ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। লিভিংস্টোন এখনও অধরা। এদিকে রসদ ফুরিয়ে আসছে। স্থানীয় সর্দারদের ভেটের দাবি এড়াতে গ্রাম এড়িয়ে গোপনে চলার চেষ্টা। উহহাদের এলাকা পার। তরজমা স্বাতী রায়
৯ নভেম্বর। ভোরের দু'ঘণ্টা আগে আমরা সুনুজ্জি নদীর পাশের শিবির ছেড়ে বনের মধ্যে দিয়ে উত্তর-পশ্চিমে রওনা হলাম, আগে আমাদের ছাগলগুলোর মুখ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, পাছে তারা ব্যা ব্যা করে আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে।
কাজটা ভুলই হয়েছিল, ভালোরকম খেসারতও দিতে হত হয়ত। পুবের আকাশে যেই হালকা ধূসর রং ধরতে শুরু করল, প্রায় তখনই আমরা জঙ্গল ছেড়ে মূল রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। আমাদের গাইড মশাই ভাবল যে আমরা উহহা পেরিয়ে গেছি, ফলে সে তো আনন্দে একটা রাম-চিৎকার পাড়ল! কাফেলার আর সকলেও তার দেখাদেখি জোরে চেঁচাতে লাগল। নতুন উৎসাহ আর বর্ধিত বল নিয়ে আমরা এগোতে থাকলাম। তারপর একটা গ্রামের কাছে এলাম, সেখানকার বাসিন্দারা সবে ঘুম ভেঙ্গে নড়াচড়া শুরু করেছে। সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে চুপ করতে বলা হল, অবিলম্বে অভিযান থমকে দাঁড়ালো। গাইডের সাথে পরামর্শ করতে সামনে গেলাম। সে বুঝতেই পারছে না যে কী করবে। বেশি ভাবার সময় নেই তখন, ছাগলগুলিকে জবাই করে রাস্তায় রেখে দিতে বললাম, আর গাইডকে বললাম গ্রামের মধ্য দিয়ে বীর বিক্রমে এগিয়ে যেতে। মুরগিও জবাই করা হল; এর পর অভিযান দ্রুতগতিতে, নিঃশব্দে এগোতে লাগল, সামনে সামনে আমাদের গাইড, তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল রাস্তার দক্ষিণের দিকের জঙ্গলে ঢুকে যাওয়ার জন্য। শেষ লোকটা জঙ্গলে না ঢোকা অবধি আমি জঙ্গলের বাইরেই রইলাম; উইনচেস্টার বাগিয়ে ধরে কাফেলার পিছন পিছন চলছি, আমার পিছনে ছিল বন্দুকধারীরা, গোলাবারুদ সমেত। যখন প্রায় গ্রামের শেষ কুঁড়েঘরটা পেরচ্ছি, তখন একজন কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে এলো আর গভীর বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল, ঝগড়া-ঝাঁটির মতন জোর চেঁচামেচি শোনা গেল। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা জঙ্গলের গভীরে পৌঁছে গেলাম, রাস্তা থেকে দ্রুত দূরে, আরও দক্ষিণে চলে যাচ্ছিলাম, কিছুটা পশ্চিম দিক ঘেঁষে। একবার মনে হল, কেউ কি পিছন পিছন ধাওয়া করল? একটা গাছের পিছনে লুকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, কেউ পিছু নিল কিনা। তবে কয়েক মিনিটের মধ্যেই বুঝে গেলাম যে কেউ আমাদের তাড়া করেনি, আধ-ঘণ্টার হাঁটার পর আবার পশ্চিম দিকে ঘুরলাম। এখন