ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। উজিজিতে লিভিংস্টোনের সন্ধান পাওয়ার পর প্রথম আলাপচারিতা। তরজমা স্বাতী রায়
‘‘ওহ্, যাঃ!’’ আমি বললাম, ‘‘একদম ভুলে গেছি। সেলিম, জলদি, সেই বোতলটা নিয়ে আয়, কোনটা জানিস তো, আর ওই রূপোর পেয়ালাটাও আন। এই ঘটনার জন্যেই বোতলটা নিয়ে আসা, মাঝে মাঝে যতই হতাশ লাগুক না কেন, জানতাম একদিন না একদিন আশা মিটবে।’’
সেলিম জানত বোতলটা কোথায়, সিলারি শ্যাম্পেনের বোতল নিয়ে সে জলদি ফিরে এলো। ডাক্তারকে রূপোর পানপাত্রে কানায় কানায় ভরা উজ্জ্বল ওয়াইন দিয়ে, আর আমার নিজের পাত্রে অল্প পরিমাণ পানীয় ঢেলে নিয়ে, বললাম, ‘‘ডঃ লিভিংস্টোন, আপনার সুস্বাস্থ্যের কামনায়, স্যার।’’
‘‘আর আপনারও সুস্বাস্থ্য কামনা করি!’’ তিনি হাসিমুখে উত্তর দিলেন।
এই আনন্দ-সাক্ষাতের জন্য যে শ্যাম্পেনটি সযত্নে তুলে রেখেছিলাম, একে অপরকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে সেটি পান করা হল।
কথা বলছি তো বলছিই। সারা বিকেল ধরেই আমাদের জন্য প্রস্তুত করা খাবার আনা হচ্ছে; আর যখনই আসছে তখনই খেয়ে নিচ্ছি, যতক্ষণ না পেট টইটম্বুর, আর ডাক্তারও বললেন যে অনেক খাওয়া হয়ে গিয়েছে। তবু, ডাক্তারের সংসারের মহিলা রাঁধুনি হালিমা তুমুল উত্তেজিত। বারান্দায় যে সত্যি সত্যিই দু'জন সাদা চামড়ার লোক বসে আছে সেটা নিশ্চিত করার জন্য সে রান্নাঘর থেকে মাথা বের করে করে দেখছে। সেখানে তো কেবল একজনই ছিলেন, তিনি আবার কিছুই খেতেন না, কারণ খেতে পারতেন না; সে এই ব্যাপারটা নিয়ে মনে মনে অনেক ভেবেছে। সে ভাবত যে ডাক্তারের তার রান্না পছন্দ হয় না; কিন্তু এখন যে বিপুল পরিমাণে খাবার খেয়ে নেওয়া হল তা দেখে সে হাঁ, একেবারে খুশিতে ফুটছে। টাটকা খবরের জন্য তার রান্নাঘরের সামনে জড়ো হওয়া জনতাকে যে কত কিছু বলেই যাচ্ছে তা আমরা শুনতেই পাচ্ছিলাম। বেচারা! খুবই বিশ্বাসী অবশ্য! আমরা যখন তার তুমুল বকর বকর শুনছিলাম, ডাক্তার তখন তার বিশ্বস্ততার গল্প শোনাচ্ছিলেন, যখন গুলির শব্দ উজিজিতে আরেকজন সাদা মানুষের পৌঁছানর খবর বয়ে আনল, তখন সে যে কী ভয়ঙ্কর উদ্বিগ্ন হয়েছিল! কীভাবে সে প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, রান্নাঘর থেকে একবার লিভিংস্টোনের কাছে, একবার আবার বাজারে, কত রকমের যে সব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছিল; এই আজব সংসারের ভাঁড়ারে যে কিছুই খাবার নেই তা নিয়ে হাহুতাশ করছিল, আর সেই খাবার না থাকাকে ঢাকা দেওয়ার জন্য বেশ একটা জমকালো চেহারা হাজির করতে চাইছিল- সাহেবকে স্বাগত জানানোর জন্য একটা 'বারমেসাইড' ভোজের বন্দোবস্ত করতে চেয়েছিল।
‘‘কেন,’’ সে বলেছিল, ‘‘তিনি কি আমাদেরই একজন নন? তিনি কি অনেক কাপড় ও পুঁতি নিয়ে আসেননি? আরবদের কথা কি আর বলি! তাদের সঙ্গে কী আর সাহেবদের তুলনা করা যায়? আরবরা, সত্যি!’’
ডাক্তার এবং আমি অনেক কিছু নিয়ে কথা বললাম, বিশেষ করে তার নিজের তখনকার সমস্যাগুলো নিয়ে কথা হল। উজিজি আসার পর যখন তাঁকে বলা হয়েছিল যে তাঁর সব জিনিসপত্র খরচ হয়ে গেছে, আর তিনি এখন গরীব, তাঁর তখনকার হতাশা নিয়েও কথা হল। শেরিফ নামের একটা লোককে রাজদূতমশাই সব জিনিসপত্রের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, সে ব্যাটা একটা দো-আঁশলা মাতাল দর্জি, এখন তার কাছে মাত্র কুড়িটা কাপড়ের মতন বাকি পরে আছে। তা ছাড়াও লিভিংস্টোন আমাশয়ে ভুগছিলেন- শরীরের অবস্থা ভারি শোচনীয়। সেদিন তার শরীরের অতি সামান্য উন্নতি হয়েছিল, যদিও তিনি ভাল করে খেয়েছিলেন, আর এর মধ্যেই একটু ভাল বোধ করতে শুরু করেছেন, গায়ের বলও একটু একটু ফিরে পাচ্ছেন।
আর দশটা দিনের মতন এই দিনটাও শেষ পর্যন্ত ফুরিয়ে গেল! বড় আনন্দের দিন! পূর্বদিকে মুখ করে বসেছিলাম, আমার আসার আগের দিনগুলোতে লিভিংস্টোন যেমন বসে থাকতেন! তালকুঞ্জের মাথা ছুঁয়ে, সেদিনই পেরিয়ে আসা পাহাড়ের প্রাচীরের উপর দিয়ে গাঢ় অন্ধকার নামছে। দ্রুত ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। আমার হৃদয় কৃতজ্ঞতায় ভরা, টাঙ্গানিকা সকল আনন্দের উৎস, সকল সুখের স্রষ্টা। আমরা টাঙ্গানিকার ঢেউর মৃদু গর্জন শুনছি। আর সেই সঙ্গে শুনছি নিশি পতঙ্গের গান। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল। তাও আমরা বসেই আছি আর উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো নিয়ে কথা বলেই যাচ্ছি। তখন মনে পড়ল অভিযাত্রী এখনও তার চিঠিপত্র পড়ে উঠতে সময় পাননি।
‘‘ডাক্তার,’’ আমি বললাম, ‘‘আপনি বরং এবার চিঠিগুলো ভালো করে পড়ে নিন। আর আপনাকে ধরে রাখব না।’’
‘‘হ্যাঁ,’’ তিনি বললেন, ‘‘অনেক রাত হল; আমি গিয়ে এবার আমার বন্ধুদের চিঠি পড়ব। শুভরাত্রি, ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।’’
‘‘শুভরাত্রি, প্রিয় ডাক্তার; আশা করা যাক যে খবরগুলো আপনার মনোমতই হবে।’’
আর এবার, প্রিয় পাঠক, ‘আমি কিভাবে লিভিংস্টোনকে খুঁজে পেয়েছি’ তার গল্প সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করার পর, আমিও আপনাকে ‘শুভরাত্রি’ বলছি।
(এখানেই একাদশ অধ্যায়ের শেষ)
(ক্রমশ…)