ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে টাঙ্গানিকা হ্রদে স্ট্যানলে ও লিভিংস্টোনের নৌযাত্রার কথা। এই পর্বে পার হয়ে আসা অঞ্চলগুলির গবাদি পশু ও নানা ফসলের বিবরণ।তরজমা স্বাতী রায়
হ্রদের সীমানা ঘেঁষে থাকা সব গ্রামেও প্রচুর পরিমাণে কলা রয়েছে। যে সব জাঁতাতে শস্য ভেঙ্গে ময়দা তৈরি করা হয়, সেই বিশাল বিশাল কাঠের জাঁতাতে কলা চটকে 'জোগ্গা' নামের মদ তৈরি করা হয়।
ক্যাকটাসিয়াস এবং অ্যালোয়েটিক উদ্ভিদগুলো সারা দেশজুড়েই দেখা যায়। তবে বিশেষ করে উগোগো এবং দক্ষিণ উভিনজার শুকনো সমতলে অনেক পাওয়া যায়।
জঙ্গলে প্রায়শই তেঁতুল গাছ দেখা যায়, তবে উসাগারা এবং উন্য়ানয়েম্বের পশ্চিম দিকে তারা সবথেকে বড় হয়। তাদের ফলগুলো জলে ভিজিয়ে রাখলে একটা দারুণ টকটক পানীয় তৈরি হয়।
কত রকমের যে ঝাউ আর বাবলা পাওয়া যায় সে একেবারে দেখার মত, একটু খানি জায়গা পেলেই হল। বাবলা গাছ তো সর্বত্র আর এমন ভাবে তারা ডালপালা ছড়ায় যে কাফেলাগুলোর জন্য তারা ভারি যন্ত্রণার! কাঁটাগাছ ও গঁদের গাছগুলো অভিযাত্রীদের জন্য সবচেয়ে ঝামেলার। কাঁটাগাছের প্রজাতিগুলো সমস্ত রকমের মারাত্মক কাঁটায় ভরা! আমার দোভাষী সেলিম একদিন আমাশায় কাতর হয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিল, তার ঘাড়ের একেবারে শিরার খুব কাছে বাবলার কাঁটায় এমন বিচ্ছিরি ভাবে কেটে যায় যে সেই দাগ তার মৃত্যুদিন অবধি রয়ে যাবে।
ফল-গাছের মধ্যে রয়েছে এমবেম্বু বা কাঠ-পীচ; মাতোঙ্গা বা নাক্স ভমিকা; তেঁতুল; সিংওয়ে, বা কাঠপ্লাম; এমটগওয়ে বা কদবেল; আর উকাওয়েন্দিতে রয়েছে অসংখ্য প্রজাতির আঙ্গুর। তবে এদের মধ্যে কিছু প্রজাতি আবার বিপজ্জনক, আর অন্যগুলো এখানকার নিজস্ব, অতি নিরীহ, তাদের নাম ধাম আমি উদ্ধার করতে পারিনি।
উন্যানেয়েম্বের আরবরা তাদের বাগানে যেসব ফলের গাছ লাগায় আর যত্নে লালন করে তার মধ্যে রয়েছে পেঁপে, পেয়ারা, লেবু, জামির, ডালিম, আম, কলা, কমলা।
উন্যামওয়েজি ও তার পশ্চিমের টাঙ্গানিকা হ্রদ অবধি ছড়ানো এলাকার বাসিন্দা বেশ কয়েকটি উপজাতির প্রধান খাদ্যের মধ্যে রয়েছে মাতামা (কিসাওয়াহিলি), বা দৌরা (আরবি), বা জোয়ার (হিন্দুস্তানি), যার লিনিয়ান নাম হল হলকাস সরঘাম; বাজরা (হলকাস স্পিকাটাস), মিলেট (প্যানিকাম ইতালিকাম); মাওয়েরি বা তিল; ভুট্টা বা ভারতীয় ভুট্টা। অনেক রকম ডালও আছে, তবে ছোলা, মটর এইগুলোই সবচেয়ে সাধারণ। উনানয়েম্বে ও উজিজিতে প্রচুর পরিমাণে চালও হয়; শুধু আরবরাই গম চাষ করে।
উন্যানয়েম্বে, উজিজিতে ও উকাওয়েন্দির কিছু কিছু অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে মিষ্টি আলু, ইয়াম ও ম্যানিওক পাওয়া যায়। উজিজিতে আখের ফলন ভাল হয়।
