ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে টাঙ্গানিকা হ্রদে স্ট্যানলে ও লিভিংস্টোনের নৌযাত্রার কথা। তরজমা স্বাতী রায়
একটা বটগাছের নিচে ছাউনি খাটানো হল; চারপাশে টাঙ্গানিকার হালকা-ধূসর জলরাশি, তার পাশে ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া পাহাড়ের সারি। পাম-কুঞ্জ, কলাঝাড়, সাবু-সহ শস্যখেত দিয়ে সাজানো নিয়াসাঙ্গা গ্রামটি অবস্থিত নিয়াসাঙ্গা নদীর মুখে। তাঁবুর কাছেই গ্রামবাসীদের ছোট-বড় আধা ডজন ক্যানো ছিল। তাঁবুর দরজার সামনেই যতদূর চোখ যায় মিষ্টি জলের রাশি মৃদু বাতাসকে ডাক পাঠাচ্ছে— দূরের উগোমা, উকারাম্বা চোখে পড়ে। ঘন-নীল-শিরা-লাঞ্ছিত মুজিমু দ্বীপপুঞ্জও ফুটে ওঠে চোখের সামনে। আমাদের পায়ের তলায় পরিষ্কার, জলে-ধোয়া নুড়ি, সমুদ্রের অস্থির ঢেউয়ে ভেসে ভেসে কূলে এসে সারি বেঁধে জমা হয়, কোথাও বা স্তূপের আকার নেয়। আমাদের ডাইনে বাঁয়ে পিছনে যে পাহাড়ের রাশি সেগুলো কি দিয়ে তৈরি তা এই পাথরগুলোর থেকেই হদিশ পাওয়া যাবে। বেলেপাথর, শক্ত সাদামাটি, লোহায়-ঠাসা হলদেটে মাটি, পালিশ করা কোয়ার্টজ আরও কত কী রয়েছে একসঙ্গে। তাঁবুর বাইরে তাকালে, দুপাশে মোটা লম্বা নলখাগড়ার সারি দেখতে পাচ্ছি, এটা যেন সমুদ্র সৈকত ও নিয়াসাঙ্গার আশেপাশের চাষের জমির মধ্যে অনেকটা বেড়ার মত দাঁড়িয়ে। এখানে দেখা পাখিদের মধ্যে, উল্লেখযোগ্য ছিল ছটফটে খঞ্জনের দল, স্থানীয়রা একে শুভ সূচক, শান্তির দূত বলে ভাবে। এদের কোনও ক্ষতি করলে তারা খুবই বিরক্ত হয়। জরিমানা আদায় করে ছাড়ে। বদ প্রবণতা থাকলে অন্য কথা, নাহলে পাখিগুলো কোনরকম হিংস্র কাজের প্ররোচনাও দেয় না অবশ্য। আমরা ডাঙ্গায় নামতেই, তারা বাতাসে ভাসতে ভাসতে আমাদের স্বাগত জানাতে উড়ে এলো। একদম হাতের নাগালের মধ্যে। এছাড়াও ছিল কাক, লাল ঘুঘু, মাছমুরাল, মাছরাঙ্গা, আইবিস নিগ্রা ও আইবিস রিলিজিওসা নামের বক, আফ্রিকান বাবুই পাখির ঝাঁক, হাঁস, গয়ার, কানিবক, চিল আর ঈগল।
এখানে ডাক্তার পেট খারাপে ভুগছিলেন— তাঁর মতে, এটা তার একমাত্র দুর্বলতা; আর, পরেও দেখেছি, তার ঘন ঘন এটা হতেই থাকে। মনের বিরক্তিই হোক বা খাওয়ার কোনও অনিয়মই হোক না কেন, শেষ হবে পেট খারাপ দিয়ে। আমার আবার উল্টোরকম: কোনো রকমে ম্যালেরিয়ার সংস্পর্শে এলে, একটা জলাজমির কাছে শিবির করলে, বা কোন কারণে মন অস্থির হলে, অত্যধিক কোষ্ঠবদ্ধতা শুরু হবে আর সেই সঙ্গে আবার পালাজ্বরও বাঁধবে।
টাঙ্গনিকায় আমাদের নৌযাত্রার তৃতীয় দিনে চার ঘণ্টা ধরে নৌকা বেয়ে আমরা এলাম জসসি নদীর ধারের গ্রামে। রাস্তা বরাবর পাহাড়গুলো হ্রদের জল থেকে দু -আড়াই হাজার ফুট উঠে গেছে। মনে হচ্ছিল যে প্রতি পদক্ষেপে দৃশ্যগুলো আরও মনোরম , আরও যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। হাডসন নদীর ধারের বা লেক জর্জের আশেপাশের দৃশ্যের থেকে অনেক বেশি মনোহর এখানকার দৃশ্য। খাঁড়ির মাথায় লুকিয়ে থাকা নিরিবিলি সুখের কোণগুলো যে কি অপূর্ব সুন্দর! পামের ঝিরিঝিরি পাতা আর সবুজ চওড়া কলাপাতায় সাজানো! এই কোণগুলো সব জেলেদের দখলে। তাদের শঙ্কু আকারের মৌচাকের মতন কুঁড়েঘরগুলো গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে। উপকূল এলাকা অতি জনবহুল; প্রতিটি ধাপ, ছোট ছোট মালভূমি আর প্রতিটা সমভূমির টুকরোই কারোর না কারোর দখলে।
একদল শঙ্কু আকৃতির পাহাড়ের জন্য জসসিকে সহজেই চেনা যায়। পাহাড়টার নাম কিরাসা, কাছাকাছি জায়গা থেকে ওঠে। এর বিপরীতে, তীর থেকে প্রায় এক মাইল দূরে, আমরা জলের গভীরতা মেপেছিলাম আর আগের দিনের মতোই ৩৫ ফ্যাদম গভীর জল পেয়েছিলাম। আরও এক মাইল দূরে গিয়ে, আমি আমার দড়ি পুরোটাই, পুরো ১১৫ ফ্যাদম, ছেড়ে দিলাম, তাও তল পেলাম না। আবার টেনে তুলতে গিয়ে দড়িটাই ছিঁড়ে গেল, আর আমি দড়ির ওজন সহ প্রায় তিন চতুর্থাংশ দড়ি হারিয়ে ফেললাম। ডাক্তার বললেন যে, এই প্রেক্ষিতে খুবই প্রাসঙ্গিক, তিনি উজিজির দক্ষিণে, সুউচ্চ কাবোগোর বিপরীতে মেপে ৩০০ ফ্যাদম গভীর জল পেয়েছিলেন। তিনিও ওজন-সমেত ১০০ ফ্যাদম মতন দড়ি হারিয়েছিলেন, তবে তার আরও প্রায় ৯০০ ফ্যাদম দড়ি হাতে ছিল, সেটা আমাদের ক্যানোতেই ছিল। আমরা পূর্ব থেকে পশ্চিম উপকূল অবধি এই টানা লম্বা দড়িই ব্যবহার করব।
চতুর্থ দিনে আমরা ন্যাম্বিগমাতে পৌঁছলাম। এটা উরুন্ডিতে অবস্থিত, একটা বালুকাময় দ্বীপ। আমরা সেখানে পৌঁছানোর আধা ঘণ্টা আগে উজিজি ও উরুন্ডির মধ্যের সীমানা পেরলাম। দুটো দেশই এমশালা নদীকে সীমান্ত রেখা বলে মেনে নেয়। যদিও রুন্ডির বেশ কিছু লোক সীমান্ত পেরিয়ে উজিজির ভিতরে চলে গিয়েছে; যেমন ধরুন, মুটওয়ারেরা অথবা জসসি থেকে এক ঘণ্টা উত্তরের জনবহুল কাগুঙ্গার বাসিন্দারা। এছাড়াও জিজিদের বেশ কটা ছোট ছোট দলও রয়েছে, এরা কাসোকওয়ে, নামুসিঙ্গা বা লুয়াবা নদীর ব-দ্বীপের দারুণ জমির সদ্ব্যবহার করতে ছাড়েনি। যে উপসাগরের মাথায় ন্যাম্বিগমার অবস্থান, সেখানেই প্রথম দুটো নদী, কাসোকওয়ে আর নামুসিঙ্গা এসে টাঙ্গানিকায় পড়েছে।
ন্যাম্বিগমা থেকে বিশ-পঁচিশ মাইল দূরত্বে, কেপ কাজিংগাও থেকে কেপ কাসোফু অবধি ছড়ানো বিশাল পর্বতশ্রেণীর একটা গভীর বাঁকের অপূর্ব দৃশ্য দেখতে পাওয়া পায়। পাহাড়ের উঁচুনিচু, শির-বার করা, অসমান রেখা— খুবই আকর্ষণীয় দৃশ্য। গভীর গিরিখাত, অতল শূন্যের থেকে বেরিয়ে আসে অসংখ্য জলধারা আর পিছনের পাহাড়ের থেকে উৎপত্তি হওয়া নদীরা। হালকা তুলোর মতন মেঘ প্রায় সবসময় পাহাড়ের শিখর ঢেকে রাখে। পাহাড়ের গোড়া থেকে শুরু হয় এক বিস্তৃত পাললিক সমভূমি, বর্ণনাতীত রকমের সমৃদ্ধ, পাম-কলা ও অন্যান্য গাছের ছায়ায় শীতল। গ্রামগুলো সর্বত্র দল বেঁধে থাকে। এই পাললিক সমতলে, কেপ কিতুন্ডার উত্তর দিকে, লুয়াবা বা লুয়ালু নদী বয়ে যায়। আর কেপের দক্ষিণ দিকে বয় কাসোকওয়ে, নামুসিঙ্গা ও এমশালা নদী।
যে সব নদী টাঙ্গানিকায় এসে পড়েছে, তাদের সবারই বদ্বীপগুলো ম্যাটেটে নামের এক দানবাকার প্রজাতির ঘাস আর প্যাপিরাসের ঘন জঙ্গল দিয়ে চারপাশে ঘেরা। লুয়াবা বা কাসোকওয়ের মতো কয়েকটা ব-দ্বীপ আবার জলাজমিতে ভরা, সেখানে ম্যাটেটে আর প্যাপিরাসের দুর্ভেদ্য জঙ্গল। আর তার নীচে রয়েছে শান্ত, গভীর জল, যেখানে রাজহাঁস, পাতিহাঁস, স্নাইপ, উইজেন, মাছরাঙ্গা, আইবিস, ক্রেন, স্টর্ক, পেলিকান ইত্যাদি জলচরা পাখিদের ইতিউতি দেখা যায়। তবে শিকারির পক্ষে তাদের আড্ডায় পৌঁছানো খুবই কঠিন; বিপদ মাথায় করে যেতে হয়। এই জলাভূমির প্রকৃতি অতি বিশ্বাসঘাতক, সেই সঙ্গে জ্বরের ভয়ঙ্কর আক্রমণও এখানকার আরেক বিপদ, শরীর বা জামাকাপড় ভিজে থাকলে তো তারপরে জ্বর হবেই।
ন্যাবিগ্মাতে আমরা প্রস্তুতই ছিলাম। দলের সবাইকে দশ রাউন্ড করে গুলি দেওয়া হয়েছিল। আসন্ন দুই দফা ঝামেলার প্রস্তুতি - অপরিচিতদের প্রতি রুন্ডিরা বিদ্বিষ্ট। সেই বিদ্বেষভাব বেশি দেখালে গুলি কাজে লাগবে।