ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে উজিজির পথে এগিয়ে চলার বর্ণনা। এ পর্বে গভীর জঙ্গল পার করে ম্রেরা নামের জনপদে শিবির ফেলার কাহিনি। তরজমা স্বাতী রায়
আমাদের শিবিরের জায়গাটা কৌশলগত ভাবে খুবই সুবিধার। পাহাড়ের পদতল থেকে উটেন্ডে গ্রাম অবধি পুরো জায়গাটাতেই এখান থেকে নজরদারি করা যায়। রাতভর পাহারা দেওয়ার জন্য লোক মোতায়েন করা হয়েছিল, তবে সৌভাগ্যবশত সকালের আগে কোন ঝামেলা হয়নি। সকালবেলা গ্রামের মাথারা কয়েকজন দলবেঁধে এলো। জানতে চাইল যে আমি কি প্রধানকে কোন উপহার না দিয়েই চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি নাকি! তাদের জবাব দিলাম যে, সর্দারের সঙ্গে বন্ধুত্ব না করে কোনো জায়গার মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছা আমার নেই, আর সর্দার যদি আমার কাছ থেকে একটা ভাল কাপড় নেন, সে তো তাকে সানন্দে দেব। তারা প্রথমে উপহারের পরিমাণ নিয়ে একটু ঘ্যানঘ্যান করছিল, শেষ পর্যন্ত সর্দারের বৌ এর জন্য এক ছড়া লাল পুঁতির অর্থাৎ সামি-সামির মালা উপহার সঙ্গে জুড়ে দেওয়ায় সব সমস্যা মিটল।
উটেন্ডের পাহাড় ও শৈলশিরা থেকে পশ্চিম দিকে ঢাল বেয়ে জঙ্গল - মাইলের পর মাইল জুড়ে রয়েছে। এটা শেষ হয়েছে আর একটা শৈলশিরাতে, সেটা মাটি থেকে ৫০০ বা ৬০০ ফুট উপরে, দারুণ দেখতে, মাথাটা একদম মসৃণ।
১২ অক্টোবর চার ঘণ্টা হাঁটার পর একটা নালার পাশে পৌঁছালাম। অনেকটা গোম্বের মতোই দেখতে। বর্ষার সময় এটা গোম্বে নদীতে গিয়ে পড়ে আর সেখান থেকে মালাগারাজি নদীতে মিশে যায়।
শিবিরের একটু দূরে একদল নিম্বা বা পাল্লার (দক্ষিণ আফ্রিকার এক ধরণের বড় আকারের বল্গা হরিণ) পাল দেখেছিলাম। কপাল ভাল যে একটাকে শিকার করতে পারলাম, গোম্বের পাশের শিবির থেকে শুকনো মাংসের ব্যবস্থা করে আনা হয়েছিল, সেই মাংসের দ্রুত হ্রস্ব-মান ভাণ্ডারে এটা স্বাগত সংযোজন। পশুদের নাদার পরিমাণ দেখে, অনুমান করলাম যে এখানে অনেক মোষ আছে, সেই সঙ্গে হাতি আর গন্ডারও অনেক। আইবিস, শঙ্খচিল, পেলিকান, স্টর্ক, সারস, বেশ কটা ধপধপে সাদা স্পুন-বিল আর ফ্লেমিংগোতে মিলে ডানাওলা প্রজাতিদের প্রতিনিধিত্ব করছে।
এই নালা বা ছোট নদীটির থেকে আমরা এমওয়ারুর দিকে এগোলাম। এটা এমওয়ারু জেলার প্রধান গ্রাম। গ্রামের সর্দার হল কা-মিরাম্বো। যে জনশূন্য জায়গাগুলোর উপর দিয়ে আমাদের দল চলছে, তা একসময় কা-মিরাম্বোর দলের দখলে ছিল। প্রায় দশ বছর আগে, মান্যয়া সেরার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়, এমকাসিওয়া এদের তাড়িয়ে দিয়েছিল। মান্যয়া সেরার ভাই নিওঙ্গো এখন এমবোগোর বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেছে। আমরা এখানে আসার মাত্র আগের দিনই সে শত্রুর কাছে হেরে এমওয়ারু দিয়ে পালিয়েছে।