প্রশস্ত দিবালোক, ছবির মত, শান্ত ছোট ছোট উপত্যকাগুলো ভারি চোখ-জুড়ানো— এখানে অজস্র বুনো ফলের গাছ, নাম না জানা ফুলের মেলা, চকচকে পালিশ করা নুড়ির উপর দিয়ে ছোট ছোট জলধারাগুলি নেচে বেড়াচ্ছে— সকল কিছু ঝকঝকে, সুন্দর— শেষে একটা সরু জলধারার সঙ্গে মোলাকাত হল— চমৎকার, টলটলে জল, মৃদু কলধ্বনিতে যেন আমাদের গুনগুনিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে, ছপর ছপর করতে করতে আমরা সেই নদী পেরলাম। অবশেষে আমরা দুষ্ট উহহাদের সীমানা পেরিয়ে উকারঙ্গায় ঢুকেছি! কী যে উল্লাসধ্বনির মাধ্যমে সেই ঘটনাকে স্বাগত জানানো হল।
এখন আমরা একটা মসৃণ রাস্তা খুঁজে পেয়েছি, আনন্দে লাফাতে লাফাতে সেই পথ ধরে চলছি, জোরকদমে চলছি, কারণ সবাই জানি যে আমাদের যাত্রা প্রায় শেষের কাছাকাছি। রুক্ষ, নির্মল জঙ্গল, কাঁটাবন আর আঘাত-দেওয়া ঘাস, বর্বরতায় ভরা জঙ্গল, এতদিন এই সবের আমরা নিরানন্দ দর্শক ছিলাম— এইসব যত ঝামেলা সহ্য করেছি, সে নিয়ে আর কোন ভাবনা নেই। কাল! হ্যাঁ, এই দারুণ দিনটা কাছে এসে গেছে, আর এই আনন্দে আমরা এখন হাসতে, গাইতেও পারি। অনেকভাবে আমাদের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে; বিভিন্ন ঝামেলায় বিরক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যেই রাগারাগি করেছি, কিন্তু সেসব এখন অতীত, সবার মুখ খুশীতে জ্বলজ্বল করছে।
দুপুরে একটা ছোট্ট বিরতি নিলাম, বিশ্রাম, খাওয়া-দাওয়া দুয়েরই জন্য। লিউচে উপত্যকার পূর্ব সীমান্ত ঘিরে যে পাহাড়গুলো রয়েছে, যেখান থেকে টাঙ্গানিকা দেখা যায়, সেগুলো আমাকে দেখাল। সে দেখে আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। এইটুকু সময় থামাতেও অস্থির, অতৃপ্ত লাগছিল। আবার হাঁটা শুরু হল। আগামীকালই তারা পুরস্কার পাবে এই কথা বলে লোকজনকে এগিয়ে চলতে অনুপ্রাণিত করেছিলাম । যতখুশি মাছ আর বিয়ার দেওয়া হবে, যতটা তারা খেতে বা পান করতে পারবে।
কারাঙ্গাদের গ্রামগুলো আমাদের চোখের সীমানায়। লোকেরা আমাদের দেখতে পেল, বেশ উত্তেজনা প্রকাশ করল। তাদের আশ্বস্ত করার জন্য আগে আগে লোক পাঠিয়েছিলাম, তারাও আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে এলো। খুব নতুন রকমের ব্যবহার— কী যে ভাল, যুদ্ধবাজ ভিনজাদের বা ভয় দেখিয়ে ভেট আদায় করা উহহার লোকদের থেকে এতটাই আলাদা এদের ব্যবহার যে আমরা আহ্লাদে প্রায় গলেই গেলাম। তবে কিনা সেই আনন্দকে প্রশ্রয় দেওয়ার মত সময় হাতে নেই। আমি আর আমার ভাবনাচিন্তাকে বাগে রাখতে পারছি না, প্রায় তাড়িতের মতন এগিয়ে যাচ্ছি। সন্দেহ, ভয় সবেরই নিরসন হওয়া দরকার। তিনি কি এখনও সেখানে আছেন? তিনি কি আমার আসার কথা শুনেছেন? তিনি কি পালিয়ে যাবেন?
