এর পর থেকে আমরা মানচিত্রের সাহায্যে যতটা সম্ভব বোঝার চেষ্টা করব স্ট্যানলে-র অভিযানের গতিপথ। ওপরের ম্যাপটিতে বোঝা যাচ্ছে বিপুল আফ্রিকা মহাদেশে তাঁর অভিযান ঠিক কোথা থেকে শুরু হল। নীচে দেখা যাচ্ছে প্রথম দিন তিনি কোন্ পথ পার করলেন।
পিছনে পড়ে রইল নারকেল, আম, লবঙ্গ ও দারচিনি বাগানে ভরা জাঞ্জিবার দ্বীপ। সেই সঙ্গে জাঞ্জিবারের পাশ দিয়ে প্রহরীর মতো ঘিরে থাকা চুম্বির মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপমালা। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সাদা চুনকাম-করা শহরের কাঁঠালের গন্ধ, বন্দর আর অতল সাগরে ঘুরে বেড়ানো জাহাজগুলোও। পশ্চিমদিকে ফুটে উঠল আফ্রিকা মহাদেশের সবুজ তটরেখা। যে হরিৎ তটভূমিটি আস্তে আস্তে দূরে সরে যেতে যেতে দিগন্তে একটি বক্ররেখার মতো দৃশ্যমান, ঠিক যেন তারই প্রতিচ্ছবি। উত্তরে ছায়া ছায়া সুউচ্চ পর্বতমালা। জাঞ্জিবার থেকে বাগামোয়োর দূরত্ব প্রায় পঁচিশ মাইল মতো। তবুও আমাদের ঢিমে গতির, গড়িমসি করে চলা ধাওগুলোর সে পথ পাড়ি দিতে প্রায় দশ ঘণ্টা লাগল। তারপর সৈকতের থেকে মাত্র শত-খানেক গজের মধ্যে নৌকাগুলি নোঙর ফেলল। সেখানে জলের কয়েক ফুট নীচে খালি চোখেই প্রবালপ্রাচীরের মাথা দেখা যায়।
জাঞ্জিবারের বন্দর, ঊনবিংশ শতকে।
পাড়ে অনেক লোকের জমায়েত—আরব, বেনিয়া, ওয়াসাওহালি ইত্যাদি। তারা এসেছে মুসুঙ্গুদের (সাদা মানুষ) অভর্থ্যনা জানাতে। অভর্থ্যনা জানানো মানে অবশ্য হাঁ করে তাকিয়ে থাকা আর সমস্বরে চেঁচানো, “ইয়াম্বো, বানা” অর্থাৎ “কেমন আছেন, প্রভু?”। আমাদের সদ্য-নিযুক্ত সৈন্যরা হুজুগপ্রিয়। তারা হইচই করতে ভালোবাসে। পাড়ের জনতাকে বারবার প্রবল উৎসাহে তারা সালাম জানাচ্ছিল।
আমাদের নিজেদের দেশে একসঙ্গে অনেক লোকের সঙ্গে দেখা করতে হলে বড্ড ক্লান্তি আসে। কারণ আমাদের স্বাধীনচেতা নাগরিকরা আঙুলের মধ্যে আঙুল গুঁজে দিয়ে জোরে জোরে হাত ঝাঁকাতে থাকেন, যতক্ষণ ইচ্ছে ততক্ষণ, হৃদ্যতার ভাবটি পরিষ্কার ফুটে না ওঠা অবধি। তবে এইখানে, সার সার দর্শক ভরা সমুদ্রতটে সম্ভাষণের প্রত্যুত্তরে শুধু ‘ইয়াম্বো, বানা!’ বলাই যথেষ্ট। অবশ্য একজন মানুষ ব্যতিক্রম। উপস্থিত সকলের মধ্যে সেই লোকটি শ্রেষ্ঠতম। সকল মহান লোকদের মতো তিনিও আলাদা করে নজর কেড়েছিলেন; আলাদা করে ‘ইয়াম্বো!’ বলতে ও করমর্দন করতে এগিয়ে এসেছিলেন। মাথায় লম্বা লেজঝোলা পাগড়ি। ইনি জমাদার এসৌ, বাগামোয়োতে উপস্থিত জাঞ্জিবারের সৈন্য, পুলিশ ও বালুচ সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক। স্পেক এবং গ্রান্টের সঙ্গে ইনি আফ্রিকার গভীরে অনেক দূর অবধি গিয়েছিলেন, এবং তাঁরাও এঁকে উদারভাবে পুরস্কৃত করেছিলেন। এই অভিযানের লোকজন, মালপত্র জাহাজ থেকে নামানোর ব্যাপারে সাহায্য করার দায়িত্বটি এসৌ নিজের ঘাড়ে টেনে নিয়েছিলেন। লোকটি লজ্জাজনক-রকমের নোংরা আর পোশাক-আশাকের দিক দিয়ে খুবই অনুপযুক্ত। তবু বিশৃঙ্খল জনতার ভিড়ের উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখেন। সেজন্য সকল ভবিষ্যতের পূর্ব-আফ্রিকা ভ্রমণার্থীদের কাছে আমি এঁর