বাগামোয়োর আবহাওয়া ভারী ভালো। সব দিক থেকেই জাঞ্জিবারের তুলনায় আমার বেশি পছন্দের। খোলা আকাশের নীচে ঘুমানো যায়। রোজ সকালে যখন ঘুম ভাঙে তখন দিল খুশ, শরীর চনমনে, সমুদ্রে প্রভাতী স্নান উপভোগ্য। আর যতক্ষণে সূর্য ওঠে, ততক্ষণে আমরা আমাদের আফ্রিকার অন্দরে যাত্রাশুরুর বিভিন্ন প্রস্তুতির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে উন্যানয়েম্বে অভিমুখী আরবরা দেখা করতে আসলে বা শিবিরে বিভিন্ন মজার ঘটনা ঘটত বা কখনো-কখনো বেয়াড়া লোকদের বিচারসভা বসলে অথবা ফারকুহর ও শ-এর মধ্যে হাতাহাতি শুরু হলে—তারা খুব খেপে উঠছে দেখলে তখন অবশ্য আমার বিচক্ষণ হস্তক্ষেপের দরকার হত—আমাদের একঘেয়েমি কেটে ঝলমলে হয়ে উঠত। মাঝে মাঝে কিঙ্গানি নদীর কাছে ও তার আশপাশের সমতলে শিকারে যেতাম। প্রাক্তন জমাদার ও তাঁর বালুচ সেনাদলের সঙ্গে আড্ডা মারতাম, তারা আমাকে সারাক্ষণ মাসিকা চলে আসবে বলে সতর্ক করত, বারবার উপদেশ দিত অভিযানের অনুকুল মরসুমের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাড়াতাড়ি রওনা দেওয়া উচিত।
বাগামোয়ো-র সমুদ্রতট। (ছবিসৌজন্য: ব্রিটিশ লাইব্রেরি)
বাগামোয়োর কৃষ্ণাঙ্গ ডাকাবুকো ভদ্রলোকেরা শিবিরে এলেই জন শ’র মেজাজ চড়ে যেত। এটা খুবই দুঃখের ব্যাপার। এইসব সময়ে আমার প্রাথমিক কর্তব্য, আরবদের রীতি অনুসরণ করে, অতিথিদের জন্য জলযোগ ও কফি সরবরাহ করা—আর সেই রীতি হল, অতিথি হওয়ায় প্রথমে তাদের পরিবেশন করা হবে, তারপর উপস্থিত শ্বেতাঙ্গদের কাছে খাদ্য-পানীয়র ট্রে যাবে।
দেখলাম শ তাতে ভারী রুষ্ট। খোঁজ নিয়ে জানলাম, আমি তার মতো এক শ্বেতাঙ্গের আগে আরবদের পরিবেশন করে তাকে খুব অসম্মান করেছি। আরবদের সে নিগার বলে খুব আনন্দ পেত। বেচারা শ! যে দেশকে নিয়ে তার এইসব ভাবনা, সেই দেশে তার জন্য যে কত দুর্ভোগ অপেক্ষা করে আছে সে বিষয়ে লোকটা তখনও শিশুর মতো অজ্ঞ! এই বিপদসংকুল অভিযানে গায়ের রং নিয়ে সমস্যা যে সব থেকে তুচ্ছ সমস্যা হবে তা তখনও তার অজানা! বিভিন্ন জাতির সঙ্গে মেলামেশা ও ভ্রমণের নিরিখে বলা যায়, শ অশিক্ষিত অ্যাংলো-স্যাকসনের অপটুত্বের একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ।
যত দিন কাটছিল, বুঝতে পারছিলাম যে ফারকুহরকে শ’র থেকে আলাদা করা দরকার। ইতিমধ্যেই প্রমাণিত যে দ্বিতীয়জনের চরিত্রে রসকষ নেই, উলটে অহংকারের একটি ঢিবি, যাতে আবার খুব সহজেই আঘাত লাগে। তার সঙ্গে আছে আকাশছোঁয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষা, যা তাকে প্রায়ই মানুষের ভাবনার সব সীমার বাইরে নিয়ে যায়।
আমি ভাবছিলাম যে, দুজনে একসঙ্গে থাকার চেয়ে ফারকুহর একা থাকলে অনেক ভালো হবে। ফারকুহরের মতো মেজাজ ও বুদ্ধি-শুদ্ধিওলা লোকের সঙ্গে শ-র ব্যবহার অতিশয় বিরক্তিকর। অতএব আফ্রিকার আরও গভীরে যাওয়ার জন্য যে তৃতীয় কাফেলাটি তৈরি হচ্ছে, ফারকুহরকে সেটির নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম, এবং আমার অভিপ্রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই দুই বেয়াদব প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে শান্তি ফিরে এল।
এই অভিযানের কর্মীদের মধ্যে দুজন ভারতীয় এবং দুজন গোয়ানিজ ছিল। এদের ধারণা জন্মেছিল যে আফ্রিকার ভিতরের অঞ্চলটি একটি এল ডোরাডো, সেখানে পথেঘাটে হাতির দাঁত পড়ে থাকে। এইরকম ভুলভাল ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা চারজন মিলে একটা ব্যাবসা শুরু করার পরিকল্পনা করেছিল। তাদের নাম ছিল জাকো, আবদুল কাদের, বন্দর সালাম ও আরানসেলার—জাকো ছুতোরের কাজের জন্য এবং সাধারণ সহায়ক হিসাবে আমার দলে ছিল; আবদুল কাদের এসেছিল দর্জি হিসেবে, বন্দর সালাম রাঁধুনি আর আরানসেলার যোগ দিয়েছিল প্রধান বাটলার হিসাবে। তবে আরানসেলর আগেই বুঝে নিয়েছিল যে মালিক হিসেবে আমি তাকে খুব ছোটাব, তাই সময় থাকতে থাকতে সে কীভাবে এই কাজ থেকে ছুটি পাওয়া যায় সেই ভাবনা ভাবতেই ব্যস্ত থাকত। সে জাঞ্জিবারে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা বলে সেখানে যাওয়ার অনুমতি নিয়েছিল। দুদিন পরে আমি শুনলাম যে তার ডান চোখটি বেরিয়ে এসেছে। একটা প্রেসক্রিপশনও পেলাম, মহামান্য সৈয়দ বুরঘাসের চিকিৎসক ডা. ক্রিস্টির কাছ থেকে জখম কতটা হয়েছে তা জানিয়ে। আমার মনে হয়েছিল তার স্বদেশীয়রাও একই রকম পরিকল্পনা করছে। তবে অগ্রিম বেতন পাওয়ার পরই, তাদের এইরকম গাধামির থেকে দূরে থাকার অবশ্য-পালনীয় আদেশ দেওয়া হয়েছিল। সেটাই কোনোরকম অশুভ অভিসন্ধি থেকে তাদের ঠেকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল।
এক রাতে এক ছোকরা কাপড়ের গাঁটরি চুরি করার সময় আমরা টের পেয়ে গিয়ে তার পিছনে ধাওয়া করে গ্রামের দিকে ছুটলাম, কিন্তু শেষে সে জঙ্গলের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেল। ঘটনাটা বেশ একটা বিনোদনের উপাদান হয়েছিল। যাত্রার প্রস্তুতির সময়টা এইসব নিয়েই কাটত। এর মধ্যে চারটে কাফেলা আফ্রিকার অন্দরে পাঠানো হয়ে গেছে এবং পাঁচ নম্বরটা তৈরি হচ্ছিল। এটাতে নৌকো এবং বাক্স, ব্যক্তিগত মালপত্র আর অল্প কিছু কাপড় এবং পুঁতির মোট যাবে। আমার নেতৃত্বে। কাফেলাগুলি কবে কোন্টি রওনা হয়েছিল তা নীচে দেওয়া হল।
১৮৭১, ফেব্রুয়ারি ৬ - অভিযান বাগামোয়োতে পৌঁছেছিল।
১৮৭১, ফেব্রুয়ারি ১৮ - প্রথম কাফেলা চব্বিশজন কুলিও তিনজন সৈন্য নিয়ে রওনা হয়েছিল।
১৮৭১, ফেব্রুয়ারী ২১ - দ্বিতীয় কাফেলা আঠাশজন কুলি, দুই প্রধান ও দুই সৈন্য নিয়ে রওনা হয়েছিল।
১৮৭১, ফেব্রুয়ারি ২৫ - তৃতীয় কাফেলাটি বাইশজন কুলি, দশটি গাধা, একজন শ্বেতাঙ্গ, একজন রাঁধুনি ও তিনজন সৈন্য নিয়ে রওনা হয়েছিল।
১৮৭১, মার্চ ১১- চতুর্থ কাফেলা পঞ্চান্নজন কুলি, দুই প্রধান ও তিন সৈন্য নিয়ে রওনা হয়েছিল।
১৮৭১, মার্চ ২১.- পঞ্চম কাফেলা আঠাশজন কুলি, বারোজন সৈন্য, দুই শ্বেতাঙ্গ, একজন দর্জি, একজন রাঁধুনি, একজন দোভাষী, এক বন্দুক-বাহক, সতেরোটি গাধা, দুটি ঘোড়া ও একটি কুকুর নিয়ে রওনা হয়েছে।
নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড পত্রিকার অভিযানের সঙ্গে জড়িত সকল কাফেলাগুলিতে মোট প্রাণীর সংখ্যা ১৯২।
(এখানেই তৃতীয় অধ্যায় সমাপ্ত। আগামী বৃহস্পতিবার শুরু হবে চতুর্থ অধ্যায়—আসল অভিযানের শুরু)