নদীর ঘাট পেরিয়ে বলাকা সিনেমা হলের পাশ দিয়ে আমরা ছেড়ে যাওয়া শহরের বাসে উঠতেই পেছন থেকে প্রতিবার একটা কথাই ভেসে আসে,
গিন্নি, আবার এসো তাড়াতাড়ি।
আমি জানি, এই তাড়াতাড়ির অর্থ—দিন গোনা শেষে মাসে গিয়ে দাঁড়াবে। অগ্রহায়ণে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে তবেই না বাড়ি ফিরতে পারবো। পূজার ছুটিতে পড়াশুনার খুব ক্ষতি হয়ে গেছে। তবে শুধু কি পড়াশুনা, ওদিকে বাবা গানের দিদিও ঠিক করে রেখেছে আমার জন্য। মোটকথা— ছোট আর আহ্লাদী বলে বাড়িতে যতই সবার প্রশ্রয় পাই না কেন, শহরে আমাকে ঠিকঠাক বাবার শাসনেই বড় হতে হবে। বাবার ওই একটাই কথা—আর যাই করো না কেন, পড়াশুনা কিংবা গানে ফাঁকি দেওয়া চলবে না মোটেও।
তাই নলকা ব্রিজ পেরিয়ে আমাদের বাস যখন শহরের দিকে বাঁক নিলো, তখন আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলাম বাড়ির যাওয়ার ফেলে আসা রাস্তাটা। আমি জানি, এই রাস্তা ধরে সোজা হেঁটে গেলেই আমি দেখা পাবো প্রাচীন বটগাছের। যে গাছ শিকড় ছড়িয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে আমাকে বরণ করে নিতে—যে কোনো সময়।
জানি না কেন—রাস্তা, নাকি বটগাছ কীসের জন্য—আমার মনটা হঠাৎ হু হু করে ওঠে। মুঠো খুলে কর গুনি অগ্রহায়ণের, তবে আমার ছোট্ট হাতে এত লম্বা সময়ের হিসেব ধরে না। থই না পেয়ে আমি মনের ভেতর বলে চলি,
আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ....
এবার শহরে ফিরে আসার পর আয়েশ করে বাড়ির জন্য মন খারাপের ধারাপাত পড়ার খুব একটা সুযোগ হলো না আমার। কলঘরের চৌবাচ্চার ঠান্ডা জলে গা ধুয়ে বাড়ির ঘ্রাণ মুছে ফেলতে না ফেলতেই বাবা হাতে ধরিয়ে দিলো স্কুলের বই-খাতা। দুপুরের খানিক সময় পরেই দীপঙ্কর স্যার পড়াতে চলে আসবেন। দাগকাটা খাতা ভরে বাকি থাকা হাতের লেখা শেষ করে ফেলতে হবে বিকেলের আগেই। আর তারপর সন্ধ্যায় গানের দিদি আসবে আরোহী-অবরোহীর সুর শেখাতে।
কয়েক ঘণ্টা আগেই যে মেয়েটি ঠাকুমার পেছন পেছন আদর খেয়ে বেরিয়েছে, দাদুর পাতের খাবারে ভাগ বসিয়েছে, বায়না ধরে মনিপিসির পুঁতির মালা নিজের গলায় পরেছে—শহরে ফিরে সেই মেয়েটি এক বন্দি হলো অদ্ভুত এক নিয়মের বেড়াজালে। যেখানে আদর-আহ্লাদ থাকলেও, চড়া সুরের শাসনও আছে তার সাথে – যা মেয়েটিকে বারবার জানান দেয়—শহুরে আদবকেতায় আর যাই হোক, সারাদিন হৈ হৈ করার ফুরসত নেই, ইচ্ছে হলেই পাড়ার বুকে ছুটে বেড়ানোর অনুমতি নেই। তাই উপায়হীন আমি বারান্দায় পাটি পেতে হাতের লেখায় সময় ফুরাবার অজুহাত খুঁজি।
আমরা বাসায় ফিরবো বলে আর কেউ অপেক্ষায় না থাকলেও, বড়দাদী ঠিকই পায়ে পায়ে এসে হাজির হয়। প্রায় দেড়মাসের জমানো আদরটুকু আমার মাথায় বুলিয়ে পান খাওয়া মুখে বলে ওঠে,
নাতিন এতদিন থাকতে হয় নাকি এই বুড়িকে ছেড়ে? তা ঠাকুমার বাড়ি নাইওর কেমন খেলে এবার?
বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা শূন্যতা এবার আমার চোখে জড়ো হয়। ঠাকুমার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আমি চোখ নামিয়ে খাতার কাছে আনি। বড়দাদীর কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করতে খাতায় লিখে চলি,
তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে…
আমাদের আসার দিনক্ষণ জেনে বড়দাদী মুসার মাকে দিয়ে বাসা পরিষ্কার করিয়ে রাখে। উঠোন জুড়ে পড়ে থাকা পাতা এক জায়গায় জড়ো করা, কলঘরের মেঝে বালু দিয়ে ঘষে ধুয়ে রাখা, টাইমকলের জল চৌবাচ্চায় ভরে রাখা—এসব কিছু বড়দাদী দাঁড়িয়ে থেকে করায়। আর আমরা বাসায় পৌঁছাতে না পৌঁছাতে হরিপদ ঘোষ ঘটি ভরে রোজকার দুধ দিয়ে যাওয়া আর রহিম চাচাকে বাজারে পাঠিয়ে আনাজপাতি কিনে আনা – এ সবকিছুও হয় বড়দাদীর আদেশে।
আসলে বড়দাদীর দেখভালে আমাদের শহুরে জীবন অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। আর সে সহজ জীবনে অভ্যস্ত হবার প্রাণপণ চেষ্টায় আমি বারবার হাতড়ে বেড়াই আমার বাইরবাড়ি, খুঁজে বেড়াই উঠোনে দুলতে থাকা পেয়ারা গাছের ছায়া। তবে সেসব না পেলেও হঠাৎ হঠাৎ আমার হাত ভরে ওঠে ঢ্যাঁপের মোয়ায়,
নাতিন নাও, ঠাকুমার পাঠানো মিঠাই আমরা একসাথে খাই…
বাড়ি থেকে আমাদের সাথে আসা মুড়ি মুড়কির টিনের মুখ খুলেছে এরই মধ্যে। সেখান থেকে বাটিতে পড়েছে পূজার মোয়া-নাড়ু বড়দাদী আর মুসার মায়ের জন্য।
আমি লেখার খাতা থেকে মুখ তুলি, হাতভরা ঢ্যাঁপের মোয়ায় মাখা গুড়ের ঘ্রাণে আমি এক ঝটকায় খুঁজে পাই ঠাকুমার ঘ্রাণ। সবভুলে আমি যতটুকু খাই তার চেয়ে অনেকবেশি আস্বাদ নিই ঠাকুমার সুবাসের। আর মনে মনে গুণে চলি,
আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ…
রহিম চাচার রেখে যাওয়া বাজারের ব্যাগ থেকে আজ বের হলো গুজার কাটা মাছ, লকলকে সবুজ কলমি শাক আর মওসুমি কিছু সবজি।
বারান্দায় কেরোসিনের স্টোভে নীল আঁচ জ্বলে উঠেছে এরইমধ্যে। সেই আঁচে সেদ্ধ বসেছে মুগডাল। আর আমাদের বাসায় ডাল মানেই তার সাথে অবধারিত একটা ভাজি থাকবেই। তাই মা তালবেগুনের কয়েক টুকরো কেটে নিলো ভাজার জন্য। সবুজ কলমি শাকের ডগা দেখেই মা বাড়ি থেজে আসা ব্যাগের মুখ খুলেছে। সেখান থেকে ঝুনো দেখে একটা নারিকেল ধরিয়ে দিয়েছে মুসার মায়ের হাতে কুরানোর জন্য।
এ ক-দিনে মুসা আরেকটু বড় হয়েছে। বড় বড় চোখের মোটা পেটের মুসা এখনও স্কুল ফাঁকি দিয়ে নীল সবুজ মার্বেল খেলায় মেতে থাকে। আর সুযোগ পেলেই নিজের মায়ের কাছে এসে হাঁক দেয়,
এ মা! ভাত দে ভুখ পাইছে…
তবে আজ কিন্তু মুসা ভাতের আবদার ধরলো না। এমনকি গলা ছেড়ে হাঁকও দিলো না। তার বদলে আজ ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বললো ওর মায়ের কাছে গিয়ে। আর সে কথা শেষ হবার সাথে সাথেই হো হো হেসে উঠলো মুসার মা,
পিঠা না আব্বা, ওগুলান লাড়ু মোয়া…
আমার হাতে ধরা ঢ্যাঁপের মোয়ার দিকে মুসার মায়ের ইঙ্গিত। মা বুঝে যায় সবকিছু। এবার বাটিতে পড়ে মুসার ভাগের নাড়ু মোয়া।
মাঠের মসজিদ থেকে ভেসে এলো দুপুরের আজান। মায়ের হাতের কাজও গতি বাড়াই এর সাথে সাথেই। ঘড়ির কাঁটা ১-এর ঘরে পৌঁছালেই বাবা কলঘরে ঢুকবে। আর রেডিওতে অনুরোধের আসর শুরু হলেই বারান্দায় পাত পড়ে যাবে আমার আর বাবার।
তবে নতুন কেনা রূপালী রঙের ন্যাশনাল ক্যাসেট প্লেয়ারে এখন বাবার প্রিয় শিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় গেয়ে চলেছে,
এত জল ও কাজল চোখে, পাষাণী, আনলে বল কে?