উটেন্ডে থেকে দৃশ্যমান যে গিরিশিরাটা পশ্চিম দিগন্ত জুড়ে অধিরাজ করে, আজ আমরা তার মাথায় চড়ব। পশ্চিম পাহাড়ের ঢাল নেমেছে দক্ষিণ-পশ্চিমে, এমরেরা নদী ধরে এখানকার জল নিচে নামে, এমরেরা গিয়ে আবার মালাগারজি নদীতে জল ঢেলে দেয়। টাঙ্গানিকার প্রভাব এখান থেকেই বুঝতে পারছি, যদিও এখনও হৃদটি বারো বা পনেরো দিন হাঁটার দূরত্বে। জঙ্গল ক্রমশ ঘন হচ্ছে, ঘাসগুলো বিশাল বিশাল লম্বা। সব দেখেশুনে উকওয়ে ও উকামির উপকূল এলাকার কথা মনে পড়ছে।
এখানে সদ্য উফিপা থেকে আসা একটা কাফেলার কাছে শুনলাম যে একজন শ্বেতাঙ্গ লোককে 'উরুয়াতে' দেখা গেছে বলে খবর আছে, মনে হয় লিভিংস্টোনের কথাই বলছে।
এমওয়ারু ছাড়ার পর আমরা ম্রেরার এলাকায় প্রবেশ করলাম, ম্রেরা একজন সর্দার যার একসময় এই অঞ্চলে বিশাল ক্ষমতা ও প্রভাব ছিল। তবে, যুদ্ধের দরুণ তার সম্পত্তি এখন তিনটে -চারটে গ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ। গ্রামগুলো গভীর জঙ্গলের মধ্যে, বাইরের দিকে জঙ্গল এমনই ঘন যেন একটা পাথরের দেওয়াল, শত্রুকে ঠেকাতে কাজে লাগে। প্রবেশদ্বারের সদর দরজার আগে, খুঁটির মাথায় মাথায় আটকানো ন’টা সাদা হয়ে যাওয়া মাথার খুলি, কোনঙ্গো ও জাভিরাদের মধ্যে চলতে থাকা বিবাদের সাক্ষী। এই শেষোক্ত উপজাতিটি যেখানে বাস করে সেটা এখান থেকে পশ্চিমে কয়েকদিনের পথ, আমাদের জায়গাটা এড়িয়ে চলাই উচিত, এক যদি না আমরা স্থানীয়দের সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়ী হওয়ার সুযোগ খুঁজি। ম্রেরার কোনঙ্গোরা আমাদের বলেছিল, জাভিরারা সমস্ত এনগোয়ানার শত্রু।
এমওয়ারু এবং ম্রেরার মধ্যে একটুকরো জলাজায়গায় বুনো হাতির একটি ছোট পাল দেখলাম। এই প্রথমবার এই প্রাণীগুলিকে তাদের নিজস্ব বাসভূমিতে দেখলাম। তাদের সম্পর্কে প্রথম দর্শনে যে ধারণা হল তা সহজে ভুলব না। ভাবতে বাধ্য হলাম যে হাতিরাই 'পশুরাজ' উপাধির যোগ্য। তার বিশাল বপু , যেমন রাজসিক ভাবে সে তার এলাকায় অনুপ্রবেশকারীর দিকে তাকিয়ে থাকে, আর তার পুরো চেহারাই যেরকম সচেতন শক্তির ইঙ্গিত দেয়, সব মিলিয়ে এই নামের প্রতি তার দাবি অতিশয় ন্যায্য। আমরা হাতির পালটিকে এক মাইল দূর দিয়ে পেরিয়ে এলাম, কাফেলা যাওয়ার সময় এরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জরিপ করতে থাকল: আর, নিজেদের কৌতূহল মিটে গেলে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল - জঙ্গলটা জলাভূমির দক্ষিণ দিকটা ঘিরে।
