ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে টাঙ্গানিকা হ্রদে স্ট্যানলে ও লিভিংস্টোনের নৌযাত্রার কথা। তরজমা স্বাতী রায়
অনেক কষ্টে এই দ্বীপগুলিকে কাভুনভয়েহ বলে ডাকা হচ্ছিল। ডাক্তার দেখলেন যে এ যাত্রায় আমরা শুধু এটাই আবিষ্কার করতে পারলাম, তাই দ্বীপগুলোর নাম দিলেন "নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড দ্বীপপুঞ্জ" - আর, নব-নামকরণ উপলক্ষে আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন। হিসেব কষে দেখা গেল তাদের অবস্থান ৩° ৪১' দক্ষিণ অক্ষাংশে।
সবচেয়ে বড় দ্বীপের মাথাটা মাপ নেওয়ার জন্য সুপ্রশস্ত। আমরাও সুযোগের সদব্যবহার করলাম - এখান থেকে লম্বা-চওড়া হ্রদ ও তাকে ঘিরে থাকা সুউচ্চ পর্বতমালাটি ভালভাবে দেখা যাচ্ছিল। এখান থেকে উত্তর-ঈশান কোণে রামাতা পাহাড় - সেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। অগ্নি কোণ আর দক্ষিণ অগ্নিকোণের মাঝবরাবর কাতাঙ্গা কেপ, সেন্টাকেয়ী পূর্ব-অগ্নি কোণে; পূর্ব আর পূর্ব-ঈশান কোণের মাঝখানে মাগালা; মুজিমুর দক্ষিণ-পশ্চিম বিন্দুটি দক্ষিণ দিক বরাবর, মুজিমু দ্বীপের উত্তর বিন্দুটি দক্ষিণ-অগ্নি দিকে।
৯ ডিসেম্বর ভোরভোর আমরা ফের সমুদ্রযাত্রার প্রস্তুতি নিলাম। রাতে একবার বা দু'বার জেলেরা এসেছিল, তবে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন ও সতর্ক হয়ে থাকায় কোনও লুটপাট হয়নি। তবে মনে হয়েছিল, উল্টো পার থেকে যারা আমাদের দিকে চোখ রাখছিল, তারা আমাদের নৌকায় ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ খুঁজছে। কিংবা আমাদের ধরে নিয়ে যাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় আছে। আমাদের দলের লোকেরা যে বিপুল বিক্রমে নৌকা বেয়ে এই শেষতম শিবিরএলাকা ছেড়ে চলে গেল, তাতে মনে হয় যে তারা এই বিপদের আশঙ্কায় খুবই চিন্তিত ছিল।
কেপ কাবোগিতে পৌঁছে আমরা সানসিদের এলাকায় ঢুকলাম। ওখানকার জেলেরা আমাদের 'মোহোলো' বলে অভ্যর্থনা করল। ভিরারা যেমন 'ওয়েক' বলে। উরুন্দি, উসিগে বা উহাতেও তেমনটাই চলে। সেই সম্ভাষণ থেকেই বুঝলাম যে আমরা একটা ভিন্ন উপজাতির সঙ্গে পরিচিত হতে যাচ্ছি; শীঘ্রই কেপ লুভুম্বা দেখা গেল। একটা পাহাড়ের দাঁড়া ঢালু হতে হতে হ্রদের মধ্যে অনেক দূরে চলে গেছে। ঝড় আসবে আসবে করছিল, তাই একটা গ্রামের আগের একটা ছোট্ট খাঁড়ির মধ্যে ঢুকে গেলাম; আর নৌকা জল থেকে পারে তুলে, তাঁবু খাটানো ও রাত কাটানোর অন্যান্য প্রস্তুতি শুরু করা হল।