এত জল ও কাজল চোখে, পাষাণী, আনলে বল কে…
বাবা মাঝে মাঝে নিজেই তবলা নিয়ে বসে যায় এসব গানের সাথে সঙ্গত করতে। এই এক ঝোঁক বাবার। এজন্যই অফিসের পর সন্ধ্যায় বাবাকে খুঁজে পাওয়া যায় বুঁদ হয়ে থাকা কোনো গানের আসরে। সঙ্গীতপাগল বাবার ওই এক কথা,
সুর হলো নিজেকে শুদ্ধ করার মন্ত্র…
এসব কথার অর্থ না বুঝলেও, এতটুকু বুঝি—বাবার কাছে সঙ্গীত হলো শ্বাস নেওয়ার মতো।
কেরোসিনের নীলচে আঁচ থেকে এখন নামলো জিরা, কাঁচামরিচ বাটায় গুজার কাটা মাছের পাতলা ঝোল। এবার স্টোভে চাপলো শাকের কড়াই। তাতে পড়লো সর্ষে আর শুকনো মরিচ ফোড়ন। এরপর কুচানো কলমির লকলকে ডগাগুলো তাতে পড়তেই সবুজ গাঢ় হলো আরো খানিক। লবণ আর হলুদ গুঁড়ো দিয়ে নেড়ে দিলো মা শাকগুলোকে। তাতে এবার পড়লো ঢাকনা।
ওদিকে মুসার মায়ের নারিকেল কুরোনো শেষ। কলাপাতায় সেই ধরধবে সাদা নারিকেল কুরোনো উঠে এসেছে বারান্দায়।
টাইমকলে জল এসেছে অনেকক্ষণ। এখনই বাকি দিনের জল ধরে রাখতে হবে চৌবাচ্চায়। তাই বাবা কলঘর থেকে বের হলেই মুসার মা চৌবাচ্চায় জল ভরতে শুরু করলো।
আঁচে শাক থেকে সবুজ জল বেরিয়ে ভরে গেছে কড়াই। মা এবার দিয়ে দিলো অনেকগুলো বুকচেরা কাঁচামরিচ। খানিক সময় সেই জল শুকিয়ে মা ভেজে রাখা কুমড়ো বড়ি দিয়ে দিলো তাতে। আবার ঢাকনা পড়লো কড়াইয়ে। সাথে সাথে আঁচও খানিক কমলো স্টোভের।
ঘড়ির কাঁটা ১-এর ঘর পেরোতেই মা উঠে গেলো ঘরে। ক্যাসেট প্লেয়ারের নব ঘুরিয়ে বাংলাদেশ বেতার ধরলো। সাথে সাথে সুর ভেসে এলো,
ডাক দিয়েছে দয়াল আমারে
রইবো না আর বেশিদিন
তোদের মাঝারে….
পাত পড়ে গেলো বারান্দায়। মা শাকের বিরিঞ্চিতে এবার কুরোনো নারিকেল ছিটিয়ে মা নামিয়ে নিলো স্টোভ থেকে কড়াই।
বাসার উঠোন আমাদের বাড়ির উঠোনের মতো চৌকোণা নয়। লম্বাটে এই উঠোনের অনেকটাই ঢাকা পড়ে থাকে জামজামরুলের ছায়ায়। সেই ছায়ায় শেষ আশ্বিনের বারবেলার ঝিরিঝিরে হাওয়া বসলো। তিরতির করে কেঁপে উঠলো ছায়াগুলো। দু-একটা রিকশা ঘণ্টা বাজিয়ে বাসার ফটক পেরোলো। শ্যাওলা ধরা আমাদের ঘরের দেয়ালে আশ্বিনের আলটপকা রোদের আয়েশী আসর বসেছে।
মা তাড়া দিলো,
মনি, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও, প্রাইভেট পড়াতে স্যার চলে আসবে।
নারিকেল আর শুকনো মরিচের ভুরভুরে ঘ্রাণে মাখা শাক বিরিঞ্চি মুখে দিতে দিতেই আমি ভাবতে থাকি,
বাইরবাড়ির বারান্দায় জেঠি ঠাকুমারা পা মেলে বসলো বোধহয় এখন। আর ঠাকুমা…
না ভাবনায় নয়, চোখের স্পষ্ট বড়ঘরের লাল মেঝেতে বসে থাকা তালপাতার পাখা হাতে ঠাকুমার মুখটা। সেই মুখে এই শহরে বসেও আমি দেখতে পাই মন খারাপের এক নিঃশব্দ ছায়া।