কাফেলাগুলো যেন তাদের কাছে রোজকারের জিনিস। আর তারা জল-জঙ্গলের স্বাধীন, অজেয় প্রভু, ভীতু দ্বিপদদের তাদের সঙ্গে ন্যায় যুদ্ধে মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই, সেই দুপেয়েদের সঙ্গে এদের কিসেরই বা মিল! একটি জঙ্গলে হাতির পাল ভয়ানক রকমের ধ্বংস ডেকে আনে। কচি গাছগুলো ওপড়ানো অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকে, সেই দিয়েই হাতিদের চলার পথ চেনা যায়, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সব পদদলিত করতে করতে তাদের পথ চলা।
সেলিম নামের ছেলেটা এতই অসুস্থ যে তার জন্য দুদিন কাফেলা থামাতে বাধ্য হলাম। তার হাত-পায়ে কিছু একটা অসুখ করেছে, হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে আর ভয়ানক ভাবে কাঁপছে, এছাড়া তার তীব্র আমাশয়-ব্যাধি তো আছেই। তবে অবিরাম যত্ন- শুশ্রূষা শীঘ্রই তাকে আবার সুস্থ করে তোলা হল; আর চতুর্থ দিনে সে ফের গাধায় চড়ার ক্লান্তি সহ্য করার মতন চাঙ্গা হল।
ম্রেরায় থাকার সময় বেশ কয়েকটি প্রাণী শিকার করতে পেরেছিলাম। চাষের জায়গার বাইরে দিয়ে যে জঙ্গল, সেখানে দারুণ দারুণ জন্তুদের ভিড়। জেব্রা, জিরাফ, হাতি এবং গন্ডার এরা তো আছেই; টার্মিগান জাতীয় বুনোহাঁস, গিনি-মোরগও প্রচুর।
ম্রেরার যোদ্ধারা প্রায় সকলেই মাস্কেটধারী, তারা বন্দুকের খুব যত্নও নেয়। আমার থেকে চকমকি পাথর, গুলি ও বারুদ পাওয়ার জন্য তারা প্রায় নাছোড়বান্দা ছিল, আমি সবসময়েই তাদের আবদার নাকচ করে দিতাম, পাছে যে কোনও সময়, কোন ঝামেলা বাঁধলেই, তারা সেই অস্ত্র উলটে আমারই বিরুদ্ধে ব্যবহার করে বসে। এই গ্রামের পুরুষরা ভারি অলস, শিকার করা, হাই তোলা, আড্ডা মারা আর ধেড়ে খোকাদের মত খেলা ছাড়া আর কিছুই করত না।
জুতো মেরামত করতে করতে আর আমার জামাকাপড়ের রাশি রাশি ছ্যাঁদাতে তাপ্পি মারতে মারতে আমার ম্রেরায় থাকার সময়ের একটা বড় অংশ গেল। বিকেলের দিকে হাঁটার সময় বিভিন্ন ধরণের কাঁটার খোঁচায় কাপড়গুলোর প্রায় শেষ দশা। ম্রেরা ছাড়িয়ে পশ্চিমমুখে এক জনহীন প্রান্তর, আমাদের বার বার ভয় দেখানো হয়েছিল যে সেই জায়গাটা পেরোতে নয় দিন লাগবে, তাই প্রচুর পরিমাণে শস্য কেনার দরকার। সামনের বিশাল জনহীন ফাঁকা প্রান্তর পাড়ি দেওয়ার আগে সেসব ঝাড়াই-বাছাই-পেষাই পর্বও শেষ করতে হবে।
(এখানে দশম অধ্যায়ের শেষ। পরের কিস্তিতে শুরু হবে একাদশ অধ্যায়)