উকরঙ্গাকে কী সুন্দর লাগছে! সবুজ পাহাড়গুলোর মাথায় ঘাসে ছাওয়া ত্রিকোণ মুকুটের গুচ্ছ। পাহাড়গুলো ওঠে ও পড়ে; কোথাও ন্যাড়া, কোথাও আবাদে ঢাকা, ওইখানে চারণভূমি, এইখানে জঙ্গল, সেইখানে কুঁড়েঘরের রাশি। একটু যেন মেরিল্যান্ডের মতন।
এমকুটি পার হলাম, একটা চমৎকার ছোট নদী! উল্টো পারে উঠে, বনের মধ্য দিয়ে হাঁটা লাগালাম, বেশ একটা নিজের কাজের জন্য গর্বিত মানুষের মতই পদক্ষেপ আমাদের। ইতিমধ্যেই নয় ঘণ্টা হাঁটা হয়ে গেছে, সূর্য দ্রুত পশ্চিম আকাশে পাটে নামছে; তবুও, আমাদের দেখে ততটা ক্লান্ত লাগছে না।
নিয়ামতগার উপকণ্ঠে পৌঁছলাম। তখনই ঢাকের শব্দ শুনতে পেলাম। সবাই জঙ্গলে পালাচ্ছে; গ্রাম-টাম ত্যাগ করে, কারণ তারা ধরে নিয়েছে যে আমরা রুগা-রুগা - মিরাম্বোর বন-দস্যু, উন্যানিয়েম্বের আরবদের সঙ্গে যুদ্ধে জেতার পরে, উজিজির আরবদের সাথে যুদ্ধ করতে আসছে। এমনকি রাজাও গ্রাম থেকে পালাচ্ছে, আর সব ছেলে-মেয়ে-বাচ্চা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে রাজার পিছন পিছন পালাচ্ছে। আমরা চুপচাপ গ্রামে ঢুকলাম আর নিঃশব্দে গ্রাম দখল করলাম। শেষমেশ, এই খবরটা ছড়ানো হল যে আমরা এনগোওয়ানা, উন্যানিয়েম্বের থেকে আসছি।
‘‘হুম, তাহলে, মিরাম্বো কি মারা গেছে?’’ তারা জানতে চাইল।
‘‘না’’, আমরা জানালাম।
‘‘আচ্ছা, কিভাবে উকারাঙ্গায় এলেন?’’
‘‘উকোনঙ্গো, উকাওয়েন্দি, ও উহহা হয়ে।’’
‘‘ওহ - হাই-লে!’’
তারপর তারা নিজেদের ভয়ের জন্য প্রাণভরে হাসল আর অজুহাত দিতে শুরু করল। রাজার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল, সে বলল যে সে আমাদের ফের আক্রমণ করার জন্যই নাকি কেবল জঙ্গলে ঢুকেছিল। আমরা রুগারুগা হলে, সে ফিরে এসে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলতেই চেয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে আমরা জানি যে বেচারা রাজা খুবই ভয় পেয়েছিল, আর আমরা রুগা-রুগা হলে তার আর কখনোই ফিরে আসার সাহস হত না। যাইহোক, তখন আর ঝগড়া করার মেজাজে ছিলাম না, বরং তার সঙ্গে করমর্দন করলাম, আর বললাম যে তার দেখা পেয়ে আমরা খুব খুশি। আর সেও আমাদের আনন্দের অংশীদার, সঙ্গে সঙ্গে সবথেকে মোটা তিনটে ভেড়া, কলসি ভরা ভরা বিয়ার, ময়দা ও মধু উপহার হিসাবে আমাদের কাছে এলো আর আমিও আমার গাঁটের দুটি সেরা কাপড় দিয়ে তাকে আরও খুশি করলাম; আর এইভাবে আমাদের মধ্যে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তি হল।
এই দিনের সব বিবরণ ডায়েরিতে লেখার সময়, আমার চাকরকে বলেছিলাম যে আমার নতুন ফ্ল্যানেলের স্যুটটা গুছিয়ে রাখতে, আমার বুটে তেল মাখাতে, আমার টুপিতে চক লাগাতে আর আর চারপাশে একটা নতুন পাগড়ি জড়িয়ে দিতে, যাতে ওই ধূসর দাড়ি-অলা শ্বেতাঙ্গের সামনে আর উজিজির আরবদের সামনে আমি যথাসম্ভব ভাল চেহারায় হাজির হতে পারি। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যে সব জামাকাপড় পরে আসছিলাম, সেগুলোর শতচ্ছিন্ন দশা। শুভ রাত্রি— শুধু পরেরদিনটা একবার আসতে দিন, তারপর দেখা যাবে কী হয়।
(ক্রমশ...)