ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। স্ট্যানলে নথিবদ্ধ করছেন লিভিংস্টোনের মুখে শোনা তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত। তরজমা স্বাতী রায়
উগুহহা বন্দর থেকে একদল ব্যবসায়ীর সঙ্গে তিনি রওনা হলেন প্রায় সোজা পশ্চিমদিকে, উরুয়ার উদ্দেশে। পনের দিন হেঁটে পৌঁছালেন বামবারেতে। এটা মান্যেমার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ হাতির দাঁতের ভাণ্ডার। স্থানীয়রা জায়গাটাকে বলে , মান্যুয়েমা। প্রায় ছ'মাস ধরে তিনি বামবারেতে আটকে রইলেন। পায়ে একটা ঘা হয়েছিল, মাটিতে পা ফেললেই সঙ্গে সঙ্গে তার থেকে পুঁজ-রক্ত বেরচ্ছিল। সেরে ওঠার পরে, তিনি উত্তর দিকে রওনা হন। বেশ কিছু দিন পর লুয়ালাবা নামের এক প্রশস্ত হ্রদ-জাত নদীর পাশে এসে পৌঁছান। এই নদী উত্তর ও পশ্চিম দিকে বয়ে চলেছে। কিছু কিছু জায়গায় আবার দক্ষিণ মুখোও তার চলা। সব মিলিয়ে বেশ গুলিয়ে দেওয়া ব্যাপার। এক থেকে তিন মাইল পর্যন্ত চওড়া নদী। নিজের জেদ ছেড়ে তিনি এর আঁকাবাঁকা গতিপথ অনুসরণ করার চেষ্টা করেন, শেষকালে দেখলেন লুয়ালাবা গিয়ে পড়েছে সরু, দীর্ঘ কামোলোন্ডোর হ্রদে। যেখানে গিয়ে পড়েছে সেই জায়গাটা মোটামুটি ৬° ৩০' অক্ষাংশ। আর একে দক্ষিণে অনুসরণ করে, তিনি আবার সেইখানে এসে পৌঁছেছিলেন যেখানে তিনি লুয়াপুলাকে মোয়েরো হ্রদে প্রবেশ করতে দেখেছিলেন।
লিভিংস্টোনের মুখে মোয়েরোর চারপাশের দৃশ্যের সৌন্দর্যের বর্ণনা শুনলে যে কেউ চাঙ্গা হয়ে উঠবে। চারদিকে উঁচু পাহাড় দিয়ে ঘেরা, গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের ঘন গাছপালায় একেবারে কানায় কানায় ভরা সেই এলাকা। মোয়েরো হৃদের উপচে পড়া জল পাহাড়ের বুকের একটা গভীর খাদের মধ্য দিয়ে বয়ে যায়। ওই দুর্বার, বিশাল নদী খাদের মধ্যে দিয়ে গর্জন করতে করতে জলপ্রপাতের বজ্রনির্ঘোষ সহ আছড়ে পড়ে, তবে ওই বদ্ধ, গভীর নদীখাত পেরিয়ে এসে শান্ত, চওড়া, মাইলের পর মাইল জোড়া লুয়ালাবায় পরিণত হয়। পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমে বড় বড় বাঁক নিয়ে, তারপরে উত্তরদিকে বেঁকে, এটা কামোলোন্ডোতে প্রবেশ করেছে। স্থানীয়রা একে লুয়ালাবা বললেও , ডাক্তার, একই নামের অন্য নদীর থেকে একে আলাদা করার জন্য, নিউস্টেড অ্যাবের ধনী মালিক মিস্টার ওয়েবের নামানুসারে একে 'ওয়েবের নদী' নাম দিয়েছেন। মিস্টার ওয়েব ডাক্তারের সবচেয়ে পুরানো ও দীর্ঘকালীন বন্ধুদের মধ্যে একজন। কামোলোন্ডো থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে দূরে আরও একটা বড় হ্রদ আছে, লোয়েকি বা লোমামি নদী সেই জল নিয়ে গিয়ে ফেলে বিশাল লুয়ালাবাতে । লোয়েকি বা লোমামি খুবই গুরুত্বপূর্ণ নদী। স্থানীয়রা এই হ্রদকে চেবুঙ্গো নামে চেনে। ডাঃ লিভিংস্টোন আমাদের নিহত রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কনের স্মরণে এর নাম দিয়েছেন 'লিঙ্কন'। এরপর থেকে মানচিত্রে, বইতে একে লেক লিংকন হিসাবে উল্লেখ করা হবে। একদা এক ইংরেজ প্রচার মঞ্চ থেকে প্রচারিত লিঙ্কনের উদ্বোধনী ভাষণের অংশবিশেষ লিভিংস্টোন শুনেছিলেন। এই ভাষণ ছিল সেই বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত, যে বিষয়ে তিনি তার ‘মুক্তির ঘোষণা’ করেছিলেন, যে চিরস্মরণীয় কাজের দৌলতে চল্লিশ লাখ দাস চিরদিনের জন্য মুক্তি পায়। সেই বক্তৃতা তাঁর মনে এমনই দাগ কাটে যে সেই কথা মনে রেখেই তিনি এই নামকরণ করেন। নিগ্রো জাতির পক্ষ নিয়ে যাঁর পরিশ্রম সকল ভালো মানুষের প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য, সেই মানুষটার স্মৃতির জন্য, লিভিংস্টোন পিতল বা পাথরের চেয়ে বেশি টেঁকসই একটি স্মৃতিস্তম্ভ বানিয়ে রেখে গেছেন।
দক্ষিণ-নৈর্ঋত দিক থেকে ওয়েবের নদীতে প্রবেশ করলে, কামোলোন্ডো হ্রদের সামান্য উত্তরে, লুফিরা নামের একটা বড় নদী আছে। তবে অসংখ্য স্রোত ওই এলাকার থেকে জল নিয়ে এসে লুয়ালাবাতে ফেলে। ডাক্তারের মানচিত্রে অতগুলো দেওয়া যায়নি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো ছাড়া বাকি নদীগুলো তিনি বাদ দিয়ে দিয়েছেন। উত্তরে দিকে চলা অব্যাহত রেখে, লুয়ালাবার অসংখ্য আঁকাবাঁকা বাঁক ধরে প্রায় ৪° দক্ষিণ অক্ষাংশ অবধি অনুসরণ করে, তিনি উত্তরদিকের একটা হৃদের কাছে এসে পৌঁছালেন। এখানেই লুয়ালাবা এসে পড়েছে। এই হৃদের কথা আগেই শুনেছিলেন। তবে এখানেই আমাদের থেমে যেতে হবে আর এর পরে কি আছে জানতে চাইলে শুনুন, এই জায়গাটাই সেই দূরতম জায়গা যেখান থেকে তিনি ৭০০ মাইল দূরের উজিজির দিকে ফিরে যেতে বাধ্য হন।
ডঃ লিভিংস্টোনের বিস্ময়কর ভ্রমণের এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে আশা করা যায় যে উপর-উপর পাতা ওলটানো পাঠক বা ভূগোলের ছাত্র সকলেই ওয়েবের নদী দ্বারা সংযুক্ত এই বিপুল হ্রদ-মালিকার বিষয়টি বুঝতে পারবেন। এই নদীটি, বিভিন্ন আলাদা আলাদা নামে, এক হ্রদ থেকে অন্য হ্রদে উত্তরমুখো বয়ে গেছে। তার সমস্ত গভীর আঁকাবাঁকা বক্রগতি নিয়ে এইটাই সেই নীল নদ - সত্যিকারের নীলনদ - ডাক্তারের সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। দীর্ঘসময় ধরে নদীটির পশ্চিমে, এমনকি দক্ষিণ-পশ্চিমে গভীর বাঁক নেওয়ার কারণে তাঁর খুবই সন্দেহ ছিল; কিন্তু এই নদীকে এর উৎস, চাম্বেজি থেকে ৭° (যদৃ) অক্ষাংশ পরিমাপ জায়গা ধরে অনুসরণ করে - অর্থাৎ ১১° দক্ষিণ অক্ষাংশ থেকে ৪° উত্তর অক্ষাংশ অবধি অনুসরণ করে - তিনি এই সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হয়েছেন যে এটা নীল নদ ছাড়া অন্য কোন নদী হতে পারে না। প্রথমে ভেবেছিলেন এটা হয়ত কঙ্গো; তবে পরে বোঝেন যে নীলনদের অববাহিকার পশ্চিম প্রান্ত থেকে উদ্ভূত, বাংওয়েওলো হৃদের সঙ্গে প্রায় একই অক্ষাংশ থেকে জন্মানো কাসাই ও কোয়াঙ্গো নামের দুটি নদী আসলে কঙ্গোর উৎস। তাঁকে লুবিলাশ নামের আরেকটা নদীর কথাও বলা হয়েছিল, সেটা উত্তর দিক থেকে জন্মে পশ্চিমবাহিনী। তবে লুয়ালাবার বিশাল চেহারা ও জলের পরিমাণ দেখে আর সেই সঙ্গে পূর্ব-পশ্চিমে পাহাড় ঘেরা বিশাল চওড়া উপত্যকার মধ্যে দিয়ে এই নদীর উত্তরবাহিনী রূপ দেখে ডাক্তার বুঝেছিলেন যে এটা কখনই কঙ্গো হতে পারে না।
ডাক্তার এই বিস্ময়কর নদীটিকে যতটুকু অনুসরণ করেছিলেন, তার মধ্যে সবচেয়ে উত্তরের স্থান বিন্দুর উচ্চতা ছিল ২০০০ ফুটের সামান্য বেশি; যাতে, যদিও বেকার তাঁর হ্রদটিকে সমুদ্রতল থেকে ২৭০০ ফুট উঁচুতে বলে বলেছেন, তবুও বাহর গজল, যার মাধ্যমে পেথেরিকের শ্বেত নীল নদের শাখা নীল নদে এসে পড়ে, তা মাত্র ২০০০ ফুট উঁচু; সে ক্ষেত্রে লুয়ালাবা নদীর পেথেরিকের শাখা হওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।
(ক্রমশ…)