছর তিনেকের তৈমুর তা পারে নাকী? সে তো দাদুর লিখে দেওয়া কাগজে হাত রাখতো শুধু। আর তাতেই বাজিমাত হয়ে যেত। অদ্ভুতভাবে মিলে যেতে শুরু করলো কাগজে লেখা সেসব কথা। কারোকারো বিপদ কেটে যেতে শুরু করলোকাগজে লেখা সেসব নিদান থেকে।
ব্যস, মোহাম্মদ তৈমুরের ঐশি ক্ষমতা আছে তা এ থেকেই প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলো।
কিন্তু এতটুকু বাচ্চাকে এভাবে দেখতে তৈমুরের মা’র ভয় হতো। আর বিশেষ করে যার স্বামী এসব করতে গিয়ে খুন হয়েছে তার নিশ্চয়ই নিজের সন্তানকে একই জায়গায় দেখতে ভালো লাগবে না।
তাই একদিন তৈমুরকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় তার মা। সন্তানকে এ বাড়ি আর মানুষগুলো থেকে দূরে রাখতে নামটাও পাল্টে দেন। মোহাম্মদ তৈমুর আধুনিকা মায়ের সাথে বড় হতে হতে হয়ে উঠলো হিল্লোল।
তবে নামে কীইবা এসে যায়? কথাটা সর্বৈব সত্য।
হিল্লোল হয়ে উঠলেই আলহ্বাজ ওবায়দুল্লাহ নিজের বংশধরকে ভুলে যাবেন তা কী করে হয়? বরং হিল্লোলকে খুঁজে পেয়ে যখন দেখলেন দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনো করে সে একজন আধুনিক মানুষ হয়ে উঠছে, তখন আলহ্বাজ ওবায়দুল্লাহ হিল্লোলের মাঝে খুঁজে পেলেন এক ক্যারিশম্যাটিক নেতার ঝলক। যার সাথে মানুষকে সম্মোহন করার গুণটা মিলিয়ে দিলে এই হিল্লোলই হবে পীর বাড়ির ক্ষমতার অলোকবিন্দু।
আর হলোও তাই। এলাকায় আসতে না আসতেই হিল্লোলের পরিমিত ব্যক্তিত্বে গুণমুগ্ধ হয়ে উঠলো অজস্র সম্ভ্রান্ত মানুষ, আবার পীরবংশের মানুষ হিসেবে এর ওর বিপদের নিদান বলে দিয়ে হয়ে উঠলো অকাট মূর্খ মানুষগুলো শ্রদ্ধাভাজন।
মোট কথা একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা।
কীভাবে এত বছর পর হিল্লোলের সেই ঐশি ক্ষমতা ফিরে এলো?
প্রশ্নটির উত্তরে হিল্লোলের একটাই কথা, মানুষগুলোর চোখের দিকে তাকালেই তো বোঝা যায় কত ভীতু আর অলস ওরা। সাহস দিয়ে কিছু বললে ওরা অনুপ্রাণিত হয়, কাজ করে। এতেই ফল পায়।
বেশ ভালো ব্যাখ্যা। তো তাই বলে সব নিদান একইভাবে ফলে? উঁহু, তা কি করে হয়? যেটা না ফলে সেটা নিয়ে আলহ্বাজ ওবায়দুল্লাহ-র বক্তব্য সম্মোহনের সময় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ না করলে নিদানে কাজ হয় না।
কী অদ্ভুত কথা, অশিক্ষিত মানুষগুলো সম্মোহনেরই অর্থ বোঝেনা তারা আবার তাতে সমর্পণ কী করবে?
তবুও সবাই আলহ্বাজ ওবায়দুল্লাহ্-র কথায় সায় দেয়। হাজার হলেও পীরবাড়ির মানুষের কথা। ভুলভাল কী করে হয়?
হ্যাঁ, তাই তো, পীরবাড়ির মানুষ বিশেষ করে মুহাম্মদ তৈমুর ওরফে হিল্লোলের তো ভুল হতেই পারে না। তিনি তো ঐশি ক্ষমতা দিয়ে সবকিছু বলতে পারেন, সবকিছু বুঝতে পারেন। যার চোখের দিকে তাকালে স্পষ্ট নিজের ভবিষ্যত দেখতে পাওয়া যায়, তিনি তো যা বলবেন তাই ঠিক হবে।
আর হলোও তাই।
এলাকার শেষ মাথায় বেশ ক’ঘর বিধর্মীদের বাস। সেখানে কতক মন্দিরও আছে। রাজনীতির প্রয়োজনে হিল্লোলকে দু’একবার যেতেও হয়েছে সেক্যুলার মানুষগুলোর খাতির পেতে আর কি।তা যাই হোক, এসব বিধর্মীদের নিয়ে হিল্লোলের মনে কোনো রুষ্টতা কখনই ছিল না। না ছিল বিশেষ কোনো আগ্রহ।
কিন্তু হঠাৎ করেই এলাকার বিধর্মী মানুষগুলোর মন্দিরে পাওয়া গেলো কোরান শরীফ। কে আনলো এই কোরান শরীফ মন্দিরে, কীভাবে এলো এই পবিত্র গ্রন্হ এমন জায়গায়——-এসব প্রশ্ন মানুষকে যতটুকু ভাবালো তার চেয়ে ঢের বেশী ক্রোধে আক্রান্ত করলো।
পবিত্র গ্রন্হকে যারা অপবিত্র করে তাদেরকে আর যাই হোক মানুষ বলা যায় না। আর তাই এলাকার শেষ প্রান্তের সেই পাড়াটাকে পশুদের পাড়া ভেবে নিলো সবাই।
পশুদের সাথে তো পশুর মতোই ব্যবহার করতে হয় নাকী?
কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো পীরবাড়ি নিয়ে। পীরবাড়ি তথা এলাকার নেতার থেকে ঘোষণা এলো পৃথিবীর কেউ চাইলেই কোরান শরীফকে অপবিত্র করতে পারবে না।
ক’দিন আগেই ভাইরাল হওয়া একটি খবরের কথা উল্লেখ করে মুহাম্মদ তৈমুর ঘোষণা দিলো, এই পবিত্র গ্রন্হকে কখনো আগুন পোড়াতে পারে না। তাহলে সেই শক্তিশালী গ্রন্হকে সাধারণ মানুষ কীভাবে তা অপবিত্র করতে পারে?
সুতরাং বিধর্মীদের পশু ভাবা বন্ধ হোক। তাদের উপর নির্যাতন করা বন্ধ হক।
আসলে হিল্লোল মন থেকে ঠিক মেনে নিতে পারছিলো না এলাকার শেষ প্রান্তের পাড়ার ওই মানুষগুলোর এই অসহায় অবস্হা। আর হুট করেই হিল্লোল নিজের সম্মোহন শক্তির উপর বিশ্বাস রেখে ধরে বসলো এক বাজি,
কেউ মুহাম্মদ তৈমুরের কথা বিশ্বাস না করলে আনা হোক সেই পবিত্র গ্রন্হ যার চারপাশে আগুন জ্বালিয়ে প্রমাণ করা হবে আগুনের উত্তাপ কতটা নিরুপায় সেই গ্রন্হের কাছে।
হিল্লোলের এই বাজিতে নীপা বেশ ভড়কে গেলো। তবুও নিজেকে সংযত করে বললো,
হিল্লোল তুমি জানো পোড়ানোই আগুনের কাজ। কেন এই বাজি ধরছো? বিপদে পড়ে যাবে তুমি।
নীপার শেষ কথাটুকু হিল্লোলের কাছে উপহাস মনে হলো।
পীরবাড়ির জনপ্রিয় নেতা ও ঐশি ক্ষমতাধর মানুষটির বিপদ হবে? চোখের দিকে তাকালেই যারা সম্মোহিত হয়ে যায়, তাদের কাছ থেকে বিপদ?
ব্যস্, মুহাম্মদ তৈমুর সেই ঘোষণায় যুক্ত করে দিলেন আরোও এক লাইন, আগুন যদি সেই গ্রন্হকে পোড়ায় তাহলে যেন তাকেও সেই আগুনে পুরিয়ে দেওয়া হয়।
এই বাড়তি লাইনটুকু নীপাকে চ্যালেন্জ করা নাকী হিল্লোলের নিজের আধিপত্যেকে চ্যালেন্জ করা, তার হিসেব মেলানোর মতো সেখানে আসলে কেউ ছিল না।
মুহাম্মদ তৈমুর ওরফে হিল্লোল জানতো পীরবাড়ির ঘোষণাই শেষ কথা। তা প্রমাণের সাহস অন্তত এলাকার কারো নেই।
কিন্তু তা আর হলো কই। এলাকার নিরেট সহজসরল মানুষগুলোই পীরবাড়ির সামনে কোরান শরীফটা নিয়ে এলো।
চারপাশে অসংখ্য শুকনো গাছের ডালপাতায় আগুন দিয়ে বললো,
দেখে নিও এই গ্রন্হ পুড়বে না। আজ আবার প্রমাণ হবে পীরবাড়ির বংশধর আর আমাদের নেতার ঐশি শক্তির মহিমা।
আসলে সরল মানুষগুলো মুহাম্মদ তৈমুরের ঐশি শক্তিতে কতটা সম্মোহিত হয়েছিল তা প্রমাণ হয়ে গেলো আরেকবার। তাই তো আগুন যতই কোরান শরীফকে পোড়াচ্ছিল ততই তার তাপ কাছে আসছিলো হিল্লোলের।
নির্বাক চোখে মুহাম্মদ তৈমুর তাকিয়ে দেখছিলো সরল মানুষগুলো যে হাত দিয়ে গ্রন্হখানা আগুন থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে ঠিক সেই হাতগুলো দিয়েই তাকে আগুনের উত্তাপে ঠেলে দিচ্ছে নির্বিকারভাবে।
পীরবাড়ির সামনে আগুন নিয়ে খেলা এ আর নতুন কি? তাই নিশ্চিত মনে কাঠ খোদাইয়ে বসেছে আজ নীপা। বাটুলির শেষ আঘাত কাঠে পড়তেই নীপার ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক অদ্ভুত হাসি। কাঠের ছাঁচ কেটে বেরিয়ে এলো মানুষের ভাস্কর্য।
যা দেখতে অবিকল হিল্লোলের মতো।