ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে হেনরি মর্টান স্ট্যানলির বাড়ি ফেরার পালার শেষ পর্যায়। তরজমা স্বাতী রায়
১৮৭২ সালের ৭ই মে বিকাল ৫ টায় যে ধাওতে চড়ে আমার দলবল ফেরত আসছিল সেটা জাঞ্জিবার বন্দরে এসে পৌঁছাল। দলের লোকরা বাড়ির এত কাছে আসতে পারে ভারি খুশি, পরের পর গুলি ছুঁড়তে লাগল, আমেরিকান পতাকা আকাশে ওড়ানো করা হল, শীঘ্রই বাড়ির ছাদ ও সমুদ্রের পাড়ে দর্শকদের ভিড় দেখা গেল। দর্শকদের মধ্যে অনেকে ইউরোপীয়, আমাদের দিকে চশমা তাক করে দেখছেন।
আমরা ধীরে ধীরে তীরে ভিড়লাম; একটা নৌকায় পা দিলাম, সেটা আমাদের পাড়ে নিয়ে চলল। শীঘ্রই আমার বন্ধু রাজদূতের সান্নিধ্যে হাজির হলাম, তিনি আমাকে জাঞ্জিবারে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন; এর পরে পরেই রেভারেন্ড চার্লস নিউ-এর সঙ্গে পরিচয় হল। তিনি আমার আগমনের এক বা দু দিন আগে ইংরেজ অনুসন্ধান অভিযানের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ছোটখাট চেহারার একজন সাধারণ মানুষ, দেখতে ছোট খাটো হলেও, এনার্জিতে ভরপুর - ওইটুকু চেহারাতেও অত বিপুল এনার্জি থাকে! তিনিও আমাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানালেন।
একটা দারুণ রকমের নৈশভোজ হল, আর সেখানে আমি খাদ্যদ্রব্যের প্রতি এতই ন্যায়বিচার করলাম যে আমার নতুন বন্ধুরা তো অবাক। তার পরে লে. ডসন আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তিনি একজন বলিষ্ঠ যুবক, চমৎকার গড়ন, সুদর্শন চেহারা, চেহারা বুদ্ধির ছাপ স্পষ্ট। বললেন:
"মিস্টার স্ট্যানলি, আপনাকে অভিনন্দন জানাই, স্যার।"
কেন তিনি আমার সাফল্য ঈর্ষান্বিত সেকথাও বললেন। বললেন, কিভাবে আমি "তাঁর পালের হাওয়া কেড়ে নিয়েছিলাম (লেঃ হেন ও এই একই রকমের নৌ-সম্বন্ধীয় শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছিলেন)। আমার লোকদের কাছ থেকে যখন তিনি শুনতে পেলেন যে ডাঃ লিভিংস্টোনকে পাওয়া গেছে, তখন তিনি কিভাবে তৎক্ষণাৎ বাগামায়ো থেকে জাঞ্জিবারে চলে এলেন, ও ডাঃ কার্কের সঙ্গে একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনার পরে, সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করলেন সে কথাও শুনলাম।
"কিন্তু আপনি কি মনে করেন না, মিস্টার ডসন, যে আপনি আমার লোকদের নিছক মুখের কথা শুনেই পদত্যাগ করার জন্য খুব তাড়াহুড়ো করেছেন?"
"হয়ত তাই," তিনি বললেন; "তবে শুনেছিলাম যে মিঃ ওয়েব আপনার কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছেন, আর আপনি ও লিভিংস্টোন আবিষ্কার করেছেন যে বুসিজি একটা হৃদে গিয়ে পড়েছে। আর আপনার কাছে ডাক্তারের চিঠি ও কাগজপত্রও আছে।"
"হ্যাঁ ঠিকই; কিন্তু আপনি নিজে তো কিছুই দেখেননি, সবই তো আমার লোকদের মুখে শোনা কথা । তাহলে আপনি সত্যের ব্যক্তিগত প্রমাণ পাওয়ার আগেই পদত্যাগ করে দিলেন।"
"আচ্ছা, ডাঃ লিভিংস্টোনকে খুঁজে পাওয়া গেছে আর তিনি রসদ-পত্রও পেয়েছেন, যেমন মিঃ হেন আমাকে জানিয়েছেন, তাই না?"
