ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। অবশেষে উজিজি। লিভিংস্টোন এখানেই থাকেন। তরজমা স্বাতী রায়
১০ই নভেম্বর। শুক্রবার। সমুদ্রের ধারের বাগামোয়ো থেকে ২৩৬তম দিন। আর উন্যানয়েম্বে থেকে ৫১তম দিন। মোটামুটি পশ্চিম-নৈর্ঋত কোণে উজিজি। হাঁটার সময়, ছয় ঘণ্টা।
দারুণ সুন্দর, আনন্দের সকাল। তাজা, ঠান্ডা বাতাস। ধরিত্রী আর তার সন্তানদের দিকে আকাশ ভালোবাসার হাসি ছড়িয়ে দিচ্ছে। গভীর অরণ্যের মাথায় উজ্জ্বল তাজা পাতার মুকুট; জঙ্গলে ঢাকা নদী পাড়ের পান্না-সবুজ ছায়ায় ছায়ায় এমুকুটির জলস্রোত কলকল শব্দে ছুটে চলেছে, যেন আমাদের চ্যালেঞ্জ করছে, কে আগে উজিজি পৌঁছাতে পারে।
আমরা সবাই গ্রামের বেতের বেড়ার বাইরে, দলের সব কজন মানুষই স্প্রুসের মত, আমরা সেই যখন জাঞ্জিবারে নৌকায় উঠেছিলাম, সে যেন কবেকার কথা, সেদিনের মতন ফিটফাট আর খুশি— কত কিছুই যে দেখলাম আর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম।
‘‘আগে বঢ়ো!’’
‘‘আয় ওয়াল্লাহ, আয় ওয়াল্লাহ, বানা ইয়াঙ্গো!’’ বলে ফুর্তিতে আমার দলের বীররা জোরে জোরে পা চালাল, এতই জোরে যে আমরা খুব শীঘ্রই উজিজি দেখতে পাব। বাঁশঝাড়ে ঢাকা একটা পাহাড়ে উঠলাম আর তারপর নামলাম একটা গিরিখাতের মধ্যে। তার মধ্যে দিয়ে একটা সরু তীব্র জলস্রোত বয়ে যায়। আরেকটা ছোট পাহাড়ে উঠলাম, তারপর, একটা টানা শৈলশিরার ঢাল-বরাবর একটা মসৃণ পায়ে চলা পথ ধরে, আমরা এগোতে লাগলাম। উৎসাহী, নির্ভার মনের লোকরা যেমন করে।
দু'ঘণ্টার মধ্যে আমাকে টাঙ্গানিকা দর্শনের জন্য প্রস্তুত হতে ইঙ্গিত করা হল, একটা খাড়া পাহাড়ের মাথা থেকে আমাদের পথপ্রদর্শক বলল যে আমার এটা দেখতে পাওয়ার কথা। চিৎকার করে আমার হৃদয়ের অনুভূতি প্রকাশ করে ফেললাম। কিন্তু ধৈর্য ধর, আগে ভাল করে দেখি। প্রায় দমবন্ধ করে ছুটতে ছুটতে পাহাড়ের মাথায় উঠলাম, পাছে দুর্দান্ত দৃশ্যটা পালিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত শিখরে পৌঁছলাম। ওহ! এখনো দেখতে পাচ্ছি না তো। আর একটু এগোন যাক— ঠিক ওখানে— ওহ! ওই তো— একটা রূপালী ঝলক। গাছের ফাঁক দিয়ে এক পলকের জন্য দেখলাম। তবে দেখা গেল শেষ পর্যন্ত! সত্যি - টাঙ্গানিকা! চারপাশে উগোমা এবং উকারম্বার নীল-কালো পর্বত। বিশাল চওড়া চাদর, চকচকে পালিশ করা রুপার খাট - উপরে নীল রঙ্গের উজ্জ্বল শামিয়ানা - সুউচ্চ পর্বতমালা তার ভারসাম্য বজায় রাখছে, খেজুরের বন যেন তার আঁচল! টাঙ্গানিকা! হুররেহ! দলের লোকরা স্টেন্টরদের* মত চেঁচিয়ে সাহেবের এই উল্লসিত চিৎকারের জবাব দিল - বিশাল জঙ্গল আর পাহাড়ও যেন আমাদের জয়ের অংশীদার।
‘‘এইখান থেকেই কি বার্টন এবং স্পেক প্রথম লেক দেখেছিলেন, বোম্বে?’’
‘‘আমার ঠিক মনে নেই, কর্তা; তবে এর ধারেকাছেই জায়গাটা ছিল বলে মনে হয়।’’
‘‘বেচারারা! একজন অর্ধেক পক্ষাঘাতগ্রস্ত, আরেক জন অর্ধ-অন্ধ,’’ স্যার রডারিক মার্চিসন বলেছিলেন, বার্টন এবং স্পেকের প্রথমবার টাঙ্গানিকা দেখার দৃশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে।
আর আমি? হ্যাঁ, আমি এতই খুশি যে, আমি যদি চলচ্ছক্তিহীন, অন্ধও হতাম, মনে হয় এই পরমলগনে আমি বিছানাপত্তর ঘাড়ে করে হাঁটা লাগাতাম, আর আমার সব অন্ধত্ব উবে যেত। তবে কিনা আমার ভাগ্য ভাল যে আমি বেশ ভালোই আছি; উন্যানয়েম্বে ছাড়ার পর থেকে আর একদিনের জন্যও ভুগিনি। আমার বর্তমানের জায়গায় থাকার জন্য শ ঠিক কত টাকা দিতে রাজি হত? কে বেশি সুখি— উন্যানয়েম্বের বিলাসে ডুবে থাকা শ, নাকি এই পর্বতচূড়ায় দাঁড়িয়ে, আনন্দিত-চোখে, খুশি-ভরা-মনে ট্যাঙ্গানিকার দিকে তাকিয়ে থাকা আমি?
পাহাড়ের পশ্চিম ঢাল বেয়ে নামছি, সামনে লিউচে উপত্যকা। দুপুরের ঘণ্টাখানেক মত আগে ঘন চিটচিটে ঝোপঝাড়ের দেখা পেলাম, নদীর দুই তীরেই গজিয়ে আছে, নির্মল স্রোতের মধ্য দিয়ে ছপছপ করতে করতে এগিয়ে গেলাম, অন্যপারে গিয়ে উঠলাম, তারপর ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলাম, আমাদের চারপাশে জিজিদের বাগান— কত রকমের যে গাছ দেখলে অবাক হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তাড়াহুড়া করে আধ খ্যাপচা দেখায় সব তো আর চোখে পড়ে না। আর আমি তখন আবেগের জোয়ারে প্রায় ডুবুডুবু। তবু সুন্দর গড়নের খেজুর গাছ, সবুজ সবজি-ভরা পরিচ্ছন্ন চাষের জমি, আর পলকা বেড়া-ঘেরা ছোট ছোট গ্রামগুলো নজর এড়ালো না।
দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি, পাছে আমাদের চোখে দেখার আগেই আর আমরা তাদের জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠার আগেই আমাদের আসার খবর উজিজির লোকদের কাছে পৌঁছে যায়! একটা ছোট্ট নদীর ধারে থামলাম, তারপর একটা ন্যাড়া পাহাড়ের লম্বা ঢাল বেয়ে উপরে উঠলাম, যে সব অযুত গিরিশিরা এতদিন ধরে ডিঙ্গিয়েছি, এটা সেই তালিকার মধ্যে শেষতম। এই পাহাড়ই এতদিন জলের পুরো বিস্তারকে সম্পূর্ণ দেখতে দিচ্ছিল না। চূড়ায় পৌঁছলাম, আড়াআড়ি পেরিয়ে তার পশ্চিম সীমানায় পৌঁছলাম, এবং - দাঁড়ান, পাঠক - উজিজি বন্দরটি আমাদের নীচে, প্রায় হাতের মুঠোর মধ্যে, আমাদের থেকে মাত্র একশ গজ দূরে! এতদিনে কত শত মাইল যে পাড়ি দিয়েছি, কত শত পাহাড়ে উঠেছি আর নেমেছি, কত বন পেরিয়েছি, পথে কত যে ঝোপ-জঙ্গল আমাদের বিরক্ত করে মেরেছে, জ্বলন্ত নোনা জমির উপর দিয়ে চলতে চলতে পায়ে কত যে ফোস্কা পড়েছে, আগুনের গোলার মত সূর্য কীভাবে আমাদের ঝলসে দিয়েছে, এই মহালগনে সেসব কথা আর কিচ্ছু মনে পড়ল না। পথের সব বিপদ আর অসুবিধার কথাও এখন খুশিতে চাপা পড়ে গেল। অবশেষে সেই মহত্তম সময়টি এসেছে— আমাদের স্বপ্ন, আমাদের আশা, আমাদের সকল অপেক্ষা এবার বাস্তবায়িত হতে চলেছে! আমাদের হৃদয়, আমাদের অনুভূতি এসে জমা হয়েছে চোখে, হাতের তালুর আড়াল দিয়ে উঁকি মেরে দেখছি, কোন হুর বা বাড়িতে সেই ‘ধূসর দাড়িওয়ালা সাদা মানুষটি’ বাস করেন, সেই মালাগারাজী থেকে যার কথা শুনছি।
‘‘পতাকা ওড়াও, আর সবার বন্দুকে গুলি ভর!’’
‘‘আই ওয়াল্লাহ, আই ওয়াল্লাহ, বানা!’’ দলের সবাই সাগ্রহে সাড়া দিল।
‘‘এক, দুই, তিন - ফায়ার!’’
প্রায় পঞ্চাশটা বন্দুকের থেকে একযোগে গুলি ছোঁড়া হল। ঠিক যেন সারবদ্ধ কামানের দেওয়া অভিবাদন। নিচের শান্ত-চেহারার গ্রামের উপর এর কী প্রভাব হয় এবার দেখি।
কিরঙ্গোজি, এবার শ্বেতাঙ্গদের পতাকাটা উঁচু করে ধরো, জঞ্জিবারের পতাকাটা এবার পেছন দিকে চলে যাক। আর দলের সবাই জোট বেঁধে থাকো, আর গুলি ছুঁড়তে থাকো যতক্ষণ না আমরা বাজারে পৌঁছচ্ছি, বা সাহেবের বাড়ির সামনে থামছি। আমাকে যে প্রায়ই বলতে যে তুমি নাকি টাঙ্গানিকার মাছের গন্ধ পাচ্ছ - এবার আমিই সেই গন্ধ পাচ্ছি। মাছ, বিয়ার আর একটা লম্বা বিশ্রাম তোমাদের অপেক্ষায়। চল!
একশ গজও যেতে হল না তার আগেই বারবার গুলি ছোঁড়ার ফল ফলল। গোটা উজিজির ঘুম ভাঙ্গল, সবাই জেনে গেল একটা কাফেলা আসছে, আর শয়ে শয়ে লোক আমাদের সঙ্গে দেখা করতে ছুটে এলো। শুধুমাত্র পতাকা দেখেই অবশ্য সবাই সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যায় যে আমরা একটা কাফেলা। তবে দৈত্যের মত চেহারার আসমানির কাঁধের উপর পতপতিয়ে উড়তে থাকা আমেরিকান পতাকা দেখে তারা প্রথমে একটু ইতস্তত করছিল। আসমানির মুখে সেই প্রথম দিনের মত এক বিশাল চওড়া হাসি। যাইহোক, এখন যারা আমাদের কাছে এসেছে তাদের অনেকেরই এই পতাকার কথা মনে আছে। আমেরিকান দূতাবাসের মাথায় উড়তে দেখেছে, আর জাঞ্জিবার বন্দরের অনেক জাহাজের মাথার উপরে পতাকা-দণ্ড থেকেও উড়তে দেখেছে। শীঘ্রই শোনা গেল — ‘‘বিন্দেরা কিসুঙ্গু— সাদা মানুষের পতাকা!’’ ‘‘বিন্দেরা মেরিকানি —আমেরিকার পতাকা!’’ বলে চিৎকার করে করে তারা সুন্দর পতাকাটিকে স্বাগত জানাচ্ছে!
তারপরে তারা আমাদের ছেঁকে ধরল, জিজি, ন্যামওয়েজি, এনগোওয়ানা, রুন্ডি, গুহহা, মান্যুএমা আর আরবরা সবাই মিলে ঘিরে ফেলল। ইয়াম্বো, ইয়াম্বো, বানা', 'ইয়াম্বো, ইয়াম্বো, বানা' চিৎকারে প্রায় কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়! দলের সবাইকে, প্রত্যেকটি মানুষকে স্বাগত জানানো হয়েছিল।
উজিজি গ্রাম থেকে এখন প্রায় তিনশ গজ দূরে, আমার পাশে থিকথিক করছে লোক। হঠাৎ আমার ডানদিকে একটা গলা শুনতে পেলাম, ‘‘সুপ্রভাত, হুজুর!’’
কালোদের ভিড়ের মধ্যে এই সম্ভাষণ শুনে চমকে উঠলাম, লোকটার খোঁজে ঝট করে ঘুরে দাঁড়ালাম, আমার পাশেই তাকে দেখলাম, কালস্য কাল একটা মুখ, কিন্তু হাসি খুশি, জীবন্ত— একটি লম্বা সাদা কুর্তা পরনে, আর পশমী মাথার চারপাশে মার্কিনী কাপড়ের পাগড়ি, জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘তুই কে রে দুষ্টু?’’
‘‘আমি সুসি, ডক্টর লিভিংস্টোনের চাকর,’’ সে হাসতে হাসতে বলল, তার ঝকঝকে দাঁতের সারি দেখা এলো।
*স্টেন্টর হলেন গ্রীক সাহিত্যের নামকরা চরিত্র। জোরে, প্রায় পঞ্চাশ মানুষের সমান চেঁচাতে পারার জন্য এর খ্যাতি।
(ক্রমশ...)