এপ্রিল মাসে টাঙ্গানিকায়, মে মাসে উন্যামওয়েজিতে ও জুন মাসে সামুদ্রিক অঞ্চলে শুধুমাত্র একটি ফসলেরই চাষ হয়।
গোটা মধ্য আফ্রিকা জুড়ে তুলা, তামাক ও ক্যাস্টর-অয়েল গাছ সর্বত্র জন্মায়। লাউ আর শসাও হয় প্রচুর। এখানে ওখানে নীল (ইন্ডিগো) গজায়।
মধ্য আফ্রিকার নিজস্ব ঝোপঝাড়, গাছপালা ও ঘাসের মধ্যে বন্য জোয়ান ও ভুঁই তুলসি, হলি, সূর্যমুখী, ধানি লঙ্কা, সবুজ লঙ্কা, আদা, হলুদ, করবী ইত্যাদি ও টাঙ্গানিকার কাছাকাছি অঞ্চলের লিলিফুল বা গ্লোরিওসা সুপারবার নাম করা যেতে পারে; উকাওয়েন্ডির গ্রামের আশেপাশে বুনো পপিফুল ছাড়াও বুনো সরিষা ও কারি পাতার গাছ দেখা যায়। হ্রদের সীমানা ঘেঁষে থাকা বিশাল জঙ্গলে শত রকমের ফুলের ঝোপের দেখা মেলে, একটা চমৎকার সুবাস ছড়ায় চারিদিকে। ঘাসের মধ্যে রয়েছে হকউইড, অক্স-আই, ভারতে ভোটা নামে পরিচিত একরকম ঘাস আর হুইটলো ছাড়াও টাইগার গ্রাস ও বর্শা-ঘাসের জাতীয় অসংখ্য প্রজাতির দেখা মেলে।
শান্ত গোম্বে হ্রদে ও উকাওয়েন্দির জলাশয়গুলিতে পদ্ম, জল এবং পাতাছাড়া লিলিফুল দেখা যায়।
টাঙ্গানিকার পলিমাটিভরা তীরের যেখানেই জন বসতিহীন জায়গা পায় সেখানেই প্যাপিরাস ও মাটেটে গাছ লকলকিয়ে ওঠে। সমস্ত বড় অন্তর্বাহিনী নদীর মোহনায় শোলা গাছ চোখে পরে।
একটি অধ্যায়ের সীমিত পরিসরে আমি মধ্য আফ্রিকার পশু-পাখির সব প্রজাতির বিশদ প্রাণীবিদ্যা বিবরণে ঢুকতে পারছি না, সংক্ষিপ্ত বিবরণীর জন্য আমার পাঠকরা সম্ভবত আমাকে ক্ষমা করবেন।
পশুদের মধ্যে সবচেয়ে সংগঠিত, চারহাতপাওলা বানরদের দিয়েই শুরু করি।
এদের সবচেয়ে বড় জাতটি ওয়ান্ডারু বেবুন নামে পরিচিত। বিশাল আকার আর সিংহসদৃশ চেহারা দিয়ে তাদের সহজেই চেনা যায়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন একটা ছোট সিংহ! উকাওয়েন্দির গহন অরণ্যে এর কর্কশ ফাঁপা গর্জন শুনলে বিভ্রান্তি বাড়ে বই কমে না।
এদের গলা ঘিরে থাকে ধূসর রঙের লম্বা কেশর, সেই কেশরেই মাথা ঢাকা। পিঠের লোম গাঢ় ধূসর, হালকা বাদামী মেশানো। লম্বা লেজ, শেষে বেশ একটা থোপলা। বড় বড় গাছের গর্ত আর গুহাতে বাস করে। রুগুফুর উৎসের কাছে এই রকমের বেবুনই দেখতে পেলাম। তবে আরও পশ্চিমে একই নদীর কিছু উপনদীতেও প্রচুর সংখ্যায় এই গোত্রের পাকা তামাটে রঙের বেবুনকে দেখেছি।
এর পরেই দেখা যায় বিশাল কুকুরমুখো বেবুন। এদের বর্ণনা আগের অধ্যায়ে দেওয়া। উকাওয়েন্ডি এবং পশ্চিম উকোনঙ্গোতে আরও অন্যান্য প্রজাতির ছোট ছোট বানর দেখতে পাওয়া যায়। কালো মুখ, আবিসিনিয়ার টোটাদের মতো। তুমুল চটপটে, আর দারুণ গাছ-বাইয়ে বানরগুলো দল বেঁধে থাকে। বুনো কুল, এমবেম্বু বা কতবেল ও পোকামাকড় খায়।