"হ্যাঁ, তা তো ঠিক। তাঁর সব প্রয়োজন মিটেছে; আর কেবলমাত্র অল্প কটা বিলাস-দ্রব্য তাঁর প্রয়োজন, সেগুলো আমি তাকে পঞ্চাশ জন স্বাধীন লোকের দলের একটি অভিযানের মাধ্যমে পাঠাব। আর তাঁর বন্ধুদের জন্য পাঠানো সকল চিঠি ও কাগজপত্রও আমার কাছে।"
“তাহলে আপনি কি মনে করেন না আমি পুরোপুরি ঠিকই করেছি?”
“উঁহু - যদিও সম্ভবত এটি শেষ পর্যন্ত একই দাঁড়াবে। ইতিমধ্যেই তাঁর কাছে যা কাপড় ও পুঁতি আছে, তার থেকে বেশি হলে সেটাই তাঁর পক্ষে একটা বড় বাধা হয়ে উঠবে। তবুও, রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি থেকে আপনাকে কিছু আদেশ করা হয়েছে। কী আদেশ তা এখনও দেখিনি। কাজেই আমি কি করে বলব যে কী করলে সবচেয়ে ভাল হত! তবে মনে হয় আমাকে স্বচক্ষে দেখার আগে পদত্যাগ করাটা ভুল হয়েছে; কারণ তাহলে আপনার পদত্যাগ করার অন্তত একটা বৈধ অজুহাত জুটত৷ আমি হলে অন্তত অভিযানের সঙ্গে থাকতাম, অন্তত যতক্ষণ না আমার নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ না করতে পারতাম; যদিও, এই ধরনের ঘটনায়, সম্ভবত আদেশ একটাই হত, , 'ফিরে আসুন।”
"তাহলে এখন যখন সেটাই হল, এখনও কি মনে হচ্ছে না যে আমার কাজটা ঠিকই হয়েছে?"
"এখন লিভিংস্টোনের সন্ধানে যাওয়া ও তাঁর দুর্দশা উপশমের ব্যবস্থা করার চেষ্টাও অবশ্যই বৃথা, কারণ ইতিমধ্যেই খুঁজে বার করা গেছে ও তাঁর কষ্টমোচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে; তবে সম্ভবত আপনাকে দেওয়া আদেশটি ভিন্ন রকমের ছিল।"
"সে তো অভিযান চলতে শুরু করলে, সেটাই আমার মনোযোগের কেন্দ্র হত। কিন্তু, মূল লক্ষ্যটিই তো আপনি ভেস্তে দিলেন! সেজন্যই আমি ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছি। নৌসেনাপ্রধান আমাকে কেবল অনুসন্ধানের জন্য অনুপস্থিতির অনুমতি দিয়েছেন - অভিযানের বাবদে কখনও কিছু বলেননি। "
"তাহলে যে নিয়োগাদেশ আপনার কাছে আছে, তাতে আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে আপনি কী করবেন সে নিয়ে কিছুই বলা হয়নি?"