এখানকার স্থানীয়রা বেশ শান্ত ও সভ্য বলেই মনে হয়েছিল। তারা যে আরব ও এনগোওয়ানাদের প্রতি কোন শত্রুতা পোষণ করে এমনটা সন্দেহ করার কোন কারণ দেখিনি। তদনুসারে সকালের জলখাবার বানানো হল। আর তারপর যথারীতি দিবানিদ্রা দেবার জন্য শুয়েছিলাম। খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েও পড়েছিলাম, নিজের তাঁবুতে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম, আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর যে কলহ- বিবাদ শুরু হয়েছিল, সেসবের কোন আন্দাজও ছিল না আমার। হঠাৎ শুনলাম আমাকে ডাকা হচ্ছে, 'কর্তা, কর্তা! উঠুন, জলদি - লড়াই লাগবে এখনই!' লাফ মেরে উঠলাম, বন্দুকের স্ট্যান্ড থেকে আমার রিভলভারের বেল্ট টান দিয়ে নিয়ে বাইরে গেলাম। হ্যাঁ ঠিকই, বিভিন্ন দলের মধ্যে বেশ ঝামেলা বেঁধেছে; একদিকে বেশ হল্লা-মাচানো, প্রতিহিংসাপূর্ণ চেহারার এক দল স্থানীয় লোক আর অন্য দিকে আমাদের দলের লোকেরা। আমাদের সাত-আটজন লোক ক্যানোর পিছনে আশ্রয় নিয়েছে। উত্তেজিত জনতার দিকে তাদের গুলি-ভরা বন্দুক প্রায় তাক করা। স্থানীয়দের সংখ্যা ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে। এদিকে ডাক্তারকে কোথাও দেখতে পেলাম না।
'ডাক্তার কোথায়?' আমি জানতে চাইলাম।
সেলিম জানালো, 'তিনি ওই পাহাড়ের ওপারে গেছেন, কর্তা ।'
'তাঁর সঙ্গে কেউ আছে?'
'সুসি আর চুমাহ।'
'বোম্বে, ডাক্তারকে সতর্ক করতে দু'জনকে পাঠিয়ে দাও আর তাঁকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে বল।'
তবে ঠিক এই সময়েই ডাক্তার ও তার সঙ্গী দু'জন পাহাড়ের চূড়ায় হাজির হলেন। যে উপত্যকায় আমরা শিবির করেছিলাম, সেখানে তৈরি হওয়া হাস্য-গম্ভীর দৃশ্যের দিকে অতি প্রসন্নভাবে তাকিয়ে আছেন। সত্যি সত্যিই ,ব্যাপারটা বেশ গুরুগম্ভীর হওয়া সত্ত্বেও, বেশ হাসিও পাচ্ছিল। একটা পুরো-মাতাল, উলঙ্গ ছেলের যা কান্ড-কারখানা! সে কোনমতে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ছিল – পরণের সবেধন-নীলমণি ল্যাঙটটা দিয়ে মাটিতে আঘাত করছিল , দাবড়াচ্ছিল আর পাগলের মতন এটা ওটা বলে চেঁচাচ্ছিল। নিজের ইচ্ছামত ভাষায় ঘোষণা করছিল যে, উসানসির পবিত্র মাটিতে কোনও এনগওয়ানা বা আরব এক মুহূর্তের জন্য থামতে পারবে না। তার বাবা, এখানকার সুলতান, তার মতোই মাতাল, যদিও সে ততটা ক্ষেপে ওঠেননি।
এর মধ্যে ডাক্তার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন। সেলিমও ততক্ষণে আমার হাতে উইনচেস্টার রাইফেল ও কার্তুজ ভর্তি ম্যাগাজিন তুলে দিয়েছে। ডাক্তার শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে। জিজি গাইডরা বলল, এই লোকগুলো আরবদের শত্রু। তাই তারা চায় আমরা চলে যাই। মুজিমু নামের উল্টোদিকের যে বড় দ্বীপটা আছে, সেখানকার সুলতানের বড় ছেলেকে খামিস নামে একজন বালুচ উজিজিতে পিটিয়ে মেরেছে, ছেলেটা তার হারেমের দিকে নজর দেওয়ার সাহস করেছিল বলে। আর সেই থেকেই সানসি ও আরবদের মধ্যে অশান্তি চলছে।
গাইডদের সঙ্গে পরামর্শ করার পর, ডাক্তার ও আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, একটা মাতাল ছেলের বেসামাল খামখেয়ালি কথায় অপমানিত না হয়ে সুলতানকে বরং একটা কিছু উপহার দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করা যাক। পাগলা রাগের মাথায় সে আমাদের একজনকে তার হাতের দা দিয়ে দু'টুকরো করার চেষ্টা করেছিল। এটাকে যুদ্ধ ঘোষণা হিসাবে নেওয়াই যায় আর সৈন্যরা যুদ্ধের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতও ছিল; কিন্তু মাতালদের সাথে যুদ্ধ করে কী লাভ! ইচ্ছা থাকলে তো শুধু আমাদের রিভলবার দিয়েই তাদের সাফ করে দেওয়া যেত।
ডাক্তার নিজের বাহু প্রসারিত করে তাদের বললেন যে তিনি এনগওয়ানা বা আরব নন, একজন সাদা মানুষ; আরব বা এনগওয়ানাদের আমাদের মত গায়ের রঙ হয় না। আমরা সাদা মানুষ, তাদের এতদিন দেখা লোকদের থেকে আমরা সম্পূর্ণ আলাদা: শ্বেতাঙ্গরা কোনও কালো পুরুষকে কখনও আঘাত করেনি। মনে হল, তাঁর কথায় বেশ ভালই কাজ হয়েছে। কারণ একটু ঠাণ্ডাভাবে বোঝানোর পরে মাতাল ছেলেটা আর তার যথেষ্ট মদ্যপ বাবা, দু'জনকেই শান্তভাবে কথা বলতে বসানো গেল। আমাদের সাথে তাদের কথোপকথনে, তারা বারবারই মুজিমুর সুলতান কিসেসার ছেলে মোম্বোর কথা বলছিল। তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। 'হ্যাঁ, নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে!' তারা বেশ কয়েকবার নিজেদের ভাষায় বলছিল; কীভাবে এই হতভাগ্য যুবকটি মারা গেছে সেটা হাত পা নেড়ে বোঝাচ্ছিল।
লিভিংস্টোন মৃদু, পিতৃসুলভ ভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলতে থাকলেন। আরব নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে তাদের হল্লাচিল্লা প্রায় থেমেই এসেছিল। সেই সময় বুড়ো সুলতান হঠাৎ উঠে পড়ল আর উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে ইচ্ছা করে নিজের বর্শার ধারালো ফলা দিয়ে নিজের পায়ে আঘাত করে পা কেটে ফেলল। তারপর চিৎকার করে উঠল যে এনগওয়ানা্রা তাকে মেরেছে!
এই চিৎকার শুনে অর্ধেক জনতা দ্রুত পালিয়ে যেতে চাইছিল, কিন্তু টিকটিকি-খোদিত পোক্ত লাঠি হাতে এক বুড়ি তার জিভের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রধানকে গালি দিতে শুরু করল, বলতে থাকল যে সে কী সবাইকে মেরে ফেলতে চায় নাকি? অন্যান্য মহিলারা তার সঙ্গে যোগ দিয়ে সর্দারকে শান্ত হতে বলল। আর আমরা স্বেচ্ছায় যে উপহার দিচ্ছি সেটাও নিতে বলল।
কিন্তু বেশ বোঝা যাচ্ছিল যে সেই ছোট্ট জায়গাটায় হাজির সব পুরুষকে তাতিয়ে লড়াইতে শামিল করতে খুব কম ইন্ধনই লাগবে। যখন সন্ধির সম্ভাবনা ক্ষীণ, তখনো সেই আসন্ন রক্তপাত ঠেকাতে ডাক্তারের নম্র, ধৈর্যশীল ব্যবহার সব থেকে বেশি কার্যকর হয়েছিল, আর শেষ পর্যন্ত ডাক্তারের চেষ্টাই ফলবতী হল। সুলতান ও তার ছেলে দু'জনকেই খুশিমনে ফেরত পাঠানো গেল।
ডাক্তার যখন তাদের সাথে কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন, তাদের তুমুল আবেগকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, সেই সময় আমি তাঁবু গোটাচ্ছিলাম। ক্যানোগুলো জলে নামালাম, তাতে মালপত্র তোলা হল। আর যেই আলোচনা সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে শেষ হল, অমনি আমি ডাক্তারকে নৌকায় লাফ দিতে বললাম। এই আপাত শান্তি ছিল ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতা। তাছাড়াও, নৌকায় দু-তিনটে এমন ভীতু আছে, যারা কোনো দ্বিতীয় ঝামেলা দেখলে আমাদের দুজনকে এখানে ফেলে রেখে চলে যেতে একটুও দ্বিধা করবে না। কেপ লুভুম্বা থেকে, প্রায় বেলা সাড়ে চারটের সময়, আমরা নৌকা চালাতে শুরু করলাম; রাত ৮টায় মুজিমু দ্বীপের উত্তরতম প্রান্ত কেপ পাঞ্জার কাছাকাছি পৌঁছেছিলাম; সকাল ৬ টায় আমরা বিকারির দক্ষিণে ছিলাম, তখন আমরা উরুন্ডির মুকুঙ্গুর দিকে চলছি। আর সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল দশটা। হ্রদ পেরোতে লেগেছে সাড়ে সতেরো ঘণ্টা, ঘণ্টায় দুই মাইল বেগ ধরলে বলা যায় এর সরলরৈখিক প্রস্থ পঁয়ত্রিশ মাইল। আর কেপ লুভুম্বা থেকে এই দূরত্ব তেতাল্লিশ মাইলের একটু বেশি।
১১ ডিসেম্বর, সাত ঘণ্টা নৌকা বাওয়ার পর, আমরা আবার সুরম্য জাসিতে এসে পৌঁছলাম; ১২ তারিখে এলাম নিয়া-সাঙ্গার সুন্দর খাঁড়িতে; আর দুপুর ২টোয় ব্যাংওয়ের পাশ দিয়ে গেলাম। উজিজি সামনেই।
সাধারণ নিয়মমত গুলি-টুলি না ছুঁড়ে আমরা খুব শান্তভাবে বন্দরে প্রবেশ করলাম। আসলে আমাদের সঙ্গে বারুদ, গোলার অভাব ছিল। নামার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সৈন্যরা ও সম্ভ্রান্ত আরবেরা আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে জলের ধারে এল।
মাব্রুকির ভাঁড়ারে অনেক বলার মত কথা জমে ছিল। আমাদের অনুপস্থিতিতে যা কিছু ঘটেছে সেসব তো আমাদের জানাতে হবে। তার হাতে লিভিংস্টোনের বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এই বিশ্বস্ত লোকটি খুবই ভাল কাজ করেছিল। কালুলু পুড়ে গিয়েছিল, তার বুকে একটা ভয়ানক কাঁচা ঘা। মাব্রুকি মারোরাকে শিকল দিয়ে আটকে রেখেছিল। কারণ সে একটা গাধাকে মেরেছিল। বিলালী নামের এক তোতলা, ডরপোক ছিল। মেয়েদের উপর মস্তানি করতে তার জুড়ি নেই। সে বাজারে খুব ঝামেলা করেছে। মাব্রুকির লাঠি দিয়ে তাকে ধুম পিটিয়েছে। আর সব থেকে ভাল খবরটা হল এই যে, জানজিবারের আমেরিকান কনসালের কাছ থেকে ১১ই জুন একটা চিঠি এসেছে। এর মধ্যে সে বছরেরই ২২শে এপ্রিল তারিখের প্যারিস থেকে আসা টেলিগ্রামও রয়েছে! বেচারা লিভিংস্টোন চেঁচিয়ে উঠলো, 'আর আমার জন্য একটাও নেই। একজন সত্যিকারের ভালো বন্ধু পাওয়াটা কতই না আনন্দের!'
টাঙ্গানিকার উপর আমাদের জলযাত্রা আঠাশ দিন ধরে চলেছিল, আর সেই সময়ে আমরা ৩০০ মাইল জলপথ পেরিয়েছি।