ভূয়সী প্রশংসা করব। আমাদের যাঁরা স্বাগত জানিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে সবার আগে আমি সেন্ট-এস্প্রিটের এক ফাদারের কথা বলব। অন্য সব জেসুইটদের সঙ্গে একযোগে ফাদার সুপিরিয়র হর্নারের অধীনে ইনি বাগামোয়োতে একটি যথেষ্ট প্রভাবশালী ও যোগ্য মিশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মিশনের আতিথ্য নেওয়ার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হল। সেখানেই খাওয়ার জন্য বলা হল, এমনকি আমরা চাইলে মিশনের জমিতেই শিবির তৈরি করতে পারি, এমনও বলেছিলেন। গভীর সহৃদয়তার সঙ্গে আমাদের স্বাগত জানান হয়েছিল। আমন্ত্রণ করা হয়েছিল অকপট আন্তরিকভাবে। তবে কিনা আমি সেই দলের একজন যারা অন্যের প্রতি নির্ভর করার থেকে, সম্ভব হলে, স্বাধীনতা পছন্দ করে। তা ছাড়াও আমার জাঞ্জিবারের দয়ালু গৃহকর্তার সুচারু সহিষ্ণুতা আমার মনে অতিথি ও গৃহকর্তার পারস্পরিক দায়বদ্ধতার ধারণাটি একটি সূক্ষ্ম তারে বেঁধে দিয়েছিল। আমি তো জানি যে তাঁর উপর কত ঝামেলাই না করেছি, তবু তিনি তিলমাত্রও ধৈর্য হারাননি। তাই অতিথিবৎসল পাদরিকে জানিয়ে দিলাম যে, মাত্র এক রাতের জন্যই শিবিরের থেকে দূরে থাকতে পারব।
স্ট্যানলে সম্ভবত এই গির্জাটির কথাই বলছেন। এটি পূর্ব আফ্রিকার প্রাচীনতম গির্জা — হোলি গোস্ট চার্চ। ১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত। এবং এখানে ডেভিড লিভিংস্টোনও থেকে ছিলেন।
শহরের পশ্চিম সীমানায় একটা বিশাল ফাঁকা মাঠ, যার মধ্যে দিয়ে উন্যানয়েম্বে থেকে পথ এসে শহরে ঢোকে। সেইখানে একটা বাড়ি পছন্দ করেছিলাম। যদি একমাসও বাগামোয়োতে থাকতাম, তাও এর থেকে ভালো জায়গা খুঁজে বার করতে পারতাম না। আমার পছন্দ করা বাড়ির সামনে তাঁবুগুলো খাটানো হল, মাঝে একটা ছোটো উঠোন, যেখানে কাজকর্ম করা যাবে। কৌতূহলী দর্শকের ঢুকে পড়ার আশঙ্কা নেই। সেখানে গাঁটরি ভালো করে দেখা, পরীক্ষা করা, চিহ্নিত করা ইত্যাদি করা যাবে। বাড়ির পিছনের একটা ঘেরা জায়গায় অভিযানের সাতাশটি প্রাণীকে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। বোঁচকা-বুঁচকি গুছিয়ে রাখা হল। সৈন্যদের গোল করে পাহারা দেওয়ার কাজে লাগিয়ে আমি জেসুইট মিশনের দিকে এগোলাম। রাতের খাওয়ার পক্ষে একটু দেরিই হল বটে। ভয়ানক ক্লান্ত তখন, পেটেও আগুন জ্বলছে। সদ্য-স্থাপিত শিবিরের দায়িত্ব রইল শ্বেতাঙ্গদের ও ক্যাপ্টেন বোম্বের উপর।
মিশনটা শহর থেকে পুরো আধ মাইল উত্তরে; একটা প্রায় গ্রামই বলা যায়, পনেরো–ষোলোটা বাড়ি। প্রায় দশ জন পাদরি ও প্রায় সমসংখ্যক সিস্টারেরা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত। সকলেই এ-দেশীয়দের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারে ব্যস্ত।সত্যি কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে তাঁরা খুবই সফল হয়েছিলেন। দুশোর বেশি ছেলে-মেয়ে থাকে মিশনে আর ছোটো থেকে বড়ো সবাই যে দরকারি শিক্ষা পাচ্ছে সে ছাপটা স্পষ্ট।
প্যারিসের যে-কোনো প্রথম শ্রেণির হোটেলের নৈশভোজে সাধারণত যত পদ সাজিয়ে দেয়, পাদরিদের ও তাঁদের অতিথিদের নৈশভোজেও ততগুলো পদই ছিল। এবং প্রায় সমান দক্ষতার সঙ্গে রান্না করা। তবে চারপাশটা কোনোভাবেই প্রথম শ্রেণির হোটেলের সমতুল্য নয়। স্যুপ থেকে মূল-পদ সকল খাদ্যের বাবদেই পাদরিদের রুচিবোধ উচ্চমানের। তা ছাড়াও হোরাস, হাফিজ ও বায়রন যে দ্রব্যটির অকাতর প্রসংশা করেন, আমি আশ্বস্ত হলাম যে পাদরিরা সেই শ্যাম্পেনের অভাবে নিজেদের ভাবনা-চিন্তাকে ভোঁতা হতে দেননি। পূর্ব আফ্রিকায় বসে শ্যাম্পেন ক্লিকোর কথা ভাবা যায়!—সেই শ্যাম্পেন ক্লিকো, লাফাত, লা রোজ, বার্গান্ডি এবং বোর্দো সবগুলিই একেবারে সেরা মানের! আহ! ফাদাররা জীবনের মর্ম বোঝেন, বেঁচে-থাকার সময়টাকে কদর করেন। এই খাবার-সাজানো টেবিল তাঁদের দরজা থেকে আফ্রিকান জঙ্গুলে-জ্বরকে হঠিয়ে দেয়। আলোকময় জগতের থেকে কেউ যখন আফ্রিকার রাতের অন্ধকারের গভীরতায় ডুব দেয়—হায়না, ব্যাং ও ঝিঁঝিঁপোকার একঘেয়ে দূরাগত ক্লান্তিকর ডাক সেই অন্ধকারের একমাত্র সাজ—তখন যে বিষাদ ও একাকীত্ব তাকে সভয়ে ঘিরে ধরে, তারও সান্ত্বনা এই সুখাদ্যে ভরপুর টেবিল। আফ্রিকার নেটিভ জীবনের অসুবিধাগুলির মধ্যে সবসময় ভদ্র ও বিনীত হয়ে থাকতে চেষ্টা করাটা, ওই চুনিরং চাঙ্গায়নী সুধার সাহায্য ছাড়া, কিছুটা অতি-মানবিকই বটে!
সান্ধ্যভোজের পরে আমার ঝিমিয়ে পড়া তেজ আবার ফিরে এল। সে জন্য আমি অশেষ কৃতজ্ঞ। তারপর প্রায় জনা-কুড়ি সবথেকে দক্ষ ছাত্র পিতলের বাদ্যযন্ত্র সহ এগিয়ে এল, একটা গোটা গানের দলই তারা তৈরি করে ফেলেছে। একদল দিশেহারা ছেলের থেকে এইরকম সুরেলা বাদ্যসংগীত শুনে আমি তো অবাক; এইরকম একটা বিচ্ছিন্ন বন্দরে পরিচিত ফরাসি সংগীত শুনতে পাওয়া, তাও আবার সে গান গাইছে নিগ্রো ছেলেরা, কয়েক মাস আগেও যারা শুধু নিজেদের নিরক্ষর মায়েদের কাছে শেখা পরম্পরার বিষয়টি ছাড়া কিছুই জানত না—সামনে দাঁড়িয়ে তারা প্যারিসের গান গাইছে—সেন্ট-আন্টনির১ পথশিশুরা যেমন সগৌরবে ফরাসি বীরত্ব ও গৌরবগাথাগুলি গাইতে থাকে, ঠিক তেমনই আত্মস্থভাবে।
রাতের বিশ্রামের পরে চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। ভোরবেলা আমার শিবির খুঁজে বার করলাম। নতুন জীবন উপভোগের ইচ্ছা নিয়ে শিবিরের প্রাণীদের গুনতে শুরু করলাম। দেখা গেল, দুটি গাধা নিখোঁজ; আর আমার আফ্রিকান মুদ্রার খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি ছয় নং তারের একটি কুণ্ডলী হাপিস। রাতের বেলা উপকূল অঞ্চলে অনেক অসৎ, ছিঁচকে চোর ঘুরে বেড়ায়। সে কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে, শিবিরের সকলেই রাতে নাক ডাকাচ্ছিল। শহরে ও আশেপাশের অঞ্চলগুলিতে খুঁজে দেখার জন্য সৈন্যদের পাঠানো হল। জমাদার এসৌকে আমাদের ক্ষতির কথা জানান হল, গাধাদের খুঁজে পেলে পুরস্কার দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে তাকে উদ্বুদ্ধ করা হল। রাতের আগে একটা গাধা পাওয়া গেল, শহরের বাইরে ম্যানিওক২ পাতা চিবোচ্ছিল, তবে অন্য প্রাণীটা আর তারের কুণ্ডলী কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পড়ছি পড়ছি। আসল বইটা পড়ি নি বলে আরো ভাল লাগছে।
চলুক। তারপর?