জাঞ্জিবারের ক্ষমতা যাদের হাতে, তাদের মধ্যে বানিয়ারা সবার মাথায়। তাদের পরেই আছে হিন্দুস্তানি মুসলমানরা। বানিয়া আর হিন্দুস্তানি মুসলমান, এই দুই গোষ্ঠীর লোকেদের মধ্যে কারা বেশি লোক ঠকাতে বদ্ধপরিকর?১ কঠিন তর্কের বিষয়—খুবই অনিচ্ছার সঙ্গে আমি বানিয়াদের পক্ষে রায় দিলাম। শুধুমাত্র একজন সৎ লোকের জন্য অসংখ্য বিবেকহীন ভারতীয় বজ্জাতের উপস্থিতি উপেক্ষা করা যায়। সাদা–কালো, লাল-হলুদ সব গোত্রের মানুষের মধ্যে সবথেকে সৎ মানুষদের মধ্যে একজন হচ্ছেন তারিয়া টোপন২, একজন হিন্দুস্তানি মুসলমান। সততা আর ব্যাবসায়িক নিষ্ঠার জন্য জাঞ্জিবারের ইউরোপীয়দের কাছে তিনি প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছেন। তিনি প্রচুর ধনী, বেশ কয়েকটি জাহাজ এবং নৌকার মালিক, সৈয়দ বুরঘাশের পরামর্শদাতাদের মধ্যে অন্যতম। তারিয়ার অনেকগুলি ছেলেমেয়ে, তাদের মধ্যে দু-তিন জন বড়ো হয়ে গেছে, তাদেরও তিনি নিজের মতো করে বড়ো করেছেন। তবে তারিয়া অতি বিরল গোত্রের মানুষ।
তারিয়া টোপন (প্রথম সারিতে বসে অন্তিম ডান দিকে), বাঁ দিকে তরোয়াল হাতে ব্যক্তিটি জাঞ্জিবারের সুলতানের পরিবারের কোনো একজন, বাকিদের পরিচিতি জানা যায় না। ছবি সৌজন্য: Oman and Zanzibar Virtual Museum
আরব, বানিয়া এবং হিন্দুস্তানি মুসলমানরা সমাজের অর্থবান ও মধ্যবিত্তদের প্রতিনিধিত্ব করে। এরা যাবতীয় ভূসম্পত্তি, জাহাজ এবং ব্যাবসা-বাণিজ্য সবকিছুর মালিক। মিশ্র-জাত ও কালো লোকরা এদের তলায় থাকেন।
গুরুত্বের দিক দিয়ে এরপরে আসেন নিগ্রোরা—এদেশের জনসংখ্যার একটা বড়ো অংশই নিগ্রো। আদিবাসী, ওয়াসাওয়াহিলি, সোমালি, কোমোরিন, ওয়ানায়ামওয়েজি আর আফ্রিকার ভিতরের এলাকাগুলোর সব আদিবাসীদের প্রতিনিধিরাই নিগ্রোদের মধ্যে পড়ে।
আফ্রিকা চিনতে ইচ্ছুক একজন বেগানা সাদা লোকের কাছে ওয়ানায়ামওয়েজি ও ওয়াসাওয়াহিলির নিগ্রোদের ডেরার মধ্যে দিয়ে হাঁটাটা একটা অভিজ্ঞতা। এখানে বোঝা যায় যে গায়ের রং আলাদা হলেও নিগ্রোরা ঠিক আর দশজনের মতোই একজন মানুষ , আর দশটা মানুষের মতোই তাদের আবেগ-সংস্কার, পছন্দ-অপছন্দ, ভালো-লাগা ও মন্দ-লাগা, স্বাদ-অনুভব সবই আছে। এটা এ অঞ্চলে আসা কোনো আগন্তুক যত তাড়াতাড়ি বুঝবে, আর সেই অনুযায়ী নিজেকে মানিয়ে নেবে, দেশের ভিতরে বিভিন্ন জাতির মানুষের মধ্য দিয়ে তার ভ্রমণও ততই সহজতর হবে। নিজের প্রকৃতি যত নমনীয় হবে, ভ্রমণও তত সমৃদ্ধ হবে।
আমার পড়াশোনা মূলত উত্তরে হলেও আমি আমাদের আমেরিকার দক্ষিণাংশের নিগ্রোদের মাঝে কিছুটা সময় কাটিয়েছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু কৃষ্ণাঙ্গের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল যাদের বন্ধু হতে পেরে আমি গর্বিত।৩ কাজেই প্রকৃত মনুষ্যত্বের অধিকারী বা কোনো ভালো গুণের অধিকারী কালো মানুষকে বন্ধু মানতে প্রস্তুত ছিলাম, ভাই বলে ভাবতেও রাজি । নিজের বর্ণ এবং জাতের যে-কোনো মানুষের মতোই তাকে শ্রদ্ধা না করারও কোনো কারণ দেখি না। গায়ের রং বা শরীরের কোনো বৈচিত্র্যর জন্য মানুষ হিসেবে কোনো অধিকার থেকে একজন মানুষকে আমি অন্তত বঞ্চিত করতে পারব না। নিজেকে প্রশ্ন করেছি, ‘পৌত্তলিক আফ্রিকার অসভ্য কালো মানুষগুলোর কি এমন কোনো গুণ আছে যাতে তাদের নিজের লোকেরা তাদের ভালোবাসে? এই বর্বর লোকগুলোও কি আমারই মতন মায়ামমতার কাঙাল বা আমারই মতো বিরক্তও হতে পারে?’ আমি কালোদের এলাকায় ঘুরতাম, তাদের লক্ষ করতাম আর নিজেকে এই প্রশ্ন করতাম। দেখেছিলাম, তারা ঠিক আমারই মতো আবেগে, ভালোবাসায় আকুল হয়, ঘৃণায় কাতর হয়। নিজের সঙ্গে তাদের স্বভাবের তেমন বিশেষ কোনো তফাৎ অনেক পর্যবেক্ষণ করেও খুঁজে পাইনি।
নিগ্রোরা এই দ্বীপের জনসংখ্যার সম্ভবত দুই-তৃতীয়াংশ। তারা দাস হিসেবে কাজ করে বা স্বাধীনভাবে খেটে খায়। দাসেরা চাষাবাদের প্রয়োজনীয় কাজ করে। জমিওয়ালা মালিকদের বাগানের কাজ, তালুকের কাজ এসবও করে। শহরের মধ্যে বা বাইরে জিনিসপত্র আনা-নেওয়ার কাজ করে। শহরের বাইরে মাথায় বিশাল বোঝা চাপিয়ে এদের হাসতে হাসতে যেতে দেখা যায়। না, এমন নয় যে তাদের বোঝা হালকা বা তাদের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করা হয়েছে বলে তারা খুশি। এরা স্বভাবতই হাসিখুশি আর চিন্তা-ভাবনাহীন। এমন কিছু আশা বা আনন্দ এরা কল্পনা করে না যা মেটাতে পারবে না। বামন হয়ে চাঁদ ধরতেও চায় না। ফলে হতাশা এদের গ্রাস করে না বা আশাভঙ্গের কষ্টও পেতে হয় না।
স্ট্যানলের বর্ণনার মতো ক্রীতদাসদের জীবন ততটা সহজ ছিল না। এ ছবি ১৮৯০ সালের। জার্মান দাসব্যবসায়ীদের নারী ক্রীতদাসের দল। ছবি সৌজন্য: Oman and Zanzibar Virtual Museum
শহরের মধ্যে, সারা দিনরাতই নিগ্রোদের মাল টানার শব্দ শোনা যায়। জোড়ায় জোড়ায় কখনও লবঙ্গের বস্তা বইছে, কখনও বা মাল ভরতি বাক্স কখনও বা অন্য এটা-সেটা। দোকান থেকে গুদামে, গুদাম থেকে দোকানে। একঘেয়ে সুরে গান গাইতে গাইতে গানের তালে তালে খালি পায়ে পথ চলে, সে গান নাকি একে অপরকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য গাওয়া। গানের সুরটা ক-দিন শুনলে সুর দিয়েই এদের চিনে ফেলা যায়। দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার আমি একজোড়া লোককে কনস্যুলেটের জানালার নীচ দিয়ে যেতে শুনেছি, একই সুরে আর কথায় গান গাইতে গাইতে। কারও কারও কাছে এই গানগুলো বোকা বোকা তবে আমার তো বেশ ভালোই লাগত। মনে হত যে উদ্দেশ্যে গানগুলো তৈরি, সেই উদ্দেশ্য তো মিটছে।
জাঞ্জিবার শহরটি দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম তীরে অবস্থিত। প্রায় এক লক্ষ লোকের বাস সেখানে। আর গোটা দ্বীপে সব জাত মিলিয়ে আমার ধারণা লাখ দুয়েক লোক হবে।
বিদেশি জাহাজ যেসব আসে, তার বেশিরভাগই আমেরিকান। মূলত আসে নিউ ইয়র্ক আর সালেম থেকে। আমেরিকার পরে আছে জার্মানরা, তারপরে ফরাসি এবং ইংরেজরা। আমেরিকান কাপড়, ব্র্যান্ডি, গান পাউডার, মাস্কেট, পুঁতি, ইংরেজি সুতিবস্ত্র, পিতলের ও চিনে মাটির জিনিসপত্র এবং অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে আসে জাহাজগুলো। আর ফেরত যায় হাতির দাঁত, কোপালের আঠা, লবঙ্গ, পশুচামড়া, কড়ি, তিল, মরিচ এবং নারকেলের তেল বোঝাই করে।
এই বন্দর থেকে রফতানির মূল্য প্রায় তিরিশ লক্ষ ডলার আর বিভিন্ন দেশ থেকে জিনিস আসে পঁয়ত্রিশ লক্ষ ডলারের।
যেসব ইউরোপীয় এবং আমেরিকানরা জাঞ্জিবার শহরে থাকেন, তারা হয় সরকারি কর্মচারী, নয় স্বতন্ত্র বণিক, নয়তো বা ইউরোপ এবং আমেরিকার নামকরা বাণিজ্য-সংস্থার প্রতিনিধি।
এখানকার সবথেকে উল্লেখযোগ্য দূতাবাসটি ব্রিটিশদের। আমি যখন আফ্রিকার গহনে যাওয়ার অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন জাঞ্জিবারে ব্রিটিশ কনসাল ছিলেন ড. জন কার্ক। এঁর সঙ্গে আলাপ করার আমার একটা কৌতূহল ছিল, কারণ অনেক সময়ই ড. ডেভিড লিভিংস্টোনের (আমি যাঁর খোঁজে এদেশে এসেছি) নামের সঙ্গে জড়িয়ে এঁর নাম শোনা যায়।
প্রায় সব সংবাদপত্রেই এঁকে ড. লিভিংস্টোনের ভূতপূর্ব সঙ্গী বলে অভিহিত করা হয়। কাগজে যেসব খবর পড়েছি আর ভারত সরকারকে দেওয়া তাঁর দুটো চিঠি পড়ে আমার মনে হয়েছিল যে ড. লিভিংস্টোনের হদিশ যদি কেউ ঠিকঠাক দিতে পারে, তাহলে সেটা ড. কার্কই পারবেন। তাই আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলাম, কখন ক্যাপ্টেন ওয়েব আমাকে ড. কার্কের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
জাঞ্জিবার পৌঁছানোর পরে দ্বিতীয় দিন সকালে, সেখানকার নিয়ম অনুযায়ী, ক্যাপ্টেন ওয়েব আর আমি রাস্তায় হাঁটছিলাম—অল্প একটু পরেই আমি এই বিখ্যাত লোকটির কাছে উপস্থিত হলাম। রোগা চেহারা, সাধারণ জামাকাপড়, সামান্য গোলচে কাঁধ, কালো চুল, সরু মুখ, গাল ভিতরে ঢোকা আর দাড়িওয়ালা একজন মানুষ। ক্যাপ্টেন ওয়েব আলাপ করিয়ে দিলেন, ইনি হলেন নিউ ইয়র্ক হেরাল্ডের মি. স্ট্যানলে।
জাঞ্জিবারে ব্রিটিশ কনসাল জন কার্ক
(ক্রমশ। পরের কিস্তি পড়ুন পরের বৃহস্পতিবার...)
• সব টীকা সম্পাদক নীলাঞ্জন হাজরা
এইটা দুর্দান্ত জিনিস হচ্ছে একেবারে। স্বাতী রায়কে অনেক ধন্যবাদ আমাদের এই স্বাদ গ্রহণের সুযোগ করে দেবার জন্যে।
"নিজেকে প্রশ্ন করেছি, ‘পৌত্তলিক আফ্রিকার অসভ্য কালো মানুষগুলোর কি এমন কোনো গুণ আছে যাতে তাদের নিজের লোকেরা তাদের ভালোবাসে? এই বর্বর লোকগুলোও কি আমারই মতন মায়ামমতার কাঙাল বা আমারই মতো বিরক্তও হতে পারে?’ আমি কালোদের এলাকায় ঘুরতাম, তাদের লক্ষ করতাম আর নিজেকে এই প্রশ্ন করতাম। দেখেছিলাম, তারা ঠিক আমারই মতো আবেগে, ভালোবাসায় আকুল হয়, ঘৃণায় কাতর হয়। নিজের সঙ্গে তাদের স্বভাবের তেমন বিশেষ কোনো তফাৎ অনেক পর্যবেক্ষণ করেও খুঁজে পাইনি।"
উপনিবেশিক আমলে সাংবাদিক স্ট্যানলের এ হেন চিন্তাভাবনা রীতিমতো যুগান্তকারী বলা যায়। অনুবাদটি বেশ সাবলীল।
বিপ্লব রহমানের বক্তব্যের দুটো পয়েন্টেই সহমত। দামি লেখা।
♥️♥️