"একটা শব্দও নেই, যদিও তাঁরা ব্যাপারটা ভালকরেই জানতেন; রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটিরই একজন সদস্য আমাকে ব্যক্তিগতভাবে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে সম্ভবত আপনার গুরুদায়িত্ব থেকে হয়ত আপনাকে আমি মুক্তি দিতে পারব। 'হেরাল্ড'-এ প্রকাশিত আপনার চিঠি ছাড়া আপনাদের অভিযান সম্পর্কে আমি তো কিছুই জানতাম না; কিন্তু আমাদের জানানো হয়েছিল যে আপনি জ্বরে অসুস্থ, এবং সম্ভবত মারা গেছেন। এখানে এসে তারপর আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু শুনলাম। এমনকি এখানে পা দিয়েই শুনলাম যে আপনি লিভিংস্টোনকে খুঁজে পেয়েছেন; কিন্তু সেসব কথায় বিশেষ কান দিইনি। আপনার নিজের লোকদের সাথে কথা বলার আগে তো কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি, ওদের সঙ্গে কথা বলেই বুঝলাম আমার এখানে কোন প্রয়োজন নেই, আর তাই পদত্যাগ করলাম।"
"আপনাকে দেওয়া নির্দেশগুলোর মধ্যে আমার নাম উল্লেখ করেনি কেন? আপনি যা বললেন, তার মানে তারা তো জানত যে আমি এ দেশেই আছি ; আর, সে আমি যতই বাজে অভিযাত্রী হই না কেন, এমন একটা পরিস্থিতি তো তৈরি হতেই পারত, তখন কি করতে হবে তা বলবে না? "
"আসলে সত্যিটা হল যে ওরা চায়নি যে আপনি তাকে খুঁজে পান। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না যে আপনার এই অভিযান নিয়ে দেশে মানুষজন কতটা ঈর্ষান্বিত।"
"তার মানে লিভিংস্টোনকে খুঁজে পাওয়াটা নয়, কে তাঁকে খুঁজে পেল আর সাহায্য করল, এটাই তাঁদের কাছে বড় ব্যাপার হল!"
এটাই আমার প্রথম ধাক্কা খাওয়া! আর এই মুহুর্ত থেকে আমার মনে হতে লাগল যে ইংরেজদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা অভিশপ্ত। শুধুমাত্র আমেরিকান অভিযান বলেই যে কেউ আমার ব্যর্থতা কামনা করার মতো অমানবিক হতে পারে এমনটা আমার সুদূরতম ভাবনাতেও আসেনি। এর আগে আমি কখনই ভাবিনি যে লোকেরা আমার সাফল্য বা ব্যর্থতাকে ঠিক কীভাবে দেখবে। কোন লোক যে আশা করতে পারে যে একজন আমেরিকান সাংবাদিক তাঁকে খুঁজে পাওয়ার চাইতে ডাঃ লিভিংস্টোন চিরদিনের মতোই হারিয়ে যান, এমন অসম্ভব অবাস্তব কথা তো আমি ভেবেও উঠতে পারিনি – আমি নিজের কাজ নিয়ে এতই বেশি ব্যস্ত ছিলাম!
তবে জাঞ্জিবারে আসার অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝে গেলাম যে ইংল্যান্ডে আমার বিরুদ্ধে কেমন বিষোদ্গার চলছে, সংবাদপত্রের কিছু খবরের ছাঁট আমাকে দেখানো হয়েছিল, যেখানে রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির বেশ কয়েকজন সদস্য আমেরিকান অভিযানকে উপহাস করেছেন; একজন সদস্য তো এমনকি এতদূরও বলেছিলেন যে আফ্রিকার অন্দরমহলে পা ফেলতে হলে "একজন ইংরেজের শান্ত দৃঢ় মাথা" ছাড়া হবে না। ডাঃ কার্ক অবশ্য ভালো কথা লিখেছিলেন, তিনি বলেছিলেন যে তাঁর আমার উপরই "একমাত্র ভরসা আছে;" সে কারণে আমি কৃতজ্ঞ, এবং এও আফসোস হল যে ডাঃ লিভিংস্টোনের থেকে তাঁকে লেখা একটা ঠাণ্ডা কেজো চিঠির আমিই বাহক। সেদিন সন্ধ্যাতে ডাঃ কার্ক এবং মিঃ অসওয়াল্ড লিভিংস্টোনের জন্য মহান অভিযাত্রীর চিঠি দিয়েআমি একটা ছেলেকে ইংরেজ কনস্যুলেটে পাঠালাম।
আমেরিকান ও জার্মান বাসিন্দারা আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন, ডাঃ লিভিংস্টোন যদি তাঁদের কাছের ও প্রিয় আত্মীয় হতেন, তাহলেও এর চেয়ে বেশি উষ্ণতা তাঁরা দেখাতে পারতেন না। ক্যাপ্টেন এইচ.এ. ফ্রেজার এবং ডক্টর জেমস ক্রিস্টিও আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। এই দুজনে মিলে তাঁদের সহনাগরিকের সাহায্যের জন্য ব্যক্তিগত ভাবে অভিযান পাঠানোর চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা ব্যর্থ হয়েছিল। তাঁরা এই প্রশংসনীয় কাজটির জন্য পাঁচশ ডলারের যোগান দিয়েছিলেন; কিন্তু যে লোকটির হাতে সেই অভিযানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তাকে অন্য একজন আরও বেশি টাকায় অন্য কাজে লাগিয়েছিল। কিন্তু, তাঁদের অসমাপ্ত কাজ আমি করে দিয়েছি বলে তারা বিরক্ত তো হননিই, বরং তাঁরাই আমার সবচেয়ে উত্সাহী ভক্তদের মধ্যে ছিলেন।
পরের দিন আমি ডাঃ কার্কের থেকে একটি টেলিফোন কল পেলাম, আমার সাফল্যের জন্য আমাকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি। তিনি ডাঃ লিভিংস্টোনের কাছ থেকে প্রাপ্ত চিঠির বিষয়বস্তু সম্বন্ধে কোনরকম ইঙ্গিত করেননি। বিশপ টোজারও এসেছিলেন, এবং আমি ডাঃ লিভিংস্টোনের জন্য যা কিছু করেছিলাম, তার জন্য আমাকে অনেক ধন্যবাদ জানালেন।
এই দিন আমার লোকদেরও ছুটি দিয়ে দিলাম, সেই সঙ্গে “বড়কর্তা”র কাছে ফেরত যাওয়ার জন্য তাদের মধ্যে বিশজনকে ফের কাজে বহাল করলাম । দেশের ভিতরে থাকার সময় বোম্বে যদিও অর্থ পুরস্কারের ধারণাটিকে নস্যাৎ করেছিল, আর যদিও সে আমার সবথেকে বড় দরকারের সময়গুলোতে আমাকে নিয়মকরে সব রকম ভাবে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে, তবুও সে তার বেতনের উপরে আরও ৫০ ডলার বকশিস পেল, সেই সঙ্গে প্রতিটি মানুষ নিজ যোগ্যতা অনুসারে ২০ থেকে ৫০ ডলার অবধি অতিরিক্ত পেল । এই তো সকল বিভেদ ভুলে যাওয়ার দিন, সব অপরাধ ক্ষমা করার দিন। তারা, গরীবমানুষ, শুধুমাত্র নিজেদের প্রকৃতি অনুযায়ী কাজ করেছিল, বরং এটাই মনে থাকবে যে উজিজি থেকে উপকূল পর্যন্ত সকলেই প্রশংসনীয় রকমের ভাল আচরণ করেছিল।
একটা মানুষ-সমান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম, ভয়ানকরকমের রোগা হয়ে গেছি, বদলে গেছি। সবাইও বলল যে আমার চেহারা অনেক বেশি বুড়োটে হয়ে গেছে। সব চুল ধূসর হয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন ফ্রেজারকে সম্ভাষণ করার সময় তিনি বলেছিলেন, "আপনি আমার থেকে বড়, স্যার!" আর নিজের নাম না বলা অবধি তিনি আমাকে চিনতেও পারেননি। তারপরেও তিনি মজা করে মন্তব্য করেছিলেন যে তাঁর ধারণা এও আরেকটা টিকবোর্ন১ কেসের মতই। মাত্র এই স্বল্প সময়ে অর্থাৎ ২৩ শে মার্চ ১৮৭১ থেকে ৭ ই মে ১৮৭২ সালের মধ্যে এতটাই বদলে গেছি যে প্রায় যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছি।