ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ পর্বে শুরু হল ত্রয়োদশ অধ্যায়— টাঙ্গানিকা হ্রদে স্ট্যানলে ও লিভিংস্টোনের নৌযাত্রার কথা। তরজমা স্বাতী রায়
ত্রয়োদশ অধ্যায়
টাঙ্গানিকা হ্রদে আমাদের নৌযাত্রা
"শ্বেত নীলনদের অবস্থান সম্পর্কে রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি থেকে প্রাপ্ত নির্দেশাবলীর বিভ্রান্তির কারণে আমি রুসিজি নদীর দিক নির্ণয়ের বিশাল গুরুত্ব সম্পর্কে অচেতন ছিলাম এই বক্তব্যকে আমি পরিষ্কার অস্বীকার করছি। আসলে ব্যাপারটা হল, আমরা এই নদীর কাছে পৌঁছাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, তবু ব্যর্থ হয়েছি।" -- বার্টনের জাঞ্জিবার
"স্থানীয়রা সকলেই একবাক্যে বলে যে, রুসিজি নদী হল উপনদী আর এটাই সবচেয়ে বড়ো যুক্তি যা প্রমাণ করে এটি হ্রদ থেকেই বেরিয়েছে।" -- স্পেক
"অতএব টাঙ্গানিকা হ্রদই আমার মতে নীলনদের দক্ষিণতম জলাধার হিসেবে সম্মান পাওয়ার দাবি রাখে, যতক্ষণ না প্রকৃত পর্যবেক্ষণ-নির্ভর আরও ইতিবাচক কোন প্রমাণ অন্যরকম নির্ধারণ না করে।" -- ফিন্ডলে, আর জি এস
লিভিংস্টোন ও আমি, টাঙ্গানিকা হ্রদের উত্তর প্রান্ত দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করার পরে যদি জিজিদের অযৌক্তিক দাবি বা ভয়ের কাছে নতি স্বীকার করে, রুসিজি নদীর সমস্যার সমাধান না করেই উন্যানয়েম্বেতে ফিরতে বাধ্য হতাম, তাহলে নিশ্চিতভাবেই দেশে ফিরে সকলের ঠাট্টা তামাশার পাত্র হতাম। কিন্তু জানতাম যে জিজিদের, বিশেষ করে ওই হাস্যকর বর্বর কানেনা সর্দারকে দলে নেওয়ার জন্যেই ক্যাপ্টেন বার্টন ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাই আমরা সতর্ক ছিলাম। বুঝেছিলাম যে এই ভৌগলিক সমস্যাটার সমাধানের ক্ষেত্রে এই ধরনের লোকেরা আমাদের কোন সাহায্যই করবে না। আমাদের সঙ্গে কয়েকজন ভাল নাবিক ছিল, খুবই অনুগত। ভাবলাম, শুধু একটা ক্যানো ধার করতে পারলেই সবকিছু ঠিকঠাক হবে।
সাইদ বিন মাজিদকে সেকথা জানাতে সে সঙ্গে সঙ্গে উদারভাবে তার নৌকোটা আমাদের দিল। আমাদের যে কোন প্রয়োজনে সেই নৌকা ব্যবহার করার অনুমতিও দিয়েছিল। মাথাপিছু দু ডটির কড়ারে দুজন জিজি গাইডকে কাজে লাগানো হল। উজিজিতে এসে পৌঁছানোর মাত্র সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই আমরা উজিজি বন্দর থেকে রওনা দিতে প্রস্তুত।
আগেই বলেছি যে কীভাবে ডাক্তার ও আমি টাঙ্গানিকার উত্তরার্ধ ও বহুল-আলোচিত রুসিজি নদী অভিযানের উদ্যোগ নিয়েছিলাম।
নবোদ্যমে যাত্রা শুরু করার আগে, কোন পথে যে যাবেন সে বিষয়ে ডঃ লিভিংস্টোন কোন স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তখন তাঁর পরিস্থিতি সত্যিই শোচনীয় ছিল। তাঁর দাসদের মধ্যে কেবলমাত্র সুসি, চুমাহ, হামোয়দাহ, গার্ডনার ও হালিমা ছিল। হালিমা হল মহিলা রাঁধুনি ও হামোয়দাহের বৌ, এর সঙ্গে কাইফ-হালেককে জুড়তে হবে। কাইফ-হালেক হল সেই লোক যাকে আমি উন্যানয়েম্বে থেকে আমার সঙ্গে আসতে বাধ্য করেছি। লিভিংস্টোনের হাতে তাঁর চিঠিগুলি তুলে দেওয়ার জন্য।
ডাঃ লিভিংস্টোন কি মাত্র এই কজন লোককে নিয়ে কোথাও যেতে পারতেন? শেরিফ তো তাঁর সব মালপত্র ধ্বংসই করে দিয়েছে! ওই পড়ে-থাকা সামান্য কিছু কাপড় আর পুঁতির ভরসায় কী-ই বা করতেন? খুবই গন্ডগোলের প্রশ্ন! ডাঃ লিভিংস্টোন যদি সুস্থ থাকতেন, তাহলে নিশ্চয় তাঁর স্বভাবগত কষ্ট-সহিষ্ণুতা ও অদম্য মনের জোর দিয়ে এই প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর দিতেন। হয়ত সাইদ বিন মাজিদের থেকে চড়া দামে কাপড় ধার নিতেন, যাতে উন্যানয়েম্বে ও সমুদ্র উপকূল অবধি এসে পৌঁছানোর মতন যথেষ্ট কাপড় থাকে তার হাতে! তবে কতদিন যে তিনি উজিজিতে বসে থাকতে বাধ্য হতেন! উন্যানয়েম্বে থেকে মালপত্র এসে পৌঁছাবে এই আশায় অপেক্ষা করতেন! অধীর আশায় থাকতেন যে এই বুঝি যুদ্ধ শেষ হল - সপ্তাহের পর সপ্তাহ আশা করতেন যে এই বুঝি তাঁর মালপত্র এসে পৌঁছাল! তাঁর দুর্বল শরীর কত কাল যে এই বিপুল হতাশার বোঝা বইতে পারত তা কে জানে!
ডাঃ লিভিংস্টোনের অভিযান সংক্রান্ত বিশাল অভিজ্ঞতার প্রতি যথাযোগ্য সম্মান জানিয়েও, আমি তাঁকে পরামর্শ দেওয়ার দুঃসাহস প্রকাশ করলাম, নিম্নলিখিত পন্থাগুলোর মধ্যে কোন একটা গ্রহণ করতে বললাম।
১নং: তিনি বাড়ি ফিরে যান - এত দীর্ঘ পরিশ্রমের পরে খানিকটা বিশ্রাম তাঁর প্রবল রকমের প্রাপ্য। তাঁর শরীরের যা হাল, তাতে তাঁর যে বিশ্রামের খুবই প্রয়োজন তা খুবই পরিষ্কার।
২ নং: তিনি উন্যানয়েম্বের দিকে এগিয়ে যান। সেখান থেকে নিজের মালপত্র সংগ্রহ করুন । মান্যুয়েমা বা রুয়া যেকোন একটা জায়গায় যাওয়ার মতন পর্যাপ্ত কুলি ভাড়া করুন, আর নীল নদের সমস্যার সমাধান করুন। তাঁর নিজের কথায়, এই সমস্যা সমাধানের দিকে তিনি অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলেন।
৩নং: উন্যানয়েম্বে গিয়ে তিনি নিজের কাফেলার দায়িত্ব নিন। লোকজন জোগাড় করুন আর তারপর স্যার স্যামুয়েল বেকারের দলে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করুন, হয় মুয়াঞ্জায় যান, নাহলে আমার নৌকায় করে উকেরেয়ের বা ভিক্টোরিয়া এন'ইয়াঞ্জার মধ্য দিয়ে উগান্ডায় এমটেসার১ প্রাসাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করুন - যদি উসুইয়ের মিরাম্বো বা স্বরুরু সাধারণ কাফেলার পথ ধরে উগান্ডার দিকে যাত্রা করে থাকে, এই পথে গেলে তাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে। নাহলে তো এদের সঙ্গে দেখা হলেই এরা তাঁর সর্বস্ব ছিনতাই করে নেবে! এমটেসার থেকে উন্যোরোর রাজা কামরাসির এলাকায় যাবেন। সেখানে তিনি অবশ্যই সেই মহান শ্বেতাঙ্গ মানুষের কথা শুনতে পাবেন যিনি নাকি গোন্ডোকোরোতে এক বিশাল দলবল নিয়ে হাজির আছেন।
৪ নং: উন্যানয়েম্বে গিয়ে তিনি নিজের কাফেলার দায়িত্ব নিন। লোকজন জোগাড় করুন। তারপর উজিজিতে ফিরে আসুন ও উগুহহা হয়ে মান্যুয়েমায় ফিরে যান।
৫ নং: রুসিজি নদী ধরে রুয়ান্ডার ও আরও সব জায়গার মধ্যে দিয়ে তিনি ইটারা, উন্যোরো বা বেকারের দিকে এগিয়ে চলুন। যে পথ তাঁর নিজের সবচেয়ে সমীচীন বলে মনে হয়, সেই পথ ধরেই চলুন। আমি ও আমার লোকেরা তাঁকে সাধ্যমত পাহারা দিয়ে নিয়ে যাব, মাল বইতে সাহায্য করব। আর তিনি যদি বাড়ি ফিরে যেতে চান, আমি সগর্বে তাঁকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাব - আর নিজে তাঁর আদেশেই চলব - তিনি চলতে বললে চলব, থামতে বললে থামব।
৬ নং: সবার শেষ পরামর্শ ছিল এইরকম, তাঁকে উন্যানয়েম্বে অবধি পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি আমাকে দেওয়া হোক, সেখানে তিনি তাঁর নিজের জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে পারবেন। আর আমিও তাঁকে সরেস কাপড়, পুঁতি, বন্দুক ও গোলাবারুদ ইত্যাদি সরবরাহ করতে পারব। তারপর সেখানে তিনি একটা সুবিধামত বাড়িতে বিশ্রাম করবেন আর আমি দ্রুত উপকূলে এসে আর একটা নতুন অভিযানের আয়োজন করব, পঞ্চাশ বা ষাট জন বিশ্বস্ত, অস্ত্র-সুসজ্জিত লোক জোগাড় করব যাদের সাহায্যে আমি স্বস্তিতে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় আরও কিছু দ্রব্যাদি পাঠাতে পারি।
অনেক ভেবে চিন্তে তিনি শেষের পরামর্শটিই বেছে নিলেন। এটাই তাঁর কাছে সবচেয়ে সম্ভবপর মনে হল। সেই সঙ্গে সর্বোত্তম বলেও মনে হল। তিনি অবশ্য তাঁর জাঞ্জিবারের এজেন্টের দায়িত্বজ্ঞানহীন উদাসীনতা হাবভাব নিয়েও মন্তব্য করতে দ্বিধা করেননি, তার জন্যেই লিভিংস্টোনকে এত কষ্ট, এত ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয়েছিল আর শত শত মাইলের ক্লান্তিকর হাঁটা তাঁর কপালে জুটেছিল।
(ক্রমশ...)