ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে টাঙ্গানিকা হ্রদে স্ট্যানলে ও লিভিংস্টোনের নৌযাত্রার কথা। এই পর্বে ন্যামওয়েজি উপজাতির মানুষদের কথা। তরজমা স্বাতী রায়
মধ্য আফ্রিকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপজাতি হল ন্যামওয়েজিরা। আমার কাছে একজন ন্যামওয়েজির সৌন্দর্যের আদর্শ হল একজন লম্বা দীর্ঘপদ কালো মানুষ, ভালো মানুষের মতন সদা হাসিভরা মুখ, হাসির ফাঁকে দাঁতের উপরের সারির মাঝখানে একটা ছোট গর্ত দৃশ্যমান। সে যখন বালকমাত্র, তখন তার গোত্র বোঝাতে এই গর্তটা তৈরি করা হয়েছিল। তার গলার থেকে শত শত লম্বা তারের ঝুমকো ঝুলছে; মানুষটা প্রায় নগ্ন হওয়ায় তার গোটা সুন্দর শরীরটা দেখতে কোন অসুবিধা নেই। অপুর্ব কালো অ্যাপোলোর মডেল যেন। আমি এই উপজাতির অনেককেই দেখেছি জাঞ্জিবারের স্বাধীনদের পোশাকে, নতুন আমেরিকান কাপড়ের পাগড়ি মাথায় বা আরবদের মত লম্বা দিশদাশেহ (শার্ট) পরে, জাঙ্গুবার উপকূলের যে কোনও সোয়াহিলির মতো সুন্দর ও বুদ্ধিমান উপস্থিতি। তবু আমার চোখ থেকে যেন এই ছবিটা মোছে না!
ন্যামওয়েজিরা যেন আফ্রিকার ইয়াঙ্কি; জন্ম থেকেই ব্যবসায়ী, তাদের পায়ের তলায় সর্ষে। সেই কোন কালের থেকে এই জাতের লোকরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে পণ্য পরিবহনের কারবারের একচেটিয়া অধিকারী। এদের বলা যায় উট, ঘোড়া, খচ্চর ও গাধার তুল্য। সব ভ্রমণার্থীরাই নিজের মালপত্র উপকূল থেকে সুদূর আফ্রিকার অভ্যন্তরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এই সব ভারবাহী জন্তুদের দিকে উদ্বিগ্নভাবে তাকিয়ে থাকে। আরবরা এদের সাহায্য ছাড়া একপাও যেতে পারে না; শ্বেতাঙ্গ যাত্রীরা যারা একটা অভিযানে বেরোতে চাইছে, তারাও এদের ছাড়া ভ্রমণ করতে পারে না। সাধারণত বাগামোয়ো, কন্ডুচি, কাওলে, দার সালাম ও কিলওয়াতে প্রচুর সংখ্যায় ন্যামওয়েজিদের দেখা মেলে, দীর্ঘ যাত্রাপথের ভাড়া পাওয়ার অপেক্ষায়। এরা অনেকটা নাবিকদের মতোই, বড় বড় বন্দর-শহরে নির্দিষ্ট নাবিকদের থাকার আস্তানাতেই ঘাঁটি গাড়ে। আর নাবিকের মতোই, এরা ভারি চঞ্চল, এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না। একজন ইংরেজ নাবিকের কাছে নিউ ইয়র্ক শহর যেমন, একজন ন্যামওয়েজির কাছেও সমুদ্র উপকূলটি ঠিক তেমন। নিউইয়র্ক শহরে যেমন ইংরেজ নাবিকরা আরও বেশি বেতনে ফের জাহাজে চাপতে পারেন, ঠিক তেমনই ন্যামওয়েজিরাও উন্যামওয়েজি থেকে সমুদ্রের দিকে যাওয়ার সময় যা ভাড়া পায়, সমুদ্র উপকূল থেকে ফেরার সময় আরও বেশি ভাড়া পায়। এমনই চাহিদা তার, আর যুদ্ধের সময় এতই লোক পাওয়া দুষ্কর যে তার দামও খুব। ছত্রিশ গজ কাপড় থেকে একশ গজ পর্যন্ত তার ভাড়া ঘোরাফেরা করে। একশজন এইরকম মানব-ভারবাহীর জন্য, এমনকি উন্যানয়েম্বে পর্যন্ত মাত্র তিন মাসের যাত্রার জন্য, খুব সহজেই ১0,000 গজ কাপড় খরচ হয়ে যায়। জাঞ্জিবারে ১0,000 গজ কাপড় মানে হল সোনার পাঁচ হাজার ডলার। তবে ধৈর্য ধরে, টিপে টিপে টাকা দিয়ে অবশ্য ৩০০০ ডলারেও কাপড় সংগ্রহ করা যেতে পারে।
ম্যাসাচুসেটসের তুলা আর গৃহদ্রব্যাদি, ইংল্যান্ডের ক্যালিকো, মাস্কাটের ছাপা কাপড়, কচ্ছের কাপড়, জার্মানির পুঁতি, গ্রেট ব্রিটেনের পিতলের তার -এইসব জিনিসে বোঝাই বোঝা জাঞ্জিবার থেকে মাথায় চাপিয়ে ন্যামওয়েজিরা দিকে দিকে যায় - লুয়ালাবাতে, উকাওয়েন্দির জঙ্গলে, উগান্ডার পাহাড়ে, কারাগওয়াহর পর্বতমালা, উরোরির সমতলে, উগোগোর মালভূমিতে, উকোনঙ্গোর ঘাসজমিতে, উসেগুহহার জলাজমিতে, উসাগারের গিরিশঙ্কটে, উবেনার জনহীন প্রান্তরে, ওয়াতুতার পশুচারক উপজাতিদের মধ্যে, রুফিজির তীরে তীরে , দাস-ব্যবসা-করা কিলওয়াতে - মধ্য আফ্রিকার সর্বত্র এদের দেখা যায়।
কাফেলার সাথে যখন থাকে, তখন তারা নম্র, সংযত; নিজেদের গ্রামে তারা খুব ফুর্তি করে; নিজেদের ব্যবসা-অভিযানে তারা খুবই আগ্রহী ও চতুর; রুগা-বুগা হিসাবে তারা সাহসী, নীতির ধার ধারে না। উকোনঙ্গো ও উকাওয়েন্দিতে তারা শিকারী; উসুকুমাতে তারা পশুব্যবসায়ী ও কর্মকার; লুন্ডায় তারা হাতির দাঁত খুঁজে বেড়ায়; আর উপকূলে তারা হাঁ করে ঘুরে বেড়ানো অবাক মানুষ।
আমার ভয় যে ন্যামওয়েজিরা শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথবা তারা দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে; তবে এমগংগো টেম্বো, রুবুগা, কিগওয়া, উটান্ডা, এমফুটো, মাসাঞ্জে, উইলিয়ানকুরু ইত্যাদি দেশের একটা বড় এলাকা জনবিরল হয়ে যাচ্ছে বলে তাদের শেষ হয়ে যাওয়ার কথাটা বললাম। মানওয়া সেরা, নিওনগো, মিরাম্বো বা ওসেটোর মতো অস্বস্তিকর, সদা-অতৃপ্ত সর্দারদের সবসময় মারামারির চোটে উন্যামওয়েজি প্রকৃতপক্ষে জনশূন্য হয়ে যাচ্ছে। এই গোষ্ঠীর নিত্যযাত্রার প্রচন্ড পরিশ্রমও এদের বংশবৃদ্ধির জন্য অনুকূল নয়। এখানে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যপথের ধারে ধারে দেখা দশটা শুকনো মাথার খুলির মধ্যে আটটাই অভাগা ন্যামওয়েজিদের। কাফেলার প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে মিশে থাকা কষ্ট আর বিপদের কাছে হার মেনেছে তারা। ঘৃণ্য দাসপ্রথা এদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছে, ধ্বংস হয়ে যেতে সাহায্য করছে। ভাবতেও কষ্ট লাগে যে লিভিংস্টোনের প্রথম লিনিয়ান্তিকে দেখার পরের থেকে, এমনকি আমাদের স্মরণকালের মধ্যেও যে ম্যাকালোলোর যোদ্ধাদের মতন একটা জাত ছিল, সেটা আজ পৃথিবীর থেকে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। একটি জনদরদী সরকার এই জনগণকে নিয়ে কী অসীম শক্তির অধিকারীই না হতে পারত! সভ্যতার গৌরবের কী দারুণ সাক্ষ্য দিতে পারত! একজন বাস্তববোধওলা ধর্মপ্রচারকের মাধ্যমে, এদের কেমন সুসমাচারে নিবেদিত প্রাণ করা যেত!
উন্যামওয়েজিতে ওঝাদের ঔষধের অপার প্রভাব। শুনলাম যে আমি নাকি একটা ওষুধ দিয়ে বৃষ্টি তৈরি করতে পারি, দেশের সব কূয়োকে বিষাক্ত করে দিতে পারি বা মিরাম্বোর সকল লোককে মেরে ফেলতে পারি। যতক্ষণ না কষ্ট করে আমার এই সব শক্তি থাকার কথা অস্বীকার করলাম, ততক্ষণ এই সব শুনতেই থাকলাম। আমার রোগনিরাময়ের অক্ষমতার বিষয়ে বিশ্বাস না আসা পর্যন্ত তারা অসুস্থদের আমার কাছে নিয়ে আসত- আলসার, সিফিলিস, চুলকানি, গুটি-বসন্ত, যক্ষ্মা ও আমাশয় ইত্যাদি বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত রোগী- । একজন দীর্ঘদিনের আমাশয়ের রোগী বৃদ্ধ রোগ নিরাময়ের মূল্য হিসেবে একটি দারুণ মোটাসোটা ভেড়া ও এক থালা বরবটির বীজও নিয়ে এসেছিলেন। হয়ত ভেড়াটি নিয়ে একটা কিছুমিছু দিয়ে দিলেই হত! কিন্তু আমি তাকে সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলাম যে তার রোগ সারানো আমার সাধ্য না। লোকটার কষ্ট দেখে এত খারাপ লেগেছিল যে আমি তাকে প্রায় একশো গ্রেন ডোভারের পাউডার দিয়েছিলাম, আর সেই সঙ্গে তার নিজের ও তার স্ত্রীর গা ঢাকা দেওয়ার জন্য কয়েকটা ভালো কাপড়ও দিয়েছিলাম, কিন্তু তার ভেড়াটা নিতে পারিনি।
ওঝাদের সাথে পরামর্শ না করে ন্যামওয়েজিদের কোন শিকার অভিযান শুরু হয় না। ওঝারাই মূল্যের বিনিময়ে তাদের মন্ত্র, ওষুধ, ভেষজ ও আশীর্বাদ দেয়। জেব্রার কানের ছোট্ট টুকরো, সিংহের রক্ত, চিতাবাঘের নখ, মহিষের ঠোঁট, জিরাফের লেজ, হার্টেবিস্টের ভ্রু, এমন সব অমূল্য ধন। টাকা ছাড়া যেসব হাতছাড়া করা যায় না। একটা পালিশ করা, তিনকোনা কোয়ার্টজের টুকরো তাদের গলায় ঝোলে, আর সেই সঙ্গে খোদাই করা কাঠের টুকরো। আর একটা ছোট চামড়ার থলেতে পোরা একটা গাছের মত এক সর্বশক্তিমান তাবিজও থাকে।
জাতি হিসেবে ন্যামওয়েজিরা কাপুরুষ। উগোগোর ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের কাফেলাগুলো ভারি বিনীত, কিন্তু, যেই সেই ভয়ঙ্কর দেশ পেরিয়ে যায়, অমনি অন্যদের সামনে তারা ভীষণ রোয়াব দেখায়। যুদ্ধের সময় তাদের দেশের প্রথা অনুসারে তারা কোন কাফেলার সঙ্গে যোগ দেয় না। তাদের প্রধানরা সব ব্যবসায়িক উদ্যোগকে তখন যেতে মানা করে, আর প্রবীণদের মুখের কথাই তাদের আইন।