উকাওয়েন্দির বনে বড় আকারের বিড়াল জাতীয় প্রাণীদের মধ্যে দেখেছি সিংহ আর চিতাবাঘ। সিংহের চামড়া হল সুলতানের সম্পত্তি। জলের পাশের ছায়া ছায়া ঘন জঙ্গলে তাদের বাস। ঘাস জমিতে যেখানেই শিকার মেলে, সেখানেই এই রাজসিক জানোয়ারটিও দেখতে পাওয়া যায়।
আমাদের আফ্রিকা অভিযানের প্রায় প্রতি রাত্রেই গায়ে ছিট ছিট দাগওলা সিন-হায়েনার কান্না শোনা যেত। বিশেষ করে উটান্ডা এবং উগোগোতে তো খুবই শোনা যেত। এই প্রাণীটি একটি ম্যাস্টিফের মতো বড়, শক্তপোক্ত মাথা, তা থেকেই বোঝা যায় এর চোয়ালের কত জোর। গায়ের রঙটা ধূসর মেশানো নোংরাটে বাদামী। তার উপর ফ্যাকাশে কালো দাগ। কানগুলো বড় বড়, পুরু, কালো ছোপওলা। দাঁতগুলো কুকুরের মতোই, তবে হায়েনার উপরের পাটিতে তিনটি নকল মোলার আর নীচের পাটিতে চারটে মোলার দাঁত। দাঁতগুলোর জোর মারাত্মক, বড় বড় হাড়ও ভেঙ্গে দিতে পারে।
এখানে যে শিয়ালগুলো দেখেছি সেগুলো আমাদের প্রেইরি অঞ্চলের কোয়োটিদের মতোই। তাদের ডাকও একই রকম তীক্ষ্ণ চিৎকার। এদের নাকের দিকটা শেয়ালের মতো, আর ঝামর-ঝোমর লেজও আছে। গায়ের রঙ গাঢ় ধূসর।
অন্যান্য যেসব প্রাণী দেখেছি সেগুলো হল হাতি, গন্ডার, ক্যামেলোপার্ড বা জিরাফ, জেব্রা, হার্টবিস্ট, ইল্যান্ড, মহিষ, স্প্রিংবক, পাল্লা, বা ওয়াটারবাক, সেবল এন্টিলোপ, ছোপওলা নু, লালচে-সীসা রঙের শুয়োর ও বুনো শুয়োর, হাইরাক্স বা কোনি, কুডু (অ্যান্ট স্ট্রেপসিরোস), ছোট্ট পার্পুসিলা, বা ব্লু বাক, এবং ডজনে ডজনে রেইটবাক বা রীডবাক (এ. এলিওট্রাগাস)। আগেই তাদের কথা বলেছি, তাই আবার বলার কোন দরকার নেই। তবে এখানে উল্লেখ করা যাক যে আমি রুগুফু বা গোম্বের তীরে প্রচুর প্রেইরি কুকুর বা মেঠো কাঠবিড়ালি দেখেছি। জলহস্তী ও কুমির বলতে, কিঙ্গানি, গোম্বে, মালাগারজি নদীতে ও টাঙ্গানিকা হ্রদে সেসব অসংখ্য দেখেছি।
গৃহপালিত প্রাণীরা আর সব দেশে সাধারণত যেমন দেখা যায় এখানেও তেমনই দেখা যায়। দু'রকমের বলদ দেখেছি এখানে; উগোগো, উন্যানিয়েম্বে ও উহাতে দেখা প্রজাতিটির কাঁধের মধ্যে একটি কুঁজ থাকায় তাঁদের আলাদা করে চেনা সহজ, অনেকটা আমেরিকান বাইসনের মত দেখতে। অন্য প্রজাতিটি শুধুমাত্র উজিজিতেই দেখেছি, এদের বৈশিষ্ট্য হল লম্বা পা, পাতলা শরীর আর প্রচুর লম্বা শিং।
সব উপজাতিরাই ভেড়া পালে। গাবদুগুবদু, চর্বিযুক্ত, ভারী লেজ এসব তাদের বৈশিষ্ট্য । অগুন্তি ছাগল, বিভিন্ন রঙের। তবে আফ্রিকার সবচেয়ে ভালো ছাগল পাওয়া যায় মান্যুয়েমাতে, মোটা সোটা, খাটো-পাওলা।
উবানারামাতে প্রচুর গাধা পাওয়া যায়, শক্তিশালী, বড়সড়, তবে সেগুলো বুনো আর বদমেজাজী।
অজস্র কুকুর, আর প্রতিটা গ্রামেই তাদের দেখা যায়। এগুলো সত্যিকারের নেড়িকুত্তা, খুব ভীতু, ঘেয়ো চেহারার।
গ্রামে গ্রামে পোষা বিড়ালও খুব দেখা যায়, আর তারা নিশ্চয় প্রাণের আনন্দে সময় কাটায়, কারণ প্রতিটি বাড়িতে, কুঁড়েঘর ও টেম্বেতে ইঁদুর থিক